হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০২

0
236

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বিতীয় পর্ব

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। ফোনের লাইটটা জ্বালিয়ে আমার বামহাতটা শক্ত করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অয়ন। হঠাৎ হোঁ°চ°ট খেলেই উনার শার্ট খা°মচে ধরি।

অয়ন আমার দিকে ফিরলে আমি শার্ট ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে চেয়েও হাত ধরা বলে তা পারিনা। আমার এমন উদ্ভট ছটফটানি দেখে অয়ন বললেন,
“কিরে, এমন বাদরের মতো লাফাচ্ছিস কেন?”
“আ.. ওই..”
“আমতাআমতা করিস না, দেরি হচ্ছে চল।”

আবারো হাঁটা লাগায় উনি। এদিকে আমাকে রীতিমতো টেনেটেনে নিচ্ছে। পায়ের ব্যথার কারণে হাঁটতে পারছি না। উনি বিরক্ত হয়ে ফিরে বলেন,
“কি সমস্যা?”
“পায়ের আঙ্গুলে ব্য°থা।”

আমার কথায় উনি হাত ছেড়ে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে ফোনের লাইটটা পায়ের দিকে ধরে। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল কে°টে র°ক্ত পড়ছে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে র°ক্ত মুছতে মুছতে বলেন,
“এইটুকু কা°টাতেই হাঁটতে পারছিস না?”

সবসময় বাবা আগলে রাখে তো, ব্য°থা পাই না কখনো। এটা আমার কাছে এতোটাও কম ব্য°থা নয়।

উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তোরা মেয়েরাও এতো ন্যাকামী পারিস।”

উনার কথায় বেশ রাগ হলো। এমনভাবে বলল যেন আমি কত ন্যাকা, যদিও ন্যাকামী আমি একটু বেশিই করি তবে তা স্বীকার করতে নারাজ।

উনি ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,
“ধর।”

ফোনটা হাতে নিতেই অয়ন আমাকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছি। একটু নড়েচড়ে উঠতেই আমাকে আরো জোরে চেপে ধরে বলেন,
“চুপ থাক, তোর মতো কচ্ছপের গতিতে হাঁটলে রাত পেরিয়ে যাবে।”

আর কিছু না বলে চুপ করেই থাকলাম। অয়নের শার্টের কলারের কাছ থেকে পারফিউমের একটা মিষ্টি স্মেল নাকে এলো। চোখ উঠিয়ে উপরে তাকিয়ে উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাকে নিয়ে সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছেন, একটুও কি কষ্ট হচ্ছে না? আমার ওজন তো নেহাত কম না।

“কি খাস এতো? ওজন কত তোর?”

উনার কথায় চমকে উঠলাম। চোখ পিটপিট করে বললাম,
“অনেকদিন হবে ওজন মাপি নি। এইতো ৫০ কেজি হবে।”

উনি আমাকে একটু নাড়িয়ে কিছুটা ব্য°ঙ্গসুরে বললেন,
“আজ্ঞে না, কমপক্ষে ৫৫-৬০ হবে।”
“হতে পারে। আপনার কষ্ট হচ্ছে?”

অয়নের মুখে হাসি দেখলাম, কিন্তু প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলাম না। ডানহাতটা বাড়িয়ে উনার দাঁড়িতে হাত রাখতেই উনি আমার দিকে তাকালেন। আমি হাত সরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। ছি, কি লজ্জায়ই না পড়তে বসেছি।

বাসার কাছাকাছি এসেই গানবাজনার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অয়ন আমাকে কোল থেকে নামিয়ে ফোনটা নিয়ে চলে ভিতরে চলে গেলেন। আমি ভিতরে ঢুকে দেখি উঠান ভর্তি মানুষজন।

আমাকে দেখে আম্মু এসে বলেন,
“এতো দেরি করলি কেন? যা, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।”
“হুম, যাচ্ছি। কোন রুমে যাবো?”
“দোতলায় গিয়ে তোর অথৈ আপুর রুমটা খালি আছে। আমাদের ব্যাগটাও ওখানেই আছে। যা, তাড়াতাড়ি।”

