হাতে রেখো হাত পর্ব-১৩+১৪

0
145

হাতে রেখো হাত (১৩)

চট্টগ্রাম শহরে আছে সীরাত। চেহারায় চিন্তার রেখা। মনে ভয়। পুলিশ খুঁজে যাচ্ছে। তবে কোথাও কোনো সন্ধান নেই। মেয়েটা নিজেই যাবে বলে স্থির করেছিল। আর তারপর শুরু হয় বিভিন্ন হোটেল,মোটেল খোঁজা। লাভ হলো না। ফলাফল সেই শূন্য। হতাশাজনক ভাবে বসে ছিল বেঞ্চে। পাশে বসে সৌমিত্র। চিকন শ্বাসে ভরে উঠেছে চারপাশ। সীরাতের নরম তুলতুলে পা দুটো বালির সাথে খেলা করছে। চোখ সেখানেই। একটা বিতৃষ্ণা চাহনী। সৌমিত্র মন পড়তে পারে এমন নয়। তবে সীরাতের ক্ষেত্রে ভিন্ন। মেয়েটার সব কিছু বুঝতে পারে কেমন করে যেন। প্রায় এক যুগ ধরে এমনটাই হয়ে চলেছে। “ভেঙে যাচ্ছ তুমি।”

চোখ মেলে তাকায় সীরাত। সৌমিত্র কে দেখে ঠোঁটের অগ্রভাগ প্রসারিত হয়। আকাশের বুকে রংধনুর মত এক চিলতে হাসি উঠে। ফের মিলিয়ে যায় মেঘের আড়ালে। সৌমিত্র গত বারোটা বছর ধরে সীরাতের পাশে। বন্ধুর মত আগলে রাখে। অথচ সীরাত জানে ছেলেটা শুধু ওর বন্ধু নয়। বন্ধুর থেকে একাংশ এগিয়ে।
“খাবার খেয়েছ?”

“উহু।”

“এভাবে থাকলে চলবে? অসুস্থ হয়ে যাবে। এসো আমার সাথে।”

“পরে খাব। তুমি খেয়ে নিও। অপেক্ষা করলে কিন্তু অভুক্ত থেকে যাওয়ার সম্ভবনা থাকবে।”

“তুমি কি করে জানলে আমি না খেয়ে?”

“এটা তো নতুন নয় স‍ৌমিত্র। আমার সাথে থাকলে কখনোই আগে খাও না। এমনকি কাছে পিঠে না থাকলে ফোন করে জানতে চাও খেয়েছি কি না। আমি সেসব বুঝি।”

বিব্রত বোধ করার কথা থাকলেও অপ্রত্যাশিত ভাবে, সৌমিত্র চুল পরিমানে বিব্রত হলো না। বরং নীরব মুখে বসে রইল। সীরাতের এখন খারাপ লাগছে। ছেলেটা কেন এমন করে?

রুস্মি চোখের জল আড়াল করে বলল “মা, খুব ই ভেঙে পড়েছে। তুমি ও নেই। বুয়া থাকলে একটু আরাম লাগে। সেও চলে যায়।আমি আসলে সামলাতে পারছিলাম না। একা অনুভব হচ্ছিল।”

“রুবিকে খুঁজতে এধার ওধার ঘুরতে হচ্ছে। তুমি জানো আমি গত তিন দিন ধরে ঢাকার অলি গলি ঘুরে চলেছি। আর সীরাত চট্টগ্রাম।”

“আমাকে সাথে নিবে প্লিজ?”

“চাচির কাছে থাকা জরুরী।”

রুস্মি এবার কেঁদে ফেলল। গত তিন দিনে আবরাজ কে কয়েকশ বার বলেছে, সঙ্গে নেওয়ার কথা। ছেলেটা প্রতিবার ই নানান ছলে বলে কৌশলে নাকোচ করেছে।
“বাচ্চাদের মত করলে চলবে না রুস্মি। খেয়ে ঘুম দাও।”

“তুমি খাবে না?”

“হু খাব।”

খাবারের প্লেট নিয়ে কেবল নড়াচড়া করে আবরাজ। সেদিকেই চেয়ে আছে রুস্মি। খাবার নামছে না গলা দিয়ে। ছেলেটার মুখের গম্ভীর ভাব ওকে যন্ত্রণা দেয়। ইচ্ছে করে মিশে যেতে। কাছে টেনে নিয়ে ভরসা দিতে।’আমি আছি’ বলে নির্ভরতা হতে। সেসব কেবল কিশোরী মনের কল্পনা। উঠে গেছে আবরাজ। ভাতের প্লেটের বেশি অংশই রয়ে গেছে। সেসব পরিষ্কার করে উঠে গেল রুস্মিও। আবরাজ এবার ঘুমের তৌড়জোড়ে ব্যস্ত হবে। আবার ভোর হতে না হতে ছুটে পালাবে। আসবে রাত দশটার পর। এভাবে চলেছে গত দিন গুলো। রুস্মি তো এমন জীবনে অভ্যস্ত নয়। সর্বদা সাদামাটা জীবন পছন্দ। অথচ ওর জীবনটা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলে রূপান্তরিত হয়।

চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে আবরাজ। ঘটনা গুলো কেমন গোলকের মত। যে পথেই যাও ফল শূন্য। দিশাহীন ভাবে চলছে কেবল। সারাটা রাত এপাশ ওপাশ করে গেল। সবে ভোর নেমেছে। আবরাজ ফজরের নামাজ শেষ করে বেরিয়ে পরল। হসপিটালের কাছে আসতেই সীরাত কে দেখতে পেল। মেয়েটার ভাঙা চাহনি।
“রুবির জীবনের নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারব না। তবে সুজিতের জীবন ও সাধারণ নয়। সবাই সমান।”

“জানি আমি। এবার সত্যিই আমাদের কিছু করার নেই। এর বেশি হলে ছেলেটা মা*রা যাবে।”

হতাশার এক পাহাড় এসে ধসিয়ে দিল সব। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো সুজিতকে বাঁচাবে। রুবির ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

সুজিতের শ্বাসগুলো ক্রমশ বেড়ে চলেছে। হসপিটালের বেডে কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়। চোখের কোণ বেয়ে নেমে যায় নোনাজল। সীরাত চোখ বন্ধ করে ফেলল। খামচে ধরল দেয়াল। অন্য হাত আবরাজের হাতে রেখে বলল “মানুষ নয়,এরা জা*নোয়ার।”

“স্থির হও সীরাত। আমাকে শক্তি দিয়ে তুমি হারিয়ে যেও না।”

“খারাপ লাগছে আমার। ছেলেটার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া ওর জীবন কতটা প্যাঁচ মাখা!”

“আর একটু,প্রুফ কালেক্ট হলেই আমরা সবটা সামনে নিব।”

সীরাত আর আবরাজ আড়ালেই রইল। সুজিত যন্ত্রণায় পা দাপাচ্ছে। জা*ন বেরিয়ে আসার জন্য লাফালাফি করছে যেন। ইনজেকশনটা বের করতেই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঘা*তটা করল আবরাজ। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পরল লোকটা। পুলিশ,ও এসে পরেছে। লোকটা পালানোর চেষ্টা করে ও পালাতে পারল না। অবেশেষে ধরা পরল এক পাপী।
.

বুয়া সব কাজ শেষ করে দিয়েছে। এবার যাওয়ার পালা। রুস্মির খুব একা লাগে। রেবেকা বেগম ঘুমে। খাবারে ঔষধ মিশিয়ে দেওয়া হয় রোজ। না হলে যত সময় জেগে থাকে চেচামেচি করবে। কান্নায় ডুবে থাকে। আবরাজ সেই সকাল বেলায় বেরিয়েছে। বেলা শেষে ফিরবে তবে সামনের একাকিত্বে ভরা সময়টা রুস্মিকে কাঁদাবে। আগে এ সময়ে বই পড়ত। তারপর রুবির জন্য শরবত করত। খাবার নিয়ে মেয়েটার চয়েজের শেষ ছিল না। রূপচর্চার হরেক প্রসাধনী ঘরের কোণে। ফুরিয়ে গেলেই বায়না ধরবে ‘আপু শপিং করব, সাথে যাবে প্লিজ।’ রুস্মি ব্যস্ত সময়গুলোতে নাকোচ করত। আর রুবি তখন নাক ফুলিয়ে বসে থাকত। দুদিন অবধি কথা বলত না। সেসব খুব সুন্দর ছিল। আনন্দের স্মৃতি গুলো আমাদের জীবনের কঠিন সময়ে বি*ষ হয়ে নামে। মনে হয় কেন এত সুন্দর ছিল সেসব?

কাজ নেই কোনো। তাই রুস্মি চাইল বই পড়তে। পারল না। বারং বার ঘেটে যাচ্ছে ঘটনা। এখন সন্ধ্যা। টিভিতে নতুন নিউজ চলবে। সেসবে যদি একটু আগ্রহ আসে।
সন্ধ্যার টিভির নিউজটা খুলল রুস্মি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও আর কিছু লাইন দেখেই আঁতকে উঠল প্রায়! তখুনি ফোন করল আবরাজকে। আবরাজ বলল ঘটনাটা খুলে জানাতে। অথচ মেয়েটা কেবল চেচামেচি করছে! ভয়ার্ত কণ্ঠ। যেন এখনি জান বেরিয়ে যাবে। অগত্যা তখনি আসতে হলো আবরাজের। রুস্মি ড্রয়িং রুম জুড়ে পায়চারি করছিল। চিন্তা আর ভয়ে যেন পাগলপ্রায়। আবরাজকে দেখেই ছুটে গেল। “সুজিত, সুজিতের বাবাকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। আমার ভয় হচ্ছে। বুঝতে পারছি না কিছু। রুবি, রুবি কোথায়, কেমন আছে, ও ঠিক নেই নিশ্চয়ই।”

“শান্ত হয়ে শুনো প্লিজ।”

“শান্ত, শান্ত হই কি করে? মা জানে না এসব। ম*রে যাবে শুনলে। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে।”

“এভাবে সবটা ঠিক হবে রুস্মি?”

মাথার হেলমেট খুলতে খুলতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল সীরাত। রুস্মি বুঝল আবরাজের সাথেই এসেছে।
“তোমাকে জানতে হবে, বুঝে শুনে সামলাতে হবে সবটা।”

“কি?”

“আগে স্থির হও বোন। ভেঙে পড়া যাবে না।”

“রুবি কি ঠিক আছে সীরাত? উত্তর আছে তোমার কাছে।” রুস্মির উদ্বিগ্ন ভরা কণ্ঠটা ঝিম ধরিয়ে দেয়। সীরাত গোপনে শ্বাস ফেলে। আবরাজ পানি এগিয়ে দিল। “পানি খাও। তুমি চটপটে আর বুদ্ধিমতি বলেই জানতাম আমি। অথচ এভাবে, যাই হোক তোমার জীবনের বড় সত্য জানতে চলেছ তুমি।”

এখন রুস্মির ভয় বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা চাতক পাখির মত তাকিয়ে। সীরাত পাশে বসল। আগলে নিল দু হাতে। “নিউজে কি কি শুনেছ?”

“সুজিতের বাবা সুফিয়ান কামাল গ্রেফতার।”

“আর কিছু?”

“উঁহু।”

সীরাত আবরাজের দিকে তাকাল। আবরাজ খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে। সীরাত চোখের ইশারা করল কিছু। যা রুস্মির চোখ এড়ায় নি।

“তোমরা কি লুকাচ্ছ?”

“কিছু লুকাব না রুস্মি। তুমি আগে শান্ত হও।”

এবার রুস্মির কণ্ঠ দৃঢ় হলো। “কি করে শান্ত হব বলতে পারও। আমার বোন নিখোঁজ। পরিবারটা ভেঙে যাচ্ছে। ঐদিকে সুজিতের বাবা নিজ ছেলেকে হ*ত্যার চেষ্টায় কারাগারে। এসব স্বাভাবিক নয়। আমি বুঝতে পারছি খুব বড় কিছু হয়েছে। তোমরা প্লিজ বলবে আমায়।”

চলবে..
কলমে~ফাতেমা তুজ

#হাতে_রেখো_হাত (১৪)

আনিসুল সাহেবের মাথা নিচু। চোখ তুলে তাকাবার ক্ষমতা তিনি হারিয়েছেন। রুস্মির জীবনে একটি আপসোস তৈরি হয়েছে। জীবনের এত গুলো বছর এক সাথে থেকেও চিনতে পারে নি বাবা নামক মানুষটিকে। রেবেকা বেগম চুপ। কোনো কালেই ভালো স্বভাবের ছিলেন না আনিসুল সাহেব। তবে রেবেকা বেগম এইটুকু জানতেন স্ত্রী সন্তানদের প্রতি ওনার ভালোবাসা আছে। সেই দিকের পরিপেক্ষিতে স্বামীর একাধিক অন্যায়ে সঙ্গ দিয়েছেন। ওনার ধারণা ছিল স্বামীর ভুল গুলোও সঠিক। তাই হয়ত এত বছর পর ও তৈরি হয় নি প্রায়শ্চিত্ত। রুস্মি প্রায় ভেঙে পড়েছে। বাবা সম্পর্কে একটি ঘটনা জানা ছিল। তবে সেসব কেবল ভুল ধারণা এমনটাই বোঝানো হয়েছে ওকে। কিন্তু সমস্তটা আজ পরিষ্কার। সত্যিই বহু বছর পূর্বে চাচার সাথে অন্যায় করেছে বাবা। ঘৃনায় তাকাতে পারে না রুস্মি। চোখ দিয়ে অগ্নি ঝড়ে। অভিনয়ের জগতটা বুঝি এত সুন্দর?

অফিশিয়ালি সুজিতের বাবা সুফিয়ান কামাল হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সুজিতের বাবা নন। ঘটনা বহু বছর পূর্বের। সুজিত তখন সবে কয়েক মাসের। সেই সময়ে মা*রা যান সুজিতের বাবা পিয়াস রহমান। অনেকটা অদ্ভুত ভাবে ঘটে যায় বিষয়টা। পিয়াস রহমানের বন্ধু ছিলেন সুফিয়ান কামাল। সে সময়ে বন্ধুর স্ত্রী তথা ইরা বেগমের পাশে দাঁড়ান। ইরা বেগমকে শশুর বাড়ি থেকে অত্যাচার করা হচ্ছিল। ভদ্রমহিলা সইতে না পেরে সুফিয়ান কামালের হাতে হাত রাখেন। বিয়ে করেন ওনারা। আর তারপর চলতে থাকে সময়। কিন্তু সুফিয়ান কামালের ভদ্র সুন্দর চেহারার পেছনে লুকিয়ে ছিল এক ভয়ংকর রূপ। ওনার প্ল্যান ছিল ভিন্ন। পিয়াস রহমানের প্রচুর সম্পত্তি ছিল। যা পাবে সুজিত। তবে সুজিতের সাথে দিনকে দিন মতের অমিল হতে থাকে। তিনি যেভাবে চাইতেন ঠিক তার উল্টো করত সুজিত। এসবে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। সুজিতের আঠারো না হলে সম্পত্তি নিয়ে কিছু করা যাচ্ছিল না। অনিশ্চয়তায় ভাসছিল দু চোখ। সে সময় সব থেকে বেশি সাপোর্ট দেন বন্ধু আনিসুল সাহেব। পেশায় আইনজীবী হলেও ব্যবসায় ধ্যান জ্ঞান ছিল। আনিসুল সাহেবের ঘটনা জানতে পেরে মাথায় মতলবটা আসে। নিজের শিক্ষার প্রভাব দেখায়। সুজিতের জন্মসনদে বয়স বৃদ্ধি করা হয়। আর তারপর ঘটে ঘটনাটা। সুজিতের সাথে শুধ মাত্র রুবির সম্পর্ক ভালো। হয়ত হৃদয়ে অন্য কিছুর আভাস ও ছিল। সেসব খুব বড় হাতিয়ার। রুবি যেহেতু মডেলিং করতে ভালোবাসে সেহেতু মডেলিং নিয়ে ওকে ফাঁদে ফেলা হয়। মিথ্যে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে একটা ডেট দেওয়া হয়। সেই ডেটে আসতে বল‍া হয় রুবিকে। যেহেতু রুবির এক্সাম সামনে তাই বাসা থেকে এসবে সায় দিচ্ছিল না। সেই জন্যই স্কুল থেকে পালিয়ে যায় রুবি। আর সহযোগিতা করে সুজিত। তবে কে জানত সুজিতের জন্য ম*রণ ফাঁদ পাতা ছিল। ওরা বাসের টিকেট নেয় ঠিক ই তবে ওদের যাওয়া হয় না চট্টগ্রাম। আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়।রুবিকে বন্দী করে সুজিতকে বলা হয় পেপারে সাইন করতে। সুফিয়ান কামাল যে সুজিতকে পছন্দ করেন না সেসব জানা ছিল। অনেক কিছু পরিষ্কার। আন্দাজেই বলে ফেলে এসব সুফিয়ান কামালের কাজ। পেপারে সাইন করে দিয়ে চেচামেচি করে সুজিত। এক পর্যায়ে গা*লাগা*ল করে। ফোনের এপাশ থেকে এসব সহ্য হচ্ছিল সুফিয়ান কামালের। তিনি ক্রোধে ডুবে যান। নির্দেশ করেন সুজিতকে মে*রে ফেলার। ছেলেটা প্রায় আধম*রা অবস্থাতেই পালিয়ে আসে। বেশি দূর যেতে পারে না। রাস্তার এক পাশে জ্ঞান হারায়। আর সেখান থেকেই উদ্ধার হয় সুজিত।
পুরো ঘটনাটা স্মরণ করে রুস্মির চিত্ত কেঁপে উঠে। ভেজা নয়নে বলে “আমার বাবা কি এমন ছিল?”

আনিসুল সাহেব নিশ্চুপ। ওনার বড় মেয়েটা একটু বেশিই ভালো প্রকৃতির। নিজের জান দিয়ে অন্যের মান রক্ষা করবে। সময় শেষ। আনিসুল সাহেবকে নিয়ে গেল পুলিশ। রেবেকা বেগম কেঁদে যাচ্ছেন। রস্মিও কাঁদছে। অথচ ওর মস্তিষ্ক বলছে কাঁদে না। এমন বিকৃতি মস্তিষ্কের মানুষের জন্য কাঁদতে নেই। কিন্তু মন বলে বাবা তো বাবাই হয়।

চোখ দুটো সামনে রাখা। রুস্মির পাশে বসল সীরাত। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল “রুবিকে দিয়া আসা হবে। মেয়েটা ভয় পেয়েছে অনেক। ইনফর্মেশনের জন্য পুলিশের কাছে রেখেছে। রুবির জবান নেওয়া হলেই সব ঝামেলা শেষ।”

সব গুলো কথা শুনল রুস্মি। এই কয়েক দিন আনিসুল সাহেবের কাছে ছিল রুবি। অথচ ভদ্রলোক কত সুন্দর অভিনয় করে গেলেন। রুস্মির হৃদয়ে যাতনা। সীরাতের দিকে চোখ তুলে তাকায়। “সব কেমন অদ্ভুত তাই না সীরাত?”

“কেমন?”

“সন্তানের জবানিতে পিতার জেল।”

রুস্মির কণ্ঠে তাচ্ছিল্য! সীরাতের খারাপ ই লাগল। তবু চুপ রইল। অনেকটা সময় এভাবে চলে যায়। ফিরে যাওয়ার সময় সীরাত বলে “জানো রুস্মি, যারা দেশকে ভালোবাসে ওরা মানুষ নয়।” রুস্মি বুঝে না কথাটা। সীরাত ইষৎ হাসে। ফের বলে
“ওরা পাথর। ওরা অ*মানুষ। ওদের হৃদয় নেই। নিজের সব থেকে কাছের মানুষ এমনকি নিজেকে গু*লি করার মত সাহস রাখতে হয়। অন্যায়কে যে প্রশ্রয় দিবে সে ও পাপীর একাংশ। তোমার মা সম্পর্কে কথাটা জানাতে নিষেধ করেছে আবরাজ। তবু বলছি কারণ অর্ধেক সত্য পৃথিবীর সব থেকে ভয়ঙ্কর জিনিস। তোমার মা এসকল বিষয় জানতেন এবং সায় ও দিয়েছেন।”

বিস্মিত হয় রুস্মি। ওর কথা হারায়। গত কয়েকদিনে করা রেবেকা বেগমের চিৎকার মেয়ের জন্য আর্তনাদ গুলো স্মরণে আনতেই রুস্মির মনে হলো সত্যিই কি এ দুনিয়ার সবটাই অভিনয়।

.

