সৎ মা পর্ব-১৮

0
218

#সৎ_মা (১৮)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

অবশেষে সবাই ঢাকা চলে এলাম। আকিব আর নাদিয়াকে নামিয়ে দিয়ে আরিফ আমাকে বাড়ি রেখে চলে গেল। চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে রইলাম। শরীর ক্লান্ত ছিল তাই ঘুম লেগে গিয়েছিল।

ঘুম ভাঙ্গার পর মাথা টা ভার ভার অনুভব করতে পারলাম। শরীরে ও শক্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আমার গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কষ্ট করে মা কে ডাক দিলাম। কিন্তু মায়ের কোনো সারা শব্দ নেই। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি এশার নামাজের সময়। তারমানে মা এখন নামাজ পড়ছে। তাই আর ডাকলাম না।

কিছুক্ষণ মা এলো। এসে ই জিজ্ঞেস করল,”কি রে কি হয়েছে এভাবে ডাকতেছিলি কেন ?”
– কিছু হয়নি মা। মাথা টা একটু ভার ভার লাগছে। আর শরীরে শক্তি পাচ্ছি না।
মা এসে আমাকে উঠিয়ে বসানোর জন্য ধরল। সাথে সাথে বলল,”কিরে সিফাত, তোর শরীরে দেখি প্রচন্ড জ্বর।”

বলে ই মা আমাকে শুইয়ে রেখে চলে গেল। বুঝতে পারলাম, জ্বরের জন্য ই মাথা ভার ভার লাগছিলো। সাথে শরীরে ও জোর পাচ্ছিলাম না। কিন্তু মা আমাকে এই অবস্থায় রেখে কোথায় চলে গেল আবার ?

আনুমানিক তিন থেকে চার মিনিট পর মা একটি বালতি ভর্তি পানি নিয়ে এলো। আমাকে খাটের কোণে শুইয়ে মাথায় পানি দিতে লাগলো।

প্রায় ত্রিশ মিনিট পানি দিয়ে মাথা মুছিয়ে সুন্দর করে শুইয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর কিছু ফল নিয়ে এসে আমাকে খেতে বলল।‌ কিন্তু আমি খেতে পারছি না। মা জোর করে খাইয়ে দিয়ে জ্বরের ঔষধ খাইয়ে আমার মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। আবার ও চোখে ঘুম লেগে গেল।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল। এখনো গায়ে জ্বর আছে। চোখ খুলে দেখি মা এখনো আমার মাথার পাশে বসে ই আছে। আমি জানি যে, ওনি সারারাত ই এখানে ছিলেন আর রাতের খাবার টা ও খায়নি। তাও জিজ্ঞেস করলাম,”সারারাত কি এখানেই ছিলে নাকি ?”
– অসুস্থ ছেলেকে একা রেখে অন্য কোথাও থাকতে পারি নাকি ?
– রাতে খেয়েছিলে ?
– হ্যাঁ।
– মিথ্যা বলো না। তোমার চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তুমি খাওনি।
– তুই খাসনি তোকে রেখে আমি কীভাবে খাই বল ?
– আমি না খেলে তোমাকে ও কি খেতে হবে না নাকি ?
– সন্তান না খেলে, মা খেতে পারে না রে বাবা। সন্তান না খেলে খেতে গেলে, খাবার গলায় ই আটকে থাকে গলার নিচে আর নামে না।

কথা আর বাড়ালাম না। কারণ জানি, এখন কিছু বলে কুলিয়ে উঠতে পারবো না। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল দশটা বাজে। বেলা অনেক হয়ে গেছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,”বাবা, ভাইয়া আর সাথী কোথায় ?”
– তোর বাবা গেছে বাজার করতে, তোর ভাইয়া কার সাথে যেন দেখা করতে গেছে আর সাথী রান্না করছে।
– রান্না হলে খেয়ে নিও।
– আচ্ছা।
– সারারাত ত মনে হয় ঘুমানোর সৌভাগ্য হয়নি। এখন যাও গিয়ে ঘুমাও।
– আমি ঘুমালে তোর দেখা শুনা করবে কে ?
একটু জোরে বলে উঠলাম,”আমার দেখা শুনা করতে হবে না। তোমাকে যা বলেছি তা ই করো।”
– ঠিক আছে, ঠিক আছে যাচ্ছি। তবুও এই চিল্লাচিল্লি করিস না নয়তো তোর ই ক্ষতি হবে।

বলে ই মা চলে গেল। বিছানা থেকে ফোন টা নিয়ে দেখি আরিফের অনেক গুলো ফোন এসেছে। তারাতাড়ি তাকে ফোন দিলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর সে ফোন ধরে ই বলে উঠলো,”ওই বেটা মোবাইল কই থাকে তোর ? কতগুলো ফোন দিয়েছি খবর আছে ?”
– আরে দোস্ত জ্বর এসেছিল, আর তাছাড়া মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল তাই খোঁজ পাইনি।
– জ্বর কখন এসেছে ?
– কালকে রাতে।
– এখন কি অবস্থা ?
– এখনো শরীরে জ্বর তবে কালকে রাতের চেয়ে কিছুটা কম আছে এখন।
– কালকে রাতে জ্বর আসছে আর তুই আমায় এতক্ষণে জানাস।‌ আচ্ছা আমি আসতেছি‌।

কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরিফ ফোন কেটে দিল।‌ সাথী খাবার নিয়ে এসে বলল হাত মুখ ধুয়ে আসতে। শরীরে শক্তি নেই তাই উঠতে কষ্ট হচ্ছে দেখে সাথী আমাকে ধরে উঠিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো,”ভাইয়া বিয়ে করে নিতে পারো না ?”
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,”কেন বলতো ?”
সাথী মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,”এই ধরো, বিয়ে যদি করতেই তাহলে আজকে তোমার কষ্ট করে বাথরুমে যেতে হতো না।‌ বরং ভাবি ঘরে ই তোমার হাত মুখ ধুয়িয়ে দিত।”
– করবো রে বোন করবো। বিয়ে করবো। আগে আমার বোন, মামা-মামী আর মামাতো বোন কে খুঁজে বের করি তারপর সব ই করবো।
– তখন ত আমাদের ভুলে ই যাবে।
কিছুক্ষণ সাথীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,”নারে বোন আমি মানুষের মত স্বার্থপর নই।”
– স্বার্থপর হতে সময় লাগে না।

কিছু আর বললাম না। কারণ, সাথী যা বলেছে তা হয়তো সত্যি। আবার মিথ্যা ও হতে পারে। কিন্তু তার কথাটা কলিজায় বিঁধেছে। সাথীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে নিজে ই উঠে পরলাম। সাথী হয়তো বুঝতে পেরেছে। বুঝার ই কথা কারণ, সে ত আর দুধের শিশু না। সে আমার হাত খাবলা দিয়ে ধরে বলতে লাগলো,”ভাইয়া আমি মজা করছিলাম। আমি ভাবিনি ও বুঝতে পারিনি আমার মজা করা টা তোমায় আঘাত করবে। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
– ঠিক আছে। তবে কারো সাথে ই এমন কোনো মজা করবি না যে, সে কষ্ট পাবে। আর শোন, সবাই কিন্তু স্বার্থপর হয় না। আমার স্বার্থপর হওয়ার হলে সেই কবে ই হয়ে যেতাম। আচ্ছা তুই গিয়ে তোর কাজ কর।
– তোমাকে খাইয়ে দিয়ে তারপর যাবো‌।
– আমাকে খাইয়ে দিতে হবে না। আমি নিজে ই খেয়ে নিতে পারবো।‌
সাথী ছল ছল নয়নে বলল,”বুঝেছি, আমাকে ক্ষমা করোনি এখনি।”
– ক্ষমা করে দিয়েছি।
– মিথ্যা কথা।
– আরে না সত্যি ই।
– সত্যি ক্ষমা করলে এভাবে বলতে না।
– আরে বললাম তো সত্যি ক্ষমা করে দিয়েছি।
– তাহলে চলো আমি তোমায় বাথরুমে দিয়ে আসছি।
– আমি একা যেতে পারবো, তুই এক কাজ কর মাকে খেতে বল গিয়ে।
– ঠিক আছে। কিন্তু খেয়ে নিও কিন্তু।
– তোর ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

আর কিছু না বলে কোনোরকমে বাথরুমে চলে এলাম। হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই দেখি আরিফ চলে এসেছে। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে ধরে খাটে নিয়ে বসিয়ে দিল।‌ আমি তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,”কি রে এত গুলো ফোন দিয়েছিস কেন ?”
– আরে বেটা আজকে ওই মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছে তাই তোকে ফোন দিয়েছি যাবার জন্য।
– ওহ্ আচ্ছা।
– হ্যাঁ। এসব রাখ, আগে বল আমাকে কি একটা বার জানাতে পারলি না যে, তোর জ্বর এসেছে ?
– আরে দোস্ত এমন জ্বর এসেছিল যে, আমি কোনো হুঁশে ই ছিলাম না প্রায়।
– আচ্ছা। যাইহোক শোন, একটা খুশির খবর আছে।
– কি খুশির খবর ?
– দোস্ত মেয়েটা রাজি হয়ে গেছে। বলেছে আজকে আমার পরিবার নিয়ে তার বাড়িতে গিয়ে বিয়ে ঠিক করতে।
আমি তার পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললাম,”আরে দোস্ত অভিনন্দন। এত বড় একটা খুশির খবর নিয়ে এসেছিস কিন্তু মিষ্টি কই হ্যাঁ ?”
– আরে বেটা, এখন ই মিষ্টি মিষ্টি করিস না। আগে বিয়ে করি তারপর না হয় যতক্ষণ পারিস মিষ্টি খাস।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– হ্যাঁ। বিকেলে তুই আমাদের সাথে যাবি।
– যদি সুস্থ হই তাহলে যাবো।‌
– দোয়া করি সুস্থ হয়ে যাবি ইনশাল্লাহ।

দুজনে মিলে কথা বলতে লাগলাম। মাঝখান দিয়ে আমি সকালের নাস্তা করে ঔষধ খেয়ে নিলাম। আরিফ কে ও খেতে বলেছিলাম। কিন্তু সে নাকি খেয়ে এসেছে। আমি বলেছি দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যেতে। সে প্রথমে রাজি হয়নি। অনেকক্ষণ জোরাজুরি করার পর রাজি হয়ে যায়।

বারোটা বাজতে ই আরিফের একটা জরুরী ফোন আসে। তাই তাকে চলে যেতে হয়। কিছুক্ষণ পর থেকে আবার শরীরে জ্বর জ্বর অনুভব করতে লাগলাম। মা ঘুমিয়েছিল তাই সাথিকে ডাক দিলাম। সে আমার মাথায় পানি দিয়ে দিল। কিন্তু জ্বরের কোনো কমতি নেই। জ্বর ক্রমশ বাড়তে ই লাগলো।

বিকেলে আরিফ আমায় নিতে আসলো।‌ এসে দেখে আমার খুব জ্বর তাই বলতাছে আজকে আর যাবে না। আমি জোরাজুরি করে পাঠালাম। তার এক কথা সে আমাকে ছাড়া বিয়ের কথা বলতে যাবে না।‌ কিন্তু অবশেষে আমার কাছে হার মেনে যেতে হয়।

প্রায় ঘন্টা তিনেক পর আরিফ আমাকে ফোন দিয়ে বলতে লাগলো,” দোস্ত বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী দশদিন পর আমাদের বিয়ে।”
– বাহ্ খুব ভালো লাগলো। তা ভাবি কেমন রে ?
– সেটা না হয় সামনাসামনি ই দেখিস।‌
– আচ্ছা।
– আরও একটা খুশির খবর আছে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”আবার কি খুশির খবর ?”
– খুশির খবর হলো, আমি তোর জন্মভূমি নরসিংদীতে ই বিয়ে করছি।
– কি বলছিস ?
– হ্যাঁ।

বেশি কথা বললাম না। কারণ, আমার শরীরে জ্বর। আরিফ নিজে থেকে ই কল কেটে দিয়ে আমার বাড়ি চলে এলো। বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করে চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে গেছে আকিবের বাড়ি যাচ্ছে আকিবদের দাওয়াত করার জন্য।

চলবে।