সে আমার শরৎফুল পর্ব-১৪+১৫

0
116

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব১৪

#আরশিয়া_জান্নাত

মাইশা চুপ করে তার মায়ের ঘরে বসে আছে। রুমানা বেগম বই বন্ধ না করেই বলল, কিছু বলার থাকলে বলে ফেল এমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকিস না।

মাইশা থমথমে গলায় বলল, মা তোমার কি মনে হয় না তুমি যা করছো সেটা ভুল? একটা টিনেজের মেয়েকে তুমি এভাবে ট্রিট করছো কেন? এই বয়সটা যে আবেগের তা ভুলে গেছ? এখন তোমার কর্মকান্ডের জেরে ও যদি ভুল কিছু করে বসে?

আমার কি এতো অকাল এসেছে যে তোর থেকে শিখতে হবে কিভাবে কথা বলবো, কিভাবে চলবো?

তুমি বিষয়টা ত্যাড়াভাবে নিলে আমার কিছু করার নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা সবাইই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রুমি। এতো অল্প বয়সে মেয়েটা বাবার ছায়া হারিয়েছে। তার উপর তোমার উপদ্রব। তুমি ওকে এমনভাবে ট্রিট করছো যেন ও তোমার মেয়ে না, কুড়িয়ে আনা মেয়ের প্রতিও মানুষ এমন কঠোর হয় না। তুমি ওকে রান্না করাচ্ছ, ঘরের যাবতীয় সকল কাজ করাচ্ছ। ওসবে আমি বাধা দিবো না। মেয়ে যখন হয়েছে ঘরের কাজ করবে অস্বাভাবিক না। তবে তুমি যা বলে বলে ওকে কাজ করাচ্ছ তা মোটেও ঠিক না। তুমি প্রতিনিয়ত ওর মাথায় ঢুকাচ্ছ এসব শিখাচ্ছ যেন তোমরা মরে গেলেও ও বাঁচতে পারে, ওকে বিয়ে দিতে পারলেই তুমি বাঁচো ইত্যাদি। মা আমাদের বাবা নাই। ধরতে গেলে আমরা এখন এতিম। তুমি এখনো আছ তুমি কি আমাদের আশ্রয় হতে পারতে না? এমন আলগা ভাব কেন তোমার? আমাদের ৩জনের ই মনে হচ্ছে কেবল বাবা যায় নি, আমাদের মাও চলে গেছে…..

তোর বোন তোকে ডেকেছে আমার বিচার করতে? তা বিচারক ম্যাডাম আমার শাস্তি কি ঠিক করলেন?

মাইশা স্তব্ধ হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলো কিয়ৎক্ষণ। কিছু একটা ভেবে বলল, তোমার যদি ওকে রাখতে সমস্যা হয় তবে বেশ আমার বোনকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাবো।
তুমি তোমার জেদ নিয়ে একাই থাকো।

মাইশা রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার বুঝতে বাকি রইলো না স্বামীর শোকে তার মায়ের হিতাহিত বোধ লোপ পেয়েছে। কেমন একটা উগ্র মনোভাব জন্মেছে মনে। এটার সমাধান না করা অবধি বোনকে সে নিজের কাছেই রাখবে।

রুমানা বেগম এমনভাবে পুনরায় বইয়ে মন দিলেন যেন কিছুই ঘটেনি। মাইশা রুমির বইপত্র জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেল‌ নিজ বাসার উদ্দেশ্যে।

কিছুদিন পরই তৃণার সেমিস্টার ফাইনাল। ল্যাব প্র্যাক্টিক্যালের পাশাপাশি রাত জেগে পড়াটাও বাড়াতে হয়েছে। ২৪ঘন্টা যেন খুবই কম সময়। ওর ইচ্ছে করছে সময়টাকে আরেকটু বাড়াতে পারলে মন্দ হতো না। এইসবের মাঝে নতুন করে যোগ হলো কোচিং সেন্টারে পড়ানো। তৃণার টাকার বিশেষ প্রয়োজন নেই। তার বাবা প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট পাঠিয়ে দেন। ওতে সব খরচ বাদেও বেশ কিছু টাকা থেকে যায়। তৃণা ওসব জমিয়ে বাবা-মা, ভাইদের জন্য বিভিন্ন জিনিস কিনে, বই কিনে। এভাবেই চলে আসছিল এতোদিন। ইরহামের সঙ্গে সপ্তাহে ২দিন দেখা হবে একমাত্র সেই লোভেই সে কোচিং এ পড়াতে রাজী হয়েছে। ইরহামের ছায়ার আশেপাশে থাকতেও তার শান্তি লাগে। তৃণা জানেনা এইসব আবেগের আদৌ কোনো মূল্য আছে কি না। নাকি এটা কেবল একপাক্ষিক প্রণয় হয়েই থেকে যাবে। তৃণার কাছে ইরহাম শরৎকালের মতোই প্রিয়। তাই তো সে তাকে মনে মনে শরৎফুল বলে ডাকে।
কোচিং এর অফিসরুমে বসতেই বাঁধন তাকে চা দিয়ে বলে, আপু আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? ক্লাস নিতে কেমন লাগছে?

