হাতে রেখো হাত পর্ব-৩+৪

0
259

#হাতে_রেখো_হাত (৩)

পু*ড়ে যাওয়া লা*শের সামনে নির্বিকার হয়ে বসে আছে আবরাজ। ছেলেটার গাঁয়ের বেশ কিছু স্থানেই পু**ড়ে গেছে। তবে মজার ব্যপার হচ্ছে কোনো ব্যথা নেই ওর। ব্যথা তো রয়েছে মনের গভীরে। প্রিয় বোনটা জ্বল*ন্ত কয়লা এখন। লা*শ চেনার উপায় নেই। শুধু পরে আছে হাড় গুলো। কতো সুন্দর ছিলো মেয়েটি। মাত্র তেরো বছরেই নিজের জীবনের অন্তিম পাতা পড়তে হবে কে জানতো? আবরাজের মনে বিষণ্ণতার পাহাড় জমেছে। বুকের ভেতর অশান্ত সমুদ্রের কলতান বাজে। ঢেউ গুলো উথালপাতাল হয়ে নেমে যায় কানের পাশ বেয়ে। হৃদয়ে জ্বালাপোড়া হয়। মাথার উপর চমকায় বিদ্যুৎ। যেন মেতেছে কোনো ধ্বংসযজ্ঞে। নিজেকে চিনতে পারে না ছেলেটা। মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে বদল ঘটে গেল জীবনের। শুকিয়ে যাওয়া চোখ গুলো চারপাশে খোঁজ চালায়। উহু নেই কোনো চিহ্ন। যন্ত্রণায় মনের কোণ থেকে একটি শব্দ ভেসে আসে ‘ আমি কেন আ*গুনে পু*ড়ে গেলাম না? ‘

ছেলেটা বাক শক্তি হারিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। এখন বিকেল চারটা বাজে। প্রায় চারটা ঘন্টা পর আ**গুন নিভাতে সক্ষম হলেন দমকল বাহিনী। তবে বাঁচাতে পারে নি কাউকেই। একটা প্রা*ণ ও রেহাই পেলো না। কারন যতোক্ষণে দমকল বাহিনী পৌছায়, ততক্ষণে ঘরের ভেতর আটকে পরা মানুষ গুলো কুচকুচে কয়*লায় পরিনত হয়েছে। বলতে গেলে প্রতিটা লা**শ ই ছিন্ন ভিন্ন। সব গুলো লা**শকে এক সাথে করার চেষ্টা করতেই তেঁতে উঠলো আবরাজ। নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে হা*ড় গুলোকে জড়িয়ে ধরলো বুকে। চার পাশে থাকা পো*ড়া মাং**সের গন্ধে অবস্থান করা যাচ্ছে না। একদম নাকে এসে বাজে গন্ধটা বুকের ভেতর অবধি ছেয়ে যাচ্ছে। আর ছেলেটা কতো সহজেই জড়িয়ে নিলো সেসব। একজন কর্মী লা**শটার অংশ নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই চেঁচিয়ে উঠলো ফের। কণ্ঠে উন্মাদ, দিগহীন পাগলের মতো আর্তনাদ
” একদম নয়। আমার বোনকে টাচ করবে না একদম। আমার বোন , আমার অরি। সুন্দর বোনটা আমার। কোথায় গেলি তুই। বোন, কষ্ট হচ্ছে তোর? ভাইয়া আছি। এই তো আমি। তোর কাছে। ”

ছেলেটার দু চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমেছে। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। ক্রন্দনরত অবস্থাতে ছেলেটাকে ভীষণ বিক্ষিপ্ত দেখায়। সুন্দর মুখ খানি বেশ নেতিয়ে পরা গোলাপের মতো রূপ বদল করেছে। জামা কাপড়ে ময়লা আর শুকিয়ে যাওয়া র**ক্তের ছোঁ*প ছোঁ*প দাগ। মেয়েটির লা**শকে ছাড়বেই না কিছুতে। অথচ অবশিষ্ট নেই এক টুকরো মাং**স। তবু হা*ড় গুলোই যেন ভীষণ আপন।

কর্মীরা উপায় না পেয়ে ছেলেটাকে সরানোর চেষ্টা করলো। একা না পারায় অনেক গুলো মানুষ এসে সরানোর চেষ্টা চালালো। সৃষ্টিকর্তা যেন প্রাণ ভরে সমস্ত শক্তি প্রদান করে দিয়েছে আবরাজের দেহে। কিছুতেই ছেলেটাকে সরাতে পারছে না কেউ। আর্তনাদ করে বলছে শুধু ” আমি যেতে দিবো না আমার বোনকে। আমার বোন আমার সাথে থাকবে। আজ আমার বোনের জন্মদিন। দিবোও না যেতে। অরি, আছি আমি। তোর ভাই। ”

না পেরে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছেলেটার পিঠে লাঠি দিয়ে আঘা*ত করলো। তবু ও পারছে না ছাড়াতে। বা হাতে আঘা*ত পরতেই ছেলেটার হাত ফঁসকে এলো। চিৎকার করে বলতে লাগলো ” আমি তোকে বাঁচাতে পারলাম না বোন। পৃথিবীর সেরা ভাই হতে পারলাম না আমি। পারলাম না তোকে বাঁচাতে। আমি কি করে থাকবো? এই দুঃখ যে আজন্মকালে ও সইবে না। আমি বাজে ভাই। খুব বাজে। ”

কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পরেছে আবরাজ। চোখ দুটো জলে ভরা কোনো বিল যেন। সমস্ত মেঘেরা বাসা বেঁধেছে ওর দু চোখে।অরিতার মুখ ভাসছে শুধু। কোনো মেঘের দেশ থেকে ভেসে আসবে কি অরিতার খিল খিল হাসি? নাকি এভাবেই শেষ হবে অরিতা নামের মেয়েটি। আবরাজ চোখ বন্ধ করার আগে ফের একটাই শব্দ কানে আসলো ‘ আমার পৃথিবীর সেরা ভাই তুমি। ‘

আট দিন,আট দিন পর পূর্ণ জ্ঞান ফিরলো আবরাজের। এই আট দিনে বহু বার জ্ঞান ফিরেছে। প্রতি বার ই অরি , অরি বলে চিৎকার করে আবারো অচেতন হয়ে পরেছে। বোনের প্রতি অসীম ভালোবাসা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। তবে হায় এ যন্ত্রণা কখনো কি লাঘব হয়?

মাথা চেপে ধরে আবরাজ। কেমন ভারী ভারী মনে হয়। প্রচন্ড ব্যথায় ঘাড় নাড়ানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনো শক্ত পোক্ত ঝোলা চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। ঘাড় যেন এখনি বেঁকে যাবে। ডান হাতটা বেড শিটের সাথে ঘসা লাগতেই আহ বলে আর্তনাদ করে উঠলো ছেলেটা। অনেকটা পু**ড়ে গেছে। ছেলেটার আর্তনাদ শুনে ছুটে আসেন নার্স। বিগত দিন গুলোতে বেশ পাগলামি করেছে আবরাজ। সেই কারনেই নার্স ভয় পেয়ে যান। বিলম্ব না করে ছুটে যান ডাক্তারের কাছে। কয়েক মুহুর্তেই সাথে নিয়ে আসেন দুজন স্টাফকে। তবে আজ পাগলামি করলো না আবরাজ। কেমন যেন হয়ে গেছে। দেহে শক্তি নেই বললেই চলে। থাকবেই বা কেমন করে। স্যালাইনের মাধ্যমে বেঁচে আছে! মৃদু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কয়েক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছেলেটা বোঝার চেষ্টা করে বিষয়টা। তবে ঠিক ঠাওর করতে পারে না। আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা হসপিটাল। ধীর পায়ে নামতে যেতেই একজন নার্স বললেন ” আপনি অসুস্থ। এখন উঠবেন না প্লিজ। ”

নার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো আবরাজ। ফ্যালফ্যালে রুগ্ন চাহনি। হাতের ইশারায় ক্যানেলা খুলতে বললো। নার্স খুলে দিলেন সন্তপর্ণে। হাত খানা কয়েক বার উঠা নামা করলো। প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হয়। হাত বোধহয় অবশ হয়ে রয়েছে।

তিন ঘন্টা পর নিজের অতীতকে মনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। নিজ ব্যক্তিত্বকে ফিরে পেলে ও আবেগ আর অনুভূতিকে লুকাতে অক্ষম। ডুকরে কেঁদে উঠলো পুরো হসপিটালের সম্মুখে। একজন ডাক্তার ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ” শান্ত হও বাবা, শান্ত হও।”

” স্যার আমার বোন। মাত্র তেরো বছর ওর। জন্মদিন ছিলো সেদিন। মেয়েটা একা করে চলে গেলো। কেউ নেই আমার। এই পৃথিবীর বুকে আমি একা। মূল্যহীন আমার বেঁচে থাকা। ”

চুল মুঠোতে এনে ধপ করে বসে পরলো। বেশ কিছু সান্ত্বনার বানী শুনতে হলো ওকে। তবে সান্ত্বনাতে কি জীবন চলে?

পো**ড়া বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো আবরাজ। হায়রে মানুষ! বিধ্বস্ত বাসাটা দেখে মৃদু হাসলো। এই বাসাতে জড়িয়ে ছিলো ওর পুরো পরিবারের স্মৃতি। শেষ সম্বল যাকে বলে। সরকারের থেকে সামান্য কিছু টাকা প্রদান করা হয়েছে ঘরের ক্ষতিপূরন হিসেবে। টাকা গুলোর দিকে তাকালো। জীবন কতোটা অদ্ভুত তাই না?

চারপাশ থেকে এখনো আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।কেউ কেউ পরিবারের মানুষ হারিয়ে কেউ বা ঘর বাড়ি হারিয়ে। চাঁপা আর্তনাদ গুলো এই ভরা সন্ধ্যাতে অশরীর চিৎকার মনে হচ্ছে। কয়েকটা পুরনো ল্যাম্পপোস্টের আলোতে চিক চিক করছে রাস্তা। সে পথ ধরেই হেঁটে চলেছে ছেলেটা। প্রাণহীন দেহ। আর এলেবেলে মস্তিষ্ক।

হাঁটতে হাঁটতে পায়ের মাঝে কিছু একটা ঠেকে যায়। মাথাটা নিচু করে দেখে খবরের কাগজ। কাগজটা এরিয়ে যেতে গিয়ে ও পারলো না। কারন এর হেডলাইন এ ঝলমল করছে সেদিনের সেই ঘটনা। না চাইতে দু চোখ ভরে উঠলো। কাঁপা হাতে খবরের কাগজটা তুললো। বড্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। বুক যেন চিরে যাবে। আলগোছে পকেটে তুলে নিলো কাগজটা। পথিমধ্যে আবরো থমকে গেলো। গুটি কয়েক মানুষের আওয়াজ কানে আসছে। একটি কথা ছিলো এমন ‘ টাকাটা পাইছিস? আমাদের কাজ এবার পরের কলোনিতে বো*মা আঘা*ত করা। প্রবাস থেকে খবর আসছে, হেলিকপ্টার দিয়া বো*মা আঘা*ত করায় আন্তজার্তিক অঙ্গনে মামলা হইছে। এবার দেশের অভ্যন্তরীণ মসলা
পাতিতেই যা করার করতে হইবো ‘

লোকগুলোর কণ্ঠে সর্তকতা। আবরাজের দু চোখে জ্বলন্ত দাবানল ।র*ক্ত চক্ষু দুটোতে হালকা পানির মালা। দেশদ্রোহি, এই হা*রামির জাতের জন্যই এতো গুলো প্রাণ চলে গেল। শরীরে তেমন শক্তি নেই। তবু ও পিছু নিয়ে এগিয়ে গেল ছেলেটা। হাতে মোটা শক্ত পাইপ। আবরাজের দিকে তাকিয়ে লোক গুলো বলল
” ঐ কে তুই? ”

” কু*ত্তার বা*চ্চা দেশে থেকে দেশের ক্ষতি করিস। দেশদ্রো*হি, মিরজাফর। ”

কথার মাঝেই পাইপ দিয়ে একজনের গাঁয়ে আঘা*ত করে বসলো ছেলেটা। রেগে গিয়ে সবাই মিলে চেপে ধরে আবরাজকে। ছেলেটা এতো গুলো লোকের সাথে পেরে উঠে না। মাথায় আঘা*ত পরতেই লুটিয়ে পরে মাটিতে। পুলিশের গাড়ির শব্দ আসতেই লোক গুলো পালাতে লাগলো। দূর্বল, র*ক্তা*ক্ত শরীর নিয়েও আবরাজ বলতে লাগলো ” মিরজাফরের বা*চ্চা , দেশদ্রো*হি, ছাড়বো না তঁদের। ”

পুলিশ গুলো ওকে উঠালো। টলমল শরীর নিয়ে ইশারা করলো আবরাজ। কয়েক জন পুলিশ সেই দিকে চলে গেছে। একজন কর্মকর্তা ঘনঘন শ্বাস ফেলে বললেন
” কারা ছিলো ওরা? ”

“দেশদ্রো*হি। ”

ছেলেটার গাঁয়ে দুটো ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। এমনিতেই অসুস্থ তারপর আবার আঘা*ত পেয়েছে। শরীরে শক্তি নেই একদম। বড় কর্মকর্তারা এসেছেন আবরাজের সাথে দেখা করতে। ছেলেটা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। ওর ধারালো মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বুঝতে পারে। এদেশে এখনো কিছু দেশদ্রো*হি রয়েছে। যাঁরা অভ্যন্তরীন উপায়ে দেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে। অন্য দেশের সাথে হাত মিলিয়ে দেশে লুটপাত করছে। তাই কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। অফিসার আবুল বললেন “সৈয়দ আবরাজ। তোমার নাম তাই তো? ”

দু দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো আবরাজ। আবুল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ছেলেটার পাশে এসে বসলেন তিনি। সিগারেট জ্বালালেন ওর সামনেই। এক টান দিয়ে অফার করলেন সিগারেট খাওয়ার জন্য। হাতটা উঠিয়ে, না বললো আবরাজ। দুর্ভেদ্য হাসলেন আবুল। সময় নিয়ে সিগারেটটা শেষ করলেন।খুব যত্নে ফিল্টার ফেললেন। সবটাই তীক্ষ্ম চোখে দেখলো আবরাজ। যাওয়ার পূর্বে ভদ্রলোক ছেলেটার মাথায় স্পর্শ করলেন। অবাক হতে হলো ওকে। হাত সরিয়ে মৃদু হাসলেন আবুল। ” জীবন অনেক বড়। স্বার্থকতা কি জানো? প্রেম, ভালোবাসা। সেটা পরিবারের প্রতিই হোক কিংবা দেশপ্রেম। নিজের দেশকে যে ব্যক্তি ভালোবাসে তাঁকে আল্লাহ ও পছন্দ করেন। তোমার জীবনে আপন বলতে এই দেশটাই রয়েছে। নিজের জীবনের পরবর্তী ধাপ টুকু দেশের সাথে জোড়ার চেষ্টা করো। ”

লোকটা দরজার কাছে এসে আবারো ফিরে এলেন। এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবরাজ। পকেট থেকে কার্ড বের করে ওর হাতে গুঁজে দিলেন তিনি। আশ্বস্ত করতে বললেন ” যে কোনো প্রয়োজনে আমার সরনাপর্ণ হবে। আমি তোমাকে সাহায্য করবো ইনশাআল্লাহ। পারলে আমার কথাটা মাথায় রেখো। তোমার ভেতরে আমি আগুন দেখেছি। পারবে, তুমিই পারবে এ দেশের কিছু অভ্যন্তরীণ শত্রুকে শেষ করে দিতে। ”

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

#হাতে_রেখো_হাত (৪)

এইচ এস সি রেজাল্ট প্রদান করা হয়েছে। সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পাস করেছে আবরাজ। ছেলেটা খুশি হবে নাকি দুঃখী হবে ঠিক বুঝতে পারছে না। অরিতা সব সময় বলতো ওর ভাইকে বেস্ট রেজাল্ট করতে হবে। তেমনি রেজাল্ট করেছে ছেলেটা। তবে সে সংবাদ অরিতার কানে পৌছালো না। বেশ মনোকষ্ট নিয়ে এক গুচ্ছ বেলি ফুল কিনে নিলো ছেলেটি। অরিতা কে গনক*বর দেওয়া হয়েছে। ক*বরস্থানের কাছে আসতেই মৃদু শীর শীর বাতাস এসে ওকে স্পর্শ করে গেল। এক মুহুর্তেই জন্য অনুভব হলো ঐ স্পর্শ যেন অরিতার ছোট ছোট হাতের স্পর্শ। মেয়েটি প্রায় সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো ওকে। আর চোখ বন্ধ করে বোনের দেওয়া ভালোবাসা গ্রহন করতো আবরাজ। দীর্ঘ সময় এভাবেই পার হয়ে গেল। কয়েকটা কাকের কা কা ধ্বনি তে ওর ধ্যান ভাঙে। হাসে, কষ্টের হাসিই বটে। কব*রের পাশে এসে ফাঁকা ঢোক গিলে। অরিতার জন্য দোয়া, প্রার্থনা করে সাথে প্রার্থনা করে সকল ক*বর বাসীর জন্য। ফুলটা ক*বরের পাশে রেখে মাটিতে হাত বুলায়। কাল রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছিলো। তাই মাটি ভেজা। ছেলেটার বুক ধক করে উঠলো। অরিতার ঠান্ডার সমস্যা ছিলো। আজ ও কি ঠান্ডা লেগে গেলো ওর? অরির কি কষ্ট হচ্ছে ঠান্ডায়? মেয়েটা বৃষ্টা আসলেই ভাই ভাই করে চেঁচাতে। কাল ও কি চেঁচিয়েছে অরি? হাজারো জল্পনা কল্পনা এসে ভর করে মস্তিষ্কে। চোখ দুটোর কোণ ভেজা নোনা জলে। আবরাজের ইচ্ছে হয় হাউমাউ করে কাঁদতে।ক*বরে হাত বুলাতে বুলাতে বলে
” বোন এই বোন কেমন আছিস তুই? কষ্ট হচ্ছে খুব। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা বাঁধিয়েছিস নিশ্চয়ই। তোর অভাগা ভাইয়ের সাধ্য হলো না তোকে রক্ষা করার। আল্লাহর কাছে কতো বার বললাম আমার বোনটা কে নিয়ে নিও না। কিন্তু তিনি তোকে ও নিয়ে গেল। বেলি ফুল তোর খুব পছন্দের তাই না? দেখ একদম তরতাজা ফুল এনেছি। খুশি তো তুই? এই অরি, শুনতে পাচ্ছিস তুই তোর ভাই সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পাস করেছে। তোর সেরা ভাই, অরি বোন আমার। আমি বাঁচতে পারছি না। শক্তি নেই আমার মাঝে। ”

আবারো আর্তনাদে ভেঙে পরে ছেলেটি। সব পরিস্থিতি তে কঠোর থাকার শক্তি এখন আর নেই ওর।পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে হারিয়ে একদম ই ভেঙে পরেছে ছেলেটা। চোখের পানিতে শুকিয়ে যাওয়া মাটির মাঝে আবারো দাগ উঠে। কাঁধে কারো স্পর্শ পায়। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে লোকটা বললেন ” শান্ত হও বাবা। শান্ত হও, জীবনটা কে এতো ঠুনকো ভেবো না। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষকে একটি লক্ষ্য দিয়ে পাঠান। তোমাকে ও পাঠিয়েছেন এমন এক লক্ষ্য দিয়ে। ”

” আপনি? ”

” কব*রস্থান দেখা শোনা করি আমি। পাশেই ছিলাম, রোজ অনেক মানুষ কান্না করে এখানে। তবে তোমার আর্তনাদ শুনে না এসে পারলাম না।

বৃদ্ধ লোকটি শ্বাস ফেললেন। ভারী গরম এক নিশ্বাস।
তারপর বললেন ” তোমার বোন হয়? ”

আবরাজ উঠে দাঁড়ালো। কব*রটা আরেক বার দেখে বলল ” হ্যাঁ। আমার বোন কে দেখে রাখবেন। মেয়েটা বড্ড ভীতু প্রকৃতির। ”

চোখ মুছে এলোমেলো পায়ে ক*বরস্থান থেকে বের হলো আবরাজ। বৃদ্ধ লোকটি ভাষাহীন নির্বিকার। এমন ভালোবাসা খুব কম ই দেখেছেন তিনি। ভালোবাসার কোনো সীমা নেই। অন্তত অসীম এই প্রক্রিয়া সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে।

ক*বরস্থান থেকে বেরোলেই একটা মসজিদে আছে। নামাজ পড়ে মসজিদেই অবস্থান করলো আবরাজ। বিগত মাস দুয়েক ধরে এখানেই থাকছে ছেলেটা। দুপুরে নামাজ শেষ করে খাবার খাওয়ার জন্য বের হয়েছে। তখনি চোখে পরে একটা মেয়েকে। মুখে মাক্স লাগিয়ে ছুটছে। দেখে মনে হচ্ছে পেছনে কোনো লোক লেগেছে। আবরাজ নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। ছুটে গেল ঐ মেয়েটির দিকে। একটু দূরে এসে হাপাচ্ছে মেয়েটি। আবরাজ ওহ হাপাচ্ছে। পেছন ঘুরে ওকে দেখে বলল ” কি চাই? ”

” আপনি এভাবে ছুটছিলেন কেন? কেউ তাড়া করেছে আপনাকে?”

” ওহ হো এর জন্য এসেছেন? ”

” হ্যাঁ। ”

মাক্সটা খুলে ফেললো মেয়েটি। নির্লিপ্ত তাকিয়ে রইলো আবরাজ। অনেক সুন্দরী না হলে ও বলা চলে বেশ মায়াবী মেয়েটি। বয়স বেশি হলে আঠারো হবে।

আবরাজের কাছে এসে দাঁড়ালো মেয়েটি। ভালো করে পরখ করে বলল ” সৈয়দ আবরাজ? ”

অচেনা মেয়েটার মুখে নিজের নাম শুনে চমকালো বেশ। মেয়েটা দারুন এক হাসি উপহার দিয়ে হাত বাড়ালো। হাতের দিকে এক পলক তাকালে ও হাত মেলালো না আবরাজ। মেয়েটি তাঁতে বিন্দু মাত্র অপমান বোধ করলো না। বরং অধর কোণে হাসি রেখেই বলল ” আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি এখন। ”

” আমাকে? ”

” এইচ এচ সিতে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছেন তাই না? ”

” হ্যাঁ। ”

” আমি ও এইচ এস সি ব্যাচ। তবে আপনার মতো এতো ভালো নাম্বার পাওয়া হলো না। তবে বোর্ড পর্যায়ে প্রথম হয়েছি। দৌড়াচ্ছিলাম কারন আমি সেনাবাহিনীতে জয়েন হতে চাই। কিছু দিন পূর্বে একটি ঘটনা ঘটে গেলো জানেন নিশ্চয়ই। আমার মন সেই দিন থেকে সেনাবাহিনীতে জয়েন করার জন্য উতলা হয়ে রয়েছে। দেশের পরিস্থিতি দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে। কোন দিন পুরো দেশটাই লুট হয়ে যাবে জানতে ও পারবে না কেউ। আমি চাই আমার দেশকে ভালোবাসতে,ভালো রাখতে। তাই এই পদে জয়েন হতে চাচ্ছি। ”

থমকে গেছে আবরাজ। মেয়েটির কথা শুনে ভেতর থেকে ভালো লাগা কাজ করলো। মনে মনে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিলো। মুখের সামনে তুরি বাজাতেই চমকে উঠলো ছেলেটি। মেয়েটি বলল ” উইল ইউ ফ্রেন্ড? ”

হেসে সম্মতি প্রদান করলো আবরাজ। বহু দিন পর ভেতর থেকে শান্তি অনুভব হচ্ছে। মেয়েটির সাথে কথা বলে জানতে পারলