সেদিন মুষুলধারে বৃষ্টি ছিল পর্ব-০৯

0
746

#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–9
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

— আপনি দয়া করে রুম থেকে বেরিয়ে যান। প্লিজ!

— যাব কিন্তু এক শর্তে।

সেজুতি ভ্রু কুচকে বলে, কি শর্ত?

— আমাকে ক্ষমা করেছো? যদি ক্ষমা করে থাকো তবেই যাব নাহলে যাচ্ছি না।

মুহিব কথাটা অত্যন্ত কাতর গলায় বললো। সেজুতির রাগ তবুও পড়লোনাকিন্তু তার কেন যেন একটু ভালো লাগলো৷ একবার হলেও মন চাইলো তাকে ক্ষমা করে দিক কিন্তু না এতো দ্রুত ক্ষমা দেওয়া যাবে না৷

মুহিব বলে উঠে, কি হলো? কথা কেন বলছো না? হু?

সেজুতি তার দিকে তাকিয়ে থেকে শাড়ি হাতে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।

মুহিব অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল।

কিছু সময় বাদে সেজুতি বের হলো। তাকে দেখা মাত্র মুহিব একটা বড়সড় টাস্কি খেল৷ ইশ কি সুন্দর লাগছে তাকে!

নীল রঙের কাতান শাড়িতে অপূর্ব লাগছে। চুল ছেড়ে রেখেছে সে। ফ্যানের হাওয়ায় চুল এলোমেলো হয়ে পড়ছে সে-ই সাথে মুহিবের মনের অন্তঃকণাদ্বয় ও কাপাকাপি শুরু করলো।

ইশ রে! এইরকম সাজে সেজুতিকে কি অপরুপই না লাগছে৷ সেজুতি কি জানে সে যখন রাগ করে নাক ফুলায় তখন নাকের ডগা লাল হয়ে যায়!

এই যে! এই মূহুর্তে তার নাকের ডগা টকটকে লাল হয়ে আছে। মুহিবের মন চাচ্ছে নাকের ডগায় চুমু খেতে!

সেজুতি চুলে খোপা বাধা শুরু করলো।

মুহিব মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটা সিগারেট ধরালে মন্দ হয় না। চোখ ধাধানো দৃশ্য দেখার সময় ফুসফুস পোড়ালে মন্দ কি?

ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে আয়নার ভেতর দিয়েই সেজুতি মুহিবকে দেখলো। কেমন নেশা লাগানো ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিবের মুখ টা দেখে যেকেউ বলে দিবে মুহিব তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ কিন্তু কে বলবে? এই ছেলে আজকে সকালে তার গায়ে হাত তুলেছে৷ এইজন্য তাকে মোটেও অনুতপ্ত লাগছে না৷

আচ্ছা সেজুতি যদি এখন তার গালেও একটা চড় বসিয়ে দেয় তবে কেমন হবে? মুহিবের রিয়্যাকশন কি হবে? ।

মুহিব আস্তে ধীরে তার কাছে এসে বলে, শাড়ির কুচি ঠিকমতো সেট আপ হয় নি। কেমন অগোছালো হয়ে আছে৷।

— যার জীবনই অগোছালো তার শাড়ির কুচি কিভাবে গোছালো হতে পারে?

মুহিব হাটু গেড়ে বসে সেজুতির প্রতিটা কুচির ভাজ সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিতে লাগলো।

সেজুতি অন্য দিকে মুখ ফিরালো। তার কান্না পাচ্ছে খুব। তার জীবনটা বড্ড অগোছালো হয়ে গেল। অগোছানো জীবনের ছন্নছাড়া সময় পার করছে সে।

মুহিব কুচির ভাজ ঠিক করে দিয়ে নিজে রেডি হয়ে নিল। মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পড়লো সে সঙ্গে কালো জিন্স। চোখ-মুখে পানি দিয়ে বের হলো৷

সেজুতি চেয়ারে বসে ফোন চালাচ্ছিলো৷ আচমকা মুহিব তার ফোন কেড়ে নিল৷

সেজুতি প্রথমে ভয়ে পেয়ে যায়৷ তারপর যখন সবটা বুঝতে পারলো সে নিজের ফোন উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়লো৷

সেজুতি কড়া গলায় বলে, আমার ফোন দিন।

— দিব তো! তোমার ফোন তো আর সবজি না যে রান্না করে খাব৷

— এক্ষুনি দিন৷

— তুমি একটু সুন্দর করে কথা বলতে পারো না?

— না৷ পারিনা।

— জন্মের সময় তোমার মুখে মধু দেওয়া হয় নি রাইট?