নাহ অসুবিধা নেই। ক্লাস নিতে খারাপ লাগছেনা। দেখার বিষয় ওদের কোনো কমপ্লেইন আছে কি না!

নাহ আপনাকে তো তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। আপনার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। মনে হচ্ছে অল্পদিনেই আপনি ওদের মন জয় করে ফেলেছেন।

কি যে বলেন!

সত্যি বলছি। আপনার পড়ানোর ধরন ভালো। আমার মনে হয় আপনি টিচিং প্রফেশনে শাইন করবেন। সব মেধাবী ছাত্র কিন্তু ভালো টিচার হতে পারেনা…

ইয়া আল্লাহ এতো প্রশংসা করলে তো বদহজম হয়ে যাবে। থামুন প্লিজ।

হাহাহা,, আচ্ছা বেশ থামলাম।

ইরহাম ভাইয়াকে দেখছিনা? কোথায় তিনি?

উনি তো বিজি মানুষ। দিনরাত এক করে খাটছেন বলা চলে।

স্বাভাবিক। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়েছে,
ব্যস্ততা বাড়বেই।

হুম। আচ্ছা আপু আপনি বসেন, আমার একটা ক্লাস নিতে হবে।

আচ্ছা।

বাধন চলে যেতেই তৃণা আজকের রুটিনটা দেখলো। চা শেষ করে ক্লাস নেওয়ার উদ্দেশ্যে উঠলো।

ওয়াসি বিবাড়িয়া এসেছে, বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি পড়েছে। তাই ৩দিনের সময় পেয়ে বাড়ি আসাই শ্রেয়। বাসায় আসলে তার প্রথমদিনটা ঘুমিয়েই কাটে। তাদের ভাইবোনদের কাছে ঘুমের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। ৩টা ছেলেমেয়েই ঘুম পাগল। সুযোগ পেলে মানুষ বেড়াতে যেতে পছন্দ করলেও ওরা পছন্দ করে ঘুমাতে। তাহমিনার ধারণা ওরা যদি পারতো ভাল্লুকের মতো এককালীন শীতনিদ্রায় চলে যেত। তৃণা অবশ্য শীত আসলে অনেকটা ভাল্লুকই বনে যায়। ছেলেমেয়ে ৩টা মা-বাবার অতি আদরের বলা বাহুল্য। এতো বড় হবার পরো তাদের আদরে আহ্লাদে রাখেন ওয়াজেদ আর তাহমিনা। কখনো উঁচুস্বরে কথা বলেন না,ধমক দেওয়া তো অনেক দূর। ছেলেমেয়েরাও বাবা মায়ের জন্য অন্তঃপ্রাণ। তাদের সবকিছু এই বাবা-মাকে ঘিরেই।

ওয়াসি? আর কত ঘুমাবি বাবা উঠ? ভাত খাবি না?

ওয়াসি ঘুমঘুম গলায় বলল, মা মেনু কি?

চিংড়ি মাছ দিয়ে কচুশাক ভাজি, আলু টমেটো দিয়ে শিং মাছের ঝোল, গতকাল রাতের মুরগির তরকারি একটু আছে।

আচ্ছা।

কি রে আচ্ছা বলে আবার ঘুমাচ্ছিস যে? উঠ না। একটু খেয়ে এসে আবার ঘুমাইস।

মা যে তরকারি রান্না করছো ঐগুলো খাওয়া শুরু করলে ঘুম কেটে যাবে। এক একটা পদের জন্য ১প্লেট করে বরাদ্দ করলেও ৩/৪ প্লেট অনায়েসে সাবাড় করা যাবে।

তাহলে তো তোর উচিত খাওয়ার লোভে উঠা। তুই উল্টো কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরলি কেন?

উহু মা এই ঘুমের রেশটা সরতে দেওয়া যাবেনা। আজ তোমার এমনকিছু রান্না করা উচিত ছিল যা আমি না পারতে খাই। তবেই কোনোরকম গিলে এসে ফের ঘুমাতে পারতাম।

তোদের কথাবার্তা আমার মাথার উপর যায়।
থাক তুই ঘুম নিয়ে।

ওয়াসি মায়ের কোল জড়িয়ে বলল, মা তুমি অনেক আলভোলা। এমন সহজ সরল হবার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

তাহমিনা ছেলের মাথায় বিলি কেটে বললেন, হ্যাঁ রে খোকা রিপার কি খবর? কথাবার্তা হয়?

আছে হয়তো ভালোই।

আবার ঝগড়া করেছিস, না?

ওয়াসি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তার কিছু দিক আমার পছন্দ না। ও কখন কাকে নিয়ে কি বলে এই বুঝ ওর নেই। এটা আমাকে কষ্ট দেয় মা। এমন না ও খারাপ। তবে মাঝেমধ্যে আমার কাছে ও নিষ্ঠুর!

আমরা কেউই সবদিকে শ্রেষ্ঠ না। মানুষের দোষগুণ থাকবেই। দেখার বিষয় হলো সেটা কতটা সহনীয়। অন্ধের মতো ভালোবাসাকে আমি কখনো সাপোর্ট করিনা। যে ভালোবাসা মানুষ কে ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় ওতে কারোই ভালো হয় না।

হুম।

তোদের নিয়ে আমার একটাই চিন্তা, তোরা যেন ভালো জীবনসঙ্গী পাস। জীবনসঙ্গী ভালো পাওয়া অনেক বড় নেয়ামত। যাদের ওটা ভালো হয়না তাদের জাহান্নামে যাওয়া লাগে না, পৃথিবীটাই জাহান্নাম হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া তোদের নসীবে ভালো কেউই আসুক,,,,

আমিন।

ইরহাম মাঠের উপর বসে লেকের দিকে চেয়ে আছে। তার মন খারাপ হলে সে এখানে এসে বসে থাকে। বাড়িতে মা-বোনদের বিবাদে সে অনেকটাই হতাশ। এখন নিরব দর্শক হওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। যদিও সে জানে এখানে মায়ের ভুল আছে। কিন্তু সবাই মিলে যদি মায়ের বিপক্ষে যায় তবে মায়ের কি হবে! সে বেচারি এমনিই খারাপ সময় পার করছে। এখন সে অন্তত তাকে কষ্ট দিতে পারবেনা। ইরহাম আনমনেই দূরে ঢিল ছুড়ে মারলো। ফোনটা হাতড়ে হিডেন ফোল্ডারে ক্লিক করে তাকালো একটা বিশেষ নারীর ছবির দিকে। ডাগর ডাগর চোখের গভীর কালো তারা, ফর্সা মুখখানীর ডান গালে কালো একটা তিল। ঠোঁটগুলো গোলাপের পাপড়ির ন্যায় কোমল, চুলগুলো রেশমি কালো। ইরহাম বেশ মনদিয়ে দেখতে থাকে সেই নারীর অগণিত ছবি। তবে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে বেগুনী রঙের কূর্তিতে ছাদের কার্ণিশে দাঁড়ানো ছবিটা। এই ছবিটা তুলতে কি কসরতই না করতে হয়েছে তাকে! ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।
ইরহামের মন খারাপ দূর হতে শুরু করলো। ইরহাম বুকের বা’পাশে হাত রেখে বলল,
“আপনি আমার মন খারাপের বিকেলে-
লালচে রাঙা আলো,
আপনাতে আমি বিভোর বেশ,
আপনাকেই বাসি ভালো।”

চলবে,,,

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব১৫

#আরশিয়া_জান্নাত

এই ফুয়াদ, দাঁড়া।

চেনা কন্ঠস্বর এতো বছর শুনে ইরহাম চমকে পেছনে তাকালো। মোহনার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। উৎসাহী গলায় বলল, ওরে রে তুই একদম বদলালি না। একদম আগের মতোই আছিস! মাই গড।

এতোদিনপর কোত্থেকে উদয় হলি তুই?

মনে রেখেছিস এই ঢের। আমিতো ভেবেছি চিনতেই পারবি না।

চিনবো না কেন? তোর মতো মেয়ে বাঁদর কে ভোলা এত সহজ?

হাহাহা,,, বদ হবার এই এক মজা। কেউ ভুলেও ভুলতে পারেনা। ভালোদের মনে রাখেনা কেউ বুঝলি!

তা যা বলেছিস।

চল কোথাও বসি।

চল,

তারপর বল কি হালচাল? কি করছিস এখন?

২৪/৭ বিজি ওমেন, ঘরদোর বাচ্চা সামলানো। সবমিলিয়ে দম ফেলার ফুরসত নেই বুঝলি! এমন এক পরিবারের বৌ হয়ে ঢুকেছি ভাইরে ভাই, বাংলাদেশের অর্ধেক জনসংখ্যা বোধহয় আমার শ্বশুড়পক্ষের আত্মীয়!!

কি বলিস এলাহী অবস্থা!

তাও নসীব ভালো ৫০% বিদেশ বিভুঁইয়ে আছে। গেল মাসে আমার এক ভাগনের বিয়ে গেল। আত্মীয়ই হলো ১৫০০, বাইরের গেস্ট বাদেই! চিন্তা কর।

বুঝলাম। তোর ছেলেমেয়ে কয়টা?

মোহনা ম্লান হেসে বলল, একটাও না…

ইরহাম বিস্ময়ে বললো, একটু আগে না বললি বাচ্চা….. বলেই চুপ হয়ে গেল।

আমার নেই তো কি হয়েছে, বাকিদের তো আছে। ওদেরকে আমিই দেখাশোনা করি। বিয়ের ৮বছর পেরিয়েছে, ভগবান হয় তো চায় না আমার কোল আলো করে কেউ আসুক। তবে কোল খালিও রাখেনি। ওরাই ছোট মা ছোট মা করে জান দেয়। ওদের জন্য বাপের বাড়িও আসতে পারিনা।

ইরহাম প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, তোর পরিবারের সবাই ভালোই তো?

হুম ভালোই। বড়দা তো কানাডা চলে গেছে স্ব-পরিবারে, মা-বাবা বেশিরভাগ মুর্শিদাবাদই থাকে। আমি জেদ ধরলাম এবার চট্টগ্রাম আসবো। তাই ওনারাও এলেন।

তোদের সবার দূরত্ব অনেক,, একেকজন একেক জায়গায় আছিস!

ঠিক বলেছিস, আমি গিয়ে পড়লাম উত্তরবঙ্গে, মেঝদি ঢাকায়, ছোটদা পটুয়াখালি! যাই হোক, তোদের কথা বল। সবাই ভালো আছে?

আছে,, ২ বছর হলো বাবা চলে গেলেন। একা সামলে উঠতে একটু হিমশিম খাচ্ছি। এই আর কি,,

কি বলিস! স্যরি রে আমি খবর পাইনি।

হুম, খবর পাবি কিভাবে তোর সঙ্গে আমারই তো যোগাযোগ নেই।

বিয়ে করিস নি?

নাহ। বেকার ছেলেকে কে বিয়ে করবে?

কি যে বলিস, চুয়েটের ছাত্র হয়ে এই কথা বললে খাটে?

সত্যি করে বল কেউ নেই? আমার চেনা অনেক রুপবতী মেয়ে আছে, তুই সিঙ্গেল থাকলে বল লাইন করে দেই।

ধুর কি যে বলিস।

ফুয়াদ, আমার বিশ্বাস হয়না তুই সিঙ্গেল। তবে অবিশ্বাসও করতে পারিনা। তুই যে মুখচোরা।
পছন্দ করিস কাউকে?

আছে একজন। যাকে বেশ ভালো লাগো।

সে জানে?

ইরহাম মাথা চুলকে মাথা নাঁড়ালো। মোহনা হেসে বলল, তোর থেকে এটাই আশা করা যায়। ছবি আছে? দেখি?

ইরহাম ফোন বের করে ছবি দেখালো। মোহনা উচ্ছাসিত গলায় বললো, ওয়াও! এতো সুন্দর? আমিই তো প্রেমে পড়ে গেলাম। কোথায় পেলি তাকে?

সে অনেক লম্বা কাহিনী। অন্যদিন বলবো।

মনের কথা বলে ফেলিস। বেশি দেরী করিস না।

একটু স্টেবল হয়ে নি, তারপর নাহয়…

ঐসব ভাবলে চলে না রে। সময়ের একফোঁড় অসময়ের দশফোঁড়ের সমান।

ইরহাম চিন্তিত ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিলো।

রূপার বিয়ে উপলক্ষে সব বান্ধবীদের মনে চাপা উত্তেজনা চলছে। তানজিনা, ঊর্মি, শেফা তো ড্রেসকোড অনুযায়ী শপিং করতেই মহাব্যস্ত।
তৃণার অবশ্য এই বিয়ে নিয়ে একদম আগ্রহ নেই। রূপার উপর একটা চাপা রাগই আছে বলতে গেলে। মুহতাসিমের সাথে দেড় বছরের মাখো মাখো প্রেম বাতিল করে কি অনায়েসে অন্যজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে রূপা! ছেলেটা কি পাগলামিই না করেছিল যখন রূপা ব্রেকাপ করেছে। এই ব্যাপারটা সবাই খুব স্বাভাবিক ভাবে নিলেও তৃণা নিতে পারেনি।ওর কেন জানি মনে হয় রূপা মুহতাসিমকে জাস্ট ইউজ করেছে, ভালোবাসেনি। তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে চুপচাপ বিয়েটা এটেন্ড করছে।

হলুদের দিন দুপুরে খাবার শেষে সবাই রূপাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পৌঁছাতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। রঙ বেরঙের বাতিতে ঝলমল করছে রাস্তার দু’ধার থেকে শুরু করে গোটা বাড়ি। অপরিচিত অতিথিদের ভীড় টপকে রূপার রুমে ঢুকতেই রূপা ঝাপটে ধরলো সবাইকে। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করে বললো, তোরা এসেছিস আমি অনেক খুশি হয়েছি। এই ঘরেই থাকবি তোরা আমার সাথে। ফাহিম ওদের জন্য নাস্তা-পানি পাঠাতে বল জলদি।

ঊর্মি বলল, দোস্ত তোদের গ্রামের রাস্তা এতো জোশ, আমিতো ফিদা। আমার কোমড়ের হাড় ঠিক জায়গায় আছে এতেই আমি আনন্দিত!!

তানজিনা বলল, আল্লাহ! এখানে কোনো চেয়ারম্যান নেই, রাস্তাঘাটের কি ছিড়ি! সত্যিই জান যে আছে এই ঢের। এতো ভাঙাচুড়া।

আরেহ এখানে এমনি।প্রতিবছরই দেখি রাস্তার কাজ চলে, আবার যে লাউ সেই কধু। তোদের অনেক কষ্ট হয়েছে নাহ?

রূপার মা হরেক পদের পিঠা আর ফলমূল নিয়ে উপস্থিত হলেন। সবার সঙ্গে কোনোরকম কুশল বিনিময় করেই তিনি আবার ব্যস্ত হয়ে গেলেন অন্য কাজে। তৃণা খাটের এককোণে বসে বললো, অনুষ্ঠান শুরু কখন? তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে আরো দেরি হবে। এখনো সাজ শুরু করিস নি!

এই তো একটু পরেই পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান আসবে। তার অপেক্ষাতেই আছি।

শেফা বলল, আমি এই প্রথম বান্ধবীর বিয়েতে আসছি। কি যে আনন্দ লাগতেছে। শোন রূপা তোর কোনো হ্যান্ডসাম কাজিন বা দেবর আছে? থাকলে দেখাইস তো। বিয়ে বাড়িতে আসলে তো কত ছেলে দেখা যায়,,

আছে আছে, অনেক আছে। তুই খালি পছন্দ করে আমাকে বলবি বাকিটা আমি সামলে নিবো।

তৃণার ফোনে মেসেজের টিউন বেজে উঠে।

“পৌঁছেছেন ঠিকঠাক? পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”

তৃণা মুচকি হেসে রিপ্লাই করে, “হুম। নাহ কোনো সমস্যা হয়নি।”

“বিয়ে বাড়িতে একটু সেইফ থাকবেন। নানারকম মানুষ একত্রিত হয়তো,,, ”

“আচ্ছা!”

তানজিনা ফিসফিস করে বলল, ইরহাম ভাইয়া টেক্সট করেছে তাই না?

কিভাবে বুঝলি?

এ আর তেমন কি! তুই লং ডিসটেন্সে গেলেই সবার আগে তার টেক্সট আসে। এতো সাধারণ নিয়ম হয়ে গেছে।

হুহ, সিসিক্যামেরার মতো নজরদারি রাখিস?!

আমি তোদের সম্পর্ক টা বুঝি না। না প্রেম না বন্ধুত্ব। কেমন যেন একটা নামহীন দৃঢ় বন্ধন!

সম্পর্কের নাম দিলে হারিয়ে যায়, এরচেয়ে নামহীন থাকাই শ্রেয়।

তাও ঠিক। তবে এভাবে আর কত বছর?

দেখি না সে আসে কি না।

তার অপেক্ষা না করে নিজে বললেই পারিস?

নাহ, আমি বলবো না। সে জাস্ট এক কদম বাড়াক, বাকিটা আমি দেখবো।

যদি উনিও একই ভাবনায় থাকে?

দেখি না কি হয়।

হুম।

মেয়ের বাবা নেই, বড় ভাইবোন আছে। ভাই ইঞ্জিনিয়ার, একটাই ভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বোনজামাইয়ের ও বেশ নামডাক আছে। বলতে গেলে ভালো বংশের মেয়ে। মেয়ের বাবা স্কুল মাস্টর আছিল। আপনারা এই মেয়েরে ঘরে আনলে ঠকবেন না এটা আমি নিশ্চিত কইতে পারি।

সব তো বুঝলাম ঘটক সাহেব। কিন্তু মেয়ে তো বেশি লম্বা না। আমাদের ছেলের জঞ্য লম্বা মেয়ে খুঁজতেছি।

দেখেন আপা মানুষ সবদিকে তো পায় না। এই মেয়ে রূপে গুণে ঠিকাছে। আপনারা একবার দেখলেই বুঝবেন।

বিয়ের পর কিন্তু পড়াশোনা করাবো না। বলছেন ওদেরকে?

পড়াশোনার কাজ কি? ছেলেমেয়েরে অ আ নাম লেখা শিখাইতে পারে ঐটুকু শিক্ষিত হইলেই চলে। ও তো তাও ইন্টারে পড়ে। অনেকখানিই পড়ছে,,

আচ্ছা দেখি ওর বাবা আসুক। একদিন সময় করে নাহয় দেখে আসবো।

আইচ্ছা।

ঘটক সাহেব সেখান থেকে বের হয়ে ইরহামদের বাড়িতে এলেন, আস্সালামু আলাইকুম আপা। কেমন আছেন?

ওয়ালাইকুমুস্সালাম। ভালো আপনি?

আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। আপা এইবার তো মনে হয়রুমি মায়ের ভাগ্য খুলছে। জব্বর একখান সম্বন্ধ পাইছি।

কি বলেন! ছেলে কি করে?

ছেলে পুলিশ। লম্বা চওড়া বাঘের মতো পোলা। মুড়াইলে নিজেদের বাড়ি আছে। ৫ভাই ৩বোইন। ছেলে ৪নম্বর। বাপের আনন্দবাজার ২টা দোকান আছে ভাড়ায় চলে। টাকাপয়সার অভাব নাই। আপনারা চাইলে কয়েকদিনের মধ্যে আসি দেখি গেল?

আচ্ছা, আমি আপনাকে কল দিয়ে জানাবো। বসেন আমি চা নাস্তা আনি।

রুমি দোতলার বারান্দা থেকে সব শুনে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ওর মা সত্যিই ওর বিয়ে দিয়ে দিবে? ইন্টার টাও পাশ করতে দিবেনা। রুমির প্রতি এতো অনীহা কেন তার?
বড় আপা ও অনার্স পাশ করেছে। তার বাবা-মা দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত। তবে রুমিকে কেন পড়ানো হচ্ছে না? কি সমস্যা ওর বেলা? আচ্ছা এমন নয়তো রুমি এ ঘরের সন্তান নয়? ওকে ওরা কুড়িয়ে এনেছে?

চলবে,,,