সে আমার শরৎফুল পর্ব-১২+১৩

0
130

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব১২

#আরশিয়া_জান্নাত

হ্যালো মিস তৃণা?

জ্বি। কে বলছেন?

আমি মৃদুল। ঢাকা থেকে বলছি, চিনেছেন?

ওহ আপনি! জ্বি বলুন

কেমন আছেন?

ভালো,আপনি?

ভালোই তবে বিশেষ ভালো না।

কেন?

এমনিই কাজের প্রেশার আর শরীরটাও বিশেষ ভালো না।

ডাক্তার সাহেবকে রোগের বিষয়ে পরামর্শ আর কি দিবো! ঠিকঠাক মেডিসিন নিন সময়মতো।

হাহাহা,, এমনি হয় আসলে। মানুষ ভাবে সে তো ডাক্তার যত্নাদির দরকার নেই। সে নিজেই নিজের প্রয়োজন মতো মেডিসিন নিতে পারবে।

সেটা বলিনি।

মজা করছি। তা আপনার মুহিব সাহেবের কি খবর?

স্যরি?

মুহিব সাহেব মানে যার জন্য কনফিউশনে ছিলেন,, কৃষ্ণপক্ষের নায়ক তো তিনি তাই না!

হাহাহা আপনি খুব মজার মানুষ তো।

মজার মানুষ হয়েও লাভ কি হলো বলুন? আচ্ছা মিস তৃণা কেউ কি আপনাকে বলেছে আপনার হাসি অনেক সুন্দর! আমি অভিভূত হচ্ছি ফোনে হাসির শব্দ শুনে। সরাসরি দেখতে না জানি কতটা সুন্দর হবে!

তৃণা চুপ হয়ে গেল। প্রশংসায় আনন্দিত হবার বদলে মুখটা থমথমে হয়ে গেল মুহূর্তেই।
মৃদুল কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল, মিস তৃণা আমি আপনাকে পছন্দ করি এটা অজানা ব্যপার না। আমি আপনার অপেক্ষা করছি। সেদিন কৃষ্ণপক্ষ’ বইটার তুলনা যখন দিলেন আমি খুব আশাহত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে আপনাকে পাওয়ার আর কোনো আশা নেই। আপনি জানেন না আমি ১সপ্তাহ ঠিকঠাক চেম্বারে বসতে পারিনি। শান্তিমতো ঘুমাতে পারিনি। হঠাৎ মনে পড়লো অরুর শেষ পর্যন্ত ডক্টর আবরারের সাথেই বিয়ে হয়। তাই আমি এখুনি হাল ছাড়া উচিত না। তারপর থেকে মনমাইন্ড বেশ ফুরফুরে,,,

তৃণা খানিকটা শক্ত গলায় বলল, আপনি পাঠক হিসেবে মুহিবের মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই! তবে বাস্তব জীবনে কারো তেমনি পরিণতি কল্পনা করলেন কিভাবে? আপনাকে আমি অন্তত নিষ্ঠুর ভাবি নি!

মিস তৃণা আমি নিষ্ঠুর নই। তবে আপনাকে পাওয়ার জন্য আমি হয়তো সেই খেতাব ও পেয়ে যাবো!

আমার মনে হয় আপনার এই বিষয়ে আর আগানো উচিত না। আপনি অযথাই অপেক্ষা করছেন। গল্পের অরু হয়তো শেষে ডক্টর সাহেবের সাথেই বাকি জীবন কাটায়। তৃণা সেটা করবে না। কখনোই করবেনা।

আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন তৃণা! এতো ভালোবাসেন তাকে? অথচ মুখে বললেন কনফিউজড?

তৃণার শরীর কাপতে লাগলো রাগে। গলায়ও সেটা প্রকাশ পাচ্ছে বেশ। তৃণা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো তবে ফলাফল শূন্য। সে ক্ষিপ্ত গলায় বললো, অনুগ্রহ করে আপনি আমাকে আর কখনো কল করবেন না।

ফোন কেটেই সে ফোনটা সাইলেন্ট করে ওয়াশরুমে গেল। মাথার উপর দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে,,
মৃদুল সামনে থাকা তৃণার ফটো অ্যালবাম নিয়ে বলল, মিস তৃণা আমি যদি আপনার রাগকে উপেক্ষা করে একটু স্বার্থপর হই আপনি কি বেশি কষ্ট পাবেন? ঘৃণা করবেন আমাকে? মানুষ একসঙ্গে থাকতে থাকতে মায়ামমতা জন্মেই যায়। ভালোবাসা হতে কতক্ষণ? কথা দিচ্ছি অনেক ভালোবাসবো আপনাকে। এতোটাই ভালোবাসবো অন্য কারো কথা মনে করার ফুরসত পাবেন না,,,

বেশকিছুক্ষণ করিডরে পায়চারি করেও মাথা ঠান্ডা হলোনা তৃণার। লোকটা কেমন! ইরহামের মৃত্যু কামনা করছে কিভাবে? ইরহামের শতবছর আয়ু হোক। প্রয়োজনে আমার আয়ুটাও আল্লাহ তাকে দিক। এসব শকুনের দোআয় গরু মরে না। আহ সেদিন তার মা কি গদগদ হয়ে বলছিল উনার ছেলে মানুষকে অনেক ভালোবাসে। দয়ার সাগর। এই তার নমুনা! ডাক্তাররা আসলে নির্দয় হয়। নির্দয় না হলে কি আর ওমন ইনজেকশন মেরে শরীর কেটেকুটে অপারেশন করতে পারে?
কালো আকাশটার দিকে চেয়ে তৃণার রাগ মন খারাপে রুপান্তর হলো। ইরহামের মনের খবর সে জানে না। লোকটা কখনো তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় না। এই যে সেদিন এতো সুন্দর করে শাড়ি পড়ে সেজেছিল। ইরহাম একবারো বলেনি আপনাকে সুন্দর লাগছে। না কখনো ভুলেও একবারের বেশি ২বার তাকিয়েছে তার দিকে। তাদের টুকটাক আলাপে ইরহামের যত্ন অনুভব করা গেলেও তার মনে তৃণার অবস্থান কিরূপ তা বোঝার মতো কিছুই ঘটেনি। মাঝেমধ্যে মনে হয় ইরহাম তাকে খুব সাধারণ কেউই মনে করে। হয়তো একই শহরের মানুষ বলে একটু খোঁজখবর নেয়, টাচে থাকে। তৃণার ভীষণ মন খারাপ হয়, চোখের কোণটাও ভরে আসে। মৃদুল তাকে এই পর্যন্ত অনেকবার বলেছে সে দেখতে খুব সুন্দর, শুধু মৃদুল কেন জাবেদ, রেদেয়ানসহ ক্যাম্পাসের অনেক ছেলেই বলে। ওদের কথায় তৃণা পাত্তা দেয় না।তৃণার কাছে মনে হয় ওরা সব মিথ্যে বলে। ও যদি সত্যিই সুন্দর হতো ইরহাম কি বলতো না? কই সে তো বলেনি কখনো। তার মানে সব মিথ্যে,,,
তৃণা গুনগুন করে গেয়ে উঠে,

“তুমি তাদের তাদের নাম দিলে না
মনের ভুলে কেউ দিলো না
তোমার দেওয়া আমার কোনো
নাম ছিল না নাম ছিল না,,,,”

দোস্ত তোরা এবনরম্যাল কিছু টের পাচ্ছিস?

কোন বিষয়ে?

রূপা বিষয়ে?

কেন কি হয়েছে রূপার?

ঊর্মি বিজ্ঞের মতো ভাব নিয়ে বললো, তোরা খেয়াল করছিস না রূপা আজকাল হুটহাট গায়েব হয়ে যায়। যখন ফিরে কেমন লাজুক লাজুক ভাব থাকে চোখেমুখে। ব্যাপারখানা তো মোটেও ভালো ঠেকছেনা।

তানজিনা শিঙারায় কামড় বসিয়ে বললো, ও রোজ ব্লাশন দিয়ে আসে, তাই গাল ওমন লাল দেখায় এ আর নতুন কি!

ধুরর লালের কথা বাদ দে। আমার গোয়েন্দা মন বলছে সেতি কারো লগে প্রেম করতেছে। মাগার আমাগোরে বলতাছে না। সারা দুনিয়ারসবার প্রেমের খবর সেতি সারা ক্যাম্পাসে প্রচার করে। তার বেলা এই লুকোচুরি মেনে নিবো ভাবছিস! একবার হাতেনাতে ধরা পাই ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াতে ছেড়ে দিবো দেখিস!

তৃণা কাটা চামচে নুডুলস পেঁচাতে পেঁচাতে বলল, তোদের সারাক্ষণ মানুষের প্রেম পিরিতি বাদে কিছু চোখে পড়ে না? যে পরিমাণ ব্রেন আর সময় তোরা এসবে নষ্ট করোস ঐটার ১০% ও যদি কোনো এক্সপেরিমেন্টে করতি এতোদিনে কত কি ঘটে যেত!

শোন ভাই আমরা মেয়েরা আর কিছু পারি না পারি গসিপে আমাদের জুড়ি নাই। চেহারা দেইখাই মানুষের মনের ভেতরটা যদি স্ক্যান করতে না পারি কিসের নারী জাত? এই বিষয়ে দক্ষতা যার যত বেশি সে ততোই বিজ্ঞ বুঝলি।

হয় বলছে তোরে! অনুমান নির্ভর কিছু ভাবনা অন্যের মধ্যে ছড়ানোকে গুজব বলে। যার সঠিক কোনো ভিত্তি নেই। তোর কাছে যে বিজ্ঞ আমার চোখে সে গুজব রটনাকারী। এই টাইপের মানুষরা সমাজের অশান্তির মূল। শুধুমাত্র অনুমাননির্ভর কানকথা শুনে কত সংসারে যে আগুন লাগে আইডিয়া আছে তোর?

তুই ওর পক্ষ নিচ্ছিস? যেখানে ও তোর নামে কত কি ছড়ায়?

দেখ ঊর্মি ওর উপর আমার রাগ নেই তা নয়। ও মাঝেমধ্যে এমন কাজ করে আমার আসলেই রাগ হয়। ইচ্ছে করে ওরে মা*র্ডা*র করে জে*লে চলে যাই। তবে তার মানে এই না আমিও ওর পথের পথিক হবো।

তানজিনা বলল, তবে ঊর্মির কথাটা ফেলনা না রে। রূপার সত্যিই কারো সঙ্গে চক্কর চলছে।ঐ দেখ,,,

সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো অনেক দূরে রূপা আর একটা ছেলে একসঙ্গে হাঁটছে। ক্যাম্পাসে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও রূপার বেলা মোটেও স্বাভাবিক না। ও ছেলেদের সাথে কথা বললেও একা একসঙ্গে আর যাই হোক ক্যাম্পাসে হাঁটবেনা। ও নিজে যেমন অন্যের নামে গসিপ করে, নিজেকেও গসিপের মূল বানাতে চাইবেনা আর যাই হোক! তবে প্রেমে পড়লে বোধহয় সব নিয়মনীতিই বদলে যায়। কোনোকিছুই আর জোর পায় না প্রেমিকপুরুষের আহ্বানের সামনে। তৃণা, ঊর্মি, তানজিনা চোখ গোল গোল করে চেয়ে রইলো তাদের দিকে। রূপা সত্যি সত্যিই প্রেম করছে!! অবাক কান্ড,,,

রূপাকে মাঝখানে রেখে ওর চারদিকে গোল হয়ে ৩জোড়া চোখ নিবদ্ধ। রূপা মেকি হেসে বলল, কি হয়েছে তোরা এমন ঝেঁকে ধরলি কেন?

ঊর্মি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, তোর পাশের ছেলেটা কে ছিল? খবরদার মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না!

রূপা আমতা আমতা করে বললো, আরেহ তোরা যা ভাবছিস তা না,

তানজিনা ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড। মাঝেসাঝে কথাবার্তা বলি,, এছাড়া আর কিছুই নয়। ঐ যে বকুলতলায় হাত ধরে বসে ছিলাম ওটাও কিছু নয়। উনি হাত গণনা করতে পারেন বলে আমার হাতটা দেখছিল। আমার চুলে ময়লা পড়েছিল বলে চুলগুলো সরিয়ে কানে গুজে দিছে। ট্রাস্ট মি গাইজ আমাদের মধ্যে কিছুই নেই

রূপা এবার জমে গেল। তার বুঝতে বাকি রইলো না এই তিন গোয়েন্দা সবটাই জেনে গেছে। সে ঢোক গিলে বললো, আসলে ও মুহতাসিম। গণিত বিভাগের। আমাদের ২ ব্যাচ সিনিয়র। অনেকদিন ধরেই পেছনে ঘুরছিল, গেল বসন্তজয়ন্তিতে প্রপোজ করলো, আমিও আর না বলিনি। কতবার আর না বলি? বেচারা কম চেষ্টা তো করেনি। ভাবলাম হ্যাঁ বলেই দেই। বাপ মার আশায় থাকলে মনমতো বর তো জুটবেনা।
নিজে খুঁজে রাখাই শ্রেয়।

এতোদিন ধরে এসব চলছে আমরা টেরই পেলাম না! তুই তো দারুণ ছুপা রুস্তম! বাপরে বাপ মানুষ গোটা গরু খেয়ে হজম করে ফেলে এটা তোকে দেখে বিশ্বাস করলাম।।

ধুর ভাই খেয়ে আর হজম করলাম কই, সবে চুলোয় দিতেই তো তোদের নাকে ঘ্রাণ চলে গেছে।

ঊর্মি আর তানজিনা হোহো করে হেসে উঠলো। তৃণা খানিকটা ভাবুক কন্ঠে বলল, রূপা প্রেম ব্যাপারটা কি এমন হয়? পিছন পিছন ঘুরেছে আর তুইও প্রেমে পড়ে গেলি! এখানে তোর অনুভূতি জন্মালো কিভাবে? নাকি তারটা দেখেই সহানুভূতি থেকে হ্যাঁ বলে দিলি!

একটা কথা কি জানিস আমাদের কে অনেকেই পছন্দ করবে, প্রপোজাল দিবে। বাট সবার বেলা মন আসবেনা। দু এক জন এমন থাকেই যাদের এই পেছনে ঘোরাটায় আমরা বিরক্ত হবার বদলে আনন্দ অনুভব করি। ভালো লাগা কাজ করে। মুহতাসিমের বেলা আমার তেমনি ঘটেছে। অন্যদের টা জানি না।

ওহ আচ্ছা।

ঊর্মি বললো, যা হবার হয়েছে এখন আমরা ট্রিট চাই। বল কবে খাওয়াবি।

কাল বিকালে মামার দোকান থেকে ফুচকা হলে চলবে না?

চলবে মানে দৌড়াবে, তবে আমি কিন্তু ৩প্লেট খাবো।

ঊর্মির কথায় সবাই হাসতে লাগলো…

চলবে,,,

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব১৩

#আরশিয়া_জান্নাত

অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশের বাদামি কুকুরটাকে রোজ ২টা কেক খাওয়ানো ওয়াসির সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এই বোবা প্রাণিটার সাথে খানিকটা গল্প করেই পার করে সে। বাসায় ফিরে ব্যাচেলর জীবন বড্ড বিতৃষ্ণা লাগে তার। ৪রুমের ফ্লাটটায় তারা ৮ জন থাকে। রান্না নিয়ে বিশেষ অসুবিধা হয়না, তবে সুবিধাও হয়না। ঢাকা শহরে কোনো বুয়া যত্ন করে ব্যাচেলরদের জন্য রান্না করবে এমন আশা করা বোকামিই বটে। ঘরটা কোনোরকম ঝাড়পোছ করে রেঁধে দিয়ে যাচ্ছে এই তো ঢের। যত্নে করুক বা অযত্নে! ওয়াসির খাওয়া নিয়ে যত নাক সব মায়ের বেলাই। অন্যদের ও কিছু বলেনা। ভালো হলেও সই মন্দ হলেও সই।

“জানতাম তুমি এখানেই থাকবে”

কথাটা বলেই ওয়াসির পাশে বসে রিপা। ওয়াসি ওর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললো, আজ দেরীতে ছুটি হলো মনে হচ্ছে!

হুম, গ্রুপ এসাইনমেন্টে ডিসকাশন শেষ হয়না। নানাজনের নানা মত!

রাইট।

চলো কোথাও বসি, ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

চলো।

ওয়াসির সঙ্গে রিপার সাক্ষাৎ অনেকটা নাটকীয় বলা চলে। অফিস শেষে ওয়াসি ৫সিটের লোক্যাল সিএনজিতে উঠে বাসায় যাচ্ছিল। একটা স্টপে রিপা বলে, ভাইয়া আপনি একটু পেছনের সিটে যাবেন আমি এখানে বসবো?

ঐ লোকটা রিপার কথায় রাজী না হয়ে বলে, আপনি পেছনে বসেন। আমি উঠতে পারবো না।

পেছনের সিটগুলো তুলনামূলক ছোট ও ৩জনই পুরুষ হওয়ায় রিপার এই রিকোয়েস্ট ছিল। কিন্তু লোকটাও নাছোড়বান্দা সে তার কথা থোরাই পাত্তা দিলো। ব্যাপারটা দেখে ওয়াসির ভীষণ রাগ হয় অপর পেসেঞ্জারটার প্রতি। সে উঠে গিয়ে বলে আপনি এখানে বসুন আমি পেছনে যাচ্ছি।
বলেই সে ফোন ইউজ করতে করতে পেছনে গিয়ে বসে। ঘটনাটা ওয়াসির কাছে খুব সাধারণ হলেও রিপার কাছে এটা মোটেও সাধারণ লাগেনি। সে একটু পরপর লুকিং গ্লাসে মানুষটাকে মনোযোগ দিয়েই নিরীক্ষণ করছিল। স্টপেজে সবাই নেমে পড়লে ভাড়া মিটিয়ে ওয়াসি আরেকটা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল তখনি রিপা দৌড়ে এসে বলে, ভাইয়া থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আমি আসলে আপনাকে উঠতে বলিনি। তবুও আপনি কষ্ট করে উঠে পেছনে গেছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আরেহ ব্যাপার না। ধন্যবাদ বলতে হবেনা। ইটস ওকে।

নাহ ভাইয়া ধন্যবাদ তো আপনি ডিজার্ভ করেন ই। আচ্ছা ভাইয়া একটা কথা বলি? ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ!

জ্বি বলুন?

আমি তো পুরাই ক্র্যাশড আপনার উপর! আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?

ওয়াসি ভীষণ চমকে তাকায় সামনের তরুণীর দিকে। মেয়েটার সাহসের জবাব নেই! হুট করে অচেনা একটা লোককে এমন সরাসরি মনের কথা বলে দিলো! ক্র্যাশ তো অনেকেই খায় তবে সরাসরি বলে কেউ? ওয়াসি অস্বস্তিতে হাসি দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। পেছনে ফেলে যায় একজোড়া মুগ্ধ নয়ন।

রিপা বেশ আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,তৃণার বিয়ের ব্যাপারে কতদূর এগোলো?

আপাতত স্থগিত আছে।

কেন? তুমি না বললে সব ঠিকঠাক প্রায়?

ওর মত নেই এখানে। তাই আর কি!

ওহ। ওর কি পছন্দের কেউ আছে? জিজ্ঞাসা করেছিলে

করেছিলাম। খোলাসা করে কিছু বলেনি। তবে এখনি বিয়ে করতে ইচ্ছুক ধা এমনটাই বললো।

বুঝলাম। তা তুমি বিয়ে করবে কবে?

ছোটবোনের আগে আমি কিভাবে সম্ভব?

তোমার ছোটবোন তো বিয়ে করবে বলে মনে হচ্ছেনা! আমার বাসা থেকে বিয়ে জন্য কত চাপ যাচ্ছে জানো? মাস শেষে ক’টা টাকা দেই বলে এখনো চুপচাপ আছে।

আমাদের পরিবারের রেওয়াজ আছে, বোনদের বিয়ে দিয়েই ভাইয়েরা বিয়ে করে। এখন যত লেট হোক।

এসব রেওয়াজ প্রেম করবার আগে মাথায় আসেনি? তোমার বোন তো কচি খুকি না। ২৩+ আর কত বছর বসিয়ে রাখবে ওকে? এখনিতো পারফেক্ট বয়স বিয়ে দেবার। ভালো পাত্র পেয়েও কোন লজিকে বাতিল করলে আমি বুঝিনা। মানুষ আসলে যা পায় তার কদর করেনা। তোমার বোন ও আদরে আদরে বাদর বনে গেছে,,,

তুমি কার সম্পর্কে কথা বলছো মাথায় আছে? ও আমার একমাত্র বোন। ও আমার টাকায় বা তোমার টাকায় চলছে না। এখানে তোমার কথা বলার রাইট নেই। বাবা তার মেয়েকে যখন ইচ্ছে বিয়ে দিবে। তুমি বলার কে?

আমি বলার কেউ না?

অবশ্যই না।

বেশ তো। কিছু বলবোনা। আইবুড়ি করে ফেলে রাখো বোনকে। নিজেও বুড়ো হও। আমাকে আর বিয়ে করতে হবেনা তোমার। আমার বাবা তো তোমাদের মতো না, মেয়েকে ঘাড়ে বসিয়ে রাখবে বছরের পর বছর। বিয়ে দিয়ে দায়সাড়া হবে যত শীঘ্রই সম্ভব। আমি তো কেউ না বলার। আর কিচ্ছু বলবো না। বায়,,

রিপা উঠে চলে গেল। ওয়াসিও আর তাকে থামালো না। একটা এডুকেটেড মেয়ে হয়েও এমন চিপ মেন্টালিটি রাখা মেয়ে হয় কিভাবে? ওর বোঝা উচিত ছিল ওয়াসি তার বোনকে কত ভালোবাসে। ওয়াসির মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। যা মন চায় করুক ওয়াসি উঠে যাবে না।

তৃণা জামালখান মোড়ে ড. খাস্তগীর গার্লস স্কুলের সামনের বেঞ্চিতে বসে আছে। গতকাল রাতে ইরহাম টেক্সট করেছিল এখানে আসতে। সেও ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে এসেছে। কারণ অব্দি জিজ্ঞাসা করেনি। এখন তার নিজের চুল নিজেই ছিড়তে মন চাইছে। আজকাল মনে হয় ইরহামের আহ্বান মোহাচ্ছন্ন করা বাঁশির সুরের মতো। একটু ফু দিয়ে বেজে উঠলেই বাকিটা শোনার দরকার হয়না, ওতেই দিশ হারিয়ে তার কাছে ছুটতে মন চায়। এই যে সে সময়ের আগেই এসে বসে আছে, না পারছে একা অপেক্ষা করতে না পারছে কল করে বলতে ইরহাম কোথায়। এর পেছনেও তার বোকমিই দায়ী। তৃণা ফোনের দিকে চেয়ে সময় দেখলো। নাহ এখনো ২০ মিনিট বাকি। এর মাঝে ২কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে। সময় আজ এতো ধীরগতিতে যাচ্ছে কেন!

হেই তৃণা!

আস্সালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছেন?

ভালো। আপনি?

আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো। বলেই ঘড়িতে তাকিয়ে বলল, আপনি দেখি বেশ ফাস্ট। আমার আগে পৌঁছে গেছেন!

নাহ আমি সবেই এসেছি।

আচ্ছা আসুন আমার সঙ্গে।

কোথায়? আর কেন আসতে বললেন তাই তো জানা হলোনা।

ভয় পাবেন না, আপনাকে কিডন্যাপ করবো না।

কিডন্যাপ করার প্রয়োজন দেখছি না। ফোনটা বাদে বিশেষ কিছু নেই,,,

ভেবে বলছেন?

ভাবনার কি আছে? অর্থের বিচারে এইটুকুই।

ভুল হিসাব। মানুষের শরীরের যে অর্গান আছে তা দিয়েই যে কেউ অনায়েসে ২০/৩০লাখের মালিক হয়ে যাবে

বাহ! ধারণা তো ভালোই। তা কতদিন আছেন এই পেশায়?

হাহাহা,,,, এই মনে হলো আপনার?

অবিশ্বাসের কিছু নেই। কারো মনের আসল খবর কি জানা যায়?
ইরহাম থমকে বললো, তাহলে থেমে যান। আগাচ্ছেন
কেন?

তৃণা ইরহামের চেহারা দেখে চমকে গেল। সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আপনি কি রাগ করলেন? আমি মজা করছিলাম।

ইরহাম তৃণার চোখে চোখ রেখে বলল, ভরসা হয় না আমাকে? আমি কি এতোদিনে এইটুকু বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি তৃণা?

বিশ্বাস না করলে কি একা আসতাম?

পাল্টা প্রশ্ন না।সোজা জবাব দিন। হ্যাঁ অথবা না।

তৃণা অকপট বলে দিল, অবশ্যই বিশ্বাস করি।

ইরহামের ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তারা প্যারেড মাঠের সামনে এসে গেছে খেয়াল নেই। তৃণা চারদিকে তাকিয়ে বললো, আপনি কি আমাকে ওয়েট লুজ করানোর ট্রেনিং দিচ্ছেন? এতোদূর অব্দি হাঁটালেন!

হাঁটার অভ্যাস নেই?

আছে তবে বেশি না

করে নিন,, এই শহরের রিকশায় চড়ার চেয়ে হাঁটার মজা বেশি।

ঘাসের উপর বসে তৃণা ক্লান্ত গলায় বললো, আমার অতো জোর নেই। এতো হাঁটলে ২দিনেঈ দম ফুরিয়ে ঠুস,,,

হাহাহা,,এমন হলে তো চলবেনা তৃণা। আমি তো হাঁটতে ভালোবাসি। এই শহরের অলিগলি চষে বেড়াই রোজ।

কেন চলবে না?

ইরহাম থমকালো যেন। নিজেকে সামলে বলল, হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি।

কেন ডাকলেন এখনো বলেননি কিন্তু!

ওহ হ্যাঁ, আমি একটা কোচিং সেন্টারে শেয়ার নিয়েছি। জানেন তো। ওখানে আপনি ক্লাস নিতে পারবেন? বেশি না সপ্তাহে ২/৩দিন সময় দিলেই হবে, সম্মানি নিয়ে ভাববেন না,,,

তৃণা আশাহত গলায় বলল, ওহ আচ্ছা এইজন্য ডেকেছেন। আচ্ছা দিলাম সময়।

আপনার তো বৃহস্পতিবার ক্লাস থাকেনা।তাহলে বৃহস্পতি, শুক্র, শনি?

শুক্রবারে সম্ভব না, আমি ২দিন সময় দেই? আসলে শুক্রবারে আমার পার্সোনাল অনেক কাজ থাকে।

আচ্ছা সমস্যা নেই।

তৃণা মনে মনে বললো, আপনি আসলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে যন্ত্র বনে গেছেন। আবেগ বলতে কিচ্ছু নেই। আমার তো সন্দেহ চোখও নেই। নয়তো একবার হলেও তাকিয়ে দেখতেন আমি কি সুন্দর করে চোখে কাজল টেনেছি। নীল রঙের এই জামাটা পড়লে সবাই বলে আমাকে অনেক সুন্দর লাগে। অথচ আপনি একটাবার দেখলেন না বলা তো বহুদূর,,,,

রুমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রুমানা বেগম থমথমে গলায় বললেন, এই চিঠিটা কে দিয়েছে?

বিশ্বাস করো মা আমি জানি না। বই বের করতে গিয়ে পেয়েছি। পড়বার আগেই তুমি নিলে। আমি সত্যিই জানিনা।

আমাকে তোর বোকা মনে হয় রুমি? তোর ব্যাগে কেউ চিঠি রেখে দিবে আর তুই তা টেরও পাবি না? টিফিন তো বাসা থেকে দিয়ে দেই, তারপরো ব্যাগ রেখে কোথায় যাস তুই?

ওয়াশরুমে,,

খবরদার বলছি বানিয়ে বলবিনা। কে এই ছেলে নামঠিকানা বল

আম্মু সত্যি বলছি আমি জানিনা। আল্লাহর কসম আমি জানি না।

কথায় কথায় কসম কাটে চোরেরা,মিথ্যাবাদিরা। তুই কি চোর-মিথ্যাবাদী?

নাহ

তবে কসম কাটা শিখলি কোত্থেকে?

ভুল হয়ে গেছে আম্মু। মাফ করে দাও

রুমানা বেগম শান্তস্বরে বললেন, বেশ। তবে মনে রাখিস আমি যদি এমন কিছু জানতে পারি যা আমি আশা করিনি, অথবা তোর জন্য আমাদের সম্মানহানী হয়। তবে তোকে কে*টে তিতাসে ভাসিয়ে দিতে আমি ২বার ভাববো না। মাথায় রাখিস!

রুমানা চলে যেতেই রুমি বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো‌। তার মা তাকে একটুও বিশ্বাস করে না! কিভাবে ভাবলো রুমি এমন কিছু করবে যাতে তার পরিবারের মাথা নত হয়? মা তার বেলা এতো অবিশ্বাস করে কেন? কি পাপ করেছে সে যে এমন শাস্তি পেতে হচ্ছে? মা সত্যিই তাকে পছন্দ করেনা। হয়তো সে তার আসল সন্তান না। তাই সবসময় কঠিন কথা বলে, অবিশ্বাস করে।

চলবে,,