— জি৷ আমার জন্মের সময় মধুর দাম বেড়ে গিয়েছিলো। তাই কেনা হয়নি।

মুহিব সেজুতির ফোন নিজের পকেটে রেখে দিয়ে বলে, আমাদের বাচ্চা যখন হবে আমি স্পেশালি সুন্দরবন থেকে মধু আনাব৷ তখন দেখবে আমাদের বেবি মিস্টি-মিস্টি কথা বলবে।

— অনেক দূর-দূরান্তের চিন্তা ভেবে ফেলেছেন দেখছি?

মুহিব মুচকি হেসে বলে, ভাবতে তো আর ট্যাক্স লাগে না তাই ভাবি। আর রাজনীতি করার তৃতীয় মূলনীতি হলো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা। এ পলিটিশিয়ান লিভস ইন দ্যা ফিউচার! বুঝলে?

— আমার ফোন পকেটে ঢুকালেন কেন?।

— কারন আমি চাই তুমি আমার পিছনে পিছনে হ্যামিলনের বাশিওয়ালা গল্পের বাচ্চাগুলো মতো ঘুর৷ আই এম ইউ দিনাজপুরের ফোনওয়ালা! ( হেসে উত্তর দিল সে)

সেজুতির রাগে গা কাপছে। সে ফোস করে দম ফেলে বলে, আপনার সঙ্গে আমি কোন ধরনের কথা বলতে ইচ্ছুক নই! যান সামনে থেকে৷

মুহিব এক গাল হেসে সেজুতির হাত ধরলো। সেজুতি সরে আসতে চাইলে তাকে বাধা দিয়ে বলে, চল। প্রোগাম শুরু হয়ে যাচ্ছে তো!

প্রোগামে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় দুই-আড়াই শ মানুষের খাওয়ার আয়োজন। গেস্টরা ইতিমধ্যে খেতে বসে গেছে৷

শোভা তাওহীদের কাছে গিয়ে বলে, দেখ তো এই শাড়িটা ঠিক আছে?

তাওহীদ মুখ বেজার করে বলে, আহা! এ-সব কেমন প্রশ্ন? দেখছো নাআমি খুব ব্যস্ত আছি এখন৷।

— ব্যস্ত তো সবসময়ই থাকছো। এতো কথা না বলে, উত্তর টা দিলেই পারতে৷

তাওহীদের মুখে বিরক্তি ভাব চলে এলো। সে এক গাদা থুথু ফেলে বলে উঠে, ডিসি সাহেব পরিবার সহ এসেছে৷ ওনাদের সময় দাও৷ আপ্যায়ন ঠিক মতো করো৷ যাও।

শোভা চলে এলো। তার খুব কষ্ট লাগলো। সে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ডিসি সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে লাগলো । ডিসি সাহেবের বউ খুব ভালো একজন মহিলা। খুব সুন্দর করে তার সঙ্গে গল্প করছে৷

কিন্তু শোভার মন সেদিকে নেই। তার চোখ, মন সব ডিসি সাহেবের বউয়ের কোলে থাকা শিশুটার দিকে৷ ইশ বাবুটা কি সুন্দর করে নিজের ছোট্ট হাতটা মুখে দিয়ে চুষছে।

শোভার চোখ চকচক করছে।মন চাচ্ছে বাবুটাকে একটু আদর করে দিতে। আচ্ছা তার এমন ফুটফুটে বাচ্চা কবে হবে? সে কি মা হবে না কোন দিন? মা না হতে পারার জন্য কি তাওহীদ এমন করে তার সঙ্গে? মানুষ টাও তো বাবা হওয়ার জন্য কাতর! সেও তো চায় আধো বুলিতে কেউ তাকে বাবা বলে ডাকুক৷ আল্লাহ কবে তার দোয়া কবুল করবে? কবে ঘর আলো করে তার ঘরে সন্তান আসবে নাকি সে অপয়া?,

শোভার বুক ধুক করে উঠে। এবারের থাইল্যান্ডে গিয়ে যেসব টেস্ট করানো হলো তাওহীদ সেইসব নিয়ে কিছু আলোচনা করেনি। তার সঙ্গে। নাকি টেস্টের রিপোর্ট দেয় নি?

শোভাকে বাকি সময় টা ভীষণ চিন্তিত দেখা গেল। আজই তাওহীদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

★★★

সেজুতি খাওয়া-দাওয়া করে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাবার সঙ্গে বাসায় যাওয়ার জন্য। গাড়ি বাসার সামনে এসে তাদের অপেক্ষা করছে৷

মুহিবের চেহারা দেখার মতো। সে কিছুতেই শ্বশুড়বাড়ি যেতে চায় না। এজন্য আম্মা তাকে সবার সামনে ধমক দিয়ে বলে, যার বাড়ির মেয়ে বিয়ে করতে তোর সমস্যা নাই, সেই বাড়ি গিয়ে থাকতে কি অসুবিধা?

মুহিবের মায়ের কথা সবাই হোহো করে হেসে দেয়। সেজুতিও হাসে। সেজুতিকে হাসতে দেখে মুহিবের ও মন ভালো হয়ে যায়।

অগত্যা শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসে সে।তার সঙ্গে সেজুতির বাবা জয়নাল সাহেব বসেছে। এতেও বেজার সে।

সে সেজুতির সঙ্গে বসবে। তা না শ্বশুড়ের পাশে বসতে হচ্ছে। এদের মাথা এতো মোটা কেন? সেজুতি কে এই গাড়িতেই বসানো হয়নি।

মুহিব প্লান করে রেখেছিল সে আর সেজুতি একসাথে একা একা যাবে। এসি ছেড়ে হাই ভলিউমে হিন্দি কোন গান বাজবে৷ সে তার একটা হাত দিয়ে সেজুতির হাত চেপে থাকবে।

সেজুতি যতোবারই রাগী কন্ডে বলবে, কি করছেন কি? ছাড়ুন!

ঠিক ততোবারই মুহিব তাকে চুমু খাবে। সুন্দর একটা লং ড্রাইভ হবে। সব রোমান্টিক প্লানে পানি ঢেলে দিলো সেজুতির বিচ্ছু কাজিনরা।হুহ!

সেজুতির বাসায় পৌছে মুহিবকে গেটের বাইরে আটকানো হলো। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেজুতি তাকে না দেখার ভান করে শাড়ির কুচি সামলিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে গেল।

কিন্তু মুহিবকে ঢুকতে দিচ্ছে না। বিশ হাজার টাকা দাবী তাদের!

মুহিব আহাম্মকের মতো চেয়ে আছে। এভাবে লোকালয়ে তার কাছে গলাকাটা ডাকাতি করা হচ্ছে। মুহিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে৷ নিজেকে অসহায় লাগছে বেশ!

কিছুক্ষন পর সেজুতি হালকা সুতির কাজ করা বেগুনি রঙের একটা ফতুয়া পড়ে বের হলো। চুল ভেজা। চুলের পানিতে পেছনের কাধ ভিজে গেছে। সে সাদা কালারের ওড়না জড়িয়ে আছে।

সেজুতি গেটের কিছুটা কাছে গিয়ে বিরস মুখে বলে উঠে, এই! তোদের দুলাভাই অনেক কিপ্টা! সারারাত ধরে চাইলেও সে এক পয়সা বের করবে না। তার চেয়ে এইসব আশা বাদ দে।আমি সুযোগ বুঝে তোদের এক দিন চাইনিজ খাইয়ে দিব।

মুহিবের ভীষণ রাগ হলো। তাকে টাকার খোটা দিল! আরে বাপ! মুহিব নিজের টাকা গুনা শুরু করলে হাতে ফোস্কা পড়ে যাবে। তাকে নাকি টাকার গরম দেখানো হচ্ছে।

সে পকেট থেকে সত্যি সত্যি বিশ হাজার টাকা বের করে দিলো। টাকা কখনোই সে এভাবে সঙ্গে রাখে না। আজকে সকালে ম্যানেজার দিয়ে গেল। সেটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিল সে।

সবাই তো হৈচৈ শুরু করে দিলো। তাকে খাতেরদারি করে ভেতরে ঢুকানো হয়৷

এরপর কিছুক্ষন পর মুহিবকে ঘুমানোর জন্য রুমে পাঠানো হয়। অবাক করা বিষয় হলো এই রুমটাও বাসর ঘরের মতো ফুল দিয়ে সাজানো।

মুহিবের ভালো লাগলো তা দেখে৷ কিন্তু ঘরে সে একা! সেজুতি নেই।

প্রায় এক ঘন্টা পার হলেও রুমে সেজুতি এলো না। ফোন যে দিবে তার ও উপায় নেই। মুহিবের নিজের চুল ছিড়তে মন চাচ্ছে। আরে ভাই! এই ফুলে ভরা রুমে সে একা কি করবে বউ ছাড়া? বসে বসে ছাগলের মতো পাতা চিবিয়ে খাবে নাকি গরুর মতো রাতের খাওয়ার পোলাও জাবর কাটবে? বউ কই তার? নাকি তাকে রুমে আনার জন্য ও সেজুতির কাজিনদেরকে টাকা দিতে হবে?এরা সবাই বড্ড যন্ত্রনা দিচ্ছে তাকে।

চলবে।