সৎ মা পর্ব-০৫

0
227

#সৎ_মা (০৫)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

কেটে গেলো সাত টা মাস। আজকে থেকে আমার স্কুলের বার্ষিক পরিক্ষা শুরু হবে। এখন মা আর আমায় মারে না।‌ পড়ার জন্য ও কিছু বলে না। এখন মা নিজেই আমাকে পড়ায়। এমনকি আজকে মা ই আমায় পরিক্ষার প্রস্তুতি নেবার জন্য পীড়া দিয়েছে। হয়তো বুঝতে পারছে, আমাদের সাথে খুব খারাপ করেছে বা করছে তাই এখন আর খারাপ ব্যবহার করে না।

পরিক্ষা শেষ করে বাড়ি আসতেই মা আমায় আটকে বলল,”সিফাত প্রশ্ন টা দে ত।”
আমি প্রশ্ন টা মায়ের হাতে দিয়ে দিলাম। মা প্রশ্ন টা ভালো করে দেখে বলল,”প্রশ্ন ত দেখছি সহজ ই এসেছে আর যা যা পড়েছিলাম তা ই এসেছে। তা পরিক্ষা কেমন দিয়েছিস ?”
আমি বললাম,”অনেক ভালো পরিক্ষা দিয়েছি।”
– কি মনে হয় কত পাবি ?
– সঠিক বলতে পারবো না কিন্তু ৮০ এর উপরে পাবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে খাতা দিলে ই দেখা যাবে। এখন গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়।
– আচ্ছা ঠিক আছে।

দৌড়ে কল পাড় এসে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে খেয়ে নিলাম। তারপর দোকানে চলে গেলাম। সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ি গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসলাম। এভাবেই পরিক্ষা শেষ হয়ে গেল। কেটে গেল আরও তিন মাস। আজকে মায়ের বাচ্চা হবে তাই মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। আজকে মাকে খুব বেশি খুশি দেখাচ্ছে। বাবাকেও অনেকটা খুশি দেখাচ্ছে। আমার মনে ও কিছুটা খুশি লাগছে। কারণ সৎ মা হলে ও ত মা।

আমি আর বাবা হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছি। মাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স হাতে একটা বাচ্চা নিয়ে এসে বাবার হাতে দিয়ে বললেন,”এই নিন আপনার ছেলেকে আপনার কোলে নিন।”
বাবা খুব খুশি হয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে নার্স কে জিজ্ঞেস করলেন,”আমার স্ত্রী কেমন আছে ?”
– আপনার স্ত্রী ভালো ই আছে এখন।
– আমার স্ত্রীকে দেখতে পারবো কি এখন ?
– এখন না, একটু পর আমরা বলব ই তখন দেখা করতে পারবেন।
– ঠিক আছে।

নার্স চলে গেল। বাবা বাচ্চাটিকে আমার কোলে দিয়ে বলল,”নে তোর ভাইকে তোর কোলে নে।”
আমি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বাবাকে বললাম,”বাবা ওর নাম কি ?”
বাবা মুচকি হেসে বললেন,” এখনো ঠিক করিনি, আচ্ছা তুই ই একটা নাম ঠিক কর।”
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম,”মায়ের, শিফার আর আমার নামের প্রথম অক্ষর ই ‘স’ ও ‘শ’ দিয়ে শুরু তাই বলছিলাম ওর নাম যদি সিপন রাখা হয় তাহলে কেমন হয় ?”
– ঠিক আছে তাহলে সাতদিন পর আকিকার সময় হুজুরের সাথে কথা বলে দেখবনে তারপর দেখা যাবে।
– আচ্ছা।

কেটে গেল ছয় বছর। এখন আমি ওনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি। আর শিফা পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে। শিফার এখন ইন্টারে থাকার কথা কিন্তু মায়ের কারণে সে লেখা পড়ায় পিছিয়ে গেছে। তবুও মামা তাকে মামার কাছে নিয়ে গিয়ে তখন চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করতে পেরেছে বলে এখন সে নবম শ্রেণীতে আছে। সে এখন মামার বাড়িতেই থাকে। আর আমাদের ছোট ভাইয়ের নাম পরে সিপন ই রাখা হয়েছে। এখনো তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি।

শেষ তিন মাস যাবৎ দেখছি, মায়ের ব্যবহার কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। আবার আগের মত হয়ে যাচ্ছে। এখন বড় হয়ে গেছি বলে মারতে পারে ঠিকি কিন্তু বকাবকি করে আর মাঝে মধ্যে খাবার দেয় না। আমি এই ব্যপারে বাবাকে কিছু বলিনা। আজকে ভার্সিটি বন্ধ তাই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবো কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই। বাবা দোকানের মাল আনতে গেছে। তাই আমি মায়ের কাছে এলাম। মা আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলো,”কিছু বলবি কি ?”
আমি বললাম,”হ্যাঁ মা।”
– ঠিক আছে বল।
– মা আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবো কিন্তু টাকা নেই। কিছু টাকা দাও না।
মা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,”টাকা কি আকাশ থেকে পড়ে নাকি ?”
আমি বললাম,”আকাশ থেকে পড়বে কেন টাকা ত দোকান থেকে আসে।”
– খুব কথা বলতে শিখে গেছিস দেখছি।
– খুব কথা বললাম কই ?
– আবার মুখের উপর কথা বলিস দিব এক থাপ্পড়।
– মা তুমি না আগের থেকে পাল্টে গেছো। এখন আর আগের মত নেই তুমি।

মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি মায়ের কাছ থেকে আমার ঘরে এসে শার্ট টা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। সোজা শীতলক্ষার পাড় চলে এলাম। একটা কলা পাতা ছিঁড়ে তা বিছিয়ে বসে পড়লাম। আজকে খুব খারাপ লাগছে আর মায়ের কথা মনে পড়ছে। বাবার কামাইয়ের টাকা নিব আর ওনি আমায় জিজ্ঞেস করছে, টাকা আকাশ থেকে পড়ে কি না। আর আজকে যদি আমার মা বেঁচে থাকতো, তাহলে আর এই কথা বলতো না সাথে সাথে টাকা দিয়ে দিত। মন চাচ্ছে এখন মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে,”মা মা গো আজকে যদি আমি তোমার কাছে টাকা চাইতাম, তাহলে কি তুমি ও টাকা না দিয়ে জিজ্ঞেস করতে, টাকা কি আকাশ থেকে পড়ে কি না ? আজকে তোমার মুখের উপর কথা বললে কি তুমি ও বলতে, থাপ্পড় দিবে ? মা মা গো তুমি কেন আমাদের দুই ভাই-বোন কে এভাবে আরেক জনের কাঁধে বোঝা হিসেবে ফেলে রেখে চলে চলে গেলে গো ? তুমি কীভাবে পারলে আমাদের এভাবে ফাঁকি দিয়ে তুমি একা একা চলে যেতে ? তোমার কি একবার ও মনে বাঁধেনি যে, তুমি না থাকলে তোমার দুই অসহায় এতিম সন্তান ভালো থাকবে না ? কীভাবে পারলে গো তুমি এতটা স্বার্থপর হতে ? মা গো তুমি কি পারতে না আমাদের ও তোমার সাথে করে নিয়ে যেতে ? নাকি আমরা তোমার কাঁধে ও বোঝা ই ছিলাম যার কারণে আমাদের এভাবে কষ্টের সাগরে ফেলে রেখে তুমি একা একা সুখের তীরে চলে গেলে ?” কিন্তু জিজ্ঞেস করার মত সুযোগ আর নেই। বসা থেকে উঠে মায়ের কবরের দিকে হাঁটা ধরলাম।

মায়ের কবরের কাছে এসে মায়ের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। নিজের অজান্তেই কয়েক ফোঁটা চোখের পানি গাল বেয়ে শার্টের উপর পড়লো। মায়ের কবর স্পর্শ করে বললাম,”মা মা গো তোমার সন্তান আজ অনেক দিন পর তোমার কাছে কিছু চাইতে এসেছে। ভয় নেই মা তোমার সন্তান তোমার কাছে তোমার সাধ্যের বাহিরে কিছু ই চাইবে না। শুধু একটু দোয়া চাইবে। মা মা গো, তুমি তোমার সন্তানের জন্য দোয়া করো মা। তোমার সন্তান যেন সুস্থ সবল ভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তোমার সন্তান যেন তোমার স্বামীর মুখ উজ্জ্বল করতে পারে, তোমার সন্তান যেন যেকোনো ধাপ খুব সহজেই অতিক্রম করে ফেলতে পারে। শেষ একটা চাওয়া, তুমি দোয়া করো যেন তোমার সন্তান যেকোনো পরিস্থিতিতে ইং দুর্বল হয়ে না পড়ে। আর কিছু চাইবো না মা। তুমি ভালো থেকো মা।”

মায়ের কবরের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছে মায়ের জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দোয়া করলাম। তারপর কবর স্থান ত্যাগ করে রশিদ চাচার দোকানে এসে কিছু টাকা নিয়ে গিয়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে বাড়ি চলে এলাম। ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে থাকতে থাকতে এক সময় চোখে ঘুম এসে ভর করে। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বলতে পারবো না।