সৎ মা পর্ব-১৯

0
236

#সৎ_মা (১৯)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

আস্তে আস্তে চলে এলো আরিফের গাঁয়ে হলুদের দিন। আজকে আমি মোটামুটি সুস্থ আছি। সকাল থেকে ই আরিফের সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করছি। রাতে গাঁয়ে হলুদ অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি চলে আসি।

পরের দিন খুব সকালে আরিফ ফোন দিয়ে বলল, তারাতাড়ি তার বাড়ি যেতে। আমি তারাতাড়ি আরিফের বাড়ি চলে এলাম। তারপর সব ঝামেলা মিটিয়ে আরিফকে গোসল করিয়ে আমি বাড়ি চলে আসি। বাড়ি থেকে তৈরি হয়ে বাবা-মা, সাদ্দাম ভাই ও সাথী কে নিয়ে আবার আরিফের বাড়ি চলে আসি। তারপর সবাই মিলে নরসিংদীর উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।

অবশেষে চলে এলাম আরিফের হবু শশুর বাড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই বুক টা ধুক করে উঠলো। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, এটা আমার চিরপরিচিত একটা বাড়ি। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম এটা আমাদের ই বাড়ি। যেই বাড়ি থেকে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল। এখন মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন এখানে আবার কাকে বিয়ে করবে সে ? আমার জানামতে তো এখানে বিয়ের উপযোগী মেয়ে নেই। আর সেই দিন যেই মেয়েকে দেখেছি, ওই মেয়ের বয়সী মেয়ে আমাদের বাড়ির চারপাশে নাই। এসব ভাবছি, হঠাৎ পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। কিছু টা চমকে উঠলাম। কিন্তু পরে পেছনে তাকিয়ে দেখি এটা আকিব। সে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলো,”সবাই গেইটের কাছে চলে গেছে তুই আসছিস না কেন ? তোকে ছাড়া ত মজা হবে না রে।”
– আচ্ছা দোস্ত, আমাদের বাড়িতে কে এমন বিয়ের উপযোগী মেয়েরে ?
– এই প্রশ্ন ত আমার মাথায় ও ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা তোর সৎ মায়ের বোনের মেয়ের সাথে আবার আরিফের বিয়ে হচ্ছে নাকি ?
– তাদের বাড়ি ত ঢাকায়, বিয়ে হলে ঢাকায় হবার কথা এখানে না।
– যদি তোর মা বলে তাহলে তো আর ওরা আপত্তি করবে না।
– হতে পারে।‌
– আচ্ছা, পরে দেখা যাবে আগে তুই গেইটে চল।

আকিবের সাথে গেইটের সামনে আসতেই গেইট আটকে রাখা ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা খুব পরিচিত মুখ দেখতে পেলাম। কিন্তু কে সে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। সে ও দেখছি আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ, “সিফাত” বলে চিৎকার দিয়ে সে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। হই হুল্লোড় এ মেতে উঠা গেইট টা মেয়েটির এক চিৎকারে একদম নীরব হয়ে গেছে। সবাই শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিফ মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,”আরে তানিয়া আপু তুমি সিফাত কে চেনো নাকি ?”
তানিয়া নাম শুনতে ই তার মুখের দিকে ভালো করে তাকালাম। দেখি তার চেহারা অনেকটা ই পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই চিনতে পারিনি। তানিয়া এবার আরিফের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,”আরে ভাইয়া আপনি যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তার বড় ভাই সে।”

তানিয়ার কথায় আমি ও আরিফ দুজনে ই অবাক হলাম। শুধু আমরা দুজন ই না।‌ এখানে থাকা প্রত্যেকেই অবাক হয়েছে। আর কিছু শোনার অপেক্ষা না করে তানিয়ার হাত ধরে সোজা বাড়ির ভেতর দৌড় দিলাম। দৌড়ের মধ্যে ই তানিয়া কে বললাম, শিফার কাছে নিয়ে যেতে। সে আমাকে শিফার কাছে নিয়ে এলো।

