সে অবেলায় এসেছে পর্ব-০৪

0
165

#সে অবেলায় এসেছে
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৪ (18+ সতর্কতা)

“আপনাকে বাঁচতে হবে অর্থী। মায়ের যায়গা কেউ কখনও নিতে পারেনা। আপনার সন্তানের জন্য হলেও আপনাকে মুক্তি পেতে হবে। আমি আছি। হয়তো আপনার শাস্তি আমি আঁটকাতে পারবোনা তবে কম করতে পারবো। আপনাকে কারোর প্রয়োজন অর্থী। ভীষণ প্রয়োজন।”

আজকাল আলোক রোজ আসে অর্থীর কাছে। হয়তো কেসের রহস্যের টানে নয়তো অন্যকিছু। মেয়েটার মায়াবী মুখে মায়ার চিহ্ন বিলীন। তবুও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আলোকের। দুজনের কথোপকথনের প্রতিটা মুহূর্তে অর্থী তাকিয়ে থাকে সেলের ছোট্টো জানালা থেকে আসা আলোর দিকে। হয়তো আশার কোনো এক আলো খোঁজে দিনের আলোয়। রাত তো বরাবরই ভয়ংকর হয়। সেখানে থাকেনা আশা আকাঙ্খা। সবটা মরীচিকা লাগে। আজকাল আলোক খুব করে চায় অর্থী তার দিকে তাকাক। কালশিটে চোঁখে তাকিয়ে দেখুক একটিবার। আলোকের সব জল্পনা কল্পনা বানের জলের সাথে মিশিয়ে দেয় অর্থী। ভাটা পরে আলোকের আকাঙ্খার স্রোতের।

“অর্থী, মা আপনার জন্য তাজা মাছের ঝোল আর কিছু ফল পাঠিয়েছেন। খেয়ে নিন জলদি।”

আলোকের কথায় মলিন হাঁসলো অর্থী। প্রাণহীন সেই হাঁসি দেখেই খানিকটা হাঁসলো আলোক। যেনো বহুদিন পর দুই অধর মুক্ত হয়েছে হাঁসার জন্য। কতকাল ওই ঠোঁটে হাঁসিরা ধরা দেয়নি।

“পুলিশরা যে আসামিদের এভাবে যত্ন করে জানা ছিলোনা।”

অর্থীর কথায় খানিক ভেবাচেকা খেয়ে যায় আলোক। সে যে কতো লুকিয়ে চুরিয়ে সেলে খাবার আনে তা কি অর্থী জানে? জানলে কখনোই এই কাজে সম্মতি দিতোনা। চোরা দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,

“মা পাঠান। আপনার জন্য নয়, আপনার অনাগত সন্তানের জন্য পাঠান।”

আলোকের জবাবে খানিক হাঁসলো অর্থী। আলোকের দৃষ্টির গভীরতা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। মেয়েরা নাকি দূর থেকেই ছেলেদের দৃষ্টি পড়ে নিতে পারে। আলোক তো তার বেশ কাছেই বসে থাকে রোজ। কয়েকহাত দূরের মানুষটার মনের অভিব্যক্তি সে খানিক বোঝে।

“আজই তো শেষ। তাই খেয়ে নেবো। কাল থেকে আপনিও আর আসবেন না আর আন্টিকেও কষ্ট করে আর রান্না করতে হবেনা।”

অর্থীর কথায় চমকালো আলোক। আজই শেষ মানে? সে তো রোজ আসবে। কোনো না কোনো বাহানা নিয়ে রোজ হাজির হবে অর্থীর দুয়ারে। না তাকাক অর্থী ফিরে, সে শুধু দুচোখ ভরে দেখেই বিদায় নেবে। নিজের ভাবনার উপর নিজেয় বিরক্তবোধ করলো আলোক। একজন আসামিকে নিয়ে এমন ভাবনা মাথায় আসা অনুচিত। ইতিহাসে প্রথম বোধহয় একজন পুলিশ আসামির প্রেমে পড়েছে। আসলেই হাস্যকর।

গুমোট রাত্রি। আকাশের বুক চিরে ক্ষণে ক্ষণে ছিটকে আসছে আলোর স্ফুলিঙ্গ। আঁধার কাটিয়ে ক্ষণিকের জন্য স্পষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি। গগনবিদারী আওয়াজে নিক্ষেপ হচ্ছে বজ্রপাত। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টি পাল্লা দিয়ে ক্রমে বেড়ে চলেছে। সূচনা হয়েছে কোনো এক ধ্বংসলীলার। প্রকৃতি যেনো চণ্ডীরূপ ধারণ করে ধ্বংসে মেতেছে। আজ উচ্ছিষ্ট করবে পাপ।

সন্ধ্যে থেকে আঁধারে ঢেকে আছে পুরো বাড়ি। সাঁঝবাতি নিভিয়েই রান্নাঘরে কিছু খুটখাট করছিলো অর্থী। এরপর শান্ত, নিস্তব্ধ। বজ্রপাতের শব্দে আজ কোনো ভীতি নেই। ভয়কে বোধহয় জয় করে ফেলেছে অর্থী। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হালকা হাঁসি যেনো খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। নীলয় বাড়ি ফেরেনি এখনও। বোধহয় ঝড় বৃষ্টির মাঝে আঁটকা পড়েছে। বহুদিন পর আজ অর্থী অপেক্ষা করছে নীলয়ের জন্য। গুনছে একটা একটা সেকেন্ড। অপেক্ষার প্রহর গুনতে একটুও বিচলিত না সে। ঠোঁটের কোনের ক্ষীণ হাঁসির ইঙ্গিত বড্ডো অশুভ ঠেকছে। বেডের উপর দুই হাঁটুর মাঝে থুতনি রেখে বসে আছে অর্থী। জানালার খোলা কপাট ঝড়ের দমকা হাওয়ার সাথে ধড়াম করে বন্ধ হয়ে আবার খুলে যাচ্ছে। নীলচে রঙের পর্দা বৃষ্টির পানিতে ভিজে চুপচুপে। বৃষ্টির ছটা খানিক অর্থীর গায়ে এসেও পড়ছে। তবুও সে নির্লিপ্ত। নির্বিকার চিত্তে বসে আছে।

দরজার শব্দে অনুভূতিহীন কাঠের পুতুলের মতো বেড থেকে নেমে এগিয়ে গেলো অর্থী। পরণের শুভ্র রাঙ্গা শাড়ীর আঁচল মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। দরজা খুলে নিলয়ের পাশে দাড়ানো তিনজন মানুষকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক অর্থী। কিংকর্তব্যবিমূঢ় চিত্তে ছলছল চোখে তাকালো তাদের দিকে। অতঃপর পিছে ফিরে চলে গেলো রুমে। অর্থীর পরণের সাদা শাড়ি দেখে অবাকের শীর্ষে পৌঁছেছে নীলয়। নিজেকে ধাতস্থ করে অর্থীর বাবা, মা আর ভাইয়াকে রুমে ঢুকতে অনুরোধ করলো।

“আপনারা কিছু মনে করবেন না। আপনাদের মেয়ে কতোটা অভিমানী জানেন তো। এতগুলো বছর পর আপনাদের দেখে অভিমানগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আমি দেখছি। আপনারা পাশের রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে রেস্ট করুন প্লিজ।”

করুণ মুখে স্থানত্যাগ করলো নীলয়। বৃষ্টির তোপে পরণের কাপড় ভিজে গেছে। চটজলদি ওয়াশরুমে ঢুকে চেঞ্জ করে নিলো। রুমের আশেপাশে তাকিয়ে অর্থীকে না পেয়ে ঝুঁকে দেখলো ব্যালকনিতে। একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে অর্থী। প্রকৃতির সাথে সাথে তাণ্ডব চলছে তার মনেও। তবে অবাক করার বিষয় হলো কান্না আসছেনা।

“অর্থী, ওনারা এখান দিয়ে যাচ্ছিলেন কোথাও। মাঝপথে গাড়ি খারাপ হয়ে যায়, সাথে ঝড় বৃষ্টির রাত। আমি মোড়ের চায়ের দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। দূর থেকে তোমার বাবাকে দেখে চিনে ফেলি। অনুরোধ করি এখানে আসার জন্য। সময় তো কম হয়নি। এতগুলো বছর পর রাগ অভিমান পুষে রেখে আর কি হবে?”

