হলদে প্রজাপতি পর্ব-৩৮+৩৯

0
235

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

আটত্রিশ

অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বান্টি বলল, বলবো তোকে সবটাই । তুই শুধু আমাকে বল, তুই কি সোনু দা সম্পর্কে কোন আপডেট রাখিস ?
ওর কথাটা ঠিকভাবে না শুনেই আমি বলে বসলাম, না ! আর আমার রাখার কোন ইচ্ছেও নেই । আপডেট কেন, আমি কোন খবরই রাখি না।
— বুঝলাম । তুই লাইফের ওই এপিসোডটা থেকে পালাতে চেয়েছিস, কিন্তু পারিসনি । যাক গে শোন । যখন রিসার্চ করতে আমাদের বাড়িতে এসে থেকে ছিল, তখন তো একটা স্কুলে ছিল । সেখান থেকে লিভ নিয়ে এসেছিল জানিস তুই। তারপরে ডক্টরেট কমপ্লিট করে পোস্ট ডক করল। স্কুলের চাকরিটা ও ছেড়ে দিয়েছিল । আমার সঙ্গে যখন দেখা হয় , তখন একটা সিএসআইআর ল্যাবের সাইন্টিস্ট । এখনো নিশ্চয়ই সেই প্রফেশনেই রয়েছে । ইনফ্যাক্ট আর প্রফেশন চেঞ্জ করার কোন গল্প থাকার কথা নয় । দাদার সঙ্গে ওর ব্যাঙ্গালোরে একটা কনফারেন্স ছিল । আমি তখন দাদার কাছে গিয়েছিলাম। সোনুদা দাদার ফ্ল্যাটে এসেছিল উইথ ফ্যামিলি । সেখানেই দেখা এতগুলো বছর পর। একটাই ছেলে আছে। সে অবশ্য সাথে আসেনি । ওরা থাকে দিল্লিতে । সোনুদার ওয়াইফের সঙ্গে আলাপ হলো । নাম ডক্টর রুচিকা মিত্র । একই, আই মিন , কাছাকাছি ফিল্ডেই দুজনের রিসার্চ । ইউ ক্যান গো ফর সার্চিং দা নেম, ডক্টর রুচিকা মিত্রা । বেশ কিছু ভালো ভালো সাইন্টিফিক পেপারের অথর্শিপ রয়েছে, এ গ্রেড জার্নালে। হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর । তুই দেখে নিস না সার্চ করে ।

আমার মাথার মধ্যে তখন হাজারটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছিল । মাথা ঝিমঝিম করছিল, শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল । স্বাভাবিকভাবেই একটা কম্প্যারিশন মনে চলে আসে । কোথায় সোনুদার বউ আর কোথায় আমি । হেল্ এন্ড হেভেন ডিফারেন্স । অথচ একটা সময় সারা দিনরাতের কল্পনা ছিল, আমি সোনুদার বউ হয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছি । সোনু দা শুধু আমার ।

