হলদে প্রজাপতি পর্ব-৩৬+৩৭

0
221

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

ছত্রিশ

সেদিন শনিবার ছিল যেদিন ইন্দ্রাশিষ বাবুর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল, তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার। মাঝে চার-চারটে দিন কেটে গেছে অথচ তিনি কিছুই জানাননি। এমনকি একটা ফোনও করেননি । যে ভালো লাগার আবেশটা জড়িয়ে ধরেছিল আমায় , সেটা হারিয়ে গেছে। এখন বেশ বুঝতে পারি , চাপা বিরক্তি আর অনেকটা অস্থিরতা পেয়ে বসেছে আমায় । বাবার মতে, অন্য সমস্ত প্রস্তাবের মতোই বিয়ের প্রস্তাবেও প্রত্যাখ্যান আসতেই পারে । সেটা সহজভাবেই নেওয়া উচিত। তাই যদি হয়ে থাকে, প্রত্যাখ্যান করার প্রয়োজনই যদি পড়ে থাকে কোন কারনে , তাই বা কেন তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন না ? এই অনিশ্চয়তা কি ভালো লাগে? হাজার হোক, তাঁর সঙ্গে, তাঁর মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা যে আমার বড় সহজ, সুন্দর ছিল । পাতাও আসেনি এ ক’দিন । মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারি, বাবা বেশ চাপা অস্বস্তিতে ভুগছে। এদিকে ফোন করেও জানা যায় না । কারণ তিনি নিজেই জানাবেন বলে গেছেন । অস্বস্তিকর পরিবেশ । এই পরিস্থিতিতে কিছু করার থাকেনা অপেক্ষা করা ছাড়া। কারণ, বল আর আমাদের কোর্টে নেই ।

আজকে কাজের বেশ চাপ রয়েছে । বেশ কিছু বস্তা চা’পাতা জমে ছিল । সেগুলোকে ক্যাটেগরি ওয়াইজ ভাগ করে ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়েছি । পাশের টি এস্টেটের টি ফ্যাক্টরিতে যে দিন স্টিমিং , কাটিং , প্যাকেজিং থাকে, সেদিন আমাকে যেতেই হয় । তার ওপর অ্যাসিস্ট্যান্ট যে ছেলেটি – মৃন্ময়, শিশির চলে যাওয়ার পর জয়েন করেছে, সে দুটো দিন ছুটি নিয়েছে। বাড়ি গেছে। তার মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। সে কারণে আমাকেই ছুটোছুটি করে সবদিক সামলাতে হচ্ছে ।

বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ কাজ সেরে টি ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম । আজকে সারাদিনে মোটামুটি যা প্যাকেজিং হলো, একটা গ্রস কাউন্ট লোড করে রাখতে হবে কম্পিউটারে। এই বিশেষ দিনগুলোর সারাদিনের একটা ছোট রিপোর্ট মালিক পক্ষকে পাঠিয়ে দিতে হয় । দেখি কাজটা কতক্ষনে শেষ হয় ।
জগন্নাথ দা’কে বললাম , তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাও । যত তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে পারি, ততই ভালো ।
গাড়িতে বসে শরীরটা যেন আর দিচ্ছিল না । ঘাড় হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আসলে যা হয়েছে, তা বোধহয় মানসিক ক্লান্তি । বেশ কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করলাম। অন করতেই দেখি বেশ কয়েকটা মিসড কল । পাঁচটা মিসড কল এসেছে মোট । ফ্যাক্টরিতে থাকলে ফোনের শব্দ শোনা যায় না । এত বিভিন্ন রকমের মেশিন, তার এত বিচিত্র কান ফাটানো শব্দ ! মোবাইলের রিংটোন কানে পৌঁছবে কি করে ? মিসড কল’গুলো চেক করলাম । একটা আননোন নাম্বার থেকে কল’গুলো এসেছে । ট্রু কলার এ অবশ্য নাম দেখালো শ্রীপর্ণা দত্ত । শ্রীপর্ণা .. শ্রীপর্ণা .. নামটা খুব চেনা চেনা, তবে ঠিক মনে পড়ছে না । কল করে একবার দেখেই নিই , না ? এত ভাবার দরকার কি ? কিন্তু না, মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খচখচানি আরম্ভ হয়েছে। উৎস কোথায় ঠিক ধরতে পারলাম না । তবে শ্রীপর্ণা দত্ত নামের কে আমাকে ফোনগুলো করেছিল, সেটা সম্পর্কে একটা ধারণা না পেলে ঘুরিয়ে ফোন করতে ইচ্ছে হলো না ।
গাড়ি পৌঁছলো অফিসের সামনে । নেমে পড়লাম । তাড়াতাড়ি কম্পিউটারটা অন করে বসলাম নিজের সিটে । যত তাড়াতাড়ি আজকের রিপোর্টটা তৈরী করতে পারি , তত তাড়াতাড়ি বের হতে পারব । আজকে বেশ কাজের চাপ ছিল বলে সকাল সাড়ে আটটার সময় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে । এখন সত্যিই শরীর আর দিচ্ছে না ।
খটা খট খট খট.. আমার আঙ্গুলগুলো টাইপ করে যাচ্ছে বটে, তবে মনে ফ্ল্যাশব্যাকে মাঝে মাঝেই শ্রীপর্ণা নামটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে । টাইপিং যখন মাঝপথে, হঠাৎ করে মাথায় ক্লিক করলো- আরে শ্রীপর্ণা তো বান্টির ভালো নাম ! অজিত কাকু , ভামিনী কাকিমার মেয়ে বান্টি ! ঠিক তো । যতদূর মনে পড়ছে , ওর বিয়ে হয়েছিলো সুপর্ণ দত্ত নামের একটি ছেলের সঙ্গে । সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার । ওরা ইউএসএতে শিফট করে গেছিলো । বান্টিরও মনে হয় সেম প্রফেশন । তবে কি ও এখন দেশে ফিরেছে? এখানেই আছে ? বহুদিন হয়ে গেল ওদের সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর আর রাখিনা । অতীতকে ভুলতে চাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা । আজকে হঠাৎ এত বছর পর বান্টি আমার ফোন নাম্বার পেল কোথা থেকে না ? আকাশ-পাতাল ভেবে লাভ নেই ।‌ এখনই ঘুরিয়ে ফোন করতে হবে । হাতের কাজ থামিয়ে মোবাইলটা তুলে নিলাম। ঘুরিয়ে ডায়াল করলাম নাম্বারটা। রিং হচ্ছে। অজান্তেই মনের ভেতর কেমন যেন একটা ঝড় এসে উপস্থিত হলো । আজকে এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পর আবার কেন আমার খোঁজ করা ? স্মৃতির অতলে যেসব দিনগুলোকে কোনরকমে চাপাচাপি দিয়ে রাখতে চাই, তাকে যেন টেনে-হিঁচড়ে বার করে আলকাতরা মাখিয়ে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া।
— হ্যালো-
ওদিক থেকে মহিলা কন্ঠের আওয়াজ পেলাম । সে গলা যে বান্টির কি অন্য কারোর কিছুই বোঝার উপায় নেই । যখন এই মেয়েটার সঙ্গে লেপটে থাকতাম, তখন সে এইট নাইনে পড়া একটা ছিপছিপে কিশোরী । পাখির মতো কলকল করে বেড়ায়। আজ এত বছর পরে কি আর তার গলা মেলাতে পারি?
— হ্যালো ।
— হ্যাঁ তরুদি ? চিনতে পারছিস তুই আমায় ?
— পারতাম না , তবে মোবাইল অ্যাপস এর কারণে বোধহয় পেরেছি । বান্টি বলছো তো ?
— নাহ্ , দেখছি তুই চিনতে পারিস নি ।
আমতা আমতা করে বললাম , তবে কে ?
খিলখিল করে হাসির আওয়াজ এলো ওদিক থেকে ।
ও বলল, তুই কি রে ? আমাকে হঠাৎ ‘তুমি’ বলছিস কেন ? সবকিছুই কি ভুলে গেছিস ? আমাকেও কি মনে নেই ?
— বুঝলাম ।
এত বছর যার সাথে আর কোনরকম যোগাযোগ নেই, যে মেয়েটা আজকে সাকসেসফুলি এস্টাবলিস্ট , দেশের বাইরে থাকে, তাকে হঠাৎ করে ‘তুই’ বলতে কোথায় যেন বাধে ।
একবার গলা ঝাড়া দিয়ে বাধো বাধো গলায় বললাম, বল্ বান্টি কেমন আছিস ? কাকু, ইয়ে সরি, কাকিমা কেমন আছেন ?
— মা ভালো আছে । এজ রিলেটেড কম্প্লিকেশনস কিছু রয়েছে । বাট স্টিল , সি ইজ ওকে। বাই দ্যা ওয়ে, জেঠু জেঠিমা কেমন আছেন রে ?
— মা মোটামুটি ঠিকই আছে । কিন্তু বাবার শরীরটা মাঝে মাঝেই গন্ডগোল করে।
— আর বল্ , তোর স্টেটাস কি এখনো সেই একই , আই মিন সিঙ্গেল এন্ড স্টেবল ?
অল্প হাসলাম , হ্যাঁ তাই।
— বিয়ে করলি না আলটিমেটলি , তাইতো ?
— না । আপাতত সেরকমই ।
ওদিক থেকে বান্টি কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি প্রসঙ্গ চাপা দিতে বললাম ,
— তোর মিস্টারের খবর বল্। সুপর্ণ ভালো আছে ?
— যাক । তাও তোর আ্যটলিস্ট আমার হাজবেন্ডের নামটা মনে আছে । না, তাহলে বলতেই হয় , তুই অনেক কিছু মনে রেখেছিস। আমি তো তোকে ফোন করার আগে ভাবছিলাম, ফোন যে করব, মনে করতে পারবি তো ? বেমালুম ভুলে যাসনি তো?
— কি যে বলিস বান্টি?
— তোর হাবভাব জাস্ট লাইক দ্যাট , তরুদি । মাঝের এতগুলো বছরে তুই কোন কমিউনিকেশনস্ রেখেছিস বল তো ? সো মেনি মিডিয়াজ আর দ্যর , ইফ এনিওয়ান ওয়ান্টস্ টু কিপ এনি কাইন্ডা কমিউনিকেশন ।
— একচুয়ালি –
— নো , নো এক্সকিউজ প্লিজ , তরুদি । ইউ হ্যাভ টার্নড অফ দা কনট্যাক্টস ইন্টেনশনালি। সেটা বোঝাই যায় ।

চুপ করে রইলাম। এটা বোঝাটা খুবই স্বাভাবিক যে আমি ইচ্ছে করেই যোগাযোগ রাখিনি। কিন্তু ঠিক কোন মানসিক অবস্থায় একজন মানুষ তার লাইফের একটা হোল এপিসোড ডিলিট করে ফেলতে চায়, সেটা শুধুমাত্র সেই ছাড়া আর কেউ বুঝবে না । অন্য কাউকে বোঝাতে যাওয়ার কোন মানেই নেই।
বললাম , তোর ছানাপোনা কটা ?
— এইতো, দুটো । একটা ছেলে, একটা মেয়ে।
— বাহ্, একেবারে গোছানো সংসার ।
— তোকেই বা গুছিয়ে সংসার করতে কে বারণ করেছিল ? করিস নি তো আর কি হবে ?
— সবাই কি আর তোর মত ভাগ্য নিয়ে জন্মায় রে ? আমি সংসার করতে নামলে নির্ঘাত ছড়াতাম ।
— সে, উ্য নো, সংসারে সবাই একটু আধটু ছড়ায় । কেউ কম, কেউ বেশি । ডিপেন্ডস্ । তুই তো কাজটাতেই নামলি না ।
— বুঝলাম । তা এখন আছিস কোথায় ?
— তোর একদম ঘাড়ের ওপর আছি।
— মানে ?
— মানে এখানে ।
— এখানে ?
— হ্যাঁরে, এখানে কিছু এমার্জেন্সি কাজ পড়েছিল ।
— এমার্জেন্সি বলতে ?
— সেটা এই এখানকার সমস্ত বাড়িঘর বিক্রি রিলেটেড বেশ কিছু লিগাল প্রসিডিওর রয়েছে, সেসব করতেই বেশ কিছুদিনের একটা ছুটিতে এসেছি এখানে। এলাম এই টু উইকস হবে । জানতামই না তুই এখানে, এই এত কাছে রয়েছিস ।
— তারপর ? জানলি কিভাবে ?
ফোনের ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ এলো , বাব্বাহ্, তুমি এখানে খুব ফেমাস হয়েছো, জানো না তো । লেডি ম্যানেজার বলে কথা । এখানে কিছুদিন থাকলেই বাতাসে ঠিক তোমার কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে ।

হেসে ফেললাম ।
বললাম, তা বাতাসই কি ফোন নাম্বারটাও দিল ?
— হ্যাঁ , একদম । শোন তরুদি , এসব ফালতু কথা ছাড়্ । তুই আমাদের বাড়িতে কবে আসছিস বল ?
— তুই এখন আছিস কোথায় ? তোদের সেই-
— আমাদের সেএএই বাড়ি। যেখানে তুমি তোমার লাইফের ভাইটাল থ্রি ইয়ার্স কাটিয়েছো , ম্যাডাম ! এখন ভুলে গেলে চলবে ? কবে আসছিস বল্ ।
— আমি একচুয়ালি –
— তোর কোন কথা শুনছি না । আমি যা বলছি শোন । এতদিন পর তুই এত কাছে রয়েছিস জেনেও এবার তোর সঙ্গে দেখা না করে , আই ওন্ট রিটার্ন ব্যাক । নেভার , তরুদি । আসতেই হবে তোকে । তুই বল কবে আসবি , আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।
— আচ্ছা ঠিক আছে, জানাবো তোকে পরে।
— না পরে না , এখনি বল্ কবে আসবি ।
— বললাম তো –
— না , তুই বললে হবে না । আমি বলছি শোন । তুই স্যাটারডে আয়, ডে আফটার টুমোরো। সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দেবো, চুপচাপ এসে আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করবি। আর হ্যাঁ, নাইট স্টে করতে হবে । কতদিন , কত বছর হয়ে গেছে, বলতো ? মনে আছে সেই আমরা একসাথে শুয়ে কত্ত গল্প করতাম তখন ?
— আরে শোন্ না, মা-বাবা আছে তো এখানে , বাবার শরীরটা তেমন ভালো নয় ।
— সে হবে । তুই আগে আয় । এখান থেকে এইটুকু । কতক্ষণ টাইম লাগবে? হাফ আ্যন আওয়ার্স হবে। তেমন কোনো প্রয়োজন পড়লে তুই মাঝরাতেও চলে যেতে পারিস। ডোন্ট ও্যরী । সেসব কথা পরে হবে । এখন যেটা তুই আগে করছিস তা হল , পরশুদিন আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো, সটান চলে আসছিস ।
— কিন্তু পরশুদিন তো শনিবার পড়ছে। অফিস রয়েছে ।
— তুই তো ম্যানেজার । ম্যানেজ করে নিবি ।
— সবকিছুই ম্যানেজ করতে হয় রে। কিন্তু ছুটি ম্যানেজ করা ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট ।
বান্টি হাসলো । বলল , ছুটি ম্যানেজ করতে হবে না । একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবি। সারাদিনের কাজ সেরে নিয়ে আমাকে শুধু টুক করে একটা ফোন করে দিবি । উইদিন হাফ আ্যন আওয়ার্স গাড়ি পৌঁছে যাবে । বুঝলি ?
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললাম , আচ্ছা ঠিক আছে রে। বেশ। তাই হবে।
হালকা হাসির আওয়াজ এল ওপাশ থেকে।
বললাম , রাখছি তাহলে এখন।
— ওক্কে বাই বাই , রাখ্ । সি ইউ সুন।

ফোনটা রেখে দিয়ে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম । চিন্তাভাবনাগুলো এলোপাথাড়ি ঘূর্ণির মতো পাক খাচ্ছে। ঝড় উঠেছে একটা । মনটা তেঁতো হয়েই ছিল । আরো দু পোঁচ করলার রস মিশলো তাতে । কেন যে এরা বোঝে না, মানুষ জীবনের যে সমস্ত অধ্যায় ভুলে থাকতে চায় , তাকে তা ভুলে থাকতে দিতে হয় । আমি যোগাযোগ রাখতে চাইনি বলেই তো রাখিনি । এইযে বান্টির সঙ্গে দেখা হবে, আর কে কে ওর সঙ্গে এখন এখানে আছে জানিনা , স্বামী ছেলে-মেয়ে তো নিশ্চয়ই থাকবে , হয়তো ভামিনী কাকিমাও রয়েছে । ওদের বাড়িতে থাকার সময়টুকুর মধ্যে আমি যে গর্ব করার মত কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারিনি। যা ঘটিয়েছিলাম, সবটাই চরম লজ্জার , কলঙ্কের । কেন আবার সে সমস্ত খুঁচিয়ে তুলে , ঝেড়েমুছে নব উদ্যোগে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ? আমি কি তাতে সুখী হব? নিশ্চয়ই না । এত বছর পর আমার মুখটা দেখেই বা ওর কি লাভ হবে জানিনা , তবে আমার অশান্তি বেড়ে যাবে অনেকখানি যে, তাতে কোন সন্দেহ নেই ।

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

সাঁইত্রিশ

আজ শনিবার । পাক্কা এক সপ্তাহ হয়ে গেল ইন্দ্রাশিষ বাবুর কোন খবর নেই । দেখা তো করতে আসেনই নি । একটা ফোন করারও সময় পাননি । বুঝলাম না হয় কোন কারনে প্রপোজালটা তিনি একসেপ্ট করতে পারলেন না । মিনিমাম ভদ্রতা বলতে কিছু একটা থাকে তো । ফোন করে জানানোটা আবশ্যক ছিল । সম্পূর্ণ অপরিচিত দুটি পরিবারের মধ্যে যখন ম্যারিটাল ইস্যু নিয়ে কোনো কথাবার্তা হয় , তখনো নেগেটিভ কিছু হলেও সেটা জানিয়ে দেওয়াই ভদ্রতা । আর সেখানে , ওনার সঙ্গে , পাতার সঙ্গে , আমার প্রায় নিজের পরিবারের মতোই সম্পর্ক হয়ে গেছিল । তাই হয়তো একটু অন্যরকম ভাবতে শুরু করেছিলাম আমি । রঙিন প্রজাপতিগুলো আবার ডানা মেলে মনের ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল । বুড়ো বয়সে এসে ভীমরতি ধরলে এমনই হয় । শখ হলো তো হল , চল্লিশ পার করে হলো ! ছি ছি ! রাগে গা রি-রি করছে আমার । উনি না হয় ফোন করেননি । আমি একটা ফোন করব । অবশ্যই করবো । চোখা চোখা অনেকগুলো বাক্য সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি । মুখের ওপরে যতক্ষণ না সবগুলো শোনাতে পারছি, ততক্ষণ আমার সারারাত এপাশ-ওপাশ করেই কাটবে । মাথার মধ্যে একগাদা গুবরে পোকা কিলবিল করছে। যতক্ষণ না সেগুলোকে সব বার করে ফেলে মাথাটাকে পরিষ্কার করতে পারছি , ততক্ষণ আমার শান্তি নেই । তবে পাতার জন্য মন কেমন করে । সত্যি করে মেয়েটার ওপর বড় মায়া পড়েছিল । ও কি আর আমার কাছে আসতে চায় না ? তা নিশ্চয়ই সম্ভব নয় । নিশ্চয়ই চায় । ওকে বারণ করা হয়েছে । বাড়ি থেকে আসতে দেওয়া হয়নি । বেচারা আবার হয়তো আগেকার মতো সৃষ্টিছাড়া জীবন পাবে । যাক গে , আমার এসব ভেবে কাজ কি ? যার জীবন, সে বুঝে নেবে । তার বাবা বুঝবে । আমার কি ? আমি কে ?

আজকে যে বান্টিদের বাড়িতে যাওয়ার কথা , রাতে ফিরতে নাও পারি , বান্টিরা এখানেই আছে , ওদের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি, বাবা-মাকে সবটা জানিয়েই একটু সকাল করে বেরিয়ে এসেছিলাম অফিসে । তাড়াতাড়ি করে কাজ গুছিয়ে ফেলেছি । যেতেই যখন হবে , তখন আর ফালতু দেরি করে লাভ কি ? এখন বেলা আড়াইটে বাজে । আমি অলরেডি বান্টিকে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলেছি।

যখন ‘রায় ভিলা’য় পৌঁছলাম, তখন বেলা সাড়ে তিনটে। মানুষের ভাগ্য যে কোন চোরাইপথে কোথা দিয়ে কাকে কখন কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে , তা কেউ জানে না । আমি আবার আজ প্রায় ‘বিশ সাল বাদ’ রায় ভিলায় পা রাখলাম। বান্টিটা খবর পেয়েই কোত্থেকে ছুটে এসে সটান আমায় জড়িয়ে ধরল। ধরেই রইলো প্রায় এক মিনিট । তারপর ছেড়ে দিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখল আমায় পায়ের চুল থেকে মাথার নখ পর্যন্ত । যেন স্ক্যান করছে ।
বলল, চুল কমে গেছে , মোটা হয়েছিস , চেহারার মধ্যে বেশ একটা ম্যানেজার-ম্যানেজার ভাব এসেছে । আর বাকি কোথায় কি হয়েছে এখনই বলতে পারব না। কিছুক্ষন কথা বলি । হাল-হকিকত দেখি। তারপর বলছি।
হেসে বললাম, আর বুড়ো হয়েছি যে, সেটা বললি নাতো ?
— ওমা ! তুই জানিস না? বুড়ো হয় সব সময় মিসেস’রা । মিস’রা কখনো বুড়ো হয় না । এভারগ্রীন থাকে । তুইই বল, তোর কি এখনি একটা চটপট প্রেম করে ফেলতে ইচ্ছে হয় না ? বল তুই-
— চটপট করতে ইচ্ছে করলেই প্রেমিক পাওয়া যায় না । তার জন্য কাঁচা বয়স দরকার হয় । আর আমাদের মত ঝড়তি পড়তি, যাদের বিয়ে হয়নি, তাদের জন্য রেডিমেড লাভার পাওয়া যায় না ।
— বিয়ে হয়নি , না করিস নি ?
— এই তুইই যা বললি আমি নাকি বিয়ে করিনি । রাজ্য সুদ্ধু সবাই জানে, আমার বিয়ে হয়নি । মেয়েদের বিয়ে হয় না। করা না করার ব্যাপারটা সমাজ মোট্টে তোয়াক্কা করে না ।
— এসব নিয়ে তোর সঙ্গে আমি খুব ঝগড়া করবো । দাঁড়া না । এখন চল, মায়ের সঙ্গে দেখা করবি আয়। মা খুব আনন্দ করছিল শুনে যে তুই আসবি।
কথাটা শুনে আশ্চর্য হলাম । আমি আসবো একথা শুনে ভামিনী কাকিমা আনন্দ পেয়েছেন ? হতে পারে । হতেই পারে । না হওয়ার কি আছে ? পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল । সেখানে, একজন খুঁতখুঁতে মানুষ, যে তার কিছু ম্যানিয়ার কারণে একটা গ্রামের মেয়েকে ঠিক পছন্দ করত না, আজকে এত বছর পর তার মানসিকতার বা দৃষ্টিভঙ্গির কি কোন পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে না ? আমিও তো পরিবর্তিত ভার্শন। আর কি সেই গ্রামের মেয়েটা আছি ? আমার গা শুঁকে কেউ কি আর সেই হারিয়ে যাওয়া সোঁদা সোঁদা মেঠো গন্ধটা পাবে ? সেই গন্ধের সঙ্গে হারিয়ে গেছে আমার শৈশবও । অনেক শৈশবই এইরকম মাজা-ঘষা পালিশের আড়ালে হারিয়ে যায় ।
— আয় তরু দি-
বলে ও সামনে হেঁটে চলল। আমি ওর পেছন পেছন। বাড়ির ভেতরটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম । বাইরের যতটা জরাজীর্ণ অবস্থা, ভেতরটা ততটা নয়। এই বাড়ির প্রতিটা কোণ আমার ভীষণ পরিচিত। বাড়ি যদি পুরনো হয়ে থাকে, আমিই বা কি কম পুরনো হয়েছি? পুরনো বাড়িতে পুরনো মানুষগুলো, সাথে অবশ্য কিছু নতুন। দেখা যাক নতুন পুরনো মিলিয়ে কার সঙ্গে কতখানি সমঝোতায় আসা যায়।

বান্টির চেহারার মধ্যে আজও বেশ একটা ছেলেমানুষীর ভাব রয়েছে । সেই ছিপছিপে গড়ন, সেই কল কলে উপস্থিতি । দিব্যি কলেজ ইউনিভার্সিটি’তে পড়া মেয়ে বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। চুলগুলো বব’কাট, ওয়াইন রেড কালার করা । পরনে একটা অলিভ কালারের লং স্কার্ট। সাথে ধবধবে সাদা সফট কটনের স্লিভলেস টপ। দুই ছেলে-মেয়ের মা যে , চেহারায় তার কোনো প্রতিফলন নেই । গাম্ভীর্য নেই। দেখে বোঝা যায়, সে আনন্দে রয়েছে, সুখে রয়েছে । তা ভালো । অবশ্য লোকের ভালোয় আমার ভালো কি মন্দ বুঝিনা । কেউ সুখে আছে দেখলে আমার নিজের অ’সুখ’টা প্রকট হয়ে পড়ে নিজের কাছেই। আচ্ছা, আমার এই অ’সুখ’ কি আমার জীবনে নিজের ইনভাইট করে নিয়ে আসা ? আমি সঠিক সময়ে বিয়ে করে সংসারী হলে কি আজকে সুখী বান্টিকে দেখে সূক্ষ্ম যে মানসিক অশান্তি আমার হচ্ছে, তা হতো না ? তবে কি বিয়ে করার মধ্যেই কোন মোক্ষলাভ ছিল? নিশ্চয়ই নয় । সমাজ যে মেয়েদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় বিয়ে করার মধ্যেই তাদের মোক্ষলাভ , এ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ভুল । একটা ভুল বিয়ে করে শুধু নিজের ম্যারিটাল স্ট্যাটাস চেঞ্জ করার কোন মানেই হয় না । এই যে আমি এখন নিজের পছন্দমত একটা জায়গায় পছন্দমত চাকরি করতে পারছি , সেটা কি একটা ভুল বিয়ে করে ফেললে সম্ভব হতো? নিশ্চয়ই নয় ।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই দোতলায় উঠলাম । যে ঘরটায় আগে বান্টি থাকতো , সেখানেই ও ঢুকলো। আমিও ওর পেছনে পেছনে। ভামিনী কাকিমা খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে বসে ছিলেন। পরনে একটা সুতির ঘরে পড়ার হাউসকোট । মানুষটার শরীরে পরতে পরতে বয়সের ছাপ । বোধ হয়, যা বয়স তার চেয়ে একটু বেশিই। শরীর মেদাল, থলথলে হয়ে উঠেছে । দেখে যা বুঝলাম, বিশেষ কিছু অ্যাক্টিভিটি আজকাল হয়ত আর ওনার দ্বারা সম্ভব হয় না। আমাকে দেখে মুখে একটা খুশির হাসি ফুটে উঠল ।
বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন। সহজ সুন্দর হেসে বললেন , ওমা ! এসেছিস তরু ? কখন থেকে ভাবছি আমি, তুই কখন আসবি।
আমি বেশ অবাক হলাম । তিনটে বছর যখন কাছে থেকেছি , তখন কোনদিন উনি এইরকম সহজ-স্বাভাবিক সুরে সম্বোধন করেন নি । কথাবার্তা কাঠখোট্টা ছিল । ‘তুই’ ‘তরু’ বলে আপন করে নেওয়ার কোন প্রশ্নই নেই । বুঝলাম সময় নিজের নিয়মে অনেক কিছু পরিবর্তন করে নেয় । আমি এগিয়ে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
— থাক থাক । কত বছর পর দেখছি তোকে । কি ভাল লাগছে ।
ভালো লাগলো ? আজ আমাকে দেখে ভামিনী কাকিমার ভালো লাগলো? যার জন্য একসময় তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন , একটা একটা করে দিন গুনেছেন কবে আমার কলেজের সেশন শেষ হবে, আপদ বিদায় হবে, আজকে তাকে দেখে ভালো লাগছে ? বিরক্ত হওয়ার মতো সঙ্গত কারণ ছিল বটে । তবে আজ কেন যে ভালো লাগছে, সেটা বুঝতে পারলাম না । হয়তো নিজের ভরা সংসার, নিজের আধিপত্য, নিজের রুপ-যৌবন-প্রতিপত্তি ভরা সময়টার প্রতিভূ হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। মানুষ তার ফেলে আসা ‘আমি’কে দেখতে খুব পছন্দ করে, একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে আসার পর ।‌ হয়তো তাই, হয়তো তা নয় । অন্য কিছুও হতে পারে। কাকিমা অনেকক্ষণ গল্প করলেন আমার সঙ্গে । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাবা-মায়ের খবর নিলেন । আমি কি করছি এখন , ডিটেইলস সব জানলেন। আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পেছনে যে ওনাদের অবদান রয়েছে , সেটাও বার দুই তিন নক করলেন ইন্ডিরেক্টলি । তবে আমার কাজকে এপ্রিশিয়েট করলেন খুব । আমি যে এখানে সাহস করে চাকরি নিয়ে চলে আসতে পেরেছি, বাবা-মাকেও নিয়ে এসে রেখেছি, সবটাই ।

বান্টি কিছুক্ষণ পরে ওর ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে এলো । ফরসা টুকটুকে তুলোর পুতুলের মতো দুই ভাইবোন। মেয়ে বড়, ছেলে ছোট । কিছুক্ষণ তারা আমার সঙ্গে বিশেষ কোনো কথা বলল না । তারপর যখন ঘন্টা খানেক সময় কাটলো , তখন আস্তে আস্তে সহজ হয়ে এলো । ছোট ছেলেদের নিয়ম তাই । নতুন মানুষের সঙ্গে চট করে মিশে যেতে পারে না , তবে একবার মিশে গেলে তখন আর কাছ ছাড়া করতে চায় না । ওর মেয়েটা মাঝে মাঝেই আমার কোলের কাছে ঘেঁষে আসছিল । একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো আমার । হঠাৎই বুঝতে পারলাম, এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ কি । পাতার কথা মনে পড়ছে । মেয়েটা কেমন যেন কাছে আসতে আসতে এক ঝটকায় দূরে সরে গেল ।

সন্ধ্যাবেলা সারাক্ষণ ধরে বসে বসে আমরা অনেক গল্প করলাম । এখনকার গল্প , পুরোনো দিনের গল্প । ওর ছানাপোনা দুটো কাছেই ঘুরঘুর করছিল। ওদের বক্তব্য , মিমি যেও না । স্টে হিয়ার উইথ আস ।
ওদের দুজনেরই ইন্ডিয়াতে এসে খুব ভালো লেগেছে । মন খারাপ এই জন্য যে , কিছুদিন পরেই আবার ফিরে যেতে হবে। বান্টির হাজবেন্ড সুপর্ণ, কিছু পার্সোনাল কাজে নিজের বাড়িতে গেছে। ওরা এখানে এই মাসটা রয়েছে । সামনের পুজোর মাসে বান্টি ওর শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে । কলকাতায় , লেকটাউন ।

তবে কি না শুধু গল্প করলে তো আর পেট ভরে না । পেট ভরানোর জন্য অবশ্য প্রচুর আয়োজন ছিল। সন্ধ্যেবেলাতেই তিন-চার রকমের স্নাক্স, পকোড়া , স্যান্ডউইচ । অত আবার কেউ খেতে পারে ! আর রাতে ডিনারে তো একদম এলাহি কান্ড । প্রণ কাটলেট , লাচ্ছা পরোটা, মাটন কষা, কাশ্মীরি পোলাও, চিকেন রেজালা , চিংড়ির মালাইকারি, ভেজ আইটেম আরো গোটা দুই তিন , স্পেশাল মিষ্টি তিন-চার রকমের । বিয়েবাড়ির আয়োজন। খাবার টেবিলে বসে কোথা থেকে আরম্ভ করব , কতটুকু খেতে পারবো, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । মোদ্দাকথা টোটালি কনফিউজড।
আমার অবস্থা দেখে বান্টি হেসে বলল, টেনশন করিস না তরুদি । বুফে সিস্টেম । তুলে তুলে নিয়ে যতটুকু পারবি খা । কেউ তোকে জবরদস্তি করবে না বেশি খাওয়ার জন্য ।
প্রথমে প্রন কাটলেট একটা তুললাম প্লেটে । প্লেটের পাশে যথারীতি টিস্যু পেপারের ওপর স্পুন, ফর্ক , নাইফ সবকিছুই রাখা রয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার সরঞ্জামপাতি ।
সেগুলোর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছি দেখে বলল, তুই হাতে করে খা । যাতে কমফর্টেবল সেভাবে খাবি। তুই স্টার্ট কর। তোর ওনারে আমরা সবাই আজ হাতে করে খাব ।
তা ভালো । যতটুকু যা পারলাম খেলাম । অবশ্যই হাতে করে, তৃপ্তি করে খেয়েছি । রাতে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে দেখলাম, নিচে যে ঘরটায় ভামিনী কাকিমা আর কাকু শুতেন , সেই ঘরে । তিন বছর এখানে থাকতে এই ঘরে তিনবারও ঢুকেছি কিনা সন্দেহ । আজকে একেবারে একটা গোটা রাত ঘুমাবো, ভাবা যায় ! আমাকে শুতে বলে ও বেরিয়ে গেল । কিছুক্ষণ পরে , বোধহয় ছেলেমেয়ের শোয়ার ব্যবস্থা তদারকি করে, আরো কিছু টুকটাক কাজ সেরে ফিরে এলো পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে এখন । ঘরের মধ্যে ঢুকে এসিটা অন করে টেম্পারেচার একেবারে এইটটিন করে দিল ।
— এত কমালি কেন রে ? আমার তো এসি দরকারই হয় না । ইনফ্যাক্ট এখানে টেম্পারেচার এমনিতেই খুব শুদিং ।
— প্লিজ দি, ডোন্ট সে দ্যাট, এসিটা এখন আমায় অফ করে দিতে হবে । আমি পারবো না । এইখানে অ্যাডজাস্ট করতে পারি না একদম ।
— কিন্তু , শীত করবে তো রে !
— ওয়েট !
বলে খাটের বক্স থেকে দুটো ব্ল্যাঙ্কেট বার করে বিছানার ওপর রাখল ।
বলল, জাস্ট এই কটা দিন এখানে স্টে করার জন্য এসিটা লাগাতে হয়েছে । আমি একদম পারিনা এসি অন না করে শুতে । না হলে, তোর অসুবিধা হচ্ছে, আমি চালাতাম না । তাহলে আমাকে সারা রাতই এপাশ ওপাশ করতে হবে।
ঢাকা নিয়ে শুয়ে দেখলাম, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না ।
বললাম , ঠিক আছে, তুই এসে শো ।
ও ওর ব্ল্যাঙ্কেটটা খুলে নিয়ে সুরুৎ করে আহ্লাদী মুখে বিড়ালের গায়ের মতো মোলায়েম আদুরে ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে সেঁদিয়ে গেল । সী গ্রীন কালারের কম্ফর্টেবল কটনের হাফ কাফতানের গলার ওপর দিয়ে ওর সাদা রাজহংসীর ডানার ভাঁজের মতো ক্লিভেজ উঁকি দিচ্ছিল । কি সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে । ছিমছাম, সুন্দরী, মড, সেক্সি । ওর বর নিশ্চয়ই যখন ওর শরীরটাকে নিয়ে খেলা করে, মাখনের মত গলে যায় সেটা । নিশ্চয়ই ওদের দুজনের মধ্যে ভীষণ রকমের রোমান্টিক একটা যৌন সম্পর্ক রয়েছে ।
ও বলল , তরু দি দ্যাখ্ , তোর লেফট সাইডে তাকা। হ্যাঁ । ওইটাই বেডসাইড সুইচ । অফ করে দে । নাইট ল্যাম্পটা আমি অন করে এসেছি ।
সুইচটা অফ করে দিলাম । টিউবের ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলোটা বন্ধ হয়ে, দক্ষিণের কোণে রাখা সুদৃশ্য টেবিল ল্যাম্পের মোলায়েম লালচে আলোয় ঘরটা ভরে গেল। বান্টি কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে উঠে বসলো।
বাঁ হাতের তালুর ওপর মাথাটা হেলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ইসস্ ! এ লং জার্নি ইন বিটুইন। বল ? সেএএই তুই আর আমি একসাথে শুতাম, কত্ত গল্প করতাম। কি সুন্দর ছিল দিনগুলো ।
আমি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বললাম না। দিনগুলো সত্যিই সুন্দর ছিল কিনা, তা আমি জানিনা। অনেক কথা বলছিল ও । আমি কখনো ‘হ্যাঁ’ , কখনো ‘না’এ কাজ সারছিলাম। দেখছিলাম, নরম আলোয় ওর চিবুক কোনো এক রূপকথার দেশের লালচে শামুকের খোলের মতো হেলেদুলে কথার তালে তালে উঠছে নামছে । ঈশ্বর এ পৃথিবীতে কাউকে কাউকে কত সুন্দর করে যত্ন ভরেই না তৈরী করেন , তাই না ? আমাদের মত হেঁজিপেঁজি মানুষজনের প্রতি জন্মের আগে থেকে ঈশ্বরই বিমুখ । মানুষের প্রতি তবে আর সে ভরসা রাখা কেন ?

এ কথা, সে কথা বলার পর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল , হ্যাঁ রে তরুদি, তুই বিয়ে করিস নি কেন বল্ তো-
— কেন আবার । ইচ্ছা করেনি ।
— আর ইউ সিরিয়াস? ইচ্ছা করেনি, নাকি শুধু একজনকেই বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল ? তার সঙ্গে হয়নি বলে –
— ছাড়্ ওসব কথা ।
— না !
বলে ও উঠে বসলো । বলল , আই নো উ্য ওন্ট ফিল ভেরি ইজি ডিসকাসিং , স্টিল লেটস ডিসকাস আ বিট । একটা কথা তুই আমায় বল্ , তুই কি সোনুদার জন্যই আর বিয়ে করলি না ?
— আরে ছাড় না এসব কথা ।
— নো । লিসেন টু মি । আমি একচুয়ালি স্ট্রংলি অ্যাপ্রিসিয়েট করি একটা মেয়ের লাইফ লং আনম্যারেড থাকার ডিসিশনকে । অ্যাট দ্যাট পয়েন্ট, আই ডু এপ্রিসিয়েট উ্য টু । কিন্তু, যে কারণে তুই আনম্যারেড থাকলি, সেখানেই আমার আপত্তি। তুই কি না সোনুদার জন্য বিয়ে না করে বসে রইলি !
— এসব কথা কেন আজকে এত বছর পর-
— তুলছি । কারণ আমার তোর উপর খুব রাগ হচ্ছে । তখন সোনুদা তোর সঙ্গে যা করেছিল , তাতেই তোর বুঝে যাওয়া উচিত ছিল । তাও তুই বুঝিস নি। যাগ্গে ছাড়্ । শোন্ তাহলে আমার সঙ্গে সোনুদার , উমমমম্ ধর এই , বিফোর ফোর টু ফাইভ ইয়ার্স , একবার দেখা হয়েছিল । ও কি বলেছে জানিস্ ? অনেক কথা হয়েছে তোর ব্যাপারে । শোন্ তাহলে।
— আমি ওসব শুনতে চাই না।
— শুনতে তোকে হবে তরুদি। উ্য শ্যুড, উ্য মাস্ট এক্সপ্লোর দ্য ট্রুথ । কান্ট প্লে হাইড এন সিক উইথ দ্য হার্ডকোর ট্রুথ অফ লাইফ । উ্য হ্যাভ টু ফেস । কথাগুলো বলি শোন তোকে ।

ক্রমশ..