নিজের বোন কে ই চিনতে পারছি না। সেই ছয় বছর আগের শিফা আর আজকের শিফার মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে‌। শিফা ও আমাকে দেখে চিনতে পারলো না। সে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তানিয়া শিফাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,”এটা কে বলতে পারবি শিফা ?”
শিফা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ই বলল,”না ত। কে ওনি ?”
তানিয়া আবার বলে উঠলো,”নিজের ভাই কে চিনতে পারছিস না তুই!”
শিফা সাথে সাথে ই ভাইয়া বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ও তাকে জড়িয়ে ধরলাম।‌ দুজনের চোখ দিয়ে ই পানি পড়তে লাগলো।‌ তানিয়া গিয়ে আমার বাবা, মামা-মামী কে ডেকে আনলো।

সবার সাথে কিছুক্ষণ পর কথা বললাম। সবাই শুধু জিজ্ঞেস করছে,”এতদিন কোথায় ছিলি ? কীভাবে ছিলি ? এখন কি করিস ?” এসব প্রশ্ন শুনতে শুনতে মাথা ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। কোনোরকমে বললাম,”এসব এখন না পরে বলবো আগে শিফার বিয়ে সম্পন্ন হোক।”
এতক্ষণ শিফা কিছু বলেনি। শুধু চুপ করে আমাদের কথা শুনছিল। এবার সে বড্ড অভিমান নিয়ে বলে উঠল,”তোমার সাথে আমি কখনো কথা বলবো না।”
– কেন রে বোন ?
– যাও তুমি কথা বলবে না। তুমি আমার ভাই না।
– কেন আমি কি করেছি হ্যাঁ ?
– কি করোনি তুমি ?
– আরে করেছি টা কি ?
– না কিছু করোনি। তুমি যদি আমার ভাই হয়ে থাকতে, তাহলে কীভাবে পারলে এতদিন দূরে থাকতে ? তুমি যদি আমার ভাই হতে, তাহলে একবার হলে ও এসে দেখে যেতে। আমি কেমন আছি তা জানতে চাইতে। কিন্তু তুমি তা করোনি। তারমানে তুমি আমার ভাই না।
বলে ই সে কান্না করে দিল।‌ আমি কিছু বলতে পারলাম না কারণ, সে কোনো ভুল বলেনি। আমি কারো ভাই হবার যোগ্য নই। আমি যদি সত্যি ই কারো ভাই হয়ে থাকতাম, তাহলে বোন কে না দেখে, বোনের খোঁজ না নিয়ে থাকতে পারতাম না। শিফার সাথে কথা বলার মুখ টা ও আমার নেই। কোন মুখে কথা বলবো ? কি অধিকারে বলবো ? ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। সবাই একদম নির্বাক হয়ে গেছে।

কিছু না বলে তানিয়া কে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। বাহিরে তানিয়া আমায় জিজ্ঞেস করল,”কি রে তুই আমায় বাহিরে নিয়ে এলি কেন ?”
– একটু বাড়ির বাহিরে আয় তোর সাথে কথা আছে।
– কি কথা এখানে ই বল।
– না। এখানে অনেক মানুষ আছে তাই এখানে কিছু বলা যাবে না।
– আচ্ছা চল।

তানিয়া কে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে এলাম। তানিয়া আমায় বলে উঠলো,”কি বলবি এবার বল।”
– শোন, বোন আমি এখন এই বাড়ি থেকে চলে যাবো। তুই যেভাবে ই হোক না কেন, আরিফের সাথে শিফার বিয়ে সম্পন্ন করবি। আর শোন, আমি নিশ্চিত আমার সৎ মা টা এখানে কোনো না কোনো ঝামেলা করবে ই। যত ঝামেলা ই করুক না কেন তুই সব ঝামেলা মিটমাট করবি।
তানিয়া অবাক হয়ে বলল,”চলে যাবি মানে ?”
– হ্যাঁ চলে যাবো।
– নিজের বোনের বিয়ে রেখে কীভাবে যেতে পারবি তুই ?
– শুনিস নি তখন, আমি তার ভাই নই ?
– সে ত শুধু একটু অভিমান করে বলেছে।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,”নারে তানিয়া এটা শুধু মাত্র অভিমানের কথা নয় এটা সত্যি কথা। আমার মতে শিফা কোনো ভুল বলেনি। আসলে, আমি কারো ভাই হবার যোগ্য ই নই। যদি কারো ভাই হবার যোগ্য হতাম, তাহলে দীর্ঘ ছয় বছর বোনকে না দেখে থাকতে পারতাম না।”
তানিয়া দুহাতে আমার গালে ধরে বলতে লাগলো,”দেখ সিফাত, তুই শিফার কথা গুলো এতটা গভীর ভাবে নিস না। সে ছোট মানুষ, অভিমানের কারণে কি না কি বলেছে তা সে নিজেও জানে না।”
– যাইহোক না কেন আমি চলে যাচ্ছি। আর তোকে যা বলেছি তুই তা করিস বোন।

তানিয়া ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলতে লাগলো,”এই এই চলে যাচ্ছি মানে কি হ্যাঁ ? ছোট বোনের সামান্য কথায় এতটা কষ্ট পাচ্ছিস আর তোর এই ছোট বোন টা যে কতটা কষ্ট পেয়েছে তা কি একবার দেখেছিস ?”
আমি কিছু বললাম না। কারণ, আমার বলার মত এখন কিছু ই নেই। তানিয়া আবার ও বলতে লাগলো,”সেই ছয় বছর আগে যখন তুই তোর সার্টিফিকেট নিয়ে চলে গিয়েছিলি, এর একমাস পর থেকে ই তোর বোন তোর কান্না করতো। গত ছয় বছর যাবৎ, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর মোনাজাতে বসে কান্না করে বলতো,’আল্লাহ, আল্লাহ গো, তুমি আমার ভাই কে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ। আমি আমার ভাই কে না দেখে আর থাকতে পারছি না। আল্লাহ্ আমি জানি না আমার ভাই কেমন আছে, কোথায় আছে। আল্লাহ্ আমি এসব জানতে চাই না। আমি চাই শুধু, আমার ভাই একবার এসে আমাকে বোন বলে জড়িয়ে ধরুক। আল্লাহ্ তুমি দরকার পড়লে আমার মৃত্যুর বিনিময়ে আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও।‌’ আর অনেক কিছু বলতো। যা শুনলে চোখের পানি ধরে রাখা যেত না। তুই যদি একবার দেখতি তাহলে বলতে পারতি।”
আমি যেন একদম বোবা হয়ে গেলাম। যে বোন আমার জন্য কান্নাকাটি করে আমি সেই বোনের সামান্য একটা কথায় এতটা অভিমান করলাম। আবার ও প্রমান পেলাম আমি আসলে ই কারো ভাই হবার যোগ্য নই। তানিয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,”ঠিক আছে, চলে যা। আমি না হয় শিফাকে কোনো রকমে বুঝিয়ে দিব যে, তার ভাই বলে কেউ ছিল না। যে ছিল সে একটা পাষাণ। তার মন বলতে কিছু নেই। সে একটা পাথরের ন্যায়। কারণ, তার যদি মন থাকতো তাহলে তার বাবা আর বোনকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারতো না।”

তানিয়া কথা গুলো শেষ করে ই চলে যেতে লাগলো। আমি আগের জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে তানিয়ার কথা গুলো মনে মনে কল্পনা করতে লাগলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম কে যেন আমার পেছন থেকে চলে গেল।‌ পেছনে ফিরে দেখলাম একটা মহিলা যাচ্ছে বাড়ির দিকে।‌ হয়তো তিনি এতক্ষন আমাদের কথা শুনেছিল কিন্তু আমরা দুজন তা লক্ষ্য করিনি।

চলবে।