স্রোতধারা পর্ব-১৭

0
311

স্রোতধারা
সপ্তদশ_পর্ব
~মিহি

“বিয়ের আগে যদি হবু স্বামীরে একটু না জ্বালাও তবে সে যে কতটা কেয়ারিং তা কেমনে বুঝবা সোনা?” মামাতো বোন তিতিরের কথায় ধারা লজ্জা পেলেও হায়া ভ্রু কুঁচকাল। বহুদিন পর তার মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধির খিচুড়ি পাকাতে শুরু করলো সে। রাত যত বাড়ছে, হৈ চৈ আড্ডা কমে এলো। হায়া অবশ্য ধারার সাথে ঘুমোতে চেয়েছিল কিন্তু জোবেদা খানম তাকে জোর করে নিজের সাথে ঘুমোতে নিয়ে গেল। হায়া এর কারণটা জানে। তিনি আপাতত হায়ার ব্রেণ ওয়াশ করতে চাচ্ছেন এ বিয়েটা ভাঙার জন্য। হায়ার বিয়ে ভাঙার মতো মানসিকতা নেই কেননা এ বিয়ের সাথে তার পরিবারের মান সম্মান ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। চাইলেই সে সব ছেড়েছুঁড়ে এখন চলে যেতে পারছে না। বাবার ফোনটা নিয়ে হায়া দাদীর ঘরে ঢোকে। সৌহার্দ্যের নম্বরটা সে বেশ কষ্টে জোগাড় করেছে। ধারার ফোন থেকে স্রোতের আইডি খুঁজে বের করেছে। তারপর সেখান থেকে সৌহার্দ্যের আইডি খুঁজেছে। ভাগ্যিস সৌহার্দ্যের ফোন নম্বর পাবলিক করা ছিল অন্যথায় আরো ঝামেলা পোহাতে হতো। অবশ্য ঝামেলাটা এবার সৌহার্দ্যকে পোহাতে হবে। ভেবেই দাঁত বের করে হেসে উঠে হায়া।

প্রায় মাঝরাত। প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে সৌহার্দ্যের। মাত্র গোসল করে বের হয়েছে সে। ফোনের মেসেজ টোনে খানিকটা বিব্রতবোধ করলো। রাত প্রায় একটা বাজে। এরকম সময়ে কে মেসেজ করতে পারে? আজ স্রোতও অন্য ঘরে ঘুমিয়েছে। স্রোতের ফোন তো বাজার কথা নয় তার মানে তার ফোনটাই বেজেছে। চুল মুছতে মুছতে ফোনটা হাতে নিল সৌহার্দ্য। আননোন নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে তবে ট্রু কলারে নামটা ঠিকই দেখতে পেল সৌহার্দ্য। নওফেল সাহেবের নাম লেখা উঠছে। তিনি সৌহার্দ্যকে মেসেজ করেছেন? বেশি না ভেবে সৌহার্দ্য মেসেজ ওপেন করে।

“শুনেছি বর নাকি বউয়ের সব আবদার পূরণ করে। রাত-বিরাতে আজব জেদ ধরলেও নাকি বর মেনে নেয়। আপনি তো আমার বর হতে চলেছেন, আপনি পারবেন তো মানতে? কথাটা এই মুহূর্তে সকলকে ফাঁকি দিয়ে আমার বাসায় এসে আমায় জানাবেন। খবরদার যেন কেউ না জানে, স্রোত ভাইয়াও না।

হায়া”

সৌহার্দ্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হায়া আসলেই তাকে এই মেসেজ করেছে ভাবতে নিয়ে বেশ দ্বিধায় পড়লো সে তবে হায়া কি সত্যিই চায় যে সৌহার্দ্য তার সাথে গিয়ে একাকী দেখা করুক? কোনমতে গায়ে একটা টি-শার্ট জড়িয়ে বাইরে এলো সৌহার্দ্য। চোরের মতো শব্দহীন পায়ে গাড়িটা বের করলো। নিজের বাড়ি থেকে চোরের মতো বের হতে হচ্ছে ভেবে লজ্জা পেলো সে কিন্তু ভালোবাসার মানুষ প্রথমবার কিছু একটা আবদার করেছে। তা তো রাখতেই হতো। গাড়ি চালাতে চালাতে সৌহার্দ্য ভাবছে কিভাবে হায়ার বাড়িতে ঢোকা যায়। সকলকে ফাঁকি দিয়ে ঢোকা এত সহজ না কারণ বাড়িভর্তি মেহমান। হুট করে কারো চোখে পড়লে হিতে বিপরীত হতে দেরি কতক্ষণ? হায়া নিশ্চয়ই ধারার ঘরে ঘুমিয়েছে। যা করতে হবে বেশ সাবধানে। ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো সৌহার্দ্য। হায়ার কথা ভাবলেই কেন যেন জাগতিক সব মোহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সৌহার্দ্য।

_______________

জোবেদা খানম একা একা বকবক করে যাচ্ছেন। হায়া যে কানে হেডফোন লাগিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে সেদিকেও তার ধ্যান নেই। তিনি বকবক করছেনই। হায়া ধরে নিয়েছে সৌহার্দ্য আসবে না। তাই সে নিশ্চিন্তে গান শুনছে। অবশ্য সৌহার্দ্য আসলে যে ঝামেলাটা সে বাঁধাতে চেয়েছিল সেটা আর হলো না। আচমকা গাড়ির শব্দে খানিকটা চমকালো হায়া। তার জানালার কাছেই বাড়ির মেইন গেট। গাড়ির শব্দ পেয়েছে সে। সৌহার্দ্য কী এসেছে? জোবেদা খানম উল্টো পাশ ফিরে নিজের মতো শুয়ে পড়েছেন। হায়া ধীরে ধীরে জানালার কাছে যেতেই দেখলো সৌহার্দ্য এসেছে। হায়ার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো। এটাই তো চেয়েছিল সে। সৌহার্দ্য ধীর পায়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে লক্ষ করলো হায়া। এখন পাইপ বেয়ে উপরে উঠা ছাড়া উপায় নেই। হায়া হালকা হেসে জানালা থেকে সরে দাঁড়ালো।

“পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো প্রেমিকার আবদার পূরণ!” কথাটা আওড়াতে আওড়াতে কোনোরকম পাইপ বেয়ে ছাদে উঠলো সৌহার্দ্য। ছাদে সব ছেলে কাজিনদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সৌহার্দ্য ধীর পায়ে সবাইকে অতিক্রম করে নিচে নামলো। প্রথমেই ধারার ঘরে ঢুকলো। বিছানায় কেবল ধারাকে দেখতে পেল। আশেপাশে লক্ষ করে অন্য ঘরে ঢুকল সে। একেক করে সবগুলো রুম চেক করে সবার শেষে দেখতে পেল জোবেদা খানমের ঘর। সেদিকেই এগোলো সৌহার্দ্য।

হায়া মনে মনে সব ছক কষে রেখেছে। সৌহার্দ্য দরজার দিকে এগোতেই হায়া তার দাদীকে ফিসফিস করে ডাকতে লাগলো।

“দাদী উঠেন…”

“কী হইছে?”

“চোর ঢুকছে বাড়িতে।”

“কীহ? চোর?”

“ঐ দেখেন ছায়া! আপনি ভয় পাচ্ছেন না তো?”

“চুপ ছেড়ি! চিনোস আমারে? আমি ভয় পাবো নাকি? ঐ চোরের একদিন কী আমার একদিন! একটা কাজ কর। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়া। চোর আসলে ওর মুখে কাঁথাটা চেপে ধরবি। তারপর ওর যা করা লাগে আমার উপর ছেড়ে দে।”

“বাবাকে ডাকি দাদী?”