তাড়াহুড়া করে সিঁড়ির কাছে যেতেই অয়ন আমার হাত ধরে উপরে নিয়ে যায়, একদম উনার রুমে। আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন,
“পায়ের ওষুধ লাগাতে হবে।”
“না, লাগবে না। আমি ঠিক আছি।”

ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে ওষুধ বের করতে করতে বললেন,
“রাস্তায় তো ঠিক ছিলি না? নাকি কোলে উঠার ধা°ন্ধা ছিল?”

আমি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছি। এটা কেমন হলো? আমি কি উনাকে কোলে নিতে বলেছিলাম নাকি? উনি আমাকে খাটে বসিয়ে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওষুধ লাগিয়ে একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেন।

“রাতে খুলে ফেলিস।”
“ঠিক আছে।”

বলেই বেরিয়ে চলে এলাম। অথৈ আপুর রুমে গিয়ে দেখি কেউই নেই, তারমানে সবাই নিচে আছে। আমি এদিকওদিক তাকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

সবুজ ও হলুদ রঙের কম্বিনেশনের লেহেঙ্গাটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলাম। বেনী খুলে চুল আঁচড়ে একপাশে ছেড়ে দিলাম। মুখে ফাউন্ডেশন লাগাচ্ছি এমনসময় দরজায় নক পড়ে।

“কে?”
“হলো তোর তন্নু? এতো সময় লাগে নাকি?”

আম্মুর গলা শুনে কোনোরকমে ফাউন্ডেশনটা লাগিয়ে গিয়েই দরজা খুলে বললাম,
“৫ মিনিট।”
“আচ্ছা, দ্রুত আসো।”

আম্মু চলে যেতে নিলে আমি বললাম,
“আম্মু, একটু আই লাইনারটা দিয়ে দিবে?”

আম্মু ফিরে একটু রাগি গলায় বলল,
“এতো সাজা লাগবে না। তাড়াতাড়ি আসো।”

আম্মু চলে গেলো। আমি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, চোখে আইলাইনার না দিয়ে আমি কিছুতেই নিচে যাবো না বলে পণ করছি এমনসময় অয়ন এসে সামনে দাঁড়ালো।

সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা জিন্স পড়েছেন উনি। ভ্রূ নাচিয়ে বললেন,
“নিচে যাবি না?”

কপালের চুলগুলো সরিয়ে বললাম,
“আমি এখনো সাজিনি।”

উনি ঠোঁট উলটে আমাকে দেখে বললেন,
“মুখে তো ভালোই ময়দা মেখেছিস, আর কি সাজবি?”

ভেংচি কেটে আমি ভিতরে চলে গেলাম। আই লাইনারটা নিয়ে নিজে নিজে দেয়ার চেষ্টা করছি তখনই অয়ন এসে আই লাইনারটা নিয়ে আমাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে বলে,
“আমি দিয়ে দিচ্ছি।”

আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। অয়ন হেসে বলেন,
“চোখ খুলে রাখলে দিবো কি করে?”
“আমি পারবো।”
“পাকনামি কম কর।”

আমি আর প্রতিবাদ না করে চোখ বন্ধ করলাম। অয়ন আই লাইনার দিয়ে দিলো, তারপর পার্লার ক্লিপ নিয়ে চুলগুলো আটকে দিলো। আমি এখনো চোখ বন্ধ করেই আছি, অনুভব করছি উনার প্রতিটা স্পর্শ।

৫ মিনিট পর চোখ খুলে উনাকে আশেপাশে দেখলাম না। আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। সবসময়ের আমার চেনা সাজটাও আজ অচেনা ঠেকছে। কেন? অয়নের ছোঁয়া? লজ্জায় গাল লাল হয়ে এলো। এমনকি আয়নার দিকেও আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।

আম্মু এসে ধমক দিয়ে বলল,
“এখনো এখানেই বসে আছো?”

আমি চমকে উঠে দ্রুত লিপস্টিক লাগিয়ে বললাম,
“এইতো যাচ্ছি।”

আম্মুর দিকে না তাকিয়েই বেরিয়ে গেলাম। মাথানিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম, এতো লজ্জা কেন লাগছে আমার? কই আগে তো এমন অনুভূতি হয়নি।

সুমি আপু এসে আমার হাত ধরে বলল,
“এদিকে আসো, এদিকে আসো।”

উঠানের ডানপাশে করা স্টেজে অথৈ আপু বসে আছে। দুজন মেয়ে তাকে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে, ওরা হয়তো পার্লার থেকেই এসেছে। আমাকে নিয়ে অথৈ আপুর পাশেই বসানো হলো।

সুমি আপু সেলফি তুলছে। তারপর আমার হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে সাউন্ডবক্সের গান বন্ধ করে বলে,
“শুরু করো তন্বী অর তন্নু, গান শুরু।”

আমি কপাল কুঁচকে একটু রেগে অথৈ আপুর দিকে তাকালাম। এই সুমিকে ধরে ইচ্ছেমত কে°লাতে পারলে শান্তি লাগতো, বিকালে একবার আর এখন একবার আমাকে ফাঁ°সিয়ে দিলো। এটা কোনো কথা? আর তন্বী অর তন্নু কি? একটা ডাকলেই তো হয়।

সুমি আপু আমার হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে আমার হাতে একটা মিনি মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেয়। সুমি আপু বলছে,
“তন্বী অরফে তন্নু, বিকালে আমাদের একটা গান শুনিয়েছে। সে তার এই ফতিভা গোপন রাখতে চায় বলে জানিয়েছেন আমাদের সম্মানিত কনে অথৈ। কিন্তু আজ এই ফতিভা (প্রতিভা) বিকশিত করার দিন এসেছে, তাই তাকে একটা গান ফরিবেশন (পরিবেশন) করার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি।”

সুমি আপু কি আমার প্রশংসা করলো নাকি অপমান করলো তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে এতোজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে যে আমি কিছু হতভম্ব হয়ে গেছি। আশেপাশে তাকিয়ে স্টেজের পাশের অয়নকে আবিষ্কার করলাম। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন উনি। আমি কি কোনোভাবে এলোমেলো হয়ে আছি। তাড়াহুড়ো করে আবার উল্টাপাল্টা লিপস্টিক লাগাইনি তো।

চশমাটা ঠিক করে অথৈ আপুকে বললাম,
“আপু, এখন না।”
“আরে তন্নু, এতো লজ্জা পেতে হবে না তো।”

মিমি আপু এসে গলায় মিনি মাইক্রোফোনটা লাগিয়ে দিলো। এখন মুখটা একদম বন্ধ করে রেখেছি, একটা কাশি দিলেও সবাই শুনে নিবে। ওদিকে সুমি আপুর আজগুবি কথাবার্তা চলছে তো চলছেই।

সুমি আপুর হাত থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে নেয় অয়ন। সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“ইত্তাজা রহমান, আমার চাচাতো ভাই, যার এখানে গান গাওয়ার কথা ছিল। অনেকের জানেন সে সিংগার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, রেডিওতেও গান গায় প্রায়ই। আবার তার এলবামও বের হবে। বেচারা এখনো এসেই উপস্থিত হতে পারেনি, তাই পোলাও এর পরিবর্তে আমাদের সুমি ম্যাডাম আমাদের পান্তা গেলানোর প্ল্যান করেছেন।”

উপস্থিত অনেকেই মুখ টিপে হাসছে, প্রায় সবাই হাসাহাসি শুরু করেছে। আমার তো কান্না পাচ্ছে এসব দেখে। সকলের সামনে গান গাইতে লজ্জা লাগে বলে আমার গলা কি এতোই খারাপ নাকি? আজ এলবাম বের করলে কাল হিট হবে, হুহ।

মনে মনে ভাব নিচ্ছি অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“শুরু করেন, মিস. পান্তা।”

চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে আছি। উনি সুমি আপুর হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে আবারো গিয়ে সেই আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েন।

আমার ইচ্ছে করছে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা স্পিচ দেই। এতোই লম্বা দেই যেন আমার কাছ থেকে এই মাইক্রোফোন নামক যন্ত্রণাটা নিয়ে নেয়। তবুও নিজেকে বোঝাই “কন্ট্রোল তন্বী কন্ট্রোল”।

একটু সোজা হয়ে বসে গান শুরু করি। অনেকেই অয়নের কথা নিয়ে এখনো হাসাহাসি করছিল, গান শুরু হতেই চুপ হয়ে যায় সবাই।

“প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দুটি নিয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকে
রোজ দুইফোঁটা যেন আরও ভালো লাগে
গানে, অভিসারে, চাই শুধু বারেবারে
তোমাকে, ও.. তোমাকে।”

আড়চোখে দুইতিনবার অয়নের দিকে তাকিয়েছি। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে সে। গান শেষে সাইদা আপু আমার কাছ থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে নেয়।

আমি উঠে কোনো কথা না বলে বাগানের দিকে চলে যাই। সাধারণত এতো মানুষের মাঝে থাকার অভ্যাস আমার নেই, জয়েন্ট ফ্যামিলির মধ্যমণি বা শতজনের কেন্দ্রবিন্দু কখনোই ভালো লাগে না।

বাগানে গিয়ে লেহেঙ্গার ওড়না ঠিক করছি অয়ন পিছন থেকে এসে বললেন,
“ওই, এভাবে চলে আসলি যে?”

একবার তাকালাম কিন্তু কিছুই বললাম না। ওড়নাটা আটকে উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কপাল কুঁচকে গেল আমার। অয়ন হাত বাড়ালেন আমার দিকে একটু পিছিয়ে গেলে উনিও এগিয়ে আসলেন, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা লিপস্টিকটুকু মুছে বললেন,
“এখনো লিপস্টিক দিতেই শিখিসনি, তোর বয়সে মেয়েরা মা হয় জানি?”

“মা” শব্দ কানে বা°রি খাচ্ছে বারবার। খুব ভারী তো এই শব্দটা। আর এমন কথা শুনতেও আমি বরাবরই আনাড়ি।

“চল, ইত্তাজা এসেছে দেখলাম। তোর গান শুনলো, তোর সাথে কথা বলার আগেই তো পালিয়ে আসলি।”

আমার হেলদুল না দেখে আমার হাতটা চেপে ধরে উঠানে নিয়ে আসলেন। স্টেজের কাছাকাছি এসেই হাত ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের সাথে অন্যদিকে চলে গেলেন।

“হাই, আমি ইত্তাজা।”

কারো কন্ঠে ফিরে তাকালাম। সবুজ পাঞ্জাবি আর কালো জিন্স পড়া ছিমছাম গড়নের ছেলেটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জোরপূর্বক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলি,
“হ্যালো, আমি তন্বী।”

ইত্তাজা চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলে,
“বসি?”
“শিউর।”

দুজনে পাশাপাশিই বসলাম। ইত্তাজা বলল,
“গান ভালোই গাইতে পারেন। (একটু থেমে) বাসায় ঢুকে ভেবেছিলাম সাউন্ড বক্সের উচ্চশব্দ শুনতে পাবো, কিন্তু একটা মিষ্টি কন্ঠই কানে এলো। সত্যি অসাধারণ ছিল।”

আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম,
“শখ করে গাওয়া হয়, এভাবে এই প্রথম।”
“এটাই কি শেষটা হবে নাকি?”
“সম্ভাবনা বেশি।”

ইত্তাজা পাঞ্জাবির হাতা গু°টাতে গু°টাতে বলল,
“আপনার আপত্তি না থাকলে আপনাকে একবার সকলের সামনে আনতে চাই। আই মিন, আমার এলবামে গান গাওয়ার সুযোগ দিতে চাই।”

আমি না বোধক মাথা নেড়ে হাসলাম। বললাম,
“আসলে এমন কিছুর ইচ্ছা আমার নেই। এইতো বেশ আছি।”

এমনসময় অথৈ আপু ইত্তাজাকে ডেকে বলল,
“ভাইয়া, এদিকে আসো। তোমার গান না শুনে কিছুতেই ছাড়ছি না।”

অনেকেই হো করে চিৎকার করে উঠলো। ইত্তাজাও চলে গেলেন গান গাইতে। আমি একা বসে রইলাম। ওষুধ দেয়ার পর পায়ের ব্য°থাটা অনেকটাই কমে গেছে। নখের দিকটায় কেটেছিল তাই ব্য°থাটা সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল।

অয়ন এসে আমার পাশে বসে একগ্লাস জুস আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি গ্লাসটা নিতেই উনি উঠে চলে গেলেন অন্যদিকে। আমি বেকুবের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছি। গান আর আনন্দে সময় যাচ্ছে আপন গতিতে।

রাত ১১ টা পেরিয়ে গেছে, দুইহাতে মেহেদি লাগিয়ে ছাড়া কয়েদিদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। এদিকে ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। খোলা বারান্দার ডানে বামে সমানে পায়চারী করছি, উঠানের চেয়ারগুলোতে বিন্দুমাত্র বসার জায়গা না পেয়ে এখানেই দাঁড়াতে হলো। বাসায় হলে ক্ষুধা লাগছে বলে বলে ট°র্নে°ডো তুলতাম, কিন্তু এখানে তো আর তা সম্ভব না।

হঠাৎ কেউ কাঁধে ধাক্কা দিলো। ফিরে অয়নকে দেখেই চোখ কপালে। আমাকে বললেন,
“তনুশ্রী, মিতু আন্টি তোকে ডাকছে।”

আমি দুহাতে ইশারা করে বললাম,
“হাঁটতে নিলেই ধাক্কা খাবো আর মেহেদি লেপ্টে যাবে।”

অয়ন হেসে আমার দুহাতের বাহুতে ধরে ডাইনিং এ নিয়ে আসলেন। জাহানারা আন্টি আমাদের দিকে তাকাতেই আমি ভয়ে চুপসে গেলাম, আম্মুও এখানে আছে। তারমানে আজ এখনই তৃতীয় বি°শ্বযু°দ্ধ লাগবে।

আমার চিন্তাভাবনাকে ভুল স্বীকৃতি দিয়ে অয়ন ভাই বলেন,
“মিতু আন্টি, তোমার মেয়ের আবার মেহেদি লেপ্টে যাওয়ার ভয় বেশি। তাই একদম ধরে নিয়ে এসেছি।”

আম্মুও উনার কথায় তাল মিলিয়ে বলে,
“একদম ঠিক করেছো।”

চেয়ার টেনে আমাকে বসতে ইশারা করে আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো অয়ন ভাই। একপাশে আম্মু আর অন্যদিকে উনি, মাঝখানে আমি নিজেকে নিতান্তই এক বন্ধী ভাবছি। নিজে খেতে পারবো না, তাই আম্মু খাইয়ে দিচ্ছে। যদিও ডাইনিং এ তেমন মানুষ নেই, তবুও বেশ লজ্জা লাগছে। লজ্জা লাগার মূল কারণ অয়ন নামক অদ্ভুত মানুষটার হাসি।

আনোয়ার রহমান, অয়নের বাবা, উনার সাথে খাবার টেবিলেই কুশল বিনিময় হলো। শান্ত স্বভাবের মানুষ হলেও বেশ ভদ্র মানুষ উনি। প্রয়োজন ছাড়া কথা কম বলেন কিন্তু প্রয়োজনেও একটা বা দুইটার বেশি কথা বলেন না, ওই একদুই কথায়ই উনি সমস্যার দফারফা করে দেন। এমন গুণ সবার থাকে না। আমাকে বেশ স্নেহই করেন, নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। গতবছর অথৈ আপুকে নিয়ে আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন, তারপর এই আজই দেখা হলো।

খাওয়া শেষে মুখ মুছে দিতেই ডাইনিং থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি। আম্মু পানি খাওয়ার জন্য ডাকলেও আমি ফিরে তাকাই না।

কিছুক্ষণ পরই অয়ন আমার সামনে একবোতল পানি ধরে বলে,
“খাওয়ার পর পানি খাওয়া লাগে জানিস না?”

দাঁত খিঁ°চিয়ে বললাম,
“জানতেও চাই না।”
“জানতে হবে না।”

বোতলের মুখ খুলে আমার মুখের সামনে ধরে খাওয়ার ইশারা করেন। পানি মুখে নিতেই বাম হাতে থেকে একটা ট্যাবলেট ডানহাতে এনে আমাকে বলেন,
“হা কর।”

মুখে পানি পুরে গাল ফুলিয়ে রেখেছি। উনি তাড়া দিয়ে বললেন,
“নে, হা কর।”

ট্যাবলেটটা খেয়ে নিয়ে বললাম,
“কিসের ট্যাবলেট?”

বোতলের মুখ লাগাতে লাগাতে ভাবলেশহীনভাবে বললেন,
“ঘুমের।”
“হোয়াট? আমি আপনাকে বিশ্বাস করে খেলাম আর আপনি আমাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ালেন? চিটার, বাটপার।”

চেঁচামেচিতে কপাল কুঁচকে একবার তাকিয়ে উনি উপরে চলে গেলেন। এতোক্ষণে মেহেদি শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে গেছে দেখে একটা দফারফা করার আশায় আমিও উনার পিছুপিছু গেলাম। উনি রুমে ঢুকে দরজা লাগানোর আগেই আমি রুমে গিয়ে হাজির।

অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আর দরজা লাগালেন না কিন্তু পর্দা টেনে দিলেন। আমি খিঁ°চিয়ে উঠে বললাম,
“ঘুমের ওষুধ কেন খাইয়েছেন?”

উনি ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন। হঠাৎ কিছু মনে পড়ার মতো করে আমি বললাম,
“আমি ঘুমালে আপনার কি উপকার হবে শুনি?”

চিরুনিটা শব্দ করে রেখে এগিয়ে এলেন। একহাতে আমার দুগাল চেপে ধরে বলেন,
“প্যারাসিটামল খেয়েছিস, তনুশ্রী। তোকে ঘুমের ওষুধ কেন খাওয়াবো। এতো বিশ্বাস তোর আমার কথা?”

আমি একটু সরে দাঁড়িয়ে আড়চোখে উনার দিকে তাকাতেই উনি হো হো করে হেসে উঠেন। আমিও হেসে দেই, সত্যিই বোকাবনে গেছি।

“যা তনুশ্রী, আমার রুমে এভাবে তোর থাকাটা সুন্দর দেখায় না।”

আশেপাশে তাকিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলাম। ঝগড়ার মুডে রুমে ঢুকলেও এখন মোটেও সেই মুডটা নেই। উনার হাসিতে সবটা কেটে গেছে। দোতলার বারান্দা থেকে নিচে তাকালাম। অথৈ আপু এখনো ওখানেই বসে আছে। স্টেজে ইত্তাজা গান গাইছে। এতোক্ষণ ধরে একটা মানুষ কি করে গান গাইতে পারে? অবশ্য কিছু মানুষ মাল্টিটেলেন্টেড হয়েই জন্মায়।

চলবে…………