স্মৃতির দেয়াল পর্ব-০৯

0
1972

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৯
Writer -Afnan Lara
.
মুন আরেকদিকে ফিরে গেছে,নীল নিজের ব্রেকফাস্ট সেরে চলে গেলো অফিসে
মুন আবারও সেদিকে চেয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে
নীলের মা রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে দেখলেন মুন এক দৃষ্টিতে নীলের চলে যাওয়া দেখছে
.
আর বলো না,আমার সবগুলো ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি তাদের জব হওয়ার সাথে সাথে কিন্তু একে কিছুতেই বিয়ে পর্যন্ত নিতে পারছি না
.
মুন নীলের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ,তার মনে একটাই কথা ঘুরছে আর সেটা হলো হিয়া যখন প্রতিরাতে আসেই তখন আর বিয়ের কি প্রয়োজন
তারপর হালকা কেশে সে বললো”জোর করে বিয়ে দিলেই তো পারেন
.
যে নিজেই পুলিশ তাকে কি করে জোর করি বলো??
.
আপনি হলেন উনার পরিবারের লোক,উনার মা,উনি আপনাকে ভয় পাবার কথা আর সেই জায়গায় আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন?
.
নীল খুব রাগী,আমার সামান্য ভুলে সে ঢাকা ছেড়ে অন্য জেলায় গিয়ে উঠতে পারে
ওর আচরণ সম্পর্কে এ টু জেট জানা আছে আমার
.
তাহলে আর কি করার!
.
হুমম,বেশি করে খাও,রুটি এভাবে নাড়ছো কেন?নিজের শরীর দেখেছো??এই জন্যই কাল অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলে তুমি,না খেয়ে না খেয়ে
.
মুন হালকা হাসলো,তার অজ্ঞান হওয়ার কারণ হলো মায়ের হাতের মার!সে আরও কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নীলের মা আফসোস করে বললেন”তোমার মতন এমন একটা মেয়ের কপালে এটা কেমন সৎ মা জুটলো,ভাবলেই খারাপ লাগে অনেক,এতদিন কি করে ছিলে সেটাই ভেবে পাচ্ছি না আমি
.
এতদিন তো বিয়ে নামক বোঝা এসে ঘাড়ে চাপে নাই তাই হয়তবা
.
ভাগ্যিস নীল ছিল নাহলে তো এতক্ষণে তোমার জীবনটা অন্য পথে থাকতো
.
মুন দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললো”হুম”

বাবা তোমার চা
.
আর চা!!তোর মাকে জেল থেকে ছাড়ানোর জামিন পেলাম না,সেই চিন্তায় কিছুই ভালো লাগছে না
.
ঐ পুলিশ লোকটা এমন কেন করছে??কি শত্রুতা তার আমার মায়ের সাথে?
.
দাদি চশমাটা মুছে চোখে দিতে দিতে বললেন”একটা নিষ্পাপ মেয়েকে এভাবে অত্যাচারিত হতে দেখলে যে কেউ রুঁখে দাঁড়াবে,ঐ ছেলেটা মুনের পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই মুন এখন এসব থেকে বাহিরে,সুরক্ষিত আছে
.
মুন আপু কোথায় এখন?সেটাও তো জানি না
.
বাবা চায়ে চুমুক দিয়ে এক দৃষ্টিতে মেইন দরজার দিকে চেয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরে বললেন”কোথায় আবার,ঐ ছেলেটা যেভাবে ওর হাত ধরে বিয়ের পিড়ি থেকে নিয়ে গেছে,এখন নিশ্চয় ওর বাসাতেই আছে
.
তুমিও না বাবা,উনার ঠ্যাকা পড়ে নাই অচেনা একটা মেয়েকে নিজের বাসায় তুলতে,শুনেছি এ লোকটা নামি পরিবারের ছেলে,ঐ যে আনিসুর চৌধুরী নামের একজন পুলিশ আঙ্কেল ছিলেন না??এই মোড় শেষ করে দ্বিতীয় মোড়ের শেষপ্রান্তে যে বাসা,এখন তো তিনি অবসরপ্রাপ্ত
.
হুম চিনেছি
.
উনার ছেলেই তো কাল মুন আপুকে নিয়ে গেছে,আমাকে পাশের বাসার অন্তু বললো

কিরে নীল,এটা কি সত্যি??
.
কি?
.
তুই নাকি ঐ ফলপাকড় চোর মেয়েটাকে বাসায় এনেছিস?এখনও সে ওখানেই আছে
.
নীল একটা ফাইলে সই করতে করতে বললো”হুম,ঠিক শুনেছিস”
.
হিয়া জানে?
.
নীলের সইটা বেলাইন হয়ে গেলো হিয়া নামটা শুনে,তারপর চোখ তুলে আসিফের দিকে তাকিয়ে সে বললো”হিয়া??”
.
হুম,হিয়া!প্রথমবার শুনছিস নাকি? যাই হোক,ওমন চোরকে বাসায় রাখিস না,পরে দেখবি তোদের বাসার সামনের এত সাধের সব গাছ খালি করে পালাবে একদিন
.
নীল হালকা হেসে ফাইলটা বন্ধ করে বললো”পালাবে আর কোথায়?বাসা তো কাছেই,ঠিক ধরে ফেলবো”
.
নীল তুই এই প্রথম অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস,বিষয়টা হিয়া জানলে বিশ্বযুদ্ধ লাগবে বলে দিচ্ছি
.
নীল উঠে দাঁড়িয়ে আসিফের দিকে চেয়ে বললো”বিশ্বযুদ্ধ হয়ে শেষ ও হয়ে গেছে,আর হবে না”
.
আসিফ নীলের একটা কথাও বুঝলো না,নীল এমন আজিব বিহেভ কেন করছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না ওর,হিয়ার নাম শুনলে লজ্জায় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতো যে নীল সে নীল কিনা এখন হিয়ার প্রসঙ্গ আসায় পালিয়ে গেলো??ঢাকায় আসার পর থেকে ওর মুখ থেকে একবারের জন্য ও হিয়ার কোনো কথা শুনলাম না,গল্প শুনলাম না,আর এই নীলই আমাদের সাথে দেখা হলে শুরু করতো হিয়ার কথা বলা,তাকে থামানোও যেতো না
কতটা বদলে গেছে নীল!
.
নীল তার অফিসের বাহিরে থাকা ফুলের বাগানের দিকে চেয়ে চুপ করে আছে,হিয়া নামটা শুনলে তার মনে আনন্দ হতো আর এখন বুক ফেটে আসে,খুব কষ্ট হয় হিয়ার নাম শুনলে,যত চেষ্টা করি অফিস টাইমে ওকে ভুলে থাকার ততই ওকে নিয়ে যত কথা রটে!
অবশ্য আমার জন্যই এমনটা হচ্ছে,আমি হিয়াকে নিয়ে বলি নাই এমন কেউ বাদ নেই,আশেপাশের মানুষ ও এখন হিয়াকে না দেখেও ওর সম্পর্কে জানে

আরে আরে মুন এমন করছো কেন?তোমার মাথা কি গেছে??পড়ে যাবে তো!এই মুন!
.
নিপা আপু সরি,আসলে এত পাকা পেয়ারা দেখে লোভ সামতে পারলাম না
.
সেটা নাহয় বুঝলাম,কিন্তু তুমি অসুস্থ শরীরে গাছে উঠতে গেলে কেন??গাছে উঠলেই বা কি করে!নীল ভাইয়া দেখলে খুব রাগ করবে,নামো নামো
.
উনি কি এখন আসবেন নাকি??তাই তো উঠলাম,প্যারা নাই চিল!!
আমাকে পেয়ারা নিতে দাও,আর তুমি এক কাজ করো গিয়ে লবণ মরিচ রেডি করো,কিছু কাঁচা পেয়ারা ও নিচ্ছি,আমরা দুজন মিলে জমিয়ে খাবো
.
নিপা মাথায় হাত দিয়ে মেইন গেটের দিকে তাকালো,নীলের জিপ ঢুকছে দেখে ওর চোখ কপালে,ইয়া বড় চোখ করে সে মুনকে বললো”মুন জলদি নামো,ভাইয়া এসে গেছে,”
.
নীলের আসার কথা শুনে ভয়ের চোটে মুনের বুকটা কাঁপছে অনবরত
সে একটা ঢাল ধরে ছিল এতক্ষণ
ভয়ে সব ভুলে হাতটা ছেড়ে দিয়ে সে গাছ থেকে এক্কেবারে নিচে পড়লো
মুন জিপ থেকে নেমে ওদিকেই তাকিয়ে ছিলো
নিপা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু না দেখার ভান করে পালিয়েছে,মুন পা ধরে চুপ করে আছে,চেঁচাবে না আগে থেকে ভেবে রেখেছে সে
শুকনো মাটি হলে ব্যাথা পেতো না কিন্তু এরা তো বড়লোক্স!!
গাছের গোড়া রেখে বাকিসব সিমেন্ট দিয়ে ঢালায় দিয়ে রাখছে যার কারণে ব্যাথা একটু লেগেছে
মুন চোরের মতন পিছন ফিরে তাকালো এবার,নীল এদিকেই আসছে
ঢোক গিলে মুন পেয়ারা গুলো ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেললো
নীল এগিয়ে এসে বললো”তোমার লাইফে এতকিছু হয়ে গেলো,গএকটা ঘূর্নিঝড়ের মতন! আর তুমি?গাছে উঠে বাঁদরামি করছো??তোমাকে আমি মানা করি নাই?”
.
মুন চুপ করে নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
.
এবার এটা ভেবো না যে আমি তোমায় সিনেমার নায়কদের মতন কোলে তুলে বাসায় নিয়ে যাবো
নিজের দোষে পড়েছো তো নিজে নিজে বাসায় আসবে,তোমার সুবুদ্ধি হোক তাতে,বেশি বেশি বেড়েছো!
.
বকাবকি শেষে নীল চলে গেলো বাসার দিকে
মুন নীলকে ভেংচি কেটে পেয়ারাগুলোর দিকে তাকালো,দুটো কাঁচা আর তিনটে পাকা নিয়েছে সে
তারপর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো এবার
হাত পা ঝেড়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাসায় ঢুকলো,নিপা চোরের মতন পর্দার আড়ালে থেকে মুনকে ইশারা করছে
মুন সোজা সেদিকেই গেলো
.
ভাইয়া তোমাকে খুব বকেছে তাই না?
.
একটু খানি,সমস্যা না,আমি উনার কথা এই কান দিয়ে ঢুকিয়ে ঐ কান দিয়ে বের করি ফেলি,নাও ধরো পেয়ারা,লবণ মরিচ নিয়েছো তো?তাহলে চলো খাই এখন

নীল সোজা রুমে গিয়ে দরজা লাগালো,তার দরজা লাগানো মানে কেউ যাতে তাকে আর ২৪ঘন্টায় ও ডিস্টার্ব না করে

নীল ফ্রেশ হয়ে এসে চুল মুছতে মুছতে আলমারি,টেবিল ড্রয়ার সব চেক করেও কোথাও কোনো মদের বোতল পেলো না
.
রফিককককক,আমার মদ কই??

স্যার খাটের পাশের টেবিলের নিচে
.
নীল মদের বোতলটা খুঁজে তার ছিপি খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো,২ঢোক খেয়ে নিচে তাকালো সে
মুন এতক্ষন সেখানে দাঁড়িয়ে লবণ মরিচ দিয়ে পেয়ারা মাখিয়ে সেটা খেতে খেতে নীলের মদ খাওয়া দেখছিলো
লবণ মরিচ দিয়ে কাঁচা ফল ঘরে বসে খেলে আসল ফিলিং আসে না এটা মুনের ধারনা
যার কারণে সে সবসময় বাহিরে এসে এসব খায়
নীল তাকাতেই সাথে সাথে দৌড়ে বাসার ভিতর চলে গেছে মুন আর দাঁড়ায়নি ওখানে
নীল পকেট থেকে হিয়ার ছবি নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো বারান্দাতে,মদ খাচ্ছে আর হিয়ার ছবি দেখছে নীল
চোখ দিয়ে ২ফোটা পানি গড়িয়ে নিচে পড়লো তার
.
নীল হাত দিয়ে চোখ মুছে বাকি মদটুকু ও খেয়ে নিলো,,
নীলের চোখ লেগে আসলো মূহুর্তেই,,চেয়ারে আধ শোয়া অবস্থাতেই সে ঘুমিয়ে পড়লো

রাত ৯টা বেজে গেছে
মা এসে নীলের দরজা ধাক্কাচ্ছে অনবরত,,নীল ঘুমিয়ে তখনও
নীলের দরজা আটকানো দেখেও তাকে কেউ ডিস্টার্ব করতো না যতক্ষন না বিরাট বড় তুলকালাম বাঁধে
মা অনেক ডাকলো নীলকে,,কিন্তু নীলের খবর নেই শেষে রফিক বাহিরে এসে মই দিয়ে নীলের বারান্দায় উঠে নীলকে ডাক দিলো
নীল ঘুম থেকে জেগে গেলো এবার,চোখ ডলে হিয়ার ছবিটা পকেটে পুরতে পুরতে বললো”কি হয়েছে??”

স্যার দরজাটা খুলেন,আপা তখন থেকে আপনাকে ডাকছে
.
নীল উঠে গিয়ে দরজা খুললো
মা সাথে সাথে ভিতরে এসেই বললেন”নীল সর্বনাশ হয়ে গেছে,,!!!
একটা ছেলে তার পরিবারকে নিয়ে এসে মুনকে জোর করে নিয়ে গেছে এখান থেকে আমরা অনেক আটকানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি,,তোকে ডেকেছি তুই ঘুমে ছিলি”
.
নীল আর একটা সেকেন্ড ও দাঁড়ালো না,বিছানার ওপর থেকে কালো জ্যাকেটটা টান দিয়ে পরতে পরতে বেরিয়ে গেলো
তার ভুলের কারনে মুনের না জানি কি ক্ষতি হয়ে যায়,নিজেকে তাহলে সে কিছুতেই মাফ করতে পারবে না
মুনের সেফটি নিয়ে আরও কড়া নিরাপত্তা দেওয়া উচিত ছিল তার,ঐ লোকগুলো এতটা সিরিয়াস জানা ছিল না আমার
আমারই বাসা থেকে এসে মুনকে নিয়ে চলেও গেলো আর তখন আমি বাসায় ছিলাম!
শিট!!!আমার বেখেয়ালির কারণে এত বড় কান্ড ঘটে গেলো
.
নীল মুনদের বাসায় এসে জানতে পারলো মুন সেখানে নেই
নীল এবার সোজা তুষারদের বাসায় গেলো,সেখানে তুষার মুনের হাত পা বেঁধে বসিয়ে রেখেছে ওকে সেখানে,,আর উকিল কাগজে কি সব লিখছেন
বিষয়টা দেখে সাফ সাফ বোঝা যাচ্ছে এখানে পুনরায় বিয়ের কাজ চলছে
নীল ভেতরে ঢুকেই পিস্তল ধরলো বরাবর তুষারের কপালে

বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখানেই মেরে দিব,তোমার সাহস হয় কি করে ওকে আমার বাসা থেকে তুলে আনার??হাউ ডেয়ার ইউ??
.
নীল মুনের দিকে তাকিয়ে পিস্তল দিয়ে তুষারের নাকে এক ঘুষি মেরে দিলো
সবাই ভয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়েছে
নীল মুনের কাছে এসে ওট মুখ আর হাত থেকে বাঁধন খুলে দিচ্ছে
মুখটা ছোট করে সে বললো “আই এম সরি”

তুষার বলে উঠলো মুনের সাথে তোমার কি সম্পর্ক??ওকে তোমার বাসায় রাখতেছো কেন??

নন অফ ইউর বিজন্যাস!

হুম রক্ষিতা করে রাখতেছো সেটা বললেই হয়
.
নীল রেগেমেগে তুষারের বাম পাশে থাকা একটা ফুলের টবে শুট করলো
.
আর একটা কথা বললে এই গুলি তোমার কপালের মাঝখানে গিয়ে পড়বে বুঝেছো??
নাকি মাথায় বুলেট ঢুকিয়ে বুঝাইতাম??
.
পুলিশ হয়ে সামান্য কারণে শুট করবা??
.
শুট করবো কি করবো না ওটা মরার পর ভাবিও কেমন??আর তোমাকে মারার পর আমাকে জেলে নিবে নাকি দুদিন পর ছেড়ে দিবে সেটা দেখার জন্য তুমিই তো থাকবে না মিঃতুষারপাত!!
.
তুষারের মুখ বন্ধ হলো এবার
.
আসিফকে ফোন করতে করতে নীল মুনের হাত ধরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো
তুষারের উপর কিডন্যাপের কেস দিব,,একটা মেয়ের পিছনে গোটা গুষ্টিরমাথা বসেছে
.
মুনের কানে শুধু বাজতেছে “রক্ষিতা”
.
মুন কিছুদূর যেতেই নীলের হাত ছাড়িয়ে নিলো

কি হলো আবার?

আমি যাব না

মানে??কি বলতে চাও?
তুমি ঐ ছেলেটাকে বিয়ে করতে চাও?

নাহ

তাহলে.?

আমি একটা জায়গা করে নিব থাকার,আপনি যান এখন

তুমি বললেই হলো??
চলবে♥