স্মৃতির দেয়াল পর্ব-০২

0
2587

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_২
Writer -Afnan Lara
.
মুনের মা সুপারি কাটছেন চৌকির উপর বসে বসে,,মুনের দাদি পান খাবেন এখন,দিনে দুবেলা খান,তিনবেলাও খাওয়ার ইচ্ছা আছে তার তবে মুনের কড়া শাসনে তিনি দুবেলা টেনেটুনে খান এই আর কি
মুনের মা চোখ তুলে সামনে তাকালেন একবার,,মুনের বাবা টিভিতে খবর দেখছেন ওখানে
হালকা কেশে মুনের মা এবার গলা ছাড়লেন।
.
শুনো মুনের বিয়ের বয়স হয়েছে,,এবার তো বিয়েটা দিয়ে দাও

মুনের বাবা কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে পড়লেন,কারণ মুনের মা প্রতিদিন ২৪-২৫বারের মতন বলে মুনের বিয়ের কথা
তাই তিনি এখন বিরক্ত নিয়েই বললেন”এমন করো কেন?ও যখন বলেছে বিএ পাস করে এসব ভাববে তখন আমাদের উচিত ওকে সময় দেওয়া”

এত সময় দিলে মেয়ে বিঘড়ে যাবে,,এমনিতেও অনেক বিঘড়ে গেছে,গাছে গাছে থাকে,কেউ এসব শুনলে জীবনেও বিয়ের প্রস্তাব আনবে না

ঠিক বলছে রাইমা,,তুই মুনের বিয়ে নিয়ে এবার ভাব,এটায় আসল বয়স বিয়ে করার,পোলা ভালা হলে এমনিতেই বিয়ের পর পড়াবে

ঠিক আছে মা,দেখতেছি আমি

নীল এখন তার অফিসে,,নিজের অফিস রুমে বসে হিয়ার ছবিটা ফ্রেমে বেঁধে ঠিক জায়গায় বসিয়ে গালে হাত দিয়ে চেয়ে আছে ছবিটার দিকে
মুখে কোনো কথা নেই,শুধু বাম হাতে থাকা লাল কলমটা ঘুরাচ্ছে ক্রমাগত
.
স্যার আমি একটা কমপ্লেইন করতে চাই!

নীল মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো,একটা আধ বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে,পরনে সাদা পাঞ্জাবি মাথায় সাদা টুপি,বেশ ভদ্র আবার গলায় স্বর্নের চেইন চিকচিক করছে,বড়লোক বটে!
নীল ব্রু কুঁচকালো,কারণ তার কেবিনে নক না করেই লোকটা ঢুকে পড়েছে,হয়ত বিপদে পড়ে এসেছে এই ভেবে সে ব্রুটা আবার নরমাল করে বললো”বসুন”
.
আগে আমার কথা শুনুন স্যার!!আমার একটা বাগান আছে,,ইয়া বড়,সব ফল,কোনো ফুল নাই
তো সেটার প্রায়ই সব গাছেই অনেক আম পেয়ারা ধরে,,এমন কোনো গাছ নাই যেটাতে ফলন কম হয়
তো একটা চোর ইদানিং ১০/২০টা করে আম,পেয়ারা নিয়ে চলে যাচ্ছে,অনেক জাল বসিয়েও তাকে ধরা সম্ভব হলো না
প্রতিদিন এমন হলে তো আমার ব্যবসা জলে যাবে
এখন আপনি কিছু করুন!

চোর?
.
নীল এগুলো নিজে হ্যান্ডেল করে না,তবে আজ সকাল থেকে একদম ফ্রি সে,তার পরেও গলাটা ভার করে আসিফকে ডাকলো সে
আসিফ হলো নীলের কলিগ,,দুজনের বন্ধুত্ব ৯বছরের,,
নীল ওকে আবারও ডেকে বললো” আসিফ এটা তুমি হ্যান্ডেল করো,চুরি কেস”

নীল আমার ঘাড়ে অলরেডি একটা রেপ কেসের ঝামেলা পড়ছে,সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি,তুমি চোরের এটা সামলাও,সকাল থেকে তো বসে বসে তো শুধু প্রিয়তমাকেই দেখলে

ফাইন,,!
আচ্ছা কখন চুরি হয় সেটা বলতে পারবেন?আর গেট থাকে না আপনার বাগানে?দারোয়ান নেই?
এত ফলন হওয়া বাগান,আপনার তো সিকিউরিটি হাই করা উচিত

স্যার গেটে তো তালা দিয়ে রাখি,,দারোয়ান রাখি না,বারতি খরচ,বাসা কাছেই আমার
আর চুরি হয় দুপুরবেলা,,

হোয়াট,দুপুর বেলা?? মানে দিনে দুপুরে চুরি?