নিঃসঙ্গ এক জীবনে বাস করছেন রেবেকা বেগম। বড় মেয়ের দুটি নয়ন সহ্য করতে পারে না ওনাকে। আর ছোট মেয়ে শোকে মর্মাহত। সবার থেকে গুটিয়ে থাকে। মূলত সাপোর্ট দেওয়ার মত কেউ নেই পাশে। এ সকল বিষয়গুলো অসুস্থ করে দিচ্ছে ওনাকে। মানসিক আর শারীরিক দু ভাবেই ভেঙে গিয়েছেন তিনি। রুস্মি তবু যাচ্ছে না। অবশ্য বুয়াকে দিয়ে খবরাখবর নেয়। তবে মায়ের প্রতি যে ঘৃনা তৈরি হয়েছে তা রুস্মিকে একেবারেই ছিন্ন করে দিয়েছে। কিছু দিন আগেই আরেকটি সত্য আসে চোখের পাতাতে। আবরাজের দাদার গ্রামে সম্পত্তি ছিল অনেকটা। অজপাড়া হওয়াতে সেই জমির মূল্য খুবই কম। কিছু দিন আগেই সরকার থেকে লোক পাঠানো হয়েছে। এলাকার পাশে শিল্প কারখানা তৈরি করা হবে। ফলে হু হু করে বাড়বে জমির মূল্য। অর্ধেকটা পাবে আবরাজ। যার মূল্য হতে পারে প্রায় শতেক কোটি টাকা। এই সিংহভাগের লোভে ডুবেছিলেন আনিসুল সাহেব আর রেবেকা বেগম। তাদের পরিকল্পনা ছিল আবরাজের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলা। আর তারপর ফের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা। তবে পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন আসে যখন আবরাজের সাথে দেখা হয়। লম্বাটে, সুন্দর আর সুশ্রী চেহারা দেখে ওনার মনে হয় ছেলেটাকে পরিবারের অংশ করে নিতে। আবরাজের সাথে রুস্মির বিয়ে দিলে ঘটনাগুলো হতে পারে আরও সুন্দর ও ঝামেলাহীন। আবরাজের বিশাল সম্পত্তি ও থাকবে ওনার দখলে। সব মিলিয়ে চমৎকার হবে বিষয়টা। তবে সেসব সফল হলো না আর। গতগ্ন দিন এসব জেনেছে রুস্মি। তবে আনিসুল সাহেবের অভিনয়টা আবরাজের মস্তিষ্কে ছিল বহু পূর্বেই। ও দেখতে চেয়েছিল কত যেতে পারেন তিনি। রুস্মির এখন লজ্জা লাগছে ভীষণ। এত দিনে আবরাজের সাথে একটা সুন্দর মোলায়েম সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বলেই ওর ধারণা। অথচ আবরাজ ভেবেছে এসবের সাথে জড়িত রুস্মিও। সেই থেকে মেয়েটা উসখুস করছে। সীরাতকে আর্জেন্ট ডেকে পাঠাল। মেয়েটা আসার পর রুস্মি বলল
“আমি জানতাম না এসব। বিশ্বাস কর সীরাত আমি আবরাজকে বাবার করা পরিকল্পনার জন্য ভালোবাসি নি।”

শেষ কথাটা বলে রুস্মি বিপদে পড়ে গেল। সীরাত চমৎকার হাসল। হাল্কা হাতে গাল ছুঁয়ে দিয়ে বলল “ভালোবাসো?”

রুস্মি, সীরাত, সৌমিত্র, আবরাজ এসেছে অরিতার ক*বরে। কব*রস্থান পরিষ্কার করার লোক থাকলেও নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। গত কিছু দিনে আবরাজের শ্বাস নেওয়ার সময় অবধি ছিল না।একের পর এক প্রমানের পেছনে ছুটে পাগল হয়ে গিয়েছিল ওরা। সৌমিত্র সামান্য উসুখস করছে। মুসলিমদের কব*রস্থান এতটা কাছ থেকে দেখা হয় নি ওর। ছেলেটা ভেতরে প্রবেশ করল না। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। আবরাজ শুরুতেই বোনের কব*রে হাত ছোঁয়ায়। ছোট ছোট স্পর্শ রাখে। অনুভব করে ছোট্র অরিতাকে। চোখ ভিজে না তবে মনের কোণে আর্তনাদ গুলো ঘুরে চলে। সীরাত ফিরে আসে। সৌমিত্রের মাথা নিচু করে রাখা
“কি হলো?”

“হু?”

“খারাপ লাগছে?”

“না। আসলে ভাবছিলাম মানুষের জীবন কতখানি অদ্ভুত।”

“হুম। তোমাকে কেমন করে কি বলব আমি জানি না। তবে এটা বলতেই হয় গোয়েন্দা বিভাগটা তোমার জন্য সেরা ।”

“হয়ত।”

“হয়ত কেন?”

“যদি আর্মিতে না গিয়ে তুমি গোয়েন্দায় জয়েন করতে সীরাত, তাহলে পরিপূর্ণ হতো আমার জীবন।”

জবাবে উত্তর পেল না সীরাত। রুস্মি ও চলে এসেছে। চোখ ফোলা। সীরাত দেখল মেয়েটার বুকের যন্ত্রণা। কোথাও একটা অপ্রাপ্তি।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