সে অবেলায় এসেছে পর্ব-০২

0
190

#সে অবেলায় এসেছে
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব-২

চৈত্রের দুপুর। সূর্যের উত্তাপে হাহাকার পরিবেশ। বিকেলে ক্লান্ত অবিশ্রান্ত শরীরটাকে কোনরকমে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি ফেরে নীলয়। মায়া হয় অর্থীর। কিচেন থেকে লেবুর শরবত এনে এগিয়ে দেয় নীলয়ের দিকে। শান্ত চোখে তাকায় অর্থীর দিকে। চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। সেদিনের পর কেটেছে এক মাস। অথচ অর্থীর সাথে সম্পর্ক সেখানেই থেমে গেছে। ওই একটা ঘটনা থামিয়ে দিয়েছে তাদের সংসার। ভালোবাসার কাছে হেরে গেছে ভুল। নীলয়ের কাছে ব্যাপারগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক হলেও অর্থী মেনে নিতে পারেনা। দূরত্ব বেড়েছে দুজনের।

“নীলয় তুমি কি সবকিছু ছেড়ে দিতে পারবে? নাহলে আমাকে হারাতে হবে তোমায়।”

বিছানার দুই প্রান্তে দুজনের অবস্থান। সময়টা মধ্যরাত্রি। অর্থীর কথায় চট করে সেদিকে তাকায় নীলয়। আবদ্ধ হয় দুই জোড়া চোখ একসাথে।

“তোমাকে আমার সাথে থাকতেই হবে অর্থী। দ্বিতীয় কোনো অপশন তোমার হাতে নেই।”

শান্ত চোখদুটো মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে পড়ে অর্থীর। শোয়া অবস্হায় এক হাতে চেপে ধরে নীলয়ের কলার।

“আমাকে অপশন দেওয়ার তুমি কে? আমি চেয়েছি বলেই তুমি আমাকে পেয়েছো। আমি চেয়েছি বলেই এতোদিন তোমার সাথে সংসার হয়েছে। আমার উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কেউ না তুমি। আমি পরবর্তীতে কি করবো সেটা একান্ত আমার সিদ্ধান্ত। প্রয়োজন পড়লে আমি আব্বুর পায়ে পরে হলেও মাফ চাইবো। আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না তারা।”

অর্থীর কথা শুনে শয়তানি হাঁসিতে ফেটে পরলো নীলয়। হাঁসির ঝাঁকুনিতে নড়ে নড়ে উঠছে বেড। মনে মনে বেশ ভয় পায় অর্থী। যতোই হোক একজন পুরুষের শক্তির সাথে তার পেরে ওঠার কথা নয়। মাঝরাতে হাঁসির শব্দগুলো বড্ডো খারাপ শোনাচ্ছে। অশরীরী কোনো প্রেতাত্মা
যেনো ধ্বংসলীলায় নেমেছে।

“তুমি বড্ডো বোকা অর্থী। ওই বাড়ি ছেড়েছো দুই বছরের বেশি সময় হয়েছে। এতদিনে ওনাদের রাগ যখন কমেনি আগামীতেও কমবেনা। তারা তোমাকে মৃত বলে পরিচয় দেয় সবার সামনে।”

নীলয়ের ব্যঙ্গাত্মক কথা শুনে চমকে ওঠে অর্থী। মাথা ঘুরছে প্রচন্ডভাবে। হটাত পাওয়া ধাক্কাটা মেনে নিতে পারছেনা।

“আ আব্বু আমাকে অনেক ভালোবাসতো।”

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অর্থীর কথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো নীলয়। আঘাতটা সঠিক জায়গায় করেছে। ঠিক এভাবেই ভেঙে গুড়িয়ে দেবে অর্থীর আওয়াজ। পদে পদে বুঝিয়ে দেবে সে ছাড়া তার আর কোনো গতি নেই।

“বুঝলে অর্থী, ভালোবাসা আর ঘৃণা দুটোই হৃদয়ের বড্ডো কাছের অংশ। যাকে ভালোবাসা যায় সময়ের কালক্ষেপে ঠিক তাকেই তীব্রভাবে ঘৃণা করা যায়।”

ঝট করে চোখ তুলে তাকালো অর্থী। কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আছে। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র অশ্রুকণা। মনে মনে বার কয়েক আওড়ালো “ঘৃণা” শব্দটা। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। আজ নিজেকে বড্ডো অসহায় লাগছে। কাতরাচ্ছে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কান্না করার জন্য। মন উচাটন হয়ে আছে মা মা সেই গন্ধের জন্য। সারাক্ষণ নিজের কথায় বাড়ি মাথায় করে রাখা মেয়েটা আজ একলা রাত্রি যাপন করছে। নিঃসঙ্গতায় ফুঁপিয়ে উঠছে। খেই হারিয়ে ফেলেছে কথার।

জীবনের হিসেব নিকেশ করতে করতে আনমনা হয়ে রান্না করছে অর্থী। দিনগুলো যেনো কোনোরকমে পার হচ্ছে। জীবনের প্রতি আর কোনো মায়া কাজ করেনা অর্থীর। ধীরে ধীরে টের পাচ্ছে কতো বড়ো ভুল করেছিলো সেদিন বাবার কথা না শুনে। যে ভুলের মাশুল হয়তো তার শেষ র’ক্তবিন্দু নির্যাস হওয়া অবধি দিতে হবে তাকে।

নীলয়ের আলমারিতে কখনও হাত দেয়নি অর্থী। মূলত নীলয় তাকে বুঝিয়েছিল সেখানে অফিসের অনেক ফাইল থাকে। এদিক ওদিক হয়ে গেলে সমস্যা হবে। ভালোবাসার মানুষের কথা চোঁখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে বিয়ের দুই বছরেও আলমারিতে সেভাবে হাত দেয়নি অর্থী। বিগত কিছুদিন অতিরিক্ত ব্যাস্ততায় দিন কাটছে নীলয়ের। সকাল সকাল নাস্তা না করেই বেরিয়ে যায়। আবার ফিরছে বেশ রাত করেই। অফিসের চাপ বেড়েছে। মাঝে মাঝে অফিসের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হচ্ছে। আলমারির অবস্থা নাজেহাল। জামাকাপড় এদিক ওদিক কোনরকম ঠেসে রাখা। ফাঁপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থী কাপড়গুলো এক এক করে গুছিয়ে রাখলো আলমারিতে। গুছানো শার্টগুলো আলমারিতে রাখতে গিয়ে অর্থীর পায়ের কাছে পড়লো একটা সাদা কাগজ। এবড়ো থেবড়ো করে ছেঁড়া একটা চিঠির খাম। অর্থী দুই চোখ বন্ধ করে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলো খামটার কথা। কিছু একটা মনে হতেই চট করে চোখ খুললো। আগের সপ্তাহে নীলয়ের নামে এসেছিলো এই চিঠি। উপরে বড়ো বড়ো করে লেখা ছিলো আর্জেন্ট মেসেজ। কারো ব্যক্তিগত জিনিস দেখার অভ্যাস কখনোই ছিলোনা অর্থীর। রাতে নীলয় ফিরার পর চিঠিটা তার হাতে দিয়ে দিয়েছিলো। অবশ্য অর্থী জানতে চেয়েছিল চিঠির কথা। অফিসের চিঠি বলে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে নীলয়।

ছটফট করছে মন। মস্তিষ্ক বলছে এই খামে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে। কিন্তু মন সায় দিচ্ছেনা। নীলয়ের অনুপস্থিতিতে তার জিনিসে হাত দিতে বিবেক বাঁধা দিচ্ছে বারবার। পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে ঘড়ির দিকে তাকালো অর্থী। সন্ধ্যা সাতটা পনেরো। টিক টিক ঘড়ির কাঁটার শব্দের সাথে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে অর্থীর হৃদ্স্পন্দন। নিজেকে শান্ত করে খাম থেকে বের করে দুটো কাগজ। খামের মধ্যে একটা চিঠি সাথে আরো একটা ছোটো খাম। চিঠিটা সাইডে রেখে ভেতরের খামটা খুলে আরো খানিকটা অবাক হয় অর্থী। একটা মেমোরি কার্ড। উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে অর্থীর। কোনো রহস্যের চাবিকাঠি নয়তো এই মেমোরি কার্ড। নীলয়ের ফিরতে এখনও ঢের বাকি। চট করে নিজের ফোন সেট করে মেমোরি কার্ড। হাত পা অসম্ভবরকম কাঁপছে। বুকের ঢিপ ঢিপ আওয়াজ বাড়ছে। হটাৎ করেই কেমন যেনো সাহসী হয়ে পড়ছে অর্থী।

মেমোরি কার্ডে একটা ভিডিও। মনে মনে বেশ অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে অন করে ভিডিও। মনকে সবরকম পরিস্থিতির জন্য মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।

স্ক্রিনে ভেসে আসছে নীলয়ের মুখ। সাথে এক নারী। সুন্দরী রমণীর পরনে অন্তর্বাস ব্যতীত কিছু নেই। ঝট করে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্থী। এমন কিছুই দেখবে সে জানতো। তবুও মেনে নেওয়া বড্ডো দুষ্কর হয়ে পড়ছে। মেয়েরা এই এক বিষয়ে ভীষণ স্বার্থপর হয়। নিজের ভালোবাসার মানুষের পাশে কাকপক্ষীকেও সহ্য করতে পারেনা। অথচ নীলয় তার স্বামী। দুই বছরের সুখের সংসার তাদের। নিজের স্বামীকে কিভাবে অন্য এক নারীর সাথে দেখে সহ্য করবে অর্থী? দম বন্ধ হয়ে আসছে। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো অর্থী। শুধু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও কেউ পাঠাবেনা। নিশ্চই আরো কিছু আছে এতে। সবটা দেখতে হবে অর্থীকে। বুকে পাথর চেপে তাকে সবটা খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

অর্থীর চোঁখের সামনে চলছে নীলয়ের সাথে এক নারীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও। ঠোঁট চেপে কান্না নিবারণের বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে অর্থী। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য অশ্রুকণা। বুকটা জ্বালাপোড়া করে শেষ হচ্ছে। ভিডিওর মেয়াদের সাথে বাড়ছে হৃদয়ের ক্ষত। কিন্তু এরপর যা হলো আঁতকে উঠলো অর্থী। মেয়েটার মুখ এতক্ষন বেশ চেনা চেনা লাগছিলো অর্থীর। সেদিকে বিশেষ খেয়াল দেয়নি অর্থী। নীলয়ের হাতে ধারালো অ’স্ত্র। বাইকের হর্নের আওয়াজ পেয়ে চমকে ওঠে অর্থী। ভিডিওটা কপি করে নেয় নিজের ফোনে। ওদিকে অনবরত দড়জা ধাক্কাচ্ছে নীলয়। তারাহুরো করে চিঠির ভাঁজ খুলে ছবি তুলে নেয় ফোনে। ফোন থেকে মেমোরি কার্ড খুলে আগের মতো ঠিকঠাক করে খামে রেখে দেয় অর্থী। ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দরজা খুলে দেয়।

“এতক্ষন কি করছিলে? এতো সময় লাগে কেনো দরজা খুলতে?”

আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অর্থী। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে জবাব দেয়,

“ঘঘুমিয়ে গেছিলাম।”

নীলয়ও আর কথা বাড়ালোনা। যথেষ্ট ক্লান্ত সে। রুমে ঢুকে ধপাস করে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। অর্থীর ঠোঁট ভেঙে আসছে। নিজেকে কিছুতেই স্বাভাবিক করতে পারছেনা। একদৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ট্যাপের পানি ছেড়ে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। কষ্টগুলো কান্নার সাথে বের করে দেওয়ার চেষ্টায় লেগে পড়ে। উন্মত্তের মতো নিজের চুল দুই হতে খামচে ধরে বসে পড়ে মেঝেতে।

চলবে?