জি স্যার

ওকে আজকে দুপুরে আমি ব্যাপারটা গিয়ে দেখবো,,আপনি যান এখন

নীল ১২টার দিকে বাসায় ফিরে পুলিশের জামাটা খুলে নরমাল একটা টিশার্ট পরে হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে গেলো,,
লোকটার দেওয়া ঠিকানার বাগানটা ওর বাসা থেকে একদম কাছেই,এ.কে রোডেই,,হেঁটে যাওয়া যায়
নীল বাগানটার কাছাকাছি এসে বাগানটা এপাশ ওপাশ একবার দেখে নিলো,এরপর দূরের একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বাগানটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে
দুপুরের কড়া রোদ চারিদিকে,খাঁ খাঁ করছে,সময়টা বৈশাখের শুরুতে,কদিন পর শুরু হবে কালবৈশাখী
লোকালয় কমে আসছে রোডে,চোরটা আজ আসবে কিনা তাও তো জানি না

চল,,আজ ব্যাগে করে নিয়ে যাব যা যা পাব,তারপর আচার বানাব,তোরা কিন্তু কাঁচা ভাগ পাবি না,আচার বানালে সবাই এক বোতল করে নিয়ে যাস কেমন??
মিনি সাইজের বোতল গুলো কিন্তু!
.
ওকে মুন আপু
.
মুন কতগুলো বাচ্চা সহ বাউন্ডারির দিকে চললো হেসে হেসে,ঐ চোরটা হলো সে

নীল ওদের দেখতে পেয়ে বললো”হুমম বুঝলাম,,মেয়ে হয়ে চুরি???দেখাচ্ছি মজা”

নীল সানগ্লাসটা ঠিক করে এগিয়ে গেলো সেদিকে
মুন বাউন্ডারিতে উঠতে যেতেই নীল মুনের কোমড়ে ধরে এক টানে দুম করে নিচে ফেললো ওকে

উহহহ মাগো,!আমার কোমড় শেষ,কে রে?কোন পাজি আমার বাড়া ভাতে ছাই দিলো??

কি বললে?দিনে দুপুরে চুরি করো,তাও একটা মেয়ে হয়ে,লজ্জা করে না তোমার?আবার বাড়া ভাত??
আজ তোমার কপালে ভাত জুটবে কিনা সেটা ভাবো আগে

কেন লজ্জা করবে??আমার চাচার বাগান এটা,আমার হক আছে এটাতে,এটার ইট বালুতেও আছে

উনি তোমার চাচা হলে পুলিশের কাছে গিয়ে মামলা কেন করলো??মিথ্যা কথার জায়গা পাও না?এক চড় মেরে দাঁত সব ফেলে দিব,তখন সত্যি কথাও বলতে পারবা না

মুন নীলের জুলন্ত ঘড়ি আলা হাতটা ধরে মাটিতে থেকে উঠে দাঁড়ালো

একটা মেয়েকে ফেলে দিয়ে আবার না উঠিয়ে বড়বড় কথা বলতেছেন আপনি,আর by the way,আমি আপনাকে কেন জবাব দিব,আপনি কি পুলিশ নাকি পুলিশের নানা??কোনটা??

শুধু মেয়ে হলে এক কথা ছিল,আর তুমি তো একটা মেয়ে চোর
চলো আমার সাথে
.
নীল মুনের হাত ধরে টানতে টানতে পুলিশ স্টেশনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে

ছোট ছোট যে বাচ্চাগুলো মুনের সাথে ছিল তারা দৌড়ে গিয়ে মুনের মাকে জানালো ব্যাপারটা

বাঁচাও আমাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে

মুনের এমন চিৎকার চেঁচামেচিতে কয়েকটা লোক এসে নীলের সামনে দাঁড়ালো

নীল বিরক্ত হয়ে মুনের দিকে তাকালো,তারপর নিজের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে উনাদের মুখের সামনে ধরলো,রাগে কটমট করছে সে,কাজে কেউ বাধা দিলে রাগ প্রচণ্ড বেড়ে যায় তার

আসসালামু আলাইকুম স্যার

মা বাবা আমাকে বাঁচাও,!!!
আর আপনারা আমাকে হেল্প না করে সালাম দিচ্ছেন কেন??আজব তো,একটা মেয়েকে বাঁচান না আপনারা,আপনাদের নামে কেস করবো আমি

নীল মুনকে এনে পুলিশ স্টেশনে ওর অফিসের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে চেয়ার নিজের দিকে ঘুরিয়ে আনলো
সে এখন টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে

মুন কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে

নীল চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে চেঁচিয়ে বললো”এই মেয়ে চোরের জন্য এক গ্লাস পানি আনো করিম!!”

করিম পানি এক গ্লাস এনে নীলের হাতে দিয়ে চলো গেছে
“নেন খান পানি,তা আর কি খাবেন,,আম খাবেন নাকি পেয়ারা?”

মুন রেগে বললো”আপনাকে খাব”
.
নীল ব্রু কুঁচকে ৫সেকেন্ড চেয়ে থাকলো,তারপর মুনের হাত টেনে ধরে সেটা থেকে ওড়না খুলে মুনের গায়ে ছুঁড়ে মেরে বললো”ওড়না হাতে বাঁধানোর জন্য তৈরি হয় না”
.
আসিফ এগিয়ে এসে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো,তারপর চোখ বড় বড় করে বললো”এক চড় মেরে দাও চুরির ভূত উঠে যাবে মাথা থেকে,না জানি আর কি কি চুরি করে,দেখে তো পকেটমার মনে হচ্ছে,গায়ে মাটি কাদা সব লেগে আছে,মাথার চুলে আম গাছের পাতা আটকে আছে,হাতে চুড়ি ও নাই,চুড়ির বদলে কালো কাপড় বাঁধানো,,পাক্কা পকেটমার এটা”
.
কথাটা বলে আসিফ একজন মহিলা পুলিশকে ডাকলেন মুনকে ধরে কয়েকটা কেলানি দেওয়ার জন্য, নীল ওকে মানা করলো এসব না করতে

নাহ!এমনিতেই কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দিছে,এখন মারলে দুনিয়া ভাসায় দিবে,আর চেহারা দেখে বংশ জাজ করা উচিত না,আমার তো মনে হয় ভদ্র ঘরের মেয়ে

আমার মেয়ে আর কোনদিন চুরি করবে না দয়া করে ওকে ছেড়ে দিন

নীল মাথা উঁচু করে দরজার দিকে তাকালো,,সেখানে মুনের মা অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন
নীল গিয়ে তার চেয়ারে বসতে বসতে বললো”হুম,ঠিক আছে”

মা তুমি ক্ষমা চাও কেন,আমি তো চাচার বাগানেই চুরি করেছি

চুপ কর একদম বেশি কথা বলবি না, বাসায় আয় আজ তোর ঠ্যাং ভেঙ্গে আমি তোর গলায় ঝুলিয়ে দিব

মা মুনের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো

নীল কমলা রঙের একটা বলপয়েন্ট হাতে নিয়ে ওলটপালট করতে করতে আসিফকে বললো”মানে আজও এরকম মেয়ে আছে যারা গাছে উঠে চুরি করে, এত সাহস,বাপরে”

ওসব বাদ দে,এগুলো মামুলি ব্যাপার স্যাপার,,আগে বল হিয়া আপু কই,সাথে করে এনেছিস ঢাকায়?

