#সৎ_মা (২১/অন্তিম)
#সামসুজ্জামান_সিফাত
আজকে ব্যাংক বন্ধ তাই একটু শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ সাথী এসে ডাকতে লাগলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,”কি হলো, অযথা ঘুম ভাঙালি কেন ?”
– তোমাকে তোমার বাবা ডাকছে।
– আচ্ছা তুই যা আমি আসছি।
– তারাতাড়ি আসো।
সাথী চলে গেল। আমি উঠে হাত মুখ ধুতে এলাম। এখন সাথীর বাবা-মা কে, আব্বু-আম্মু বলে ডাকি। আর আমার বাবাকে বাবা বলে ই ডাকি। সৎ মা কে ও মা বলে ই ডাকি।
হাত মুখ ধুয়ে চলে এলাম বাবার কাছে। বাবা আমাকে দেখে ই বলে উঠলো,”বস এখানে, তোর সাথে কথা আছে।”
আমি বসে জিজ্ঞেস করলাম,”হ্যাঁ বলো কি কথা ?”
– শোন, আমার বয়স হয়ে গেছে আর তোর ও বয়স ভালো ই হয়েছে, তাই ভাবছি তোকে বিয়ে দিয়ে দিব।
– তোমার যা ইচ্ছে, তাহলে মেয়ে দেখতে শুরু করো।
– মেয়ে দেখা লাগবে না।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কেন ?”
– মেয়ে দেখা হয়ে গেছে।
– তাহলে তো হলো ই। এখন বিয়ের তারিখ ঠিক করো।
– বিয়ের তারিখ ঠিক করা আছে, আজকে বিয়ে।
– আচ্ছা। আমি যাই তাহলে এখন ?
– যাবি ভালো কথা মেয়ে কে তা জানতে চাইলি না ?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,”যেখানে আমার বাবা মেয়ে দেখেছে সেখানে আমার জানার দরকার নেই যে, মেয়ে কে।”
আর কিছু না বলে বা না শুনে চলে এলাম আমার ঘরে। প্রথমেই আরিফ কে ফোন দিলাম আমাদের বাড়ি আসতে। আরিফের আরও এক মাস আগে ই চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু শিফা বলে কয়ে আরও তিনমাসের ছুটি নিয়ে নিল। আরিফের সাথে কথা বলে আকিব কে ফোন দিয়ে আসতে বললাম।
একটু পর সাথী খাবার নিয়ে এলো। প্রতিদিন তানিয়া খাবার দিয়ে যায় আর আজকে হঠাৎ সাথী খাবার নিয়ে আসায় একটু অবাক হলাম। সাথী কে জিজ্ঞেস করলাম,”কিরে আজ তানিয়া কোথায় ?”
– কেন ?
– প্রতিদিন তানিয়া খাবার দিয়ে যায়। আজকে তানিয়ার পরিবর্তে তুই, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
– ওহ্, আচ্ছা এখন খেয়ে নাও আমার কাজ আছে আমি যাই।
– ঠিক আছে যা।
সাথী চলে যায়। আমি খেতে লাগলাম। প্রায় খাওয়া শেষ এমন সময় আরিফ আর আকিব চলে এলো। আমি তাদের দেখে জিজ্ঞেস করলাম,”কিরে তোরা দুইটায় একসাথে কীভাবে ?”
– এত কিছু তোর জানতে হবে ন। তা আমাদের এত সকালে আসতে বলার কারণ কী ?
– আরে বেটা আজকে আমার বিয়ে তাই।
আরিফ আর আকিব দুজনে ই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,”কি বলিস ?”
– হ্যাঁ।
আকিব আমার মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল,”মজা করার আর জায়গা পাস না নাকি ?”
– মজা করতে যাবো কেন ?
আরিফ জিজ্ঞেস করল,”তাহলে সত্যি ই আজকে তোর বিয়ে ?”
– হ্যাঁ।
– আমাদের আগে জানাতে না কেন ?
– আমি নিজে কি জানতাম নাকি ?
দুজনে ই একসাথে বলে উঠল,”মানে! তোর বিয়ে আর তুই জানতি না ?”
– না রে দোস্ত, সকালে আব্বু ডেকে নিয়ে বলল যে, আজকে আমার বিয়ে তাই তোদের ডাকলাম।
আরিফ জিজ্ঞেস করলো,”তা ভাবির নাম কি, বাড়ি কই ?”
– এত কিছু জানিনা। শুধু জানি যে আজকে আমার বিয়ে।
– তাহলে তো তোর কিছু কেনা কাটা ই হয়নি। তারাতাড়ি খাওয়া শেষ কর তারপর কেনা কাটা করতে বের হবো।
– আচ্ছা।
তারাতাড়ি খেয়ে তিনজনে মিলে বেরিয়ে গেলাম কেনা কাটা করতে। দুই আড়াই ঘন্টার মত কেনা কাটা করে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি আসার পর আরিফ আর আকিব মিলে গোসল করিয়ে দিলো। তারপর ঘরে নিয়ে এসে সাজাতে লাগলো। হঠাৎ, সাথী এসে বলল,”এত সাজতে হবে না। আমরা আর বরযাত্রী যাচ্ছি না। বিয়ে হবে বাড়িতে ই।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,”বাড়িতে ই মানে ?”
