হঠাৎ অদ্ভুতুড়ে পর্ব-০১ | বাংলা রোমান্টিক গল্প

0
4464

#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে (পর্বঃ-০১)
লিখাঃ- সুহাসিনী

আমাদের ফ্ল্যাটে ইদানীং একটা অদ্ভুত সমস্যা দেখা দিয়েছে । প্রথম কয়েকটা দিন গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল না করলেও এখন বিষয়টা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ফ্ল্যাটের পাশেই নিচে বিশাল বড় একটা বাগান। আম,মেহগনি গাছ আর লতাপাতায় ভর্তি। সন্ধ্যা হলেই শেয়াল ডাকা শুরু করে। মাঝে মাঝে তো বাসার নিচেই প্রাচীরের ওপাশেই চলে আসে। এখন আর শেয়ালের ডাকে ভয় পাই না।

সেদিন রাতে রুমের দরজা, জানালা এমনকি জানালার পর্দাও আটকিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে হঠাৎ খেয়াল হলো- জানালার পর্দাগুলো একপাশে জড়ো করে রাখা। অথচ আমি রাতে ঘুমোনোর সময় ঠিকই জানালার পর্দাগুলো দিয়ে রেখেছিলাম। পরদিনও তাই। বেশ কিছুদিন এভাবেই পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বিষয়টা বেশ গোলমেলে লাগছে।

তারপর একদিন হঠাৎ-ই আমার রুমমেট ত্রাত্রির মেকাপ আইটেম উধাও। সারা ফ্ল্যাট তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলাম না। গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা মাত্র তিনজন রয়েছি ফ্ল্যাটে। বাকি সবাই ছুটিতে বাসায়। টিউশনির জন্য আমাদের যাওয়ার সুযোগ হলো না এবার।

রুমমেট ত্রাত্রি তার দুইদিন পর টিউশনির ছুটি পেলো। দামী মেকাপ আইটেম হারিয়েছে সে। মন খারাপ করে ছিলো দুটো দিন। ছুটি পেয়ে বাসায় যাবার সময় হঠাৎ ফ্ল্যাটের নিচে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলে উঠলো- আমার মনের মধ্যে তোর জন্য কেমন খচখচ করছে। তোকে রেখে যেতে সায় দিচ্ছে না। আমার বাসায় যাবি?

-পাগল নাকি? টিউশনির ছুটিই পাচ্ছি না। সুযোগ হলে তো নিজের বাসাতেই চলে যেতাম।

ত্রাত্রি আমাকে একা রেখে যেতে বোধহয় মনে সায় পাচ্ছে না। অনেকটা দোটানার মধ্যে থেকেই বাসায় চলে গেলো সে। বেশ খানিকটা পথও ওকে এগিয়ে দিয়ে এলাম। দেড়মাস হলো আমরা এই একরুমে থাকছি।
ত্রাত্রিকে এগিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় টিউশনি শেষ করে এসে রুমে ফিরলাম। ঘরে ঢুকতেই টের পেলাম, পুরো ঘর জুড়ে পারমিউমের সুগন্ধ। আমার নতুন কেনা ‘কিউট রোমান্স’ পারফিউমটার মতোই গন্ধটা। কী মনে হল,টেবিলের উপর রেখে যাওয়া বোতলটা চেক করতে গিয়ে দেখি- বোতল উধাও।

একেক সময় এইভাবে জিনিসপত্র হারানো ব্যাপারটা মেনে নেওয়া যায় না। কোনার রুমে বড় আপু থাকেন, ফাইজা। তেমন কথা হয় না। সবসময় দরজা, জানালা বন্ধ করে পড়তেই থাকেন। খাবার সময় চুপচাপ খাবার নিয়ে যান। কখনো কখনো বনঘর থেকে মিষ্টি কিনে আনলে আমাকে ডেকে খেতে দেন। হাসিখুশি একটা মেয়ে। ফাইজা আপুর রুমে টোকা দিলাম। আপু তখনো গুনগুনিয়ে পড়ছিলেন। আমার ডাকে দরজা খুলে কেবল ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন। জিজ্ঞাসা করলাম- আপু, একটু দরকার ছিলো। ফ্রি আছো?

নিজের প্রশ্নের ভিড়ে খেয়ালই করি নি,ফাইজা আপুর হাতে হ্যান্ডব্যাগ। বোরখা, হিজাব পরে একেবারে রেডি। পড়তে পড়তেই খায়, রেডি হয়। অদ্ভুত একটা মেয়ে এই ফাইজা আপু। অবাক হয়ে ফাইজু আপুর দিকে তাকালাম।

-কোথাও বের হচ্ছেন এই সন্ধ্যায়?

আপু ব্যস্ততার সুরে বলতে লাগলেন – ভালোই হয়েছে তুমি এসেছো। আমার বেস্টফ্রেন্ডের বাবা অসুস্থ। আংকেলকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। ওখানেই যাচ্ছি। তুমি তো একা পুরো ফ্ল্যাটে থাকতে পারবে না। আমার সাথে যাবে?

-সকালবেলা উঠেই পড়তে যেতে হবে। তারপর টিউশনি। হাসপাতালে গেলে তো সকালে ফিরে আসতে অনেক বেশিই দেরি হয়ে যাবে। আপনিই বরং ঘুরে আসুন আপু। আমি থাকতে পারবো।

ফাইজা আপু হাতে দুটো মিষ্টি দিয়ে একটা প্লেট ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।পথের দিকে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আপুকে আমার রুমের পারফিউম উধাও হবার ব্যাপারে কিছুই বলা হলো না।
সমস্ত ফ্ল্যাট জুড়ে নিরবতা। এতক্ষণ পর আমার বড্ড অস্বস্তি লাগছে। রুমে ফিরে মিষ্টির প্লেটটা টেবিলের উপর রেখে হাতমুখ ধুতে চলে গেলাম ওয়াশরুমে। আয়নার দিকে তাকিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। সব যেনো কেমন ভারি ভারি লাগছে। ব্যাপারটা এমন যে, কেউ আমার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। তার নিশ্বাস বোধরহয় আমি টের পাচ্ছি। চোখেমুখে ক্লান্তি নেমে আসছে একটানা। ট্যাপের ঠান্ডা পানিতেও সেই ক্লান্তির ছাপ দূর হয় না। ফাইজা আপুর সাথে যাওয়াটাই হয়ত উচিত ছিল তখন। এখন ভারি আফসোস হচ্ছে। সারাটা রাত একা একাই আমাকে কাটাতে হবে।

তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রুমে ঢুকলাম। ফাইজা আপুর দেওয়া মিষ্টি আমার এবং ত্রাত্রির ভীষণ পছন্দের। ছানা দিয়ে তৈরি করে বোধহয়। অতদূরে মিষ্টি কিনতে যাবার সুযোগ হয় না আমাদের। দরজার কাছে আসতেই দেখি ত্রাত্রি। আর সে প্লেট থেকে মিষ্টি তুলে খাচ্ছে। ত্রাত্রি বাসায় না গিয়ে ফিরে এসেছে! যাক, ভালোই হলো। একা একা রাত কাটানোটা ভারি সমস্যার হত। তোয়ালেটা সিঁড়ি ঘরের বারান্দায় দিয়ে এসে আবার রুমে ফিরলাম। ওকে পারফিউমের ব্যাপারটা বলতে হবে এবার।

কিন্তু এ কি! ত্রাত্রি কোথায়? পুরো ফ্ল্যাটজুড়ে খুঁজেও কোথাও পেলাম না ত্রাত্রিকে। নাহ, কোথাও নেই সে। অথচ, একটু আগেই আমি ওকে মিষ্টি খেতে দেখলাম। টেবিলের উপর রাখা প্লেটে মিষ্টিও নেই। তার মানেটা কী.! এসব ঘটছে টা কী আমার সাথে? ত্রাত্রির নাম্বারে কল দিলাম। নাম্বার ব্যস্ত। নিশ্চয় কারো সাথে কথা বলায় ব্যস্ত সে। ওর এই এক স্বভাব। কেউ দরকারের সময় হাজারবার কল দিয়ে মরেও গেলেও ওর নাম্বার ব্যস্ত থাকবেই। এত কার সাথে কথা বলে, কে জানে!

ত্রাত্রির কথা পরে ভাবলেও চলবে। আমার মিষ্টির হদিস পাচ্ছি না এখনো। এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা জীবনেও ঘটেনি। একা মেয়ে এভাবে সারারাত আমি কাটাবো কী করে? লাইট জ্বালিয়ে রাখলে এদিকে আবার ঘুম হয় না। বুদ্ধিমানের স্বর্গে বসবাস করেও আজীবন বোকাটাই রয়ে গেলাম আমি।

শেষমেস ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমাতে হলো। সমস্ত ভয় শঙ্কাকে একপাশে ঠেলেও মনের ভিতর আত্মতুষ্টির ভালো লাগা কাজ করছে। আজকে দুই ডজন পছন্দের লাল চুড়ি কিনেছি। ব্যাগ থেকে বের করে বড্ড যত্নে চুড়ির র‍্যাকের কোটে ঝুলিয়ে দিলাম। আমার মন ভালো করার জন্য এক ডজন চুড়িই অনেক বড় কিছু।

তবে ঘুম আসছে না। ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা কাটেনি। রাত হয়ে এসেছে বেশ। এগারোটা, সাড়ে এগারোটা,সাড়ে বারোটা, একটা। তামাম পৃথিবীটাকে ধীরে ধীরে শূণ্য মনে হচ্ছে। এতক্ষণ পর নিশ্চয় তবে ঘুম লেগেছে চোখে। আর কিছুই খেয়ালে আসছে না। মনে নেই কিছুই। আমি হেটে চলেছি ফ্যান্টাসির প্রবেশপথে।

হঠাৎ রিনিঝিনি শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকালাম। এটা কিসের শব্দ! চুড়ি! হ্যাঁ, চুড়ির শব্দই তো। আমার নতুন কাচের চুড়ির শব্দ। রুমের ভিতর কেউই নেই। তবু শব্দটা স্পষ্ট। মিটিমিটি চোখে পাশ ফিরে তাকালাম। চুড়ির র‍্যাক থেকে কেউ যেন একটা একটা করে চুড়ি পরছে। চুড়িগুলো একে অপরের সাথে ধাক্কা লাগতেই আওয়াজ করে উঠছে। কিন্তু কে পরছে চুড়ি? কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। গলা শুকিয়ে আসছে আমার। এভাবেই কী তবে রোজ আমাদের জিনিসপত্র উধাও হয়ে যায়? হালকা ড্রিম লাইটে টের পাচ্ছি, চুড়িগুলো আস্তে আস্তে জানালার দিকে এগোচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকে মৃদু কম্পন তুলছে জোরালোভাবে। আমি একলাফে উঠেই খপ করে চুড়ির গোছাটা মুঠি করে ধরলাম। সাথে সাথে কেউ যেনো নিজেকে ছাড়ানোর জোর চেষ্টা করছে। আমাকে তবে ধাক্কা দিচ্ছে না। সুযোগ বুঝে, বিষয়টা টের পেয়েই আরো শক্ত করে চেপে ধরলাম। কোনমতেই ছাড়া যাবে না। এ যাবৎকালে আমাদের যত জিনিসপত্র হারিয়েছে, সব এই কারণেই। এভাবে তো কাউকে ছাড় দেওয়া যায় না। কিন্তু এই অদৃশ্য শরীরটাই বা কীসের? সেটা শরীর নাকি অন্য কিছু? ভাবতে পারছি না। অন্যকিছু ভাবতে গেলেই এখন দুর্বল হয়ে যাবো আমি। আর দুর্বলতা মানেই তাকে হাতছাড়া করে ফেলতে হবে।

এত শক্ত করে চেপে ধরে আছি যে, কারো গোঙানির শব্দ টের পাচ্ছি স্পষ্ট। তবু দয়ামায়ার ছিটেফোঁটা দেখালাম না। এই মুহুর্তে ছেড়ে দিলে, আমি নিজেই ভয়ে মারা যাবো। জোরে টান দেবার চোটে একটা একটা করে চুড়ি ভাঙতে শুরু করে দিলো। কয়েকটা বেশ পিছিয়েও গেছে। তার মানে আরেকটু সামনেই এগিয়ে ধরতে হবে। একটু সামনে নিশ্চয় তার কব্জি। চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম- দেখো, তুমি যে বা যাই হও না কেনো, আমি তোমাকে ছাড়বো না। তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আমি একা একা এই রুমে সারারাত পার করতে পারবো না। আতঙ্কেই মারা যাবো। তাই, ভালোই ভালোই আমার কথামতো দৃশ্যমান হও।

কিন্তু আমার কথার কোনো জবাব এলো না। জানালার পর্দা কাঁপছে আরো জোরালো গতিতে। জানালার পর্দার কম্পনে এত ভয়ংকর আওয়াজ হয়! ওই আওয়াজ আমার বুকের ভিতর দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে সবকিছু। টের পাচ্ছি, হাত দুটোও দুর্বল হয়ে আসছে। হঠাৎ কেউ যেনো আমাকে বেশ জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। সামলাতে না পেরে ছুটে গিয়ে ধাক্কা খেলাম দেওয়ালে। মাথায় কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা। জানালা দিয়ে প্রবল কম্পনে যেনো কেউ বাইরে ছুটে পালালো। এরপর আস্তে আস্তে সব কেমন অন্ধকার লাগছে।
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন…