সে আমার শরৎফুল পর্ব-০১

0
207

#সে_আমার_শরৎফুল
#আরশিয়া_জান্নাত

তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল শরৎকালে। ঝকঝকে নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেসে চলা কিংবা নদীর কিনারা বা খালি প্লটে জেগে উঠা কাঁশফুলের ঋতুতে!
শরৎ নিয়ে আমার বরাবরই ভীষণ আদিখ্যেতা, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটা একটু ঝাঁজালো হলেও বেশ প্রিয়। তাই এই সময়ে তার আগমন টা আমার কাছে একটু বিশেষ বলা চলে।
সেবার পুজোয় ছুটি পেয়েই হল ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই ভোর ছ’টা নাগাদ। শীত না হলেও সকালে আর বিকেলে শীতের আভাস ঠিকই মিলতে শুরু হয়ে যায় অক্টোবরে। গায়ে শাল পেঁচিয়ে ট্রেনের নির্দিষ্ট বগীতে উঠে টিকিট হাতে সিট খুঁজছিলাম তখনি তার সঙ্গে দেখা। ছিপছিপে গড়নের লম্বা একটা ছেলে। পড়নে ধূসর রঙের পাঞ্জাবী। চোখেমুখে বিষন্নতার ছোঁয়া। চোখদুটোয় নির্ঘুম থাকার ছাপ। একবার মনে হলো ভোরে জেগেছে বোধহয় এমন‌ রক্ত লাল হয়ে আছে অক্ষিযুগল। সে যাই হোক আমি জানলার পাশে বেশ আয়েশ করেই বসলাম। ব্যাগ থেকে গরম পানির ফ্ল্যাক্স বের করে একটু গলা ভেজালাম। আমার আবার ঠান্ডা সহ্য হয়না। অল্পতেই টনসিল ফুলে যায়, গলা বসে যায়। তাই নিয়মিত গরম পানি খেতেই হয়। মগে অল্প অল্প চুমুক দিতেই দেখি ঐ হ্যাংলা পাতলা লোকটার সিট আমার পাশেই পড়েছে। চিকন মানুষ সহযাত্রী হবার সুবিধা হলো এদের স্পেস বেশি লাগেনা। তাই আরাম করেই বসা যায়। ট্রেন তার বাঁশি বাজিয়ে জানান দিলো ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। আমিও সব ঠিকঠাক করে শালটা বেশ গুছিয়ে উষ্ণ বলয় তৈরির চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলাম। তখন পাশ থেকে সে বলল, জানালা খুলে রেখে নিজে ঠিকই গরম কাপড়ে আছেন, এদিকে আমি যে হিম হচ্ছি! জানালাটা বন্ধ করে দিন বরং?

আমি ভদ্রতার হাসি হেসে বললাম, ফ্যান ছেড়ে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস তো, তাই আর কি!!! আপনার অসুবিধা হচ্ছে যখন অফ করে দিচ্ছি।

সে আর কথা বাড়ালো না। কোচে হেলান দিয়ে উপরের দিকে চেয়ে রইলো। চোখেমুখে রাজ্যের বিষন্নতা। এতো বিষাদ কেন এই ছেলেটার মুখে, তাও এমন ভোরবেলায়? আমার মতে ভোরে কারোই মন খারাপ হতে পারেনা। সদ্য ঘুম থেকে জেগে কেউ কেন দিনের শুরুতে মন খারাপ করবে? আমি কৌতুহল চাপানোর বৃথা চেষ্টা করলাম ঘন্টাখানেক। হঠাৎ তার ফোনে কল বেজে উঠে। সে দ্রুত রিসিভ করে কানে তুলে, হ্যাঁ রুমি রওয়ানা দিয়েছি। যোহরের আগেই পৌঁছাবো। সবাইকে খবর দিয়েছিস?

অপরপ্রান্তের মেয়েটা ক্লান্ত গলায় বললো,ভাইয়া আম্মা বেহুশ, আমি একা কয়জনকে খবর দিবো?তবুও অনেকেরেই বলছি।ওনারাই খবর দিবে।

তুই চিন্তা করিস না, কাফনের কাপড় মেঝ মামা আনবে বলছে। তুই আম্মার পাশেই থাক। আর শোন!

হুম?

আব্বারে এখনি খাট থেকে নামাইসনা……

কথাটা বলেই ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে সময় নিলো না। আমি স্তব্ধ হয়ে শুনলাম, কি কঠিন লাইন আব্বারে এখনি খাট থেকে নামাইস না!

সদ্য পিতা হারানো সন্তানের মনের অবস্থা কল্পনা করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি জাস্ট শেষ লাইনেই আটকে ছিলাম। ফোনটা রেখে সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। বেশ কয়েক জনকে ফোন করে নিস্তেজ হয়ে চোখ বুজলো। বয়স কত হবে তার? ২৬ কি ২৭? নাকি আরো কম! অথচ কি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখিই না হতে হচ্ছে তাকে!
মনের অজান্তেই বলে ফেললাম, নিবর্ষ হবেন না। এই পৃথিবী থেকে একদিন আমাদের সবাইকেই বিদায় নিতে হবে। মনকে শক্ত করুন,,

সে আমার দিকে চেয়ে ম্লান হেসে বললো, আব্বা যে হঠাৎ করে চলে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। কাল রাতেও কথা হয়েছে। খেয়েদেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটা ঘুমাতে গেল। রাত ৩টায় বোনের ফোন এলো উনি কেমন যেন করছেন,,,,
কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, আব্বাকে একটু সুখ দেখাতে পারলাম না। পুরো জীবন যে মানুষটা আমাদের জন্য এতো খাটলেন তাকে বিশ্রাম দেওয়ার সময়টা পেলাম না। উনি আমাকে ঋণী করেই রেখে গেলেন….

বাবা মায়ের ঋণ কখনোই শোধ হয়না। আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনজনের মৃত্যুতে কিভাবে শোক প্রকাশ করতে হয় জানা নেই! তবে দোআ করি আল্লাহ আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দিন।

আমার মনটাও বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। একটু আগে যে জার্নিটা খুব এক্সাইটিং ছিল মুহূর্তেই তা ছাই মনে হলো। আমি কোলের উপর রাখা উপন্যাসের বইটা অনাদরেই ফেলে রাখলাম। খুলে দেখার আগ্রহ পেলাম না।

প্রায় ৬ঘন্টা জার্নি শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে থামে। ব্যাগপত্র নিয়ে স্টেশনে নেমে রেললাইন পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠা আমার কাছে সবসময় বিরক্তিকর লাগে। তবুও লাগেজটা টেনে হিচড়ে কোনোমতে দরজায় দাঁড়ালাম তখন তিনি পেছন ফিরে বললো, আমায় দিন আমি সাহায্য করছি! আমি কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বললাম ধন্যবাদ।
ও এরমাঝে তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়টা জানা হয়েছে। তার নাম ফুয়াদ আজমির ইরহাম। চট্টগ্রাম প্রকোশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পরিবার বলতে দুই বোন আর সে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, ছোটবোন ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবা সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।
স্টেশনে পেরিয়ে রিকশা ঠিক করা অবধি তিনি আমার পাশেই ছিলেন। আমি শেষবারের মতো ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

বিবাড়িয়ায় দূর্গাপূজার আমেজ বেশি দেখা যায়। এখানে বেশ কিছু পুরনো মন্দির থাকায় পুজোপার্বণে পাড়ায় পাড়ায় হৈহুল্লোড় পড়ে যায়। বাসায় ফিরে সবার সঙ্গে কুশোল বিনিময় করে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় গড়াগড়ি খেলাম। আহ নিজের খাটের মতো আরামদায়ক আর কোথাও নেই।

আরেহ আমার পরিচয় বলা হয়নি! দেখেছ কান্ড এতক্ষণ কত বকবক করছি অতচ পরিচয়পর্বই সারলাম না,,, আমি আইনান তাজরিন তৃণা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা নিয়ে পড়ছি।আমার জীবন কাটে নানারকম প্রাণিদের নিয়ে। আর এই বিষয়ে পড়ে মানুষ ব্যতীত অন্য সকল প্রাণির প্রতিই আমার তীব্র অনুরাগ জন্মেছে। এই পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্যতা ছাড়া মানুষ টিকতে না পারলেও মানুষ ছাড়া জীববৈচিত্র্যতা ঠিকই টিকবে। এই সহজ সত্যিটা জানার পরও মানুষ প্রতিনিয়ত জীববৈচিত্র্যতাকে প্রতিনিয়ত কিভাবে হুমকির মুখে ফেলছে এটা আমার বোধগম্য হয়না। স্বার্থপর মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য হলেও পৃথিবীটার যত্ন নেওয়া উচিত। অথচ তারা সেটা বেমালুম ভুলে বসেছে। আমি যখনই কোনো এক্সপেরিমেন্টাল ট্যুরে যাই আর দেখি কত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি বিলুপ্ত হয়ে গেছে শুধুমাত্র মানুষদের জন্য, তখন আমার মনে আর যাই হোক এই জাতিটার প্রতি আবেগ আসেনা। এখন কিছু লোক আমায় গালমন্দ করতে পারেন, স্বীয় সত্তাকে অবমাননা করছি এমন ট্যাগও লাগাতে পারেন। আমিও তো মানুষ, আমার বাবা-মাও মানুষ। তাদেরকেও বুঝি ঘৃণা করি? এই বিষয়ে তর্কে না যাই। শুধু এই বলে ইতি টানি মানুষ যেখানেই গেছে তা ধ্বংস করেছে। আর এটার দৃষ্টান্ত পুরো পৃথিবীময় দৃশ্যমান।

বাবার সঙ্গে সচরাচর আমি খেতে বসিনা, কেননা তিনি খাওয়ার সময় দুনিয়ার ফিরিস্তি খুলে বসেন। কিন্তু আজ সকালে একজনের পিতৃবিয়োগ দেখে আমার মনটা খানিকটা নরম হয়ে আছে। আসলেই তো পৃথিবীতে আমরা কেউই চিরস্থায়ী নই। সবসময় ফিরেই যে আপন মানুষদের জীবিত দেখবো তার কি নিশ্চয়তা আছে? আমি বাবা মায়ের দিকে মন ভরে চাইলাম। মনে মনে আল্লাহকে বললাম এনাদের তুমি আরো অনেকদিন হায়াৎ দাও মালিক!

ঘন্টাখানেক আরাম করে ঘুমিয়ে বিকেলে ছাদে যেতেই পাশের বাড়ির সব বান্ধবীরা জোট পাকিয়ে ধরলো।

তৃণা তুই কেমন রে? ফিরে একবার খোজ ও করলিনা, এসেই ভুসভুস করে ঘুমোলি!!

তোরাও না কেমন! সেই ভোরে উঠেছি জানিস? বাড়িতে আসার খুশিতে রাতেও ঠিকঠাক ঘুম হয়নি। একটু ঘুমিয়ে নিতেই এভাবে মৌচাকে ঢিল মারার মতো ছুটে এলি?

সেসব রাখ আগে বল কয়দিনে ছুটিতে এলি?

এই তো আছি ৮/১০দিন।

অনেক মজা হবে।

কিরে রুবিনা আসেনি?

নাহ। এবার আসবেনা বলে। ওর শ্বশুরপক্ষের কার যেন বিয়ে আছে,,,

ওহ। তা তোরা সবাই ভালো তো?

হুম ভালোই।

মা আমাদের সবার জন্য চা আর মুড়িমাখা পাঠালেন। আমরা ৭/৮জন মেয়ে মিলে পুরো ছাদ মাথায় তুললাম হাসি আর কথাতে।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হঠাৎ খেয়াল হলো দত্তা’ উপন্যাসের বইটা কোথাও নেই। ট্রেনে পড়বো ভেবে যে বইটা রেখেছিলাম, কোথায় যে ফেলে এসেছি!! কি আর করা একরাশ মন খারাপ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

জানাজা পড়িয়ে দাফন কাফন শেষ করতে করতে দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে যায়। এরই মাঝে দুই দফা খাওয়ানোর পর্ব শেষ। আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী মিলে সবজায়গায় উপচে পড়া ভীড়। মরা বাড়িতে একটু যে নির্জনে বসে দু ফোঁটা পানি ফেলবে সেই ফুরসত নেই। ইতোমধ্যেই চাচা ফুফুরা মিটিং বসিয়ে ফেলেছেন কত টাকা ঋণ আছে, কে দায়ভার নিবেসহ নানান শলাপরামর্শের। ইরহাম আকাশের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আব্বা কার কাছে রেখে গেলে? এই এতো বড় পৃথিবীতে আমার মাথায় ছায়া যে আর রইলো না। আমি কিভাবে সব সামলাবো?

রাতে ঘরে ঢুকতেই বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠলো। ড্রইং রুমে থাকা কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারটা তার বাবার জন্য অবধারিত।এই চেয়ারে বসে আর কেউ খবর দেখবেনা, চোখে চশমা পড়ে পত্রিকা পড়বেনা।কেমন এক শূন্যতা গ্রাস করলো তাকে। চেয়ারেরসামনে বসেই আব্বা বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে।রুমি দৌড়ে এসে ভাইয়ের পাশে বসে। নিরবে সেও কাঁদতে থাকে। ইশ যদি এমন হতো এটা জাস্ট একটা দুঃস্বপ্ন। চোখ মেললেই সে দেখবে সে হলেই আছে। ছুটিতে বাড়ি আসার জন্য তার বাবা কল করে তোড়জোড় করছে…..হতে পারেনা এমন?

চলবে,,,