– হ্যাঁ বাড়িতে ই।
পাশ থেকে আরিফ জিজ্ঞেস করে উঠলো,”পাত্রী কে ? মানে আমাদের ভাবি টা কে ?”
– আপনার ভাইয়ের মামাতো বোন তানিয়া।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কি বলছিস তুই ?”
– হ্যাঁ যা সত্যি তা ই বলছি।
– তানিয়ার মত আছে কি ?
– সে ই ত বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
– ওহ্ আচ্ছা।
আর সাজগোজ হলো না। ইতি মধ্যে শিফা ও চলে এসেছে। শিফা গিয়ে তানিয়া কে সাজাতে লাগলো সাথে সাথী ও। আমাকে সাজতে বারণ করে ওনারা গিয়ে তানিয়াকে সাজাচ্ছে।
যোহরের নামাজের পর বাবা গিয়ে কাজী সাহেব কে নিয়ে এলেন। তারপর আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। কাজী সাহেব চলে যাবার পর মা এসে আমার পায়ে পড়লো। কিছু ই বুঝলাম না আমি। হঠাৎ করে আমার পায়ে পড়লো কেন ? আমি মাকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কি হয়েছে মা, হঠাৎ আমার পায়ে পড়লে কেন ?”
মা কান্না করে দিয়ে বলল,”বাবা তুই আমায় বেঁচে থাকার একটা সুযোগ করে দে। আমি তোর পায়ে পড়ি বাবা তুই আমার প্রতি দয়া কর। আমি আর পারছি না।”
মা এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে আবার ও আমার পায়ে ধরতে যাবে ঠিক সেই সময় আমি আটকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কি হয়েছে মা, হঠাৎ এমন করছো কেন ?”
এতক্ষণ সব কিছু ই আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। মা বলতে লাগলো,”বাবা আজ কিছু সত্যি ও গোপন কথা শোন, যা কি না আমি, তোর বাবা আর শিপন এই তিনজন ছাড়া আর কেউ ই জানি না।”
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। কি এমন গোপন কথা যে, ওরা তিনজন ছাড়া আর কেউ ই জানে না। আর সেই কথা আজকে যা সবার সামনে ই আমার কাছে প্রকাশ করতে যাচ্ছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,”কি এমন গোপন কথা যে, তোমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ ই জানো না ?”
মা চোখের পানি মুছে নিয়ে বলতে লাগলো,”বাবা রে, যেদিন তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, এর ঠিক ছয়মাস পর তোর বাবা সব সত্যি জানতে পারে। তারপর থেকে শুরু হয় আমার আর শিপনের উপর অত্যাচার। তোকে আর তোর বোনকে যেভাবে আমি মারধর করতাম, ঠিক সেভাবেই তোর বাবার আমার সামনে আমার ছেলে শিপনকে মারে। সেই থেকে শুরু হয়েছে এখনো মারধর ই করে। শুধু এ ই নয়। আমাকে ও প্রতিদিন তিন বেলা মারধর করে। আমার করা রান্না খেতো না। তোর বাবা হোটেল থেকে খেয়ে আসতো। আমার রান্না করা খাবার খেতে বললে বলত,’তোর ওই অপবিত্র হাতের রান্না আমি খাবো না। তুই তোর ওই পাপের ফসল ছেলেকে নিয়ে ই খা।’ বলে ই মারতে শুরু করতো। আমি তালাক চাইলে তালাক দিত না। আর বলতো,’তোকে আমি এত সহজে তালাক দিব না। তুই আমার ছেলে মেয়েকে অনেক মারধর করেছিস,আমার নির্দোষ ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করেছিস, আমি তোকে এত সহজে ছাড়বো না। তোকে আমি একটু একটু করে আঘাত দিয়ে শেষ করবো। তোকে আমি বুঝিয়ে দিব আমার ছেলে মেয়েরা কত টুকু কষ্ট পেয়েছে, কত টুকু আঘাত পেয়েছে।’ ভালো মন্দ খেতে দিত না, পড়তে দিত না। এখন তোর সাথে আছি বলে ভালো মন্দ খেতে পারি, পড়তে পারি। তোর বাবা আমার সাথে এক খাটে থাকে না। বলে,’ তোর মত নষ্টা আর অপবিত্র মহিলার সাথে আমি থাকতে পারবো না।’ বলে ই কিছুক্ষণ মারধর করে নিচে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এখনো আমি শান্তি পাচ্ছি না বাবা। তোর বোনের বিয়ের দিন আমি শুধু মাত্র আমাদের উপর করা অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য করেছি। তারপর থেকে আরও খারাপ অবস্থা আমার ও আমার ছেলের।”
বলে ই মা শিপনকে এনে তার গায়ের শার্ট খুলতেই দেখি তার গায়ে অনেক জায়গায় পুড়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ জলন্ত সিগারেট দিয়ে ছেঁকা দিয়েছে। তারপর মা তার শাড়ি সরিয়ে ব্লাউজের বোতাম খুলে দেখালো, তার পিঠে ও একি অবস্থা। আমি জিজ্ঞেস করলাম,”তোমাদের শরীরের এই অবস্থা কেন ?”
মা কাঁদতে কাঁদতে বলল,”তোর বাবা প্রতিদিন আমাদের দুই মা-ছেলেকে জলন্ত সিগারেট দিয়ে ছেঁকা দেয়। শুধু তাই নয়, আমার হাতের আঙ্গুল দরজার ফাঁকে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে যায়। আমার তখন মনে হয় আমার আত্মা বের হয়ে যাচ্ছে। যেন চিল্লাতে না পারি তাই কাপড় দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দেয়। বাবা তুই ই একমাত্র আমাকে বাঁচাতে পারবি। তুই তোর বাবাকে বুঝিয়ে বল বাবা। আমি অনেক শাস্তি পেয়েছি, আর সহ্য করতে পারছি না।”
বলে ই আমার পায়ে পড়লো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। বাবা আমাদের দুই ভাই-বোনের জন্য এতকিছু করলো। মা আমার পায়ে ধরা অবস্থায় ই বলতে লাগলো,”তোর বোনের বিয়ের দিন যখন তোর বাবা আমাকে তালাক দিতে যাচ্ছিল, তখন যদি আমি মেনে নিতাম তাহলে হয়তো, এই চারটে মাস আমার আর আমার ছেলের এত অত্যাচার সহ্য করতে হতো না।”
আবার ও কান্না করতে লাগলো। আব্বু আর আম্মু আমাকে বলতে লাগলো,”দেখ বাবা সিফাত, ওনি অনেক শাস্তি পেয়েছে। তুই তোর বাবাকে বল যেন ওদের ক্ষমা করে দেয়। তাছাড়া, শিপন ত আর কিছু করেনি। সে তো তার মায়ের অপরাধের শাস্তি ভোগ করার কথা না। তুই অন্তত তার মুখের দিকে তাকিয়ে হলে ও তাদের ক্ষমা করে দিতে বল তোর বাবাকে।”
পাশ থেকে আম্মু ও বলে উঠলো,”হ্যাঁ বাবা আমি ও তোর আব্বুর সাথে একমত। কারণ, একটা মায়ের সামনে যখন কেউ তার সন্তানকে আঘাত করে, সেই আঘাত টা সন্তানের গাঁয়ে যতটা না লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি সেই মায়ের কলিজায় লাগে। তাই আমি ও বলছি তুই তোর বাবাকে বল, তোর মাকে ক্ষমা করে দিতে।”
আমি মায়ের কথা বিশ্বাস না করে, বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,”আচ্ছা বাবা মা যা বলছে তা কি সত্যি ?”
বাবা কিছু বলছে না। তাই আমি আবার ও জিজ্ঞেস করলাম,”কি হলো বাবা ? বলছো না কেন ? মায়ের কথা কি সত্যি ?”
বাবা এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,”হ্যাঁ সত্যি।”
আমি এবার ভেবে দেখলাম যে, এখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া ই উচিত। কারণ, অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে। সাথে মামা-মামী, তানিয়া, আরিফ ও আকিব ও একি কথা বলছে কিন্তু শিফা কিছু বলছে না। তাই বাবাকে বললাম,”বাবা আমার একটা অনুরোধ রাখবে তুমি ?”
– বল কি অনুরোধ ?
– আগে বলো রাখবে কি না ?
– হ্যাঁ রাখবো।
– তাহলে তুমি মাকে ক্ষমা করে দাও।
– না জীবনে ও না।
– তুমি বলেছো আমার অনুরোধ রাখবে।
– শুধু তোর কথায় আমি তাকে ক্ষমা করতে পারবো না। কারণ, তার কাছে শুধু তুই ই নির্যাতিত হসনি, আরো একজন হয়েছে।
আমি বুঝলাম, বাবা শিফার কথা বলেছে। তাই শিফাকে বললাম, বাবাকে বলতে, যেন মাকে ক্ষমা করে দেয়। শিফা আমার কথা ফেলেনি। অবশেষে বাবা মাকে ক্ষমা করে দেয়। আমি মাকে পা থেকে তুলে জড়িয়ে ধরলাম। মা ও আমাকে ও শিফাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। শুরু হলো আমাদের একটা নতুন, সুন্দর ও সুখী জীবন।
(সমাপ্ত)