সে আমার শরৎফুল পর্ব-০২

0
125

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব_২

#আরশিয়া_জান্নাত

আমাদের বাড়ির পাশেই বিশাল একটা মাঠ আছে, এলাকার যেকোনো বড় অনুষ্ঠান এখানেই প্যান্ডেল সাজিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য পুজোর মন্ডপও এখানেই হবে। তাই এদিকে নিরবতা একটু কম। অলরেডি প্যান্ডেল সাজিয়ে ডেকোরেশন শুরু হয়ে গেছে। আমি ছাদে বসে তাদের কাজ দেখছি। পাশের ছাদ থেকে মালতি বৌদি আর প্রমিতাও সেসব দেখছে। আমাকে দেখে বললো, কি খবর তৃণা? কবে এলি?

এই তো বৌদি গতকালকেই। তোমরা ভালো তো?

ভালোই তবে বাবার শরীরটা বিশেষ ভালো নয়, গেল সপ্তাহে অপারেশন হলো।

কি হয়েছে?

বয়স হলে কত রোগবালাই যে হয়। পিত্তথলির পাশে পাথর হয়েছে। কেটে ফেলে দিতে হলো।

আহারে! তা এখন সুস্থ তো?

রেস্টে আছেন, এসো সময় করে দেখে যেও।

প্রমিতা কিনারায় ঘেষে চালভাজা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তৃণা আপা নাও চালভাজা খাও। আমি মুঠো ভরে নিয়ে বললাম, তোর পড়ার কি খবর?

পড়াশোনার কথা বলিও না তো। যে পড়াশোনা আবিষ্কার করেছে তাকে পেলে আমি কি যে করতাম!!

বৌদি আর আমি হেসে উঠলাম ওর কথার ভঙ্গি দেখে। বেশকিছুক্ষণ গল্প শেষে নীচে নামতেই দেখি বড় ভাইয়াসবেই ঢাকা থেকে ফিরেছেন। আমাকে দেখেই বললেন, এই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটা কখন ফিরলো মা?

দাদাভাই আমি মোটেও কুড়িয়ে আনা মেয়ে না। বরং তুই কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে।

এহ! আমি নিজে দেখেছি তোকে সদর হাসপাতালের পাশে কে যেন ফেলে গেছিল। বাবা মায়া দেখিয়ে তুলে এনেছে….

বললেই হলো।

আলবাৎ হলো।

হুহ। আমার জন্য কিছু আনিস নি খালি হাতে এসেছিস!

আমার যেন ঠেকা পড়ছে বুড়ির জন্য চিপস চকলেট নিয়ে আসতাম?

বুড়ি বলবিনা দাদাভাই।

শোন মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি আর তুই তো এখন ২২ তার মানে বুড়ি হয়েছিস যে এরও ২বছর হয়ে গেছে।

আম্মু দেখছো ভাইয়া কি বলে?

আহ ওয়াসি ছোট রয়ে গেলি তোরা এখনো? আসতে না আসতেই ঝগড়া শুরু,,,

তামজিদ কোথায় মা?

কোচিং এ গেছে।

ওহ। আচ্ছা আমাকে কিছু দাও, না খেয়েই বেরিয়েছি,,,

তুই হাতমুখ ধুয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।

আমি চোখ ছোটছোট করে বললাম দাদাভাই সত্যিই কিছু আনিস নি?

সে ব্যাগ থেকে চকোলেটের প্যাকেট ধরিয়ে বললো এটা মিস দিয়ে ছুটি বরবাদ করতাম?

আমি বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললাম, এইতো বুদ্ধিমান ছেলে। সুখী হও বৎস!

আমরা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই ঢাকায় এমবিএ করছেন, পাশাপাশি টুকটাক টিউশন করেন। জবের জন্য ট্রায় করলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারছেন না। আর ছোট ভাই তামজিদ ক্লাস এইটে পড়ে। আমাদের আর্থিক অবস্থা মাঝারি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তেতলা বিল্ডিং আর কিছু ফসলি জমি আছে। বাবা ব্যবসা করেন। এলাকার মোড়ে আমাদের নিজস্ব মোদি দোকান আছে।

মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে বসে সবজি কুটছি আর মা অনেক কথা বলছেন। আমার মা গল্প করতে ভীষণ ভালোবাসেন। সবসময় কথা বলেই যান। অথচ আমরা যখন থাকিনা বেচারী একা হয়ে যান। তাই ছুটির দিনে আমি মায়ের সব গল্প বেশ মন দিয়েই শুনি।

বলছি কি বাবা বড় ভাইয়ের তো বেশ কিছু ধারদেনা আছে। এতো টাকা এই মুহূর্তে কই পাবা। তো আমি বলতেছিলাম কি উত্তরের যে ফসলি জমিটা আছে ঐটা বিক্রি করে দাও। তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করো। মৃতের উপর কর্জের বোঝা কমুক! তুমি চাইলে আমিই ওটা কিনে নিবো, সলিড দামে….

ইরহাম শান্ত দৃষ্টিতে তার ছোট চাচার দিকে তাকায়, চাচা ঐ জমি থেকেই আমাদের সারাবছরের চাল আর আলু আসে। এখন ঐটা বিক্রি করলে আমরা চলবো কিভাবে? আর বাবার বড় ছেলে এখনো জীবিত আছে, আমার বাবার ঋণ আমিই পরিশোধ করবো।

দেখ বাবা বলা সহজ করা কঠিন। তুমি এখনো পড়াশোনায় আছ চাকরি বাকরি নাই। কেমনে কি করবা?

তবুও চাচা, জমিজমা বিক্রি করা আব্বার পছন্দ ছিল না। উনি সবসময় বলতেন মাটির সাথে সম্পর্ক মজবুত করো। দিনশেষে এটাই আশ্রয় হয়।

বেশ তোমার যা মর্জি। আমিতো তোমাগো ভালার কথা ভাইবাই পরামর্শ দিছিলাম। তোমরা যা ভালো বুঝো।

ওর চাচা চলে যেতেই সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। এতোই যখন দরদ বলতে পারতো আমি শোধ করে দিচ্ছি তুই ধীরে ধীরে আমারে দিস। তা না জমিতে নজর দিছে!

ইরহাম চুপচাপ ভাবতে লাগলো কি করা উচিত।

ভাইয়া তুই চাচার কথা পাত্তা দিস না। উনার আজীবন ঐ জমিটার উপর নজর ছিল। এখন বাহানা পাইছে।

রুমি আব্বার ঋণের খাতাটা নিয়ে আয় তো। হিসাব করে দেখি…

ইরহামের বড় বোন মাইশা বললো, মানুষ এতো অবিবেচক না ছোটু। আব্বাকে সবাই অনেক সম্মান করে। তার ছেলেমেয়ের উপর ওরা অবিচার করবে না। আর তুই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হলেই দেখবি অল্পদিনেই সব শেষ হবে। তবে এখন যারা বেশি বিরক্ত করছে, তাদেরকে আমি দিয়ে দিবো। তুই এতো চাপ নিস না ভাই। তোর আপা দুলাভাই এখনো আছে তোর ছায়া হয়ে,,,

ওর দুলাভাই ওর কাধে হাত রেখে বলল, এতো দূর্বল হবার কিছু নেই। আল্লাহ ভরসা। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনাটা শেষ করো।

ইরহাম ভরসা পায়। তার দুলাভাই মাটির মানুষ। সবসময় বড় ভাইয়ের মতোই স্নেহ করেন। বাবার অবর্তমানে তাকেই ভীষণ আপন মনে হলো। তাদের মা শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন, দুনিয়ার কোনোকিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছেনা। স্বামীকে বড্ড বেশি ভালোবাসতেন বলে তার এই হঠাৎ বিদায় মেনে নিতে সময় লাগছে তার।

ইরহাম নিজের রুমে গিয়ে বসলো। দেখতে দেখতে ৩ সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এবার হলে ফেরা উচিত। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতেই খেয়াল হলো একটা বই তার ব্যাগে। এটা কার বই!
পাতা উল্টেপাল্টে দেখতেই বই থেকে বেরিয়ে আসে ট্রেনের টিকিটের প্রিন্ট কপি। বাঁধন টিকিট দেখে মন পড়ে এটা সেদিনের সহযাত্রীর বই। কিভাবে যে তার ব্যাগে ঢুকলো! উফফ…

আচ্ছা টিকিটে তো তার ফোন নাম্বার আছেই, কল করে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিলেই হবে!
এমনটা ভেবেই ফোন নাম্বারটা ডায়াল করে। দু’বার রিং বেজে ৩য় বার কল রিসিভ করে তৃণা।

আস্সালামু আলাইকুম

ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কে বলছেন?

জ্বি আমি ইরহাম, সপ্তাহখানেক আগে ট্রেনে আলাপ হয়েছিল।

ওহ হ্যাঁ আপনি! কিন্তু আমার কনট্যাক্ট নম্বর পেলেন কিভাবে?

আসলে আপনার বই ভুলবশত আমার কাছে রয়ে গেছে। সেখানেই আপনার টিকিট পেয়ে কল করলাম।

দত্তা’ বইটা আপনার কাছে! কি যে মন খারাপ লাগছিল বইটা পড়ার আগেই হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে।

আপনি চাইলে এড্রেস দিতে পারেন, আমি এটা কুরিয়ার করে দিবো।

তৃণা ভীষণ অবাক হলো, কেউ কুড়িয়ে পাওয়া বই ফিরিয়ে দেয় আজকাল? মানুষকে পড়তে দিলেই ফেরত দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যায়।
তৃণা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিল বইটার।

সে হেসে বলল, আপনি ভীষণ দায়িত্ববান দেখছি! আপনি চিচাগং ব্যাক করেছেন?

না কাল রওয়ানা দিবো।

তবে সরাসরিই নিবো। কুরিয়ার দিতে হবেনা। একই শহরে আছি নিতে অসুবিধা হবেনা।

ইরহাম খানিকটা ইতস্ততবোধ করলেও প্রকাশ করলোনা। ছোট করে বললো, আচ্ছা।

আপনি ভালো আছেন তো?

জ্বি আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?

জ্বি ভালো।

আচ্ছা রাখছি তাহলে। ভালো থাকবেন

আপনিও ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

ইরহাম কল রেখে টিকিটটার দিকে তাকালো, আইনান তাজরিন তৃণা…..

কিছু বই কেনার উদ্দেশ্যে নিউমার্কেটের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। তাই তৃণা ভাবলো কালই যাওয়া যাক। ইরহাম যেহেতু কাল ফিরছে, নিউমার্কেট তথা বটতলী স্টেশনেই নামবে। এতে উনারও আলাদা ঝাক্কি পোহাতে হবেনা।
টেক্সট করে বিষয়টা জানিয়ে সে পড়ায় মন দিলো।

চলবে,,