নীল স্তব্ধ হয়ে গেলো,হাতে থাকা বলপয়েন্টটাও রেখে দিলো,,এরপর করুন চোখে আসিফের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ
তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো”নাহহ,আনিনি”

কেন??ভাবিকে একা রাখলি কেন,সাথে করে নিয়ে আসতি

আমার বাসায় ফিরতে হবে,এখন বাই

তোরে মানা করলেও শুনস না তো,ঠিক আছে,তোর বিয়ে আমি এই মাসেই দিয়ে ছাড়ব,,সবার সামনে আমাকে অপমান করেই ছাড়লি তাহলে,,নিজের পেটের মেয়ে আর আরেক জনের পেটের মেয়ের তফাৎ!
এরা শুধু পারে সৎ মাকে কষ্ট দিতে

মা প্লিস আমি আরও পড়তে চাই

চুপ,কেমন পড়ার ইচ্ছা তোর তা দেখি আমি,সাফায় দিতে হবে না আর,একেবারে পুলিশ স্টেশন,ছিঃ ছিঃ
আমার মান সম্মান সব গেলো

আপু তোমার গায়ে কাদা লেগে আছে,যাও গোসল করে আসো

মাকে বুঝা প্লিস,মা বললো আমার বিয়ে দিয়ে ছাড়বে,,আমি আসতেছি পুকুর থেকে

ঠিক আছে দাঁড়াও দেখতেছি ব্যাপারটা

মুন পুকুর থেকে গোসল করে উঠতেই ওর মনে হলো কেউ ওকে দেখছে,পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো গাছের পিছনে কে যেন লুকিয়ে গেলো সাথে সাথে

মুন ওড়না পেছিয়ে গাছের সামনে গেলো দেখার জন্য
,গিয়ে দেখলো তুষার,,মুনের চাচাতো ভাই সে

মুন রেগে রেগে বললো”তোর লজ্জা করে না,আমি গোসল করতেছি আর তুই সেটা দেখস লুকিয়ে লুকিয়ে!!”

কেন কি সমস্যা, আমি তো তোকে ভালোবাসি,তোকেই বিয়ে করবো,দেখলে কি সমস্যা??
.
তুষার এগিয়ে এসে মুনের দুকাঁধ ধরলো হাত দিয়ে

ছাড় আমাকে,অসভ্যতামি করবি না একদম
.
মুন আর কোনো উপায় না পেয়ে তুষারকে চড় মেরে দিলো
তারপর সাত পাঁচ না ভেবে চলে এলো বাসায়

এটা তুই ঠিক করলি না মুন,এর প্রতিশোধ আমি নিব

মুন গোসল করে বাসায় আসতেই শুনতে পেলো বাবা ওর বিয়ের জন্য ছেলে দেখতেছে

বাবা তুমি তো আমাকে বুঝো,,আমি এখন বিয়ে করতে চাই না,,আমি পড়তে চাই

মা আমি মানা করছি সবাইকে কেউ আমার কথাতে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না,,জানস তো যেদিন থেকে তোর মা মারা গেছে ঠিক তার ১মাসের পর থেকে সেলিনা তোকে নিজের মেয়ের মত করে পালছে,তোর কোনো ক্ষতি সে চায় না,,তোর প্রতি ওর যত্ন দেখেই আমি ওকে বিয়ে করে এনেছি,ও শাসন একটু বেশি করে ঠিক আছে তবে তোকে খুব ভালোবাসে,হয়ত বিয়ে করলে তোর এসব দুষ্টুমি কমবে,,গাছে উঠা,ফল চুরি করা তো ভালো না মুন,বুঝার চেষ্টা করো

মুনের মায়ের কথা মনে পড়লো,ওর নিজের মা হলে হয়ত আজ ওর অমতে বিয়ের কথা ভাবতো না,
আলমারি থেকে নিজের মায়ের ছবিটা বের করে সেটা বুকে ধরে মুন খুব কাঁদলো,

পরেরদিন সকাল সকাল কলিং বেল বাজতেই রুশা গিয়ে দরজা খুললো
চাচা এসেছে

কিরে টিপু,হঠাৎ আমাদের বাসায় কি মনে করে??

আসলে ভাইয়া আমি তোমাদের সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি
.
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে চাচাকে বসতে বললেন,আর মুনকে নাস্তা আনতে পাঠালেন রান্নাঘরে
চলবে♥