স্রোতধারা পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
616

স্রোতধারা
ঊনবিংশ_পর্ব
~মিহি

“কাজটা কী ঠিক হলো বেয়ান সাহেবা?”

অভিকের কথায় পিছন ফিরতেই অভিক হাতভর্তি রঙ মাখিয়ে দিল তিতিরের গালে। তিতির প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি কিন্তু যখন অভিকের হাত কালো রঙে মাখানো দেখল তখনি তার চোখ রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় হয়ে গেল। অগ্নিদৃষ্টিতে অভিকের দিকে তাকালো সে।

“এটা কী করলেন আপনি? আমাকে কালি মাখালেন কোন সাহসে?”

“সাহসের প্রশ্ন আমাকে করতে আসিয়েন না বেয়ান সাহেবা। আপনি যেমন বুনো ওল, আমিও তেমনি বাঘা তেঁতুল।”

বলেই অভিক মুচকি হেসে চলে গেল। তিতির আপাতত সেদিকে নছর দিল না। মুখ ধুয়ে জুতো চুরির প্ল্যানটা এক্সিকিউট করতে হবে তাকে। দুই জোড়া জুতো বেশ অভিনব কায়দায় লুকোনোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছে সে।

মুখটা ধুয়ে কাজিন গ্যাংয়ের কাছে ফিরলো তিতির। জুতো সরানোর জন্য মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে ডান্স কম্পিটিশন। বরপক্ষ আর কনেপক্ষের মধ্যে নাচের প্রতিযোগিতার বাহানায় ছেলের বন্ধুদের ব্যস্ত রাখবে সবাই আর এ সুযোগে তিতির জুতোগুলো নিয়ে যথাস্থানে লুকিয়ে ফেলবে। তিতিরের প্ল্যান অনুযায়ী ডান্স কনটেস্টের কথা তোলা হলো বরপক্ষের ছেলেদের তাচ্ছিল্য করে। ব্যস! ছেলেরা রাজি হয়ে গেল। তুষার বেচারা না না করছিল কিন্তু অভিক আর মাহিদ মিলে ওকেও সাথে নিয়ে এলো। শ্রাবণ বুঝতেই পারছে না প্র্যাকটিস ছাড়া কিভাবে এখন তারা নাচবে। নাচতে গিয়ে কেউ পড়ে গেলে তার ইজ্জতের বারোটা বেজে যাবে আজীবনের জন্য। অভিক একটু বেশিই লাফাচ্ছে। নিশি নাচটা বরাবরই ভালো পারে, বেশ কয়েকটা প্রোগ্রামেই নেচেছে। তার মধ্যে চিন্তার লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না তবে তুষারের পা কাঁপাকাঁপি পর্ব চলছে। শেষমেশ অভিক ঠিক করলো সে আর নিশি শুরু করবে। পরে তুষার এবং বাকিরা জয়েন করবে। প্রথম পারফর্মেন্স শুরু হবে ছেলেপক্ষদের দিয়ে। এটার কারণ তিতির জুতোগুলো লুকিয়ে ফিরে এসে নাচতে শুরু করবে। এর মধ্যে যেন কেউ কিছু টের না পায়। আর জুতো কোথায় আছে তা নিয়েও যেন সন্দেহ না করে। যা ভেবেছিল সে অনুযায়ীই সব শুরু হলো। অভিক আর নিশি গান সিলেক্ট করেছে ‘দিল্লিওয়ালি গার্লফ্রেন্ড’।

মিউজিক স্টার্ট হতেই নিশির হাতে হাত রাখলো অভিক। তিতির ভ্রু কুঁচকে একবার সেদিকে তাকিয়ে খুব সতর্কতার সাথে জুতোগুলো সরিয়ে নিল। কাকপক্ষীও কিচ্ছু টের পেল না। জুতোজোড়া মিষ্টির বাক্সে রেখে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলো তিতির। যত যাই হোক, জুতোর জন্য তো আর কেউ ফ্রিজ খুঁজতে আসবে না! জুতো রেখে স্টেজের সামনে আসতেই দেখলো বরপক্ষের নাচ শেষ। এবার ওদের নাচার পালা। তিতির নাচের প্র্যাকটিস করে রেখেছিল কিন্তু অভিক আর নিশিকে কাছাকাছি দেখে কেন যেন রাগে গা জ্বলছে তার। তবুও সবাই মিলে তৈরি হলো নাচার জন্য। তিতির গান সিলেক্ট করেছিল “ইয়ে লাড়কা হায় আল্লাহ”।