“ওদের টেনশন দেওয়ার দরকার নাই। আমার মার খাইলে এমনিই পালায়ে যাবে।”

হায়া ঠোঁট টিপে হাসছে। এটাই তো চেয়েছিল সে। এবার সৌহার্দ্য বুঝবে মজা। বিয়ের আগের রাতে কিনা দাদী শাশুড়ির লাঠির বাড়ি খাবে সে!

সৌহার্দ্য ঘরে ঢুকতেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখে চাদর পড়ল তার। চাদর সরানোর সুযোগটুকু পেল না। একজোড়া নরম হাত পেছন থেকে সজোরে জাপটে ধরলো তাকে। ছাব্বিশটা বসন্ত পেরিয়ে এ প্রথম বুঝি তার মনে রঙিন প্রজাপতি উড়তে লাগল। এ সুখকর অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। এলোপাথাড়ি লাঠির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো সে। জোবেদা খানম তখনো মারতেই আছেন। জোবেদা খানমের হাত লেগে চাদর সরে গেল। চাদরের নিচে সৌহার্দ্যকে দেখে তিন ধপ করে লাঠিটা ফেলে দিলেন। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,”নাতজামাই তুমি?”

সৌহার্দ্য একবার হায়ার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। হায়া মুখ কাঁচুমাচু করে রইল। ব্যথায় বাম হাত নাড়াতে পারছে না সৌহার্দ্য। জোবেদা খানম হায়াকে আদেশ দিলেন মলম এনে লাগিয়ে দিতে। অতঃপর মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

হায়া এখন অপরাধবোধ করছে। সৌহার্দ্যের সাথে সে যা করেছে তা নিতান্তই বাড়াবাড়ি। “একটু সাহায্য করবে? উঠতে পারছি না।” সৌহার্দ্যের কাতর কণ্ঠ যেন হায়ার অপরাধবোধ শতগুণে বাড়িয়ে দিল। হায়া সৌহার্দ্যের হাত ধরে তাকে উঠে বিছানা পর্যন্ত যেতে সাহায্য করলো। অতঃপর মলম এনে হাতে লাগিয়েও দিল। হায়ার এমন রূপ দেখে সৌহার্দ্য মুচকি হাসলো। আনমনে বলে উঠল,

” যে দেয় ক্ষত
সেই সারায়,
বলো তো কেন ভালোবাসা এত পোড়ায়?”

হায়ার হাত থেমে গেল। নিস্তব্ধতা চারিদিকে। সৌহার্দ্যের হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি দিব্যি শুনতে পাচ্ছে হায়া।

“যেটা বলতে এসেছিলাম, সেটা বলি?”

“আমি দুঃখিত।”

“আমি ততটা রোমান্টিক টাইপের নই তবে দায়িত্ববান বলতে পারো। যেহেতু তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হতে চলেছো, তাই তুমি আমার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তোমার সমস্ত আবদার আমি পালনের চেষ্টা করবো। ভালোবাসা হয়তো রঙ বদলায় তবে শ্রদ্ধা, সম্মান এ সবকিছু থাকলে সম্পর্ক ঠিকই টিকে। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি, ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কটাকেও শ্রদ্ধা করবো। তোমার যখন যা ইচ্ছে হয়, সবকিছুই পূরণের চেষ্টা করবো।”

“এ বিয়েটা আপনার কাছে দায়িত্ব তবে আমার কাছে শিকল, বাধ্যবাধকতা।”

“বেশ। বিয়ের পর তোমার যদি আলাদা থাকতে ইচ্ছে হয় তুমি থাকতে পারো। আমি নিষেধ করবো না।”

কথাটুকু বলে মলিন হাসলো সৌহার্দ্য। হায়া বুঝলো না এ হাসির মানে। আর কিছু মুহূর্ত, অতঃপর দুজনেই এক অনাকাঙিক্ষত সম্পর্কে ঠিকই আবদ্ধ হবে কিন্তু ভবিতব্য কী হবে দুজনের?

চলবে…