স্রোতধারা পর্ব-১১

0
369

স্রোতধারা
একাদশ_পর্ব
~মিহি

“স্রোত, তোমার পাগলামি বন্ধ করো, হাত খোলো আমার।”

“আগে বিয়ে হবে তারপর।”

ধারা অসহায় দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্রোত হাত ধরার বাহানায় কখন হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়েছে সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। ছেলেটার মাথায় এত শয়তানি বুদ্ধি যে গিজগিজ করছে তা তার নিষ্পাপ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। ধারার অসহায় মুখ দেখে স্রোত বেশ মজা পাচ্ছে। তেজী বাঘিনীকে ঘায়েল করতে পারার যে আনন্দ তা উপলব্ধি হচ্ছে তার।

“আর দশ মিনিট পর আমাদের সিরিয়াল। তুমি কি সাইন করবে নাকি আজীবন আমার হাত আর তোমার হাত এই হ্যান্ডকাফেই আবদ্ধ থাকবে?”

“আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।”

“তো কাকে বিয়ে করবে?”

“সেটা তোমায় বলতে হবে কেন?”

“একটা পার্ফেক্ট এরেঞ্জ ম্যারেজ করতে চাও তো? হবে না। আমি থাকতে তোমার সে স্বপ্ন আর পূরণ হচ্ছে না। কী ভেবেছো? বিয়ে করে সংসার করবে আর আমি তোমার বিরহে গান গাবো, চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি ধারা শুনছো? এমন হচ্ছে না। তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। চুপচাপ এখন ভেতরে গিয়ে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করবে।”

“আমি সাইন করবো না।”

“উফ! ভালো কথার যুগই নাই। সজ্ঞানে বিয়ে করার শখ যখন নাই, তখন নেশার ঘোরেই বিয়ে করো।”

বলেই ধারার মুখে কিছু একটা স্প্রে করে স্রোত। ধারা চোখমুখ কুঁচকে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে। নাকের কাছে বেশ গাঢ় একটা গন্ধ পেতেই মাথাটা ঘুরে উঠে। স্রোতের দিকে তাকিয়ে সবকিছু ঝাপসা দেখতে শুরু করে। গলাটাও যেন ধরে আসছে।

“কী স্প্রে করেছো তু..তুমি স্রোত?”

“আর তিন মিনিট পর তুমি নিজের জ্ঞানে থাকবে না। আমি যা বলবো তাই করবে। ভালোই ভালোই বলেছিলাম, কথা শুনলে না তো। এখন নিজের বিয়ে নিজেই দেখতে পারবে না।”

“স্রোত..এ..এমন করো না। স..সর্বনাশ হয়ে যাবে। আ..আমার সামনে বিয়ে।”

“এজন্যই তো তোমায় তুলে এনে বিয়ে করছি। লিগ্যালি তোমায় নিজের করবো তারপর যদি বাড়িছাড়া হতে হয় হবো।”

“পা..পাগলামি করো না। আমার পরিবারের মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। স্টপ স্রোত।”

“তোমার বিয়ে আমার সাথে না হলে আর কারোর সাথেই হবে না।”

“স্টপ! তোমার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তোমার মা এসেছিলেন, আমিই আন্টিকে বলেছি তোমায় কিছু না জানাতে।”

ধারার কথা শেষ হওয়ামাত্র স্রোত হাসতে থাকল। ধারা ভ্রু কুঁচকাল। হাসছে কেন ছেলেটা? স্রোত হাসি থামিয়ে ধারার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলো।

“ব্যস! এটাই শুনতে চেয়েছিলাম তোমার মুখ থেকে।”

“মানে?”

“মানে তুমি যে এই বিয়ের ষড়যন্ত্রটা প্ল্যান করেছো, তা আমি তোমার মুখ থেকেই কনফার্ম করতে চেয়েছিলাম।”

“মানে এসব নাটক ছিল?”

“হ্যাঁ মিস.ধারা আহমেদ।”

“তাহলে আমার মুখে যেটা স্প্রে করলে সেটা কী ছিল?”

“নরমাল ঠাণ্ডা পানি। তোমার অবচেতন মন যেটাকে চেতনানাশক ধরে নিয়েছে। সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টস! ডাক্তার হয়ে এত বোকা হলে হয়, জান?”

“তুমি কি জানো তুমি একটা আস্ত বজ্জাতের গাছ!”

“গাছ হই আর মানুষ হই, হবো তো তোমারই।”

স্রোতের ঠোঁটের কোণে এখনো হাসি ঝুলছে। আচমকা স্রোত ধারার এক হাত শক্ত করে ধরল। কাতর দৃষ্টিতে বলল,”আমি পুড়ছি ধারা, তোমার বিরহের অনলে আমি পুড়ছিলাম। কেন এত কষ্ট দিতে ভালোবাসো? স্বাভাবিকভাবে বিয়েটা হলে আমি তোমায় এভাবে এখানে আনতাম না কিন্তু নাহ! তোমরা মেয়েরা ড্রামা ছাড়া কিচ্ছু করতে পারো না। একবার বিয়েটা হোক, এসব প্র্যাঙ্কের জন্য এক বস্তা শাস্তি জমাচ্ছি তোমার নামে।” ধারা হাসলো। মাথার উপর থেকে বিরাট বড় বোঝা নামলে যেমন একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলা সুখকর হয়, তেমন করে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিল সে। স্রোত এক হাত ছেড়ে দিলেও হ্যান্ডকাফটা খুলল না। সামান্য দূরত্ব রেখে দুজন সামনে হাঁটতে লাগলো।

______________

“তুমি ক্লাস টেনে উঠছো কেমনে আমারে একটু বলবা?”

“তখন পড়াশোনা করতাম, এখন করিনা সিম্পল!”

“করো না কেন?”

“এত পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না। আমি বিয়ে করতে চাই। ভালো করে পড়লে বাড়িতে বিয়ে দিবে না তাই পড়িনা।”

“তো খারাপ করে পড়লে তোমায় বিয়েটা কে করবে?”

“যে ভালোবাসবে সে ঠিকই করবে।”

“এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। মুভি দেখো তুমি?”

“হ্যাঁ।”

“এই তিনটা ম্যাথ শেষ করলে তোমায় আমার প্রিয় একটা মুভি সাজেস্ট করবো।”

হায়া কী ভাবলো কে জানে। খাতাটা নিয়ে চুপচাপ কলম ঘোরাতে লাগল। অঙ্কটা সে কোনভাবেই পারবে না এ বিশ্বাস তার নিজেরও আছে কিন্তু ধ্রুবর কথাটা ফেলতে কেন যেন দ্বিধা হচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর একটা অঙ্ক কোনরকম করতে পারলো হায়া। ধ্রুব অঙ্কটা দেখতে লাগল।

“হুম পেরেছো। যেদিন তিনটা পারবে সেদিন আমি মুভির নামটা বলবো। বাকি দুইটা বুঝিয়ে দিচ্ছি শোনো।”

“আপনি তো কেমিস্ট্রির টিচার, ম্যাথ কেন পড়াচ্ছেন?”

“টেবিলে তোমার ম্যাথ বই দেখলাম, ভাবলাম দেখি তুমি কেমন ম্যাথ পারো। যাই হোক, এই দুটো অঙ্ক শেষ করে আমরা রসায়ন পড়া শুরু করবো।”

হায়া কেবল মাথা নাড়ে। মন ভালো নেই তার। ধ্রুবর উপস্থিতিও বিদঘুটে লাগছে। এর অবশ্য একটা কারণ আছে। আজ হায়ার দাদী আসছেন গ্রাম থেকে। চরম জাঁদরেল একজন মহিলা তিনি। ঠিক কী কারণে হায়া তার চক্ষুশূল সে এখনো জানেনা। কোনভাবেই তার দাদী তাকে সহ্য করতে পারে না বরং কারণে অকারণে অপমান করার নিত্যনতুন সুযোগ খুঁজতে থাকে। এজন্য হায়া সবসময় চেষ্টা করে তার থেকে দূরে থাকতে। যেকোন সময় তিনি এসে চেঁচানো শুরু করবেন। উদাসী দৃষ্টিতে বাইরে তাকালো হায়া।

“অন্যমনস্ক থাকলে তো পড়া হবে না হায়া। তোমার বাবার বিশ্বাসটা আমি ভাঙতে পারবো না। দয়া করে একটু মনোযোগ দাও।”

“আমি কাল থেকে পড়ি? আজ হয়তো অনেক চেষ্টা করলেও আমি মনোযোগ দিতে পারবো না।”

“কারণ কী বলো।”

“এমনি। বাসায় ভালো লাগছে না তাই আর কী। কাল থেকে আমি ভালোমতো পড়বো। সত্যি!”

“বাসায় ভালো লাগছে না? অবশ্য আমিও এখানে আসার পর থেকে কোথাও বের হইনি। চলো ঘুরে আসি।”

“মজা করছেন?”

“আরে নাহ। তুমি তো আমার ছোটবোনের মতো, মজা করবো কেন?”

‘ছোটবোন’ কথা শুনে হায়ার মুখ কুঁচকে গেল। পৃথিবীতে এত উদাহরণ থাকতে ছোটবোন? কেন রে ভাই? আমি কি তোর মায়ের পেটের বোন? বন্ধু বলতে পারতি তো, বোন ক্যান বলা লাগল তোর? রাগে গজগজ করতে করতে মনে মনে ধ্রুবর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করল হায়া। অতঃপর মলিন স্বরে বলল,”মা কিছুতেই আমাকে বের হতে দেবে না এখন। আপনিই ঘোরেন।” হায়ার কথা শুনে ধ্রুব চুলে হাত বোলাতে বোলাতে কিছু একটা ভাবলো অতঃপর ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে বলল,”যদি তোমায় ঘুরতে নিয়ে যেতে পারি, কী দিবে আমায়?”হায়া কিছুক্ষণ ভাবলো কী দেয়া যায়। মাথায় সেভাবে কিছু আসলো না। বাধ্য হয়ে বললো,”আপনি কী নিবেন বলেন।” ধ্রুব হাসলো। এটাই চাচ্ছিল বোধহয় সে। হায়ার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। হায়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। লোকটা গেল কোথায় এভাবে?

মুখ গোমড়া করে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল হায়া। এরই মধ্যে শায়লা আহমেদ এলেন ঘরে। হায়ার উদ্দেশ্যে বললেন,”পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে। তোকে বেরোতে হবে একটু।” মায়ের কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লো হায়া। বাড়িতে তার দাদী আসছে অথচ মা তাকে বের হওয়ার পারমিশন দিয়ে দিল? ধ্রুব কী এমন জাদু করলো মাকে? দরজার আড়ালে থাকা ধ্রুবর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল হায়া। পরক্ষণেই ধ্রুবর সাথে সে ঘুরতে বের হবে ভাবতেই সমস্ত গা শিরশির করে উঠলো।

চলবে…