হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০৮

0
195

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টম পর্ব

তিন তিনটি দিন কেটে গেছে,

আজ আকাশের অবস্থা মন ভালো না। মেঘের আনাগোনা আর কিছুক্ষণ পর পর ব°জ্র°পা°ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো, সাথে তীব্র বাতাস।

আমারও মন খুব একটা ভালো না, তিনদিন ধরে কলেজে যাইনি। অয়নের সাথে দেখা হয়নি। মানহাকে যদিও বলেছিলাম অয়নকে আমার ব্যাপারটা জানাতে, কিন্তু জানিয়েছে কিনা জানি না। মাথা মন এলোমেলো আমার।

আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টিতে আমার বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছে অয়ন। গোসল সেরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল ঝা°ড়ছি আর বৃষ্টি উপভোগ করছি। নিচে চোখ পড়তেই দেখলাম কেউ এদিকে তাকিয়ে আছে, চেনা চেনা ঠেকলো। রুম থেকে চশমা এনে চোখে দিয়ে ভালো করে দেখলাম সেই ব্যক্তি অয়ন। ভিজে একদম চুপচুপে হয়ে আছে। গায়ের শার্টটা শরীরের সাথে মিশে গেছে। ভেজা চুলগুলো কপালের উপর এলোমেলো হয়ে পড়েছে। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসলাম।

তার সামনে এসেই ধমক দিয়ে বললাম,
“সমস্যাটা কি তোমার?”
“সমস্যা হতে হবে?”

অয়নের কন্ঠে হেয়ালি স্পষ্ট৷ কপাল কুঁচকে বললাম,
“এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“তোর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“এই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে না থেকে বাসায় আসতে পারতে। চলো, বাসায়।”

হাত ধরে টান দিয়েও অয়নকে নাড়াতে পারলাম না। ভাবলেশহীনভাবে আমাকে টেনে কাছে নিয়ে বলল,
“দেখতে এসেছি, দেখা শেষ। এখন আমি গেলাম।”

বাইকে উঠে গেল। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল,
“বাই দা ওয়ে, তোকে খুব সুন্দর লাগছে।”

বলে সে তো চলে গেল। আমি এদিকে হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি। কেন যে এলো আর কেনই যে চলে গেল কিছুই বুঝলাম না। পাগলামির একটা লিমিট থাকে, কিন্তু তার নেই।

আবারো ফিরে এসে বললেন,
“একবারও জিজ্ঞাসা করলি না আমি কেমন আছি?”
“অয়ন।”
“হুম।”
“আমি ভালো নেই।”

অয়ন ভালো করে আমাকে দেখে বলল,
“শরীর খারাপ?”
“অয়ন, তোমার কারণে আমি ভালো নেই। আমি আর আগের মতো নেই, আর না হতে পারছি। দুতিনটা দিন আমাকে এতো বদলে দিলো কেন? এই কেন আমাকে ঘিরে ধরে আছে। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে, সারাক্ষণ দেখতে ইচ্ছা করে। কিছু অনুভব করতে ইচ্ছা করে।”

অয়ন মুচকি হাসছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বাইক থেকে নেমে এসে বলেন,
“তুই প্রেমে পড়েছিস, খুব খারাপভাবে জড়িয়ে গেছিস কারো সাথে। যার কথা তুই সারাদিন ভাবিস, সেও তোর কথাই ভাবে। তারও তোকে দেখতে ইচ্ছা করে।”

বলেই আমার গালের সাথে নিজের গাল ঘসে দিলেন অয়ন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। খোঁচাখোঁচা দাঁড়ির ঘ°সা লাগলো।

আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“আমার হয়ে যা তনুশ্রী। সারাজীবনের জন্য আমার হয়ে যা।”
“আগলে রাখবে তো?”
“পুরো পৃথিবী থেকে আড়াল করে নিবো।”

অয়ন আমার দুগালে হাত দিয়ে চোখে চোখ রাখলো। দুজনের দৃষ্টি দুজনের চোখে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ খেয়াল হলো বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। দ্রুত অয়নের কাছ থেকে সরে এলাম।

অয়ন হেসে বলল,
“বাই, খুব শীঘ্রই দেখা হবে।”