বেশ কিছু পদ রান্না করেছে অর্থী অল্প সময়ে। রাত গভীর হাওয়ার সাথে সাথে খিদের মাত্রাও বাড়ছে সবার। স্বল্প সময়ের মধ্যেই খাবার পরিবেশন করে অর্থী। খাওয়া শেষে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় অর্থী পাশের রুমে। মেয়েকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে ডাকেন কিংকর সাহেব। বাবার বুকে গুটিশুটি মেরে বিড়ালছানার মতো লেপ্টে যায় অর্থী। অনেকগুলো বছর পর শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে। ডুকরে কেঁদে উঠলো অর্থী। বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। আপনজনকে পেয়ে উগলে দিতে ইচ্ছে করছে মনের সব কষ্ট। উজাড় করে পেতে চাইছে সবার আদর ভালোবাসা। মেয়ের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠেন আমেনা বেগম। এতগুলো বছর পর আদরের বোনকে পেয়ে চোখ ভরে আসছে অনিকেরও। পুরো রুম জুড়ে বিষাদের ছায়া। খানিকটা সময় কাঁদলো অর্থী। বুক উজাড় করে কাঁদলো। কাছের মানুষগুলো জড়িয়ে ধরে কাঁদলো।

“তোমরা চলে যাও আব্বু।”

“কি বলছো মা তুমি এগুলো? এতদিন পর তোমাকে আমরা কাছে পেয়েছি। মান অভিমানের মাঝে এতগুলো বছর কাটিয়ে আর হারাতে চাইনা তোমাকে মা। তোমার আব্বুকে কি মাফ করা যায়না?”

“আমাকে আর নিজের কাছে ছোটো করে দিওনা প্লিজ। ভুল তো আমি করেছি। তোমাদের সম্মানের কথা না ভেবে নিজের সুখটাই দেখেছি। আমাকে মাফ করো তোমরা।”

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে অর্থীর। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। থেমে থেমে আসছে নিঃশ্বাস কান্নার ফলে। মুখের কাছে ধরা পানির গ্লাস একহাতে সরিয়ে দেয় অর্থী।

“তোমরা চলে যাও। তোমরা না গেলে আমি পানি খাবোনা। তাতে আমি মরে গেলে যাবো। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমরা এই বাড়ি ছাড়বে। নাহলে মেয়ের মরা মুখ দেখার জন্য প্রস্তুত থাকো।”

মুখ কালো হয়ে যায় তিনজনের। এতগুলো বছর পর সন্তানকে কাছে পেয়েও মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে মন সায় দিচ্ছেনা কারোর। তাও ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারবেনা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগোতেই ছাতা হাতে এগিয়ে আসে একলোক।

“ভাইজান অর্থী মা ফোন করে আমাকে বললো আপনারা নাকি তার আত্মীয় হন। বাড়িতে তালা দেওয়া। আজ নাকি ফিরতে পারবেনা। আজ রাত যেনো আমার বাড়িতে আপনাদেরকে যত্নআত্তি করি। আসেন ভাইজান।”

বয়স্ক ভদ্রলোকের কথা শুনে বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকান কিংকর সাহেব। আমেনা বেগম আর অনিকের মুখের অবস্থাও একই রকম। এই মাত্র তারা অর্থীর বাড়ি থেকে বের হলো। অথচ অর্থী ভদ্রলোককে বলেছেন সে বাড়িতে নেই। কোনোরকমভাবে হিসেব মেলাতে পারছেন না কিংকর সাহেব। কোথাও একটা খটকা লাগছে। অর্থীর এভাবে তাদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা, সাদা শাড়ি পড়া, বিধস্ত মুখশ্রী। কিছুই যেনো মেলাতে পারছেন না। আমেনা বেগমের বুকটা যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো। মায়েরা নাকি আগাম বুঝতে পারেন সন্তানের বিপদ। তবে কি অর্থী কোনো বিপদে আছে? চকিতে তাকান স্বামীর দিকে।

খুব সাবধানে নীলয়ের পানির গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলো অর্থী। ফলস্বরূপ গভীর ঘুমে মগ্ন সে। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো অর্থী। নীলয়ের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলো বেশ খানিকটা সময়। পরণের সাদা শাড়ি সাথে কোমর পর্যন্ত খোলা চুল। একেবারে বিধ্বংসী লাগছে অর্থীকে। একে একে বুক থেকে শার্টের বোতাম খুলে ফেললো অর্থী। উন্মুক্ত বুকে মাথা রাখলো পরম শান্তিতে। হু হু করে কেঁদে উঠলো বুক। কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে কেঁপে উঠছে শরীর। বুক থেকে মাথা তুলে আবারো তাকালো নীলয়ের মুখপানে। কি নিস্পাপ চেহারা। এই চেহারার প্রেমে পড়ে অর্থী কাটিয়েছে এতগুলো বছর। এই মানুষটার হাত ধরে ছেড়েছে বাড়ি। আর কখনো পিছু ফিরে তাকায়নি। এক জনম কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দিয়ে ঘর বেঁধেছিলো দুজনে। একে একে মনে পড়ে তাদের সুখের সংসার। দুজনের খুনসুটিতে ভরা প্রেম। খড়কুটোর সংসারে ভালোবাসার কমতি ছিলোনা কখনও। বুক ফেটে কান্না আসে অর্থীর। এই বুকে মাথা রেখে কাটিয়েছে কতোশত রাত। প্রশান্তিতে চোখ বুঁজে ফেলে অর্থী। বন্ধ চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে সারি সারি অশ্রুফোঁটা।

“যেই পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি আমি, তার অস্তিত্ব কেমনে করি বিলীন!”

“এ কেমন পরীক্ষা আমার বিধাতা? এই বুক এফোঁড় ওফোঁড় করার শক্তি যে আমার নেই। এটা যে আমার শান্তির নীড়। দিনশেষে এই নীড়েই আমার বাস। আমার বাসভূমি উজাড় করার শক্তি দাও আমায় বিধাতা। সব অন্যায় নির্মোচনের ক্ষমতা দাও।”

বুকের যন্ত্রণায় ঘুম হালকা হয়ে আসে নীলয়ের। সামনে বসা বিধস্ত রণমূর্তিধারিনি নারীকে দেখে হকচকিয়ে যায় সে। ঘুমের রেশ কেটে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করে পরিস্থিতি। এক হাত বুকে চেপে চোখের সামনে আনতেই চমকে ওঠে নীলয়। তাজা র’ক্তে ভিজে আছে হাত। অবাকত্বের সীমানা বাকশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে। বোবা মানুষের মতো আ আ শব্দ হচ্ছে মুখ থেকে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় একটা কথাও উচ্চারিত হচ্ছেনা মুখ দিয়ে। কালো রঙের বড়ো বড়ো পিঁপড়েগুলো মুখের কাছের শক্ত অংশ দিয়ে খুবলে দিচ্ছে বুকের মাংসল অংশ। বুক চিরে র’ক্তে লহুলুহান করাই যেনো তাদের আসল উদ্দেশ্য।

“কষ্ট অনুভব হচ্ছে নীলয়? অনুভব করতে পারছো মেয়েগুলোর কষ্ট? যাদেরকে একদলা মাংসের টুকরো মনে করে অত্যাচার করতে। ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে। কামড়ে আঁচড়ে নিঃশেষ করতে। মনে পড়ছে তাদের কথা? সেই ব্যথার তুলনায় এ যে খুব সামান্য। তুমি সৌভাগ্যবান নীলয়। কারণ তুমি আমার অর্ধাঙ্গ। তোমার ঐ দেহের প্রতিটা ক্ষত চিরে দিচ্ছে আমার বুক। নিজেকে কিভাবে বেশি কষ্ট দিয় বলো? নিজের জন্য হলেও তোমার শাস্তি অনেকটা কমে গেলো।”

হিংস্র চাহনিতে তাকিয়ে আছে নীলয় অর্থীর দিকে। চোখের সাদা অংশে লালাভ ছাপ স্পষ্ট। মনে মনে ভয় পেলেও নির্লিপ্ত অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো অর্থী। অর্থীর নিলিপ্ততায় ক্রোধে ফেটে পড়ছে নীলয়। বুক থেকে কালো পিঁপড়েগুলোকে একে একে উঠিয়ে ফেলে দিল নীলয়। কয়েক পা এগিয়ে ডানহাতে শক্ত করে মুঠো করে ধরলো অর্থীর চুল।

“তোকে ভালোবাসা আমার ভুল। সবচেয়ে বড়ো ভুল। বাকিদের মতো কোনোদিন ব্যবহারের দ্রব্য মনে করিনি তোকে। ঘরের বউ করে এনেছি। ভালোবাসা, সম্মান সবটা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছি। তবুও তোর মন ভরলোনা। আমার পথের কাঁটা হওয়ার খুব সখ জেগেছে তোর তাইনা? বাকিদেরকে যেভাবে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি তোর সাথেও তাই করা উচিত ছিলো। মাথায় তুলে রাখতে চেয়েছিলাম তোকে। কিন্তু তুই সে যোগ্য নাহ। ভিডিওটা দেখে ফেলেছিস তাইনা? ভালো হয়েছে। আর কোনো লুকোচুরির খেলা খেলতে হবেনা তবে আমাকে। তোর চোখের সামনেই মেয়ে এনে ফুর্তি করতে পারবো আমি। এক শরীরে আমার মন ভরেনা। আর তোর এই শরীরে আর এমনিতেও আছে কি? এর স্বাদ এখন পানসে। আমার তো তাজা জিনিস পছন্দ।”

ঘৃণায় এক দলা থুতু ছিটিয়ে দেয় অর্থী নীলয়ের মুখে। চুলের গোড়ার টান আরও মজবুত হতেই দরজা থেকে প্রবেশ করেন কিংকর সাহেব, আমিনা বেগম আর অনিক। দুজনের বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে থমকে যান তারা। ভয়ে শিটিয়ে যান আমেনা বেগম। মেয়ের অসহায় অবস্থা দেখে মুখে হাত চেপে কান্না করে দেন। অর্থীর পরিবারের লোকজনকে দেখে হাঁসি ফুটে ওঠে নীলয়ের ঠোঁটে। খুঁজে পায় বাঁচার পথ। পায়ের কাছের মাংস কাটার ধা’রালো ছু’রিটা সাবধানে উঠিয়ে পিছন থেকে ধরে কিংকর সাহেবের গলায়। ভয়ে আঁতকে ওঠে অর্থী। বাবা অন্তঃপ্রাণ মেয়েটাকে বাগে আনতে পারে ক্রুর হাঁসে নীলয়।

“তোমার বাবার প্রাণ বাঁচাতে চাইলে আমার রাস্তা ছাড়ো। চলে যেতে দাও আমাকে এখান থেকে।”

“আব্বুর গলা থেকে ছুরিটা সরাও নীলয়। ছুরিতে ধার অনেক। আজ সকালেই কসাইকে বলে বেশি করে ধার দিয়েছি। ওটা রাখো নীলয়।”

আমেনা বেগম আর অনিক রীতিমত আঁতকে উঠেছে। চোখের সামনে বাবাকে এই অবস্থায় দেখে অসহায় অনুভব করছে অনিক। হাত পা যেনো বাঁধা তার। এক পা এগোলেই বাবার প্রাণ সংশয় হয় সেই ভয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে অনুনয় করে যাচ্ছে নীলয়ের কাছে। বর্তমানে এছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেনা। অর্থী চোখের ইশারায় ভাইকে কিছু একটা বোঝাতেই কয়েক পা পিছিয়ে যায় অনিক। টেবিল থেকে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ লুকিয়ে নেয় হাতের মাঝে। সাবধানী পায়ে পিছন থেকে নীলয়ের ঘাড়ে সিরিঞ্জ পুশ করবে এমন সময় অনিকের পেটে গেঁথে দেয় ছুরি। ছাড় পাননি কিংকর সাহেবও। গলা বরাবর এক টানে ফিনকি দিয়ে বয়ে যায় র’ক্তের স্রোত। নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। পেটে হাত চেপে কোনোক্রমে উঠে দাড়ায় অনিক। বহু কষ্টে নীলয়ের ঘাড়ে গেঁথে দেয় সিরিঞ্জ।

“মা কে দেখে রাখিস অ অর্থী।”

ভাইয়ের শেষোক্ত কথা শুনে হুঁশ ফেরে অর্থীর। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লো বাবা আর ভাই নামক দুই আশ্রয়স্থল। ইনজেকশনের ওষুধের ফলে নিভু নিভু হয়ে আসছে নীলয়ের চোখ। অর্থী এক হাতে দা উঠিয়ে কো’প বসায় নীলয়ের বুক বরাবর। র’ক্ত ছিটকে এসে পড়ে অর্থীর মুখে। সাদা শাড়ি মুহুর্তেই লালে রঞ্জিত। একে একে ঘটনাগুলো কিভাবে যেনো ঘটে গেলো টের পেলেন না আমেনা বেগম। চিন্তাশক্তি শুধু জানান দিচ্ছে সে নিঃস্ব। সর্বস্ব হারিয়েছেন তিনি। এক পা দুই পা করে পিছিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েন মেঝেতে। টেবিলের কোনার কাঁচের অংশে ঠুঁকে যায় মাথা। “আহ” শব্দ উচ্চারিত হয় নিস্তব্দ রুমে। তারপর সব শান্ত। সর্বশান্ত হয়ে পড়ে একটা পরিবার। ভাইয়ের দেওয়া শেষ কথা রাখতে পারলোনা অর্থী। পারলোনা মাকে বাঁচিয়ে রাখতে। সবার মতো মাও ছেড়ে চলে গেলো তাকে। দুনিয়ার বুকে একেবারে নিঃস্ব করে দিলো তাকে। কয়েক মুহুর্তেই খালি হয়ে গেলো তার ভরা সংসার। খা খা করছে দুনিয়া। বাহিরের ঝড়ের তান্ডব থেমেছে। সেই সাথে বাড়ছে চার দেওয়ালের মাঝে নিস্তব্ধতা।

#চলবে?