মিউজিক শুরু হতেই তিতিরের দিকে নজর গেল অভিকের। এক মুহূর্তের জন্য যেন সবকিছু থমকে দাঁড়ালো, চোখের সামনে কেবল জ্বলজ্বল করতে লাগল তিতিরের হাসিমাখা মুখখানা। অভিক লাজুক হেসে নিজেকে বললো,”প্রেমে এমন পিছলে পড়েছিস অভিক! নিশ্চিত পা ভাঙবে।”

__________________

স্রোত আর সৌহার্দ্য এতক্ষণ ঘরে ছিল। মূলত মুরুব্বিদের সাথে আলাপ করছিল তারা। ততক্ষণে বিয়ের কনেদের স্টেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্রোত আর সৌহার্দ্যকেও এখন নিয়ে যেতে হবে। দরজার দিকে তাকাতেই স্রোত দেখল জুতো নেই দুজনের একজনেরও। রাগান্বিত দৃষ্টিতে আশেপাশে অভিককে খুঁজতে লাগল সে। ঐ গাধাটাই বলেছিল যে ও জুতো সামলাবে। এখন গেল কই? বলতে বলতেই অভিক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ালো। স্রোত বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো।

“আমাদের জুতো কই, অভিক?”

“তোদের জুতো কি আমি পড়ে ঘুরছি যে আমাকে বলছিস? আজব!”

“এক লাত্থি দিব, তুই তো কইলি জুতো যাতে চুরি না হয় সে দায়িত্ব তোর। এখন জুতো খুঁজে দে।”

“মানে? জুতো গেছে? কখন? কেমনে?”

স্রোতের অগ্নিদৃষ্টির ঝলকানিতে আর কোনো শব্দ বের হলো না অভিকের মুখ দিয়ে।

“দুটো জুতোজোড়া মিলে পঞ্চাশ হাজার। তাড়াতাড়ি দিয়ে বিয়ে করতে বসুন দুলাভাই।” তিতির হাসতে হাসতে এসে বললো। স্রোত কটমট করে অভিকের দিকে তাকিয়ে আছে। অভিক এখন বুঝতে পারছে এসব নাচের কম্পিটিশনের পেছনের চক্রান্তটা। কিন্তু সেও তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়।

“জুতো যদি আমি খুঁজে বের করতে পারি, তবে কী করবেন বেয়ান সাহেবা?”

“খুঁজে আগে আনেন তো বেয়াই সাহেব।” বলেই মুখ টিপে হাসলো তিতির। অভিক তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। তুষার আর মাহিদকে বললো আশেপাশে দেখতে। শ্রাবণকে আরেক দিকে পাঠিয়ে সে আর নিশি এগোলো। এটা দেখে তিতির মুখ ভেংচি কেটে ওদের পেছন পেছন গেল। কেন যেন অভিকের সাথে নিশিকে ঠিক সহ্যই করতে পারছে না তিতির। নিশি অন্যদিকে এগিয়েছে। এরই মধ্যে অভিকের নজর গেল ফ্রিজের দিকে। কী ভেবে যেন ফ্রিজের দিকে এগোলো সে। পেছনেই তিতির দাঁড়িয়ে ছিল। অভিককে ফ্রিজের দিকে যেতে দেখে অভিকের হাত ধরে টান দিল তিতির। অভিক তাল সামলাতে না পেরে তিতিরের গায়ের উপর গিয়ে পড়লো। তিতির ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। অভিক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে চোখের দিকে। মুহূর্তেই সে ভুলে গেল সে এখানে কেন এসেছিল। তিতিরের মায়ায় পড়ে স্রোত আর সৌহার্দ্যের জুতোর মায়া দিব্যি ভুলে বসলো সে। সেই যে তিতিরের মায়ায় পড়ল, বাকিটা সময় সে ফ্যালফ্যাল করে তিতিরের দিকেই তাকিয়ে রইল। স্রোত শেষমেশ বাধ্য হয়ে অভিককে গালি দিয়েই টাকাটা দিল। অভিকের আর তো আর সেসবে মন নেই। তার মন পড়েছে তিতিরে।
__________________

স্টেজের একপাশে স্রোত আর সৌহার্দ্য বসে, অপরপাশে ধারা ও হায়া। মাঝখানে একটা বড় পর্দা দেওয়া। কাজী সাহেব এসেছেন। বিয়ে পড়ানো হবে। স্রোতের কবুল বলতে সময় লাগলো না, ধারা তা দেখে হালকা হাসলো। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে কবুল বলে দিল। সৌহার্দ্যের বেলায় সবকিছু যেন থমথমে হয়ে এলো। সৌহার্দ্য বারবার পর্দার আড়ালে হায়ার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো। হায়া যদি একবার না করে দেয় তবে সে এ বিয়ে করবে না। জোর করে কোনো কিছু সম্ভব নয়। হায়ার মুখ দেখার ব্যর্থ চেষ্টার পর আচমকাই মেসেজের শব্দে চমকে ফোনের দিকে তাকালো সে। “কবুল বলতে এত সময় লাগে?” হায়ার মেসেজে যেন স্বস্তি পেল সৌহার্দ্য। তড়িৎ গতিতে কবুল বলে দিতেই আশেপাশের সবাই হেসে উঠলো। হায়াকে কবুল বলতে বলা হলো। হায়া একবার নিজের মায়ার দিকে তাকালো। মায়ের চোখ ছলছল করছে। কবুল বলে দিল হায়া। পরক্ষণেই অনুভব করলো তার চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে। হায়া বুঝে উঠতে পারলো এ জল কি আনন্দের নাকি দুঃখের?

বিদায়বেলায় একটুও কাঁদলো না হায়া, চোখের অশ্রু যেন শুকিয়ে এসেছে। অন্যদিকে ধারাকে সামলানোই গেল না। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি তুলে ফেলেছে মেয়েটা। শেষে স্রোত ধারাকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসালো। দুটো গাড়িতে দুই জোড়া বর-বউ যাবে। প্রথম গাড়িতে সৌহার্দ্য আর হায়া উঠলো, পরেরটাতে স্রোত আর ধারা।

গাড়ি চলছে। সৌহার্দ্যের একটা ভয়ঙ্কর ইচ্ছে হচ্ছে। হায়ার হাতে হাত রাখার তীব্র এক বাসনা তার মনে চেপে বসেছে। সৌহার্দ্য কী ভেবে যেন হায়ার আঙুলে আঙুল ঠেকিয়েই চটজলদি হাত সরিয়ে নিল। অতঃপর মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে বলল,”গাধা! গাধার মতো কাজ না করলে হয় না তোর সৌহার্দ্য? ছিঃ!” পরক্ষণেই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটলো। সৌহার্দ্যের হৃদস্পন্দন থেমে গেল, সারা গা শিরশির করে উঠলো। হায়া সৌহার্দ্যের হাতে হাত রেখে কাঁধে মাথা রেখেছে। সৌহার্দ্যের মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে চিমটি কাটতে ইচ্ছে হলো তার কিন্তু হাত তো হায়ার দখলে। সৌহার্দ্য চুপচাপ চোখে বুঁজে রইল, অনুভব করলো স্বর্গীয় অনুভূতিটুকু।

____________

“জানো স্রোত, হায়াকে নিয়ে আমার স্বপ্নটা পূরণ হওয়ায় আমার পৃথিবীটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”

“তাই? তাহলে তোমার পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে তোলা উচিত আমার।”

“হুহ।”

“না মানে মা বলছিল দেরিতে বিয়ে করলাম তো, নাতি-নাতনির মুখ যেন তাড়াতাড়ি দেখাই।”

“নির্লজ্জ!”

“বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো, বাচ্চার বাপ হওয়ার বয়স পার হয়ে গেলে বাবা হবো?”

ধারা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ধারার হাসির মুগ্ধতায় স্রোত অপলক তাকিয়ে থাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর দিকে।

একই দিনে দু জোড়া মানুষের নতুন জীবনের সূচনা। একজোড়া এগিয়ে চলেছে নিজেদের দায়িত্বের সম্পর্কের মাঝে টুকরো ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে তো আরেকজোড়া এগিয়ে চলছে নিজেদেদ ভালোবাসার বিশালতায় দায়িত্বের ভেলা ভাসাতে।

সমাপ্ত||