অয়ন চলে গেল। আমিও বাসায় চলে আসলাম। দরজার কাছে এসে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আমার কাপড় থেকে পানি পড়ে ভিজে গেছে। একটা ঢোক গিলে ভিতরে গেলাম।

চুপিচুপি রুমে চলে আসলাম। আম্মু কারো সাথে ফোনে কথা বলছে, তাই আমাকে খেয়াল করেনি।

ড্রেস পাল্টে বিছানায় এসে বসে রইলাম। অশান্ত মনটুকু আজ কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে৷ অয়নের অস্থির দৃষ্টিতে আর তার সেই ফিসফিস কন্ঠ মনে হতেই একদল লজ্জা ঘিরে ধরলো আমাকে। দুহাত দুদিকে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

“তন্বী, ঘর ভিজেছে কিভাবে?”

আম্মুর কথায় লাফিয়ে উঠে বললাম,
“আম্মু, বারান্দায় গিয়ে পা ভিজেছিল। সেই পা নিয়ে ডাইনিং এ যাওয়ায় এমন হয়েছে।”

আম্মুর দরজা ঠেলে আমার রুমে আসলো। বারান্দায় গিয়ে আমার ভিজা কাপড় দেখে বলল,
“মিথ্যা কথাও গুছিয়ে বলা লাগে। কোথায় গেছিলা? বৃষ্টির মধ্যে আবারো ছাদে গিয়ে ভিজেছো, তাই তো?”
“আ.. আম্মু..”

আমার কথার মাঝেই একটা রাম ধমক দিয়ে আম্মু ব°কতে ব°কতে বেরিয়ে গেল। আজকে আমাকে এই কথা শুনাতেই থাকবে। আমি শিউর আজ আমার নিস্তার নেই।

বিকালের দিকে বাসায় নাস্তা তৈরির ঘটা দেখে মনে হলো বাসায় মেহমান আসবে। আপু পাস্তা বানাচ্ছে। পিছন থেকে গিয়ে হুট করে বললাম,
“আপু।”

আপু আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“বল।”
“বাসায় কি কেউ আসবে?”
“হ্যাঁ।”
“কে আসবে?”
“তোর এক ভাইয়া।”

ব্য°ঙ্গসুরে বললাম,
“ভাইয়া?”
“হুম।”

আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে আসলাম। কোথাকার কোন ভাইয়া আসবে কে জানে? টেবিল গোছাচ্ছি, এমনসময় কলিং বেল বেজে উঠলো।

“তন্বী, দরজা খুল।”

আপুর ডাকে দরজার দিকে যেতে যেতে বললাম,
“আম্মু কোথায়?”
“রুমে আছে।”

আবারো বেলের শব্দ শুনে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“দূর, ভালো লাগে না। তোমরা কেউ দরজা খুলতে পারছো না।”

দরজার লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বাহিরটা অন্ধকার দেখলাম। আপুর বলা সেই ভাইয়া এলো নাকি অন্যকেউ? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তো এমন লুকিং গ্লাসে হাত দিয়ে রেখেছে কেন।

“কে?”

অপরপাশ থেকে কোনো রেসপন্স এলো না। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই অবাকে চরম পর্যায়ে চলে গেছি। কো°টর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।

“সারপ্রাইজ।”

অয়নের কথাটা আমার কর্ণকুহরে আংশিক প্রবেশ করলেও বোধগম্য হলো না। ধুম করে দরজা লাগিয়ে দিলাম। অয়ন দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
“তনুশ্রী, দরজা খুল।”

আম্মু এতোক্ষণে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে, তার পিছুপিছু এসেছে আপু। দরজায় হেলান দিয়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মু বলল,
“দরজা খুলোনি?”

আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,
“বাইরে একটা পাগলা, খ্যা°পা°টে শিয়াল।”
“শিয়াল?”
আপু চোখ কুঁচকে কথাটা বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা খুলে দিলো।

অয়ন ভিতরে এসে আম্মুকে এক লম্বা সালাম দিলো। আপুকে বলল,
“কিরে তানিমা, কেমন আছিস?”
“ভালো ভাইয়া। তুমি কেমন আছো?”
“এইতো ভালোই।”

অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“তন্বী তো কয়েকদিন আগেই আমাকে দেখলো তাও ভাবখানা এমন যেন চিনেই না আমাকে।”
“ওর কথা আর কি বলবো? বসো তুমি।”

অয়ন বসলো। আম্মু সামনের সোফায় বসে আমাদের বলল,
“নাস্তা নিয়ে আসো, যাও।”

আমি আর আপু চুপচাপ নাস্তা আনতে গেলাম। ট্রেতে নাস্তা সাজিয়ে আপু আমাকে দিয়ে বলল,
“যা, দিয়ে আয়।”
“আমিই কেন?”
“বলেছি তাই, এতো নাটক করিস না।”

আমি গাল ফুলিয়ে ড্রইংরুমে এসে অয়নকে নাস্তা দিলাম। আম্মু বলল,
“তন্বু অয়নকে তোর বইগুলো দেখা।”

কপাল কুঁ°চকে দাঁত খিঁ°চি°য়ে বললাম,
“আমি বাচ্চা না যে বাসায় মেহমান আসলে তাকে আমার বই দেখাবো।”
“দেখাবি, কারণ অয়ন তোকে এখন থেকে পড়াবে।”

আমি অবাক হয়ে একটু জোরে বললাম,
“হোম টিউটর?”

আম্মু কিছু বলার আগেই অয়ন বলল,
“ইয়েস, আ’ম ইয়র টিচার ফ্রম টুডে।”

চোখ বড়বড় করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছি। আম্মু উঠে ভিতরে যেতে যেতে বলল,
“কোচিং এর নামে টইটই করে ঘুরা বের করবো।”

আম্মু ভিতরে চলে গেলে অয়ন নিচুস্বরে বলল,
“তোর টই টই এখন বাসায় আসবে।”
বলেই বামচোখ টিপে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি দিলো।

আমি কিছু না বলে ভিতরে চলে আসলাম। কিভাবে কি হলো সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তবে একটা তো ভালো হলো, রোজ নিয়ম করে দুইঘন্টা অয়নকে দেখবো। একদম আমার সামনে বসে থাকবে। ইশ, ভাবতেই যা ভালো লাগছে, সামনে থাকলে কেমন যে লাগবে?

আজকের মতো অয়ন চলে গেল। কাল থেকে আমাকে পড়াতে আসবে, এমনটাই কথা হয়েছে।

রাতে খেতে বসেছি। আম্মু আব্বুকে বলছে,
“জাহানারার ছেলে আছে না? ওই অয়ন। ওকে বলেছি কাল থেকে তন্বীকে পড়াতে আসতে। মেয়ের দিকে তো তোমার কোনো নজরই নেই।”

আব্বু খেতে খেতে বলল,
“ভণিতা করো না তো। কয়দিন পড়াবে বলেছে?”
“ছেলেটা ভালো মানুষ বলে সপ্তাহে ছয়দিন পড়াতে রাজি হয়েছে। বেতনআদি নিয়ে কোনো কথা বলেনাই, ঠকে না যেন।”

আমি দুজনের কথা শুনছি। অয়ন কেন ছয়দিন পড়াবে সেটা তো আমিই ভালো জানি।

দুজনের কথার মাঝে আপু বলল,
“তাও একটা প্রেসারে থাকবে, কিছুটা পড়বে। আমাকে তো মোটেও মানে না।”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“এই আপু, তুমি মোটেও ভালো করে কথা বলো না। এজন্য তোমার কথা শুনি না।”
“অয়ন ভাইকে বলবো তোকে রোজ রোজ পি°টা°ইতে।”
“হুদাই কেন পি°টা°বে?”
“হুদা না, তুই পড়া পারবি না তাই মা°ই°র খাবি।”
“মোটেও না।”

আব্বু একটু বকা দিয়ে বলল,
“ঝগড়া না, চুপচাপ খাও।”

দুজনে ডোরেমন-নবিতার মতো দুদিক ফিরে খাচ্ছি আর কিছুক্ষণ পর পর নিজেদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেং°চি কা°টছি।

আজ শুক্রবার, সকালে একটু দেরি করেই উঠার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেই ঘুম আমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পালিয়ে সেই শেষরাতে। সেই যে চোখ খুললাম সেটা আর বন্ধ হলো না।

সকালের নাস্তা করে রুমে এসে বিছানায় একটু আরাম করার আগেই অয়ন এসে হাজির। আজকে ১০ টা থেকে পড়ানোর কথা ছিল, মাত্রই ১০ টা বাজলো।

আপু এসে আমার বই খাতা গুছাতে গুছাতে বলল,
“অয়ন ভাই এসেছে। শুয়ে থাকিস না।”

আমি উঠে চেয়ার টেনে বসলাম। আপু দরজার কাছে গিয়ে বলে,
“ভাইয়া এখানে আসো।”

অয়ন ভিতরে এসে একটা ভদ্র হাসি দিয়ে বলল,
“কেমন আছিস?”
“ভালো ভাইয়া। আচ্ছা, তুমি পড়াও। দেখো তোমার স্টুডেন্টের কি অবস্থা, কিছু পারে কিনা।”

অয়ন হেসে বলে,
“আচ্ছা, আচ্ছা।”

আপু বেরিয়ে গেল৷ অয়ন এসে ঠিক আমার সামনে মুখোমুখি বসে। আমি একটা ছোট হাসি দিয়ে ফিজিক্স প্রথম পত্র বইটা অয়নের দিকে এগিয়ে দিলাম৷

অয়ন বইটা খুলে বলল,
“কোন চাপ্টারে বেশি সমস্যা বা একবারেই পারিস না?”
“আমি একটা জিনিস বুঝি না।”
“কি?”
“তুমি এমনে পা°ল°টি খাও কেন?”

অয়ন কপাল কুঁচকে বলল,
“মানে?”
“মানে কাল সকালে একরকম ছিলে আর সন্ধ্যায় একরকম। এমন দিন হবে না তো যে তুমি আমাকেই ভুলে গেছো।”

অয়ন হেসে আমার গাল টেনে বলল,
“আমার বোকা স্টুডেন্টকে আমি কখনোই ভুলি না। এখন পড়ায় মন দে।”

দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আমাকে টানা পড়ালো। অন্যকোনো কথা বলল না। যেন আমি তার স্টুডেন্ট আর সে আমার কেয়ারিং টিচার। মাঝে আপু এসে চা আর কেক দিয়ে গেল। আমার সামনে বসে দিব্বি গিলে নিলো, আমাকে সাধলো না পর্যন্ত। আরে সাধলেই কি তোমার খাবার আমি খেতাম নাকি।

যাওয়ার সময় উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“পড়াগুলো সব পড়ে রাখবি।”

আমি ঘাড় বাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। অয়ন এগিয়ে এসে আমার নাকে নিজের নাক ঘষে ফিসফিস করে “বাই” বলে চলে গেল। হঠাৎ এমন আচরণে আমি ত°ব্ধা খেয়ে গেলাম।

ঘোর কাটলে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি ড্রইংরুমে অয়ন আব্বুর সাথে কথা বলছে।

“আংকেল, তন্বী বুঝে ভালো কিন্তু এতোদিনের অবহেলায় এই অবস্থা হয়েছে। এভাবে চললে এক্সামে খারাপ করবে।”

আব্বুও অয়নের কথায় সায় দিয়ে বলে,
“প্যা°ন্ডে°মি°কের সময় তো বই নিয়েই বসেনি। তানিমা পড়তে বসালেও ওকে তো পাত্তাই দেয় না। দেখো, এই কয়েকদিনে কিছু হয় কিনা। বাসায় বেশি করে পড়া দিও।”
“জি, আংকেল।”

আম্মু রান্নাঘর থেকে এসে বলল,
“অয়ন বাবা, আজকে আমাদের সাথে লাঞ্চ করো। তোমার আংকেলের সাথে একসাথে নামাজ পড়ো।”

অয়ন হেসে বলে,
“আন্টি আরেকদিন নাহয়…”

অয়নের কথার মাঝেই আব্বু বলল,
“না না, আরেকদিন না আজই।”
“আচ্ছা আংকেল। তবুও আমার একটু বাসায় যেতে হবে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে যাও। তবে এসো কিন্তু।”
“জি অবশ্যই আংকেল।”

অয়ন বেরিয়ে গেলে আম্মু আবারো রান্নাঘরে চলে যায় আর আব্বু চলে যায় গোসল করতে। আমি ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে এসে ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসে একটু জোরে বললাম,
“ক্ষুধা লাগছে, খাবার দাও।”

আম্মু রান্নাঘর থেকে বলল,
“অবহেলা তো কম করো নাই। এখন একটু সিরিয়াস হও। এভাবে পড়াশুনা চললে ফে°ই°ল মার্কেও ফে°ই°ল করতে হবে। ভাগ্যিস তানিমা ফেসবুকে টিচার খুঁজতেছিল, অয়ন তো ওই পোস্ট দেখেই এসেছে।”

বিরক্ত হয়ে বললাম,
“আহ, আম্মু। থামো তো, খেতে দেও।”

আম্মু এসে একটা চিপসের প্যাকেট দিয়ে যেতে যেতে বলল,
“তাও ভালো অয়ন এসেছে, অন্যছেলে হলে আমি টেনশনে থাকতাম। আজকালকার দিন ভালো না, আবার মেয়েটাও ভালো না।”

খাওয়া ফেলে একদৃষ্টিতে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দিন ভালো না, মেয়ে ভালো না এইটুকু বুঝলাম, কিন্তু অয়ন কি খুব ভালো। এমন দিন কি আসবে না যেদিন অয়ন এসে তার মেয়ের হাত চেয়ে বলবে “আপনাদের রাজকন্যাকে আমার রানী করে নিতে চাই।”

জুম্মার নামাজের পর ঠিকই অয়ন আমাদের বাসায় এলো। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামায় ভালো মানিয়েছে মানুষটাকে। গোছানো চুল আর মুখের চওড়া হাসি, সব মিলিয়ে মি. পারফেক্ট।

আপু খাবার টেবিল সাজাচ্ছে, আমি সাহায্য করছি। অয়ন আর আব্বু সোফায় বসে টিভি দেখছে।

আমি কিছুক্ষণ পর পর অয়নের দিকে তাকাচ্ছি। আপু হয়তো বিষয়টা নোটিশ করেছে।

আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে নিচুস্বরে বলল,
“ভাইয়াকে বারবার দেখছিস কেন?”

আমি আপুর কানের কাছে গিয়ে বললাম,
“বলল আর চলে আসলো, কেমন ছ্যাঁ°চ°ড়া একটা।”

আপু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই চুপ করে গেলাম। হঠাৎ আপু হেসে দিলো। সুযোগ পেলে মানুষ যা করে আমিও তাই করলাম, হো হো করে হেসে উঠলাম।

আব্বু ডেকে বললেন,
“আর কত দেরি তানিমা। ক্ষুধায় তো ইঁদুর পেটে দমবৈঠক করছে।”
“হয়ে গেছে।”

সবাই খেতে বসলাম। এই শুক্রবারই একটা দিন যেদিন আমাদের পুরো পরিবার একসাথে লাঞ্চ করে। খাওয়া শেষে আমি ও আপু আমাদের রুমে চলে আসলাম।

অয়ন, আম্মু ও আব্বু ড্রইংরুমে আবারো গল্পে মজেছে। গল্প করছে বললে ভুল হবে, জাহানারা আন্টি মানে অয়নের আম্মুর সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে আমার আম্মু। এ কথা কবে শেষ হবে তা কেউই জানে না।

আপু খাটে শুয়ে বলল,
“আজকে কি কি পড়াইছে?”
“ফিজিক্স আর ম্যাথ করাইছে।”
“হোমওয়ার্ক দেয় নাই?”

বিরক্ত হয়ে বললাম,
“সারাদিন নবিতার আম্মুর মতো হোমওয়ার্ক হোমওয়ার্ক করো কেন? এখন আমি ঘুমাবো, সরো সরো।”

এমনসময় আব্বু দরজায় নক করে বলল,
“তন্বী, অয়নকে নিয়ে একটু ছাদে হেঁটে আসো। তোমার আম্মু আর আন্টির কথায় বেচারা হয়তো বোর হচ্ছে। আমি একটু ঘুমাবো।”

রুম থেকে বের হয়ে আব্বুকে বললাম,
“শুধু বোর কেন? রাদারফোর্ড, আইনস্টাইন, নিউটন সব হতে বলো।”

কথাটা একটু জোরেই বলেছি। অয়ন হয়তো শুনেছে, তার মুখের মিটিমিটি হাসি তো তাই জানান দিচ্ছে।

“চলুন অয়ন ভাই, ছাদে হেঁটে আসি।”

আমার কথায় তেমন কোনো জবাব না দিয়ে অয়ন উঠে আমার সাথে চলতে শুরু করলো। ছাদে এসে একপাশ ঘে°ষে দাঁড়িয়ে বললাম,
“এখান থেকে যদি তোমাকে ফেলে দিই।”

অয়ন পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,
“তোকে ছাড়া পড়বো না, নো টেনশন।”

আমি কিছু বলার আগেই অয়ন আবার বলল,
“আইনস্টাইন, নিউটন, রাদারফোর্ড তোর কথা শুনলে লজ্জা পেতো।”

আমি হেসে দিলাম। তারপর বললাম,
“বাইক কার? তোমার নিজের বাইক আছে বলে তো জানতাম না।”
“কিভাবে জানবি? আমাকে কতটুকু চিনিস?”
“গাজীপুরে তো আংকেলের বাইকটা নিয়ে ঘুরছো। এখনেরটা তো নতুন লাগে।”
“বাহ, কি খোঁজখবর নিয়েছিস তুই।”

একটু রেগে বললাম,
“হেয়ালি করো না।”

অয়ন হেসে বলল,
“আব্বুর বাইকটা বিক্রি করে আমাকে এটা কিনে দিয়েছে। তুই তো তিনচারদিন বেরই হসনি। আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখনই কিনলাম আরকি।”
“তাহলে এর আগের বাইকটা কার ছিল?”
“ফ্রেন্ডের থেকে ধার করা।”

চেঁচিয়ে বললাম,
“মানে কাগজপত্র ছাড়া বে°আ°ইনি?”
“তোরে পুলিশ ধরছে না কাগজ চাইছে? হুদাই চিল্লায়। (একটু থেমে) ফ্রেন্ডের থেকে ধার নিয়ে এদিকওদিক যাই, এটা জেনেই আব্বু কিনে দিলো।”

“ওহ, আংকেল তোমাকে কত আদর করে দেখছো। নিজের বাইক বিক্রি করে তোমাকে কিনে দিয়েছে।”

অয়ন আলতো হাসলো। তারপর রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোর কোচিং অফ করছে কেন?”

হঠাৎ হাসিটা বন্ধ হয়ে গেল। অয়ন আবারো বলল,
“তানিমা কিছু সন্দেহ করছে?”
“ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে অয়ন..”

আমার কথার মাঝেই বলল,
“কি?”
“এতো লুকোচুরি কিসের?”
“কই লুকোচুরি? আমরা ঘুরতে গেছিলাম, এটা জানলে তোকে ব°কবে?”
“হ্যাঁ, ব°কবে।”
“তারপর জানতে চাইবে আমাদের মাঝে কি সম্পর্ক আছে? তখন কি বলবি?”

আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“আপু এতো বোকা না, সে বুঝে যাবে এই সম্পর্কের নাম।”

আমি আর সরে আসতে পারলাম না। অয়ন আমাকে একহাতে একপ্রকার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কি নাম তার? আমিও জানতে চাই।”

সমস্ত শরীরে বিদ্যুতের ঝাঁ°কু°নি অনুভব করলাম। আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। অয়ন নিজেও জানে, আমিও জানি। তবে আবারো কেন এই প্রশ্ন? সে আমার থেকে শুনতে চায়? কি বলবো আমি?

আমাদের হৃদয়ের স্রোত একই মোহনায় ঢেউ তুলেছে, আছড়ে পড়ছে বারবার একই দিকে। না ভুল বললাম, দুটি মহাসমুদ্রের উ°ত্তাল ঢেউ ধেয়ে এসে ডু°বিয়ে দিচ্ছে আমাদের আর আমরা চলে যাচ্ছি অতল সমুদ্রের নিচে এক অজানা দেশে, পাতালপুরীতে। সেখানে সে হবে রাজা আর আমি তার একমাত্র রাণী।

চলবে……..