বান্টি বলে চলেছে , আর দেখতে ! ও মাই গড ! ইজিলি মডেলিং করতে পারত, জানিস ? রিয়েলি ফ্যাব্যুলাস ! সুন্দরী যাকে বলে । ভদ্রমহিলাকে দেখে, তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে যেকোনো কারোর ভালো লাগতে বাধ্য । আমিতো কিছুক্ষণের আলাপেই ফ্যান হয়ে গেছিলাম । যাই হোক , সেদিন বেশি কথা হয়নি । তারপরের দিন অবশ্য দাদা সোনুদাকে ডিনারে ইনভাইট করেছিল । অবশ্যই উইথ ফ্যামিলি । কিন্তু কি যেন একটা প্রবলেম হয়েছিল, যে কারণে সোনুদা একাই এসেছিল ডিনার অ্যাটেন্ড করতে । সেদিন রাতের খাওয়া দাওয়ার পরে বেশ অনেকক্ষণ আমি একা বসে বসে সোনুদার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম তার কারণ হচ্ছে একটাই, অনেকগুলো বছর ধরে আমি কিছু কোশ্চেনের আনসার খুঁজেছি । তুই যেহেতু তখন আমাকে সবই বলতিস , তাই আমি তোর এই রিলেশনশিপটার সাথে মেন্টালি ইনভলভড ছিলাম কিছুটা । আই মিন , তোদের ব্যাপারে । ব্যাপারটা এমন ভাবে টার্ন অফ হয়ে গেছিল, সেটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারিনি ।
এটা ওটা কথাবার্তা বলার পর, জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের দুজনের ম্যাচিং তো ডেঞ্জারাস । যাকে বলে ডেডলি । লাভ ম্যারেজ নিশ্চয়ই ।
বলল, ধুর ! এটা একদম ইমম্যাচিউর এর মত কথা হয়ে গেল যে !
— মানে !
— ডেডলি ম্যাচিং বিটুইন লাইফ পার্টনার্স, আ্যন্ড লাভ ম্যারেজ, দুটো একদম কন্ট্রাডিক্টরি ।
— কেন ?
— আরে কন্ট্রাডিক্টরি হবে না ? ফার্স্ট অফ অল, ম্যারিটাল পার্টনার্স , আ্যন্ড ম্যাচিং বিটুইন দেম, ইস এন্ অ্যাবস্ট্রাক্ট আইডিয়া ।
— মানে ?
— ওই যেমন ধরো , ফিল করা যায় , ছোঁয়া যায় না । যাক গে ছাড়ো। তবুও অ্যাবস্ট্রাক্ট-টাকেই হাইপোথিসিস ধরে নিয়ে বলছি , যদি সেটা পসিবল হয়েও যায় , তবুও কোনভাবেই লাভ ম্যারেজের প্রোডাক্ট হতে পারে না।
— কেন, হতে পারে না কেন?
— ধুস্ ! ওয়ার্ল্ড এর সমস্ত লিটারেচার ঘেঁটে দেখো , লাভ ইজ ব্লাইন্ড। লাভ হয়ে গেলেই লাইফটা স্রেফ ন্যাতা মেরে গেল । হ্যাপেন্স টু বি ডেস্ট্রাক্টিভ । লাভ, ম্যাচিং খোঁজে কোথায়? সে তো আনাড়ি । খাদে ঝপাং !
আমি বললাম, কথাগুলো নিশ্চয়ই ইনফারেন্স থেকে বলছো ?
মুচকি মুচকি হাসলো সোনু দা , ইউ মিন, আই ইন লাভ সামহাউ, সামডে ?
মোলায়েম গলায় বললাম, আমি তো তাই জানি।
— কিরকম শুনি ?
— তুমি আমাদের বাড়িতে যে বছর দুয়েক মতো ছিলে , সেই সময় তুমি একটা রিলেশনশিপে ছিলে তরুদির সঙ্গে । আ্যন্ড আই প্রেফার টু ডেপিক্ট ইট অ্যাজ এ লাভ রিলেশনশিপ ।
সোনু দা ফস্ করে বলল, তুমি হলে ভেবে দেখতাম ।
— মানে !
— এখনো ভেবে দেখতে পারি ।
আমি বললাম , তোমার এজ কত সোনু দা ?
— ফর্টি টু । আ্যজ পার সার্টিফিকেট । একেবারে আ্যক্যুউরেট বায়োলজিক্যাল এজ যদি জানতে চাও, দেন দ্যাটস্ ফোর্টি ফোর ।
— এখনো ফ্লার্ট করতে ইচ্ছে করে ? বিশেষ করে এই রকম একটা সিরিয়াস প্রফেশনে থেকেও ?
— প্রফেশন যাই হোক না কেন, অলওয়েজ সিরিয়াস। তাতে কি? প্রফেশনের সাথে কোন কিছু ট্যাগ করতে যাওয়ার মানে হয় না। আর ফ্লার্টিং ? নো ফ্লার্টিং । আ্যম ড্যাম সিরিয়াস ।

আমার যা কোয়্যারি সেখান থেকে টপিকটাকে সোনুদা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে ফেলতে চাইছে, বা ও ওই কথাগুলো বলতে চাইতেও পারে , কিন্তু তাতে করে টপিকটার ডিরেকশন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে ।
তাই জন্য আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম , সোনু দা একটা কথা বলতো, তুমি তরুদির সঙ্গে রিলেশনশিপ-টাকে ঠিক কিভাবে নিতে ?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো , জাস্ট আ রিলেশনশিপ ।
— সে তো আমি জানি , একটা রিলেশনশিপ । আমি জানতে চাইছি , সেটাকে তুমি কি বলে ডিফাইন করবে, কিরকম রিলেশনশিপ ছিলো সেটা?
— জাস্ট এ ক্যাজুয়াল রিলেশনশিপ বিটুইন এ ম্যান এন্ড এ ওম্যান , ন্যাচারাল ।
— ক্যাজুয়াল রিলেশনশিপ বলতে কি বলতে চাইলে ? সেটা একটা লাভ রিলেশনশিপ ছিলো কিনা ?
বেঁকা হাসি হাসলো সোনু দা । বলল , লাভ ? দেন ইউ ফার্স্ট ডিফাইন লাভ ।
বললাম, ইন বিটুইন এ ম্যান আ্যন্ড এ ওম্যান লাভ হ্যাপেনস ইন এ ভেরী স্পেশাল ম্যানার। এমন একটা ফিলিং জগতে যা শুধুমাত্র সেই একটা মানুষের প্রতিই আসে , আর কারো প্রতি নয় , সাইমালট্যানিউআসলি । মানে বলতে চাইছি, এমন একটা স্পেশাল ফিলিং, যেটা একটা সময় একজনের প্রতিই আসতে পারে । আবার ইন ফিউচার সেই রিলেশনশিপ ব্রেকআপ হয়ে গেলে, নতুন রিলেশনশিপ তৈরি হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সেই স্পেশাল ফিলিংটা একজনের প্রতিই থাকবে ।
— সো ইউ ওয়ান্ট টু নো , তোমার তরুদির প্রতি আমার কোন স্পেশাল ফিলিং ছিল কিনা, রাইট ?
— এগজ্যাক্টলি সো । আমি জানতে চাই তোমার কাছে তরুদি এবং রিলেশনশিপটা কতটা স্পেশাল ছিল বা আদৌ ছিল কিনা?
ও মুচকি মুচকি হাসছিল । বললো , আমি যে তোমাকে বললাম এইমাত্র , ন্যাচারাল আ্যন্ড ক্যাজুয়াল রিলেশনশিপ । ক্যাজুয়াল কোন কিছু কি স্পেশাল হয় ?
–আমি তোমাদের রিলেশনশিপ এর ব্যাপারে তরুদির কাছে যেটুকু শুনেছিলাম, ইট ওয়াজ ভেরি ভেরি মাচ স্পেশাল ওয়ান্ টু হার । আ্যন্ড, তোমরা যথেষ্ট ইন্টিমেট ছিলে । তাহলে বলছো এতটা ইন্টিমেসি, সবকিছুই তোমার কাছে খুব ক্যাজুয়াল ছিল ? নাথিং স্পেশাল ?
— ইউ ওয়ান্ট মি টু কনফেস রংলি , ড্যাট ওয়াজ আ স্পেশাল রিলেশনশিপ ?
— না, আমি তোমাকে একদমই ফোর্স করিনি সেটা বলতে। আমি জাস্ট ফ্যাক্টটা জানতে চাইছি । একটা রিলেশনশীপ এতটা ইন্টিমেট হওয়া সত্বেও, তুমি বলছো সেটা তোমার কাছে স্পেশাল ছিলই না?
— নট আ্যট অল –
— কিন্তু আমি জানি তরুদির কাছে সম্পর্কটা ভীষণ স্পেশাল ছিল । তুমি বলো তো সোনু দা, দুজন একটা সম্পর্কে ছিল , তাদের মধ্যে একজনের কাছে সম্পর্কটা খুব স্পেশাল, আরেকজনের কাছে ‘জাস্ট এ ক্যাসুয়াল রিলেশনশিপ’ হয় কি করে?
এবার ও বেশ লাউডলি হেসে উঠলো । বললো, তোমার তরুদির মতো বোকাসোকা, ম্যাদা-মারা, গুড ফর নাথিং মেয়েরা জাস্ট পা বাড়িয়ে থাকে একটা হ্যান্ডসাম ট্যালেন্টেড ইয়ং গাইয়ের প্রেমে পড়ার জন্য । তোমার তরুদি তো আবার আমার লিগাল ওয়াইফ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো । হাউ ফানি !
ভীষণ রাগ হল । বললাম , তরুদি তো তোমাকে ফোর্স করেনি প্রেম করার জন্য । তুমি তাহলে সেটা করেছিলে কেন?
— ইউ আর মেকিং দা সেম মিসটেক রিপিটেডলি । ড্যাঠ ওয়াজ সিম্প্লি আ ক্যাজুয়াল রিলেশনশিপ , নাথিং স্পেশাল । প্রেম করার কোন প্রশ্নই আসে না । আ্যম আই ক্লিয়ার ? প্রেম করেছিল তোমার তরুদি । নট মি !
— তুমি সেটা জানতে যে , ও রিলেশনশিপটার প্রতি ভীষণভাবে কমিটেড । খুব স্পেশাল সম্পর্কটা ওর কাছে। ও সেটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, সারা দিন-রাত বুঁদ হয়ে থাকে। তুমি সমস্তটা জেনেও এই ছেলেখেলাটা করেছিলে তরুদির সঙ্গে ?
— ছেলেখেলা ? ছেলেখেলা কে বলল ? কখন বললাম ? ছেলেখেলা নয় তো । আমিও ছিলাম সম্পর্কটার মধ্যে ।
— কিন্তু তুমি কোনভাবেই কমিটেড ছিলে না । তাহলে সেটাকে তো ছেলেখেলাই বলা চলে ।
— কে বলেছে একটা রিলেশনশিপে কমিটমেন্ট মাস্ট ?
বললাম , আচ্ছা সোনু দা, তুমি কি রুচিকাদির প্রতি কমিটেড ?
দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছে । বলল , কমিটমেন্ট দেখানোর অনেক জায়গা রয়েছে । সাপোজ আমার প্রফেশন এর প্রতি আমি কমিটেড , আমার রিসার্চ ওয়ার্ক এর প্রতি ভীষণভাবে কমিটেড । আমার সোশ্যাল স্ট্যাটাস , আমার রিসার্চ প্রগ্রেস, সানি মাই সান- ওর ফিউচার , এজুকেশন, এগুলো নিয়ে আমি কনসার্নড, বলতে পারো এগুলোর প্রতি আমি কমিটেড । কমিটমেন্টের এতগুলো জায়গা থাকতে, রিলেশনশিপের কমিটমেন্টের জায়গাটাই আমার কাছে ক্লিয়ার নয় । ইনফ্যাক্ট, ওখানে কমিটমেন্টের কোন মানেই হয়না । আই আ্যম অলওয়েজ ওপেন ফর এনি কাইন্ড অফ রিলেশনশিপ ।
আমার দিকে ভুরু তুলে তাকে একটা মিনিংফুল হাসি হাসলো ।
বললাম, আ্যন্ড ইওর ওয়াইফ?
— রুচির ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না । সি ইজ ভেরি মাচ প্রফেশনাল , আ্যন্ড অলওয়েজ ইনক্লাইন্ড টুয়ার্ডস হার রিসার্চ ওয়ার্কস ।
— তারমানে তোমরা ম্যারেড কাপল, স্টিল কেউ কারোর প্রতি কমিটেড নও ?
— বেটার টু সে, বোথ অফ আস আর নট কনসার্নড অ্যাবাউট দা বোগাস কমিটমেন্ট । বাই নেচার উই আর আইদার পলিয়্যানড্রাস অর পলিগ্যামাস। ইনফ্যাক্ট উই আর ক্যারিং দা জেনেটিক কনস্টিটিউয়েন্ট থ্রু দা এভলিউশনারি পাথওয়ে । লুক আ্যট দা প্রাইড অফ লায়নস্ অর দা স্ট্রিক অফ টাইগার্স । পলিগ্যামাস । বাই নেচার আমরা যা, তা থেকে ফোর্সফুলি নিজেদের সিফট্ করিয়ে নেওয়ার মানে কি ? করার দরকারই বা কী?
— কিন্তু সকলের তো তোমার মত মেন্টালিটি নাও থাকতে পারে । যাদের কাছে রিলেশনশিপে কমিটমেন্ট বিশাল বড় একটা কিছু, সেইরকম মেন্টালিটির একজনের সঙ্গে তুমি তোমার মনের ভেতরে ‘বাই নেচার’ পাওয়া ‘পলিগ্যামাস মেন্টালিটি’ নিয়ে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে, সেটা কি তার প্রতি খুব জাস্টিস করা হয় ? সে তো আর তোমার মনের ভেতরে ঢুকে দেখতে যাচ্ছে না তোমার কাছে কমিটমেন্ট এর কোন মানে নেই ?
— যে আমার সাথে ইন্টিমেসি চাইছে, আই নো তরুশী, দ্যাট ওয়ার্থলেস গার্ল , ওয়াজ ইন লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট উইথ মি । তার কাছে, ইনফ্যাক্ট তার সাথে, আমি যে একটা ইন্টিমেন্ট সম্পর্ক বিল্ডআপ করছি, সেটাই তার কাছে কমিটমেন্ট । আমি যে তাকে সেই চান্স দিলাম , সেটাইতো আমার কাছে এনাফ কমিটমেন্ট । আবার কোন কমিটমেন্ট এর কথা বলছো? আমি আমার হোল লাইফে আর কখনো কি ওই রকম ক্যাটেগরির একটা মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে জড়িয়েছি ? নেভার !
” সত্যি কথা বলতে কি জানিস তো , আমারই ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল , রাগ হচ্ছিল । সোনু দা এমন একজন মানুষ , যে ভাঙবে তবু মচকাবে না । আগাগোড়া নিজে একটা দোষ করে গেছে , অথচ কোনোভাবেই তার ওয়ান পার্সেন্টও স্বীকার করানো যাচ্ছে না ।”

বললাম , তরুদি তখন জাস্ট কলেজে ভর্তি হওয়া ছোট একটা মেয়ে। গ্রামে থেকে পড়াশোনা করেছে । সেই রকম একটা মেয়েকে তুমি নানাভাবে ইনফ্লুয়েন্স করতে । এমনভাবে ইভেন্টগুলো ক্রিয়েট করতে , তুমি নিজেই খুব ভালো করেই জানতে যে মেয়েটা সম্পর্কে ভীষণভাবে ইনভলভড্ হয়ে পড়বে ।
— দ্যাট ইজ অলসো কোয়াইট ন্যাচারাল । মানুষের কথা ছেড়েই দাও , পাফার ফিশ এর একটা পার্টিকুলার স্পিসিস তার মেটিং পার্টনারকে আ্যট্রাক্ট করার জন্য সি বেডের বালির ওপর অদ্ভুত নিখুঁত একটা আলপনার মতো নকশা তৈরি করে । ম্যান্ডেলা টাইপ আর্ট । পাখনা দিয়ে বালি সরিয়ে সরিয়ে করে । যার আর্ট যত পারফেক্ট হয়, তাদের মেট আ্যট্রাক্ট করার ক্ষমতা তত বেশি । পিকক স্পাইডারের মেল ক্যান্ডিডেটরা খুব ছোট হয় । স্টিল , ওরা ঠিক ময়ূরের পাখনা মেলার মত নিজেদের আ্যবডোমেন ফ্ল্যাপ প্রজেক্ট করে ডান্স করতে থাকে । অনলি টু আ্যট্রাক্ট দ্য ফিমেল ওয়ান্স। আফটার মেটিং ফিমেল’রা মেল’দের গিলে খেয়ে ফেলে । স্টিল , দে প্রজেক্ট দেমসেলভস্ আ্যজ আ পোটেন্ট মেটিং পার্টনার । এইতো গেল একদম লোয়ার গ্রেডের অ্যানিম্যাল’দের কথা। একটু আপার গ্রেডে এলে দেখতে পাবে , অনলি ফর মেটিং কি না কি ঘটে যাচ্ছে । বাঘ , সিংহ, হিপোপটেমাস, মাঙ্কি, প্রায় প্রতিটা স্পিসিসের আ্যনিমালের দলের মধ্যে সবসময় মারামারি লেগেই থাকে, অনলি ফর মেটিং । পদ্মিনীকে মেটিং পার্টনার হিসেবে পাওয়ার জন্য আলাউদ্দিন খিলজী কি না কি করেছে ! এ তো গেল শুধু একটা এক্সাম্পল । এইরকম এক্সাম্পল কোটি কোটি দেওয়া যায় । সেখানে, আই হ্যাভ ডান নাথিং । তোমার তরুদি আমার প্রেমে যাকে বলে পাগল ছিল । আমি নিজেকে ফর দা টাইম বিইং ওর কাছে আ্যভেলেবেল করেছিলাম মাত্র । আই থিঙ্ক ওই টাইমটা ওর হোল লাইফের একটা আ্যসেট হয়ে রয়ে গেছে ।

আমি সত্যিই আর কি বলবো ভেবে পেলাম না । শুধু বললাম , একটা মানুষের ড্রিম , ইমোশন, এভরিথিং রয়েছে তোমাকে জড়িয়ে । এটার কি এতটুকুও ইম্পর্টেন্স নেই তোমার কাছে , মানে ছিল না ?
— আছে না ? অবশ্যই আছে । ইউ জাস্ট কাম টু মি , আ্যন্ড আই উইল শো ইউ ।
ডান হাতের তালুটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে ভুরু নাচিয়ে বললো , আ্যম অলওয়েজ ইন আ্যন ওপ্পোন কাইন্ডা রিলেইশনশিপ –
গা জ্বলছিল আমার । বললাম , তোমার কথা মতো বুঝলে সোনু দা, আমি খুব ম্যাদা-মারা ওয়ার্থলেস একটা মেয়ে । স্টিল বিলিভ ইন কমিটমেন্ট । আওয়ার্স ইজ আ কমিটেড রিলেশনশিপ ।
ঠোঁটটা ওপরে তুলে একটা ভুরু নাচিয়ে মিনিংফুলি বলল , গুড ! সেক্সি আ্যন্ড বিউটিফুল । স্টিল কমিটেড ফর হাজবেন্ড-

আ্যন্ড হি উইন্কড্ আ্যট মি !

আর বেশি কথা বাড়াইনি । উঠে পড়েছিলাম ।

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

উনচল্লিশ

— তুই আমাকে ইমম্যাচিওরড্ ভাবিসনা তরুদি । আমি বুঝতে পারছি তোর এই কথাগুলো শুনতে একদম ভালো লাগছে না। আমার বলা হয়তো উচিত ছিল না। তবুও তোকে বললাম । যদিও শর্টকাটে বলেছি । আরো বেশকিছু কথাই বলেছিল ও সেদিন । সেগুলো আর তোর শুনে কাজ নেই। যেটুকু বললাম, সেটুকুও না বললেই ভাল হতো। কারন এটা তোর অনেকদিনের আগেকার একটা ‘পাস্ট’ । সেটাকে আর প্রেজেন্টে টেনে আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না । তবুও বললাম । কেন বলতো ? কারণ সেই সময়টা তুই একমাত্র আমাকেই তোর সব কথা বলতিস । আমি তখন অনেকটাই ছোট ছিলাম । সে ভাবে বুঝতে পারতাম না । তবু তোর কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগত । ওই বয়সে সকলেরই কমবেশি প্রেমঘটিত গল্প-স্বল্প শুনতে ভালো লাগে । আমারও লাগতো । তারপর তোদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পরে , আই মিন , সোনু দা আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরে, আমি তোর অবস্থা দেখেছিলাম । সো মাচ প্যাথেটিক। এখনো আমার ভাবলে কষ্ট হয় । তুই কিছুই বুঝিস নি, না বুঝে সম্পর্কটায় নিজেকে ভীষণ ভাবে ইনভলভ করে ফেলেছিলি । তুই যে পরিমাণ কষ্টটা পেয়েছিলি , সেটা হয়তো নরমালি কেউ ব্রেকআপ হওয়ার পর পায়না । অন্তত আমি আমার জীবনে সেরকমভাবে আর কাউকে কষ্ট পেতে দেখিনি, শুনিওনি । ইমোশনাল ড্যামেজ তোর এতটাই হয়েছিল, তারপর থেকে তুই সেই এপিসোডটাকে জীবন থেকে আর বাদ দিতেই পারলিনা । ওভারকাম করে উঠতেই পারিস নি , দ্যাখ । প্রেমের ওপর বিতৃষ্ণা চলে এলো, বিয়ের ওপর এলো। একজন মহিলা সিঙ্গেল থাকার ডিসিশন নিতেই পারে , সেটা তার নিজস্ব ডিসিশন । একদম নিজস্ব । কারো সেখানে কিছু বলার নেই । থাকতে পারে না । আর আমি সেই ডিসিশনটাকে পার্সোনালি শ্রদ্ধা করি । কিন্তু সেটা তার ভালো থাকার জন্য হবে। প্রত্যেকটা মানুষ জীবনে ভালো থাকতে চায় , ভেবে দ্যাখ । তুই যদি ভাল থাকার জন্য সিঙ্গেল স্ট্যাটাসটাকে বেছে নিতিস, আমার কিচ্ছু বলার ছিল না । কিন্তু তুই একটা বিটার এক্সপেরিয়েন্স এর জন্য এরকম ডিসিশনটা নিলি । তোর কাছে ওই ব্যাপারগুলো সবই অর্থহীন হয়ে গেল। বিয়ে করে একবার দেখতে তো পারতিস , হয়তো কিছু অর্থ খুঁজে পেলেও পেতিস। সব মানুষ কি এক ধাঁচের হয় ? সোনুদার ধাঁচ সম্পূর্ণ আলাদা । তোর জন্য একদম অন্যরকম একটা ধাঁচের মানুষ চাই । হয়তো বিয়ে করে পেতিস সেটা । তারপরে এডজাস্টমেন্ট না হলে ডিভোর্স করে দিতিস । একটা এক্সপেরিমেন্টে লাইফে যদি রং আউটকাম চলে আসে, তাহলে মানুষ কি আর একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখবে না? বেশ, বিয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম । সেটা করিস , না করিস, করলি না .. ঠিক আছে । সোনু দা , মানুষটাকে তোর মনের ভেতর থেকে ঘেন্না করা উচিত তরু দি। না , এজন্য নয় যে, ও তোর সাথে একটা ক্যাজুয়াল রিলেশনশিপে জড়িয়ে ছিল বা হি ডিসিভড্ ইউ । এক একজনের কাছে সম্পর্কের অর্থ এক এক রকম হয় । তার কাছে সম্পর্কের অর্থ ঐরকমই । সেটাকে আমি ভালো-মন্দ কিছুই বলছি না । সেটা ওর নিজস্ব পারসেপশন । কিন্তু তোর ওকে ঘেন্না করা উচিত একটা কারণেই যে , ও তোকে প্রতি পদে ছোট করেছে । তখন আমি ছোট ছিলাম । তাই অত কিছু বুঝতে পারতাম না । তবে তখনও তোর কাছে কিছু কিছু ঘটনা বা কথা শুনে আমার মনে হতো, ও তোকে তোর প্রাপ্য সম্মানটা একেবারেই দেয় না । আর এইখানেই তোর ওকে ঘেন্না করা উচিত। একটা মানুষ তোকে ছোট করেছে । ছোট চোখেই দেখে সে তোকে বরাবর । সে নিজেও , আ্যজ এ হিউম্যান বিং , যে খুব ভালো মানসিকতার পরিচয় রাখতে পেরেছে, তেমনটা নয় । অ্যারোগান্ট একটা সেল্ফ সেন্টার্ড মানুষ। তাহলে তুই তাকে ঘেন্না করতে পারবি না কেন ? মন খুলে ঘেন্না কর তো , তরুদি । সোনু দা হয়তো ওর কাছের মানুষদের কাছে, ওর ছেলের কাছে , সম্মান পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু তোর কাছ থেকে ও ঘেন্না ছাড়া আর অন্য কিছুই পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না । মন খুলে ঘেন্না কর । দেখবি, মনের মধ্যে ওই সোনু দা রিলেটেড যা যা গ্লানি বা আনইজি ফেনোমেনা মেমোরিতে রয়ে গেছে আজও, সেগুলো অনেক সহজে ডিলিট হয়ে যাবে । ফ্রি হয়ে যেতে পারবি অনেকটা তুই । সেই কারণেই এতগুলো কথা তোকে বলা ।”

বান্টি গুনগুন গুনগুন করে আরো অনেক কথাই বলে যেতে লাগলো । আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল, কিছু ঢুকছিল না । ছেঁড়া ছেঁড়া অতীতের অনেকগুলো স্মৃতি ঘুরে ফিরে আসছিল সাইক্লিকাল অর্ডারে । সীমাহীন খারাপ লাগার মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলোকে ঠিক সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে পারছিলাম না । ঘন্টাখানেক ধরে বান্টি অনেক কথাই বলল । ওর নিজের কথা, হাজবেন্ডের কথা , ছেলেমেয়ের কথা । আমি ‘হ্যাঁ হুঁ’ করে শুধু সাড়া দিচ্ছিলাম । হয়তো ও এত বছর পর আমাকে পেয়ে কথা বলার ঝোঁকে এই কথাগুলো বলে যাচ্ছিল । তাই অতটা লক্ষ্য করেনি। নয়তো বুঝতো, আমি ওর কোনো কথাই শুনছি না । শুনেও না শোনা যাকে বলে। একটা সময় একটা সম্পূর্ণ হাই তিন-চারটে ইন্সটলমেন্টে তুলতে তুলতে মুখের সামনে ডানহাতটাকে নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল ,
— ঘুম পাচ্ছে রে তরু দি । আজ ঘুমোলাম । তুইতো এখানেই আছিস । দেখি আমাকেও হয়তো এখনো মাসখানেক থাকতে হবে । আবার একদিন জমিয়ে আড্ডা দেবো কেমন ?
বালিশে মাথা রেখে ও পাশ ফিরে শুলো। ইনস্টলমেন্টের শেষ দফাটা সেরে নিয়ে বলল , গুন্নাইট !
— গুড নাইট !
বান্টি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার সামনে একটা অনন্ত রাত পড়ে রয়েছে । এইরকম ‘অনন্ত রাত’ আমার জীবনে বেশ কিছু এসেছে । এক সময় পরপর এইরকম না ঘুমানো ‘অনন্ত রাত’ আমি জেগে কাটিয়েছি। বান্টি ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা । আমিও ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছি । সোনুদার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে সেই অভিসারের রাত পর্যন্ত প্রতিটা দিন, প্রতিটা স্মৃতি, প্রতিটা ঘটনা, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রিক্যাপ করতে খুব ভালো লাগে । সারাজীবনে বহুবার করেছি , অগুন্তি । সময় পেলেই করেছি । এমনকি অসময়েও করেছি । যখনি করেছি মনের মাঝে কোকিল ডেকে উঠেছে , ভরা বসন্তকাল । কিন্তু সেই যে সেদিন রাতে , মাঝরাতের পরে আমি ফিরে এলাম ‘রায় ভিলা’য় মাথা নিচু করে , হাত দুটো ঠান্ডা , অসাড়.. পা কাঁপছে .. , তারপরের যে সমস্ত ঘটনা, সেগুলো মনে করা তো দূর , আপ্রাণ ভুলে থাকতে চেয়েছি । কিন্তু ভুলে যতই যেতে চেয়েছি , ঘটনাগুলো আমাকে অশরীরীর মতো তাড়া করেছে । পালাতে চেয়েছি , ভুলতে চেয়েছি , কিন্তু সেইসব দগদগে স্মৃতি আমাকে ছেড়ে যায়নি । মনে পড়লেই হিমশীতল ঠাণ্ডা অনুভূতি হয় । শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় । ভয় করে রীতিমতো । যেন একটা হরর স্টোরি আমার লাইফের –

সেই সেদিন রাতে ফিরে আসার পর যখন জানতে পারলাম, বাড়িতে রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে, সবাই জানতে পেরেছে আমি বাড়িতে নেই , তখন কাঠের মূর্তির মত নিশ্চল হয়ে যেতে চেয়েছিল পা দুটো । তবুও টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম । তখনই আমাকে দেখতে পেয়ে কাকু আর কাকিমাকে ডেকে বসেছিল পূর্ণিমা মাসি । আমি দাঁড়িয়ে আছি লজ্জা আর গ্লানির আল্পস্ মাথায় নিয়ে । ভিসুভিয়াসের লাভা উদগীরণের আশঙ্কায় একটা করে মুহূর্ত গুনছি । ভামিনী কাকিমা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একেবারে সামনে চলে এসেছে ।

গঙ্গোত্রীর সমস্ত শৈত্য ঝরে পড়ল কাকিমার গলায় ,
— এত রাতে কোত্থেকে ফিরলে ! কোথায় গেছিলে ?

আমার ভেতরের সমস্ত উষ্ণতা তখন আটলান্টিকের হিমবাহ হয়ে গেছে । বরফ .. শুধু বরফ ! সেই শীতলতা কাটিয়ে একটা বাক্যও মুখ ফুটে বলতে পারলাম না ।
এইবার ভামিনী কাকিমার চোখে থর মরুভূমির মধ্য গগনের সূর্য । গলে গলে পড়ছে তরল বালি । কোথাও কোন আশ্রয় নেই । চোখের দিকে তাকানো যায়না, ঝলসে যায় ।
আমার আলুথালু চেহারা, অগোছালো পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে সেই ঝলসে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে ভামিনী কাকিমা আবার মুখ খুললেন । তবে গলায় সূর্যের গনগনে আগুনের ছিটেফোঁটাও নেই । ভিসুভিয়াসের লাভা উদগীরণও নেই । সেখানে শুধুই গঙ্গোত্রীর বরফ-কঠিন শীতলতা । এই মূর্তি আমি চিনি , খুউব চিনি । আর , পাহাড়ের দুর্গমতম খাদে নিশীথ রাতে, চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে, পা ফস্কে পড়ে যাওয়ার চরমতম মুহূর্তের চেয়েও বেশি ভয় করি !
কাকিমা নিঃশব্দে তর্জনী দিয়ে সিঁড়ির পথ-নির্দেশ করলেন ।
বললেন , তুমি নিজের বেডরুমে যাও । আমি যাচ্ছি। সেখানে গিয়েই যা কথা হবার হবে ।

আমি উঠে এসেছিলাম নিজের বেডরুমে । ভামিনী কাকিমাও কিছুক্ষনের মধ্যেই এসেছিলেন সে ঘরে । গলার শীতলতা নামাতে নামাতে একসময় ক্রায়োপ্রিজার্ভেশনের কাছাকাছি টেম্পারেচারে নামিয়ে এনেছিলেন । তবুও না । আমিতো বলিনি । আমি কিছুতেই বলিনি, কোথায় গিয়েছিলাম । শুধু অবশ মাথার নিউরনগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিলাম , আমি যে ঘরে নেই , এটা এত তাড়াতাড়ি চাউর হয়ে পড়ল কি করে ? বান্টি কি ঘুম থেকে উঠে দেখেছিল আমি তার পাশে নেই ? খুব সম্ভবত তাই হবে। হয়তো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখেছিল , আমি যখন ফিরে আসিনি তখন খুঁজেছে আমায় । তারপরে হয়তো বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে যেতে ঘাবড়ে গিয়ে কাকু কাকিমাকে বলেছে । কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে । কি হয়েছে সেটা বড় কথা নয় । কি হতে চলেছে সেটাই বড় কথা ।

এবং, যা হল সেটা আমার জন্য সাংঘাতিক। বাবা-মাকে জরুরি তলব করে ডেকে পাঠানো হলো। আমি জানি , আমার কোন একটা সিক্সথ সেন্স বলছে, আমি না বললেও কাকু-কাকিমা জেনে গেছেন আমি কোথায় গিয়েছিলাম । কিভাবে জেনেছেন , আমি জানিনা । তবে জেনেছেন । ঠিক দু’দিনের মাথায় বাবা-মা এসে পৌঁছল । এই দুটো দিন লজ্জার মাথা খেয়ে কাউকে নিজের মুখটা দেখাতে পারিনি , কারোর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারিনি । প্রথম দেখলাম, বাবার মুখটা লজ্জায় নিচু হয়ে আছে । আমার ভেতরের সমস্ত গ্লানি যেন বাবা নিজের মধ্যে শুষে নিয়ে কেমন একটা হয়ে গেছে ।
আমার চোখে চোখ পড়তে সেদিন বাবা একটাই প্রশ্ন করেছিল , এই করলে তুমি এখানে এসে !
সেই প্রথম বাবা আমাকে ‘তুমি’ করে বলেছিল । আর কিছুই বলেনি । তবে ওইটুকু কথার মধ্যে যা ছিল, তা মেপে শেষ করা যায় না । দূরত্ব ছিল , অন্তহীন দূরত্ব । আমি বুঝতে পেরেছিলাম , বাবা নিজেকে আমার থেকে এক ঝটকায় কত শত, হাজার, লক্ষ , কোটি মাইল দূরে সরিয়ে নিয়েছে , কিংবা আলোকবর্ষ !

আমি দোতলায় নিজের বেডরুমে ছিলাম । নিচের তলায় বসেছিল ইম্পর্টেন্ট মিটিং । মিটিং এর বিষয়বস্তু অবশ্যই আমি । আর একজনকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিল সেখানে , সোনু দা । সেখানে কি কথাবার্তা হয়েছিল আমি জানি না । তবে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলেছিল মিটিং । একটা সময় ভামিনী কাকিমা নিজে এসে আমাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন সেই ঘরে । একবারই ঢুকেছিলাম আমি কয়েক মিনিটের জন্য । বাবা সোফার ওপর বসেছিল। ঠিক তার সামনা সামনি রাখা একটা টুলের ওপর আমাকে বসতে বলা হলো । আমি দেখলাম, বাবার ঘাড় হেঁট ।
আমি বসতে, অজিত কাকু বাবাকে বললো ,
— নে ! তোর কি জানার আছে, জেনে নে মেয়ের কাছে।

বাবা আমার দিকে তাকালো । সে চাউনিতে কি ছিল আমি ঠিক বলতে পারব না । তবে এক পরাজিত বাবা হওয়ার গ্লানিবোধ অনেকখানি ছিল ।
বাবা বলল, সেদিন রাতে কি তুই ম্যানেজারের বাংলোয় গিয়েছিলি ?
পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল আমার প্রশ্ন শুনে। ঘরের মধ্যে অজিত কাকু রয়েছেন , ভামিনী কাকিমা আছেন, মা আছে, সোনু দা বসে রয়েছে ঠিক বাবার সোফার সঙ্গে সমকোণে রাখা অন্য একটা সোফায়, সবচেয়ে বড় কথা বাবা রয়েছে । বাবার সামনে এই চরম সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই । আবার , সোনু দা থাকতে এই সাংঘাতিক কথা আমি স্বীকার করি কী করে ? চুপ করে রইলাম । গা গুলাচ্ছে , মাথা ঝিমঝিম করছে। গা এতটাই গুলোচ্ছে যে , মনে হচ্ছে শরীরের ভেতর রক্তমাংস-অস্থিমজ্জা সবকিছু দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে । কিছু বলতে পারছিনা আমি । গলা দিয়ে কোন স্বরই ফুটে বেরোচ্ছে না ।
বাবা আবার প্রশ্ন করল , আমার দিকে তাকা । মুখ তোল্ । বল্ , সেদিন রাতে কি তুই সেখানে গেছিলি ?
বাবার দিকে তাকাতে পারিনি । তবে ঘাড় হেঁট করেই মাথাটাকে ওপর-নিচে করে জানিয়েছিলাম , আমি গেছিলাম সেখানে । বাবা ঘাড়টাকে ঝুঁকিয়ে নিয়েছিল। আমি চাইনি বাবার দিকে একবারও, তবু বুঝেছিলাম বাবা মেয়ের গ্লানিতে গ্লানি-লিপ্ত ।
ঘাড় হেঁট করেই ভামিনী কাকিমার উদ্দেশ্যে বলেছিল , বৌদিমণি , ওকে এখান থেকে নিয়ে যান ।

ফিরে এসেছিলাম নিজের ঘরে । ঘরের তাপমাত্রা তখন হিমাঙ্কের নিচে । আর কেউ বুঝবে না , আমিই শুধু বুঝতে পারছিলাম । বরফ পড়ছিল । চাপ চাপ বরফ ! আমি সেই বরফের কফিনের নিচে শুয়েছিলাম । ওপর নিচে জমাট বরফ । আমার মৃতদেহে শ্বাস-প্রশ্বাস বইছিল । কফিন বুনছিল আমার সেই ঘরটা। ‘রায়ভিলা’র দোতলার আমার সেই বেডরুমটা –

সেদিনই সন্ধ্যার ট্রেনে বাবা-মা আমাকে নিয়ে ফিরে এসেছিল পুরুলিয়ায় । একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ধরে ঘুরতে থাকা একটা গ্রহ কিংবা উপগ্রহ কিংবা অ্যাস্টেরয়েড .. তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অন্য একটা ব্রহ্মান্ডে । ফিরে এসেছিলাম আবার মাস তিনেক পরে । কলেজে ফলস মেডিকেল সার্টিফিকেট সাবমিট করা হয়েছিল , অ্যাবসেন্ট থাকার কারণ হিসেবে । ফিরে আমায় আসতেই হতো । ফাইনাল ইয়ার চলছিল তখন । পরীক্ষা বাকি ছিল । কিন্তু ফিরে যখন এসেছিলাম , তখন আমার সেই পরিচিত কক্ষপথ আর নেই। সব টালমাটাল অবস্থা । কোনো এক মহাশক্তিশালী ধুমকেতু এসে যেন পুচ্ছ সঞ্চালনে কেমন এলোমেলো করে দিয়েছে ।
আমি নিজের কক্ষপথটাই খুঁজে পেলাম না –
কিংবা নিজেকেই-
কে জানে – !

ক্রমশ..