স্রোতধারা পর্ব-১৮

0
410

স্রোতধারা
অষ্টাদশ_পর্ব
~মিহি

সৌহার্দ্য বাড়িতে ঢুকে মাত্র শুয়েছিল, এর মধ্যেই স্রোত এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। সৌহার্দ্যের বাবা কিংবা মায়ের দিকের আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। আর বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেও কারো সাথে যোগাযোগ নেই। বলতে গেলে নিশ্চুপ বিয়েবাড়ি মনে হচ্ছে তাদের বাড়িটা। স্রোতের বন্ধুরা এসেছে সকালবেলা। হৈ চৈ চলছেই। সৌহার্দ্য কিছুটা বিরক্ত এত ডাকাডাকিতে কারণ সারারাত ঘুমোয়নি সে। তার উপর আবার হাতের ব্যথা। দেখা গেল বিয়ের আসরে টুপতে থাকবে সে! কী বিশ্রি কাণ্ড হবে তখন! নিজের আজগুবি চিন্তা-ভাবনাকে সীমিত করে নিচে আসে সৌহার্দ্য। সারারাত নির্ঘুম থাকায় চোখ খানিকটা লাল দেখাচ্ছে। সৌহার্দ্যের বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই। স্রোতের বন্ধুরাই তার বন্ধু। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় জীবনের অধিকাংশ সময় তার একাকীই কেটেছে। স্রোতের বন্ধু বলতে ছয় জনের ফ্রেন্ড সার্কেল ওদের। পাঁচজনই ছেলে, তুষার, অভিক, মাহিদ আর শ্রাবণ। মেয়ে শুধু নিশি। সৌহার্দ্যের সাথেও ওদের সম্পর্ক বেশ ভালো। ছেলেদের মধ্যে অভিক একটু নির্লজ্জ আর ঠোঁটকাটা স্বভাবের। বাকিরা বেশ শান্ত। তবে অভিকই আসর জমাতে ওস্তাদ।

বাড়ির দুই ছেলের বিয়ে অথচ আত্মীয়-স্বজন নেই। বেশ মন খারাপ করেছিলেন শাহরীন চৌধুরী কিন্তু এখন ছেলের বন্ধুরা যেভাবে বাড়িটা মাথায় তুলেছে তাতে তার আনন্দের কুল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না।
ড্রয়িংরুমের মেঝে আপাতত আড্ডাস্থল হয়ে উঠেছে। মাঝখানে বসেছে দুই বর। তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে তুষার গীত গাইছে। সৌহার্দ্য আর স্রোত লজ্জায় মুখ টিপে হাসছে। তুষারের মেয়েলি কণ্ঠের গীত শুনে হাসি আটকাতে পারছে না কেউই। এরই মধ্যে অভিক আচমকা হেসে উঠলো। নিশি বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো,

“কীরে শাকচুন্নির জামাই? হাসলি ক্যান?”

“সেই একটা বাসর রাতের প্ল্যান পাইছি দোস্ত!”

“শালা অশ্লীল!”

“আরে শোন না কী করবো…”

“চুপ কর বেহায়া…”

“আরে শোন রে আগে।”

“বল।”

“বাসরে কী হয়?”

“তুই কি মাইর খাবি?”

“আরে সেটা না…মানে, বাসরে বরের গেট ধরে তো? আমরা ভাবীকে আটকাবো।”

“মানে কী?”

“ভাবী যখন বাড়িতে আসবে, আমরা টাকা না নিয়ে ভাবীকে বাসরঘরে ঢুকতে দিব না। সব নিয়ম খালি বরের বেলায় কেন?”

“আচ্ছা, একটা কথা বল। ভাবী যদি ঢুকতেই না চায়? অন্য ঘরেও তো শিফট হতে চাইতে পারে।”

“চাইবে না কারণ ভাবীর জামাই আগে থেকে বাসর ঘরে বসে থাকবে।”

অভিকের কথা শেষ হওয়ামাত্র সবাই হো হো করে হেসে উঠে। স্রোত আচমকাই বলে উঠে,”বুদ্ধি ভালোই। আমার বেলায় এটাই হবে। আর ভাইয়ার যেহেতু টাকা বেশি, ভাইয়ার গেট তোরা ধরিস।” সৌহার্দ্য বাঁকা চোখে তাকাতেই স্রোত চুপ হয়ে যায়। একটু পর শাহরীন চৌধুরী এসে সকলকে তাড়া দিতে থাকে রেডি হওয়ার জন্য। বিকেলের আগে বিয়ের যাবতীয় কার্যাদি শেষ করার ইচ্ছা তার।

ছেলের বাড়ি থেকে ছেলের বন্ধু ছাড়া কোনো আত্মীয় স্বজন আসবে না শুনে বেশ চমকালেন শায়লা আহমেদ। শাহরীন চৌধুরী পরে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন। ফোন রেখে শায়লা আহমেদ গেলেন তার ছোট মেয়ের কাছে। হায়ার মন ভালো নেই তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। দুই মেয়েকে তিনি নিজ হাতে সাজাবেন। পার্লারের ঐ কৃত্রিম সাজ তার অপছন্দ। ধারা এখনো গোসলে ব্যস্ত। হায়া গোসল সেরে বেরিয়েছে। অপরিপক্ক হাতে শাড়ির কুঁচি সামলানোর চেষ্টা করছে। শায়লা আহমেদ এসে হায়াকে বসালেন। আলতো করে মেয়ের কপালে চুমু দিতেই তার দুচোখ ভরে উঠলো নোনাজলে। বাচ্চাটা তার কত বড় হয়ে গেছে! প্রথম যখন হায়াকে কোলে নিয়েছিলেন তিনি তখন হায়ার মা মারা যাওয়ার বিরহে তার মন ভারাক্রান্ত তবুও হায়ার দিকে তাকিয়ে তিনি সব কষ্ট ভুলেছেন। হায়ার মধ্য দিয়ে তিনি পুনরায় মাতৃত্ব অনুভব করেছেন। একটাবারও তিনি এই চিন্তা করেননি যে হায়া তার নিজের সন্তান নয়। মায়ের চোখে পানি দেখে হায়ার মনটা কেঁপে উঠলো। যে ভয়ঙ্কর সত্য সে জেনেছে তা মায়ের মুখ থেকে একবার শুনতে ইচ্ছে করছে।

“মা, তোমার কষ্ট হচ্ছে?”

“এতগুলো বছর তোকে কখনো চোখের আড়াল হতে দিইনি রে মা। তোকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি?”

“আমি বিয়ে করে এখানে এসে থাকবো।”

“ধূর পাগলী মেয়ে। তা বললে চলে? এখানে যেমন তোর একটা পরিবার আছে তেমন ওখানেও একটা পরিবার হবে। তখন তোকে ঐ পরিবারের দায়িত্বটাও তো নিতে হবে।”

“মেয়েদেরই কেন যেতে হয় মা?”

“পাগলী রে। এটাই তো নিয়ম।”

কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন শায়লা আহমেদ। জমানো যত কথা যেন অশ্রু আকারে চোখ বেয়ে গড়াতে লাগল। কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল হায়া। মাকে সে কিছুতেই কোনো প্রশ্ন করবে না। এতবছর যে নির্মম সত্য তারা লুকিয়েছে, সে সত্য নিয়ে তাকে প্রশ্ন করে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না। অল্প সময়েই যেন হায়ার বয়স কয়েকগুণে বেড়েছে, পরিণত একটা হাবভাব এসেছে তার মধ্যে। ধারা গোসল সেরে বেরোতেই মা আর বোনকে দেখে মুচকি হাসলো। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,”হ্যাঁ হ্যাঁ সব আদর ওকেই দাও। বিয়ে তো আমার হচ্ছে না!হুহ!” শায়লা আহমেদ হেসে চোখের পানি মুছলেন। দুই মেয়ের দিকে তাকালেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে। আজ মেয়েদুটোকে রানীর মতো সাজাবেন তিনি। তার মেয়েরা তো কোনো রানীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

সকাল ১১ টায় বাড়িতে হৈ উঠে, “বর এসেছে..বর এসেছে।” ব্যস্ত শায়লা আহমেদ দরজায় যান। কাজিনরা সবাই যথারীতি গেট ধরে পঁচিশ হাজার টাকা ডিমান্ড করেছে। সবার বড় তিতির, সে-ই কথা বলছে। ওপাশ থেকে অভিক বলে উঠলো,”পঁচিশ হাজার যদি খালি বিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই লাগে, তাহলে তো বর বউকে পালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিলেই হতো।” অভিকের কথায় মুখ ভেঙচায় তিতির।

“আমাদের মেয়ে যার তার সাথে পালাবে না। যে ছেলে শালীদের পঁচিশ হাজার টাকা দিতে কিপ্টামি করে তার সাথে তো না-ই।”

“পঁচিশ হাজার টাকায় এক মাস সংসার চালানো যায় আর তোমরা সংসার চালু করার আগেই লুটতে আসছো!”

তিতির কিছু বলার আগেই পাশ থেকে ছোট একজন বলে উঠলো,”এই লম্বুটা এত কথা বলে ক্যান? তিতির আপা, এডার ব্যবস্থা করো।:” তিতির মুচকি হাসে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানানো জুসের গ্লাসটা অভিকের হাতে ধরিয়ে বলে,”মাথা ঠাণ্ডা করেন বেয়াই সাহেব।” অভিক সরল মনে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সম্পূর্ণ জুসটুকু খায়। অতঃপর কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেটে মোচড় অনুভব করে। অসহায় দৃষ্টিতে একবার তিতিরের দিকে তাকায়, একবার স্রোতের দিকে।

“বেয়ান সাহেব, গেটটা খোলেন।”

“টাকা চাই, টাকা চাই, টাকা ছাড়া বিয়ে নাই।”

“পায়ে ধরি আপা, খোলেন।”

“আগে টাকা…”

অভিকের পেটের মোচড়ামোচড়িতে তার আর নড়ার শক্তি নাই। বেচারা স্রোতের কানের কাছে গিয়ে বললো,” ভাই দোহাই লাগে! টাকাটা দে।” স্রোত শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,” কেন দিব? গাড়িতে আসার সময় তুই তো বলছিলি একটা টাকাও না দিতে। আমি দিব না টাকা।” ছলছল চোখে তাকালো অভিক। স্রোতের কানে কানে বললো, ” অবস্থাটা বোঝেক ভাই। আমার মান সম্মান তোর হাতে।” স্রোত হাসতে হাসতে টাকাটা দিতেই তিতির ফিতা সরালো। তিতিরের ফিতা সরাতে দেরি অভিকের ভিতরে দৌড় দিতে দেরি নাই। পেছন থেকে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। তিতিরের ঠোঁটের কোণে হাসিটা একটু বেশিই প্রসারিত। তিতির মনে মনে বলতে লাগলো,”বেয়াই সাহেব, ইয়ে তো বাস ট্রেইলার থা। পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।” কথাটা বলেই নিজের বুদ্ধির প্রশংসা নিজেই করলো। অতঃপর স্রোত এবং সৌহার্দ্যকে মিষ্টিমুখ করালো সবাই মিলে একেক করে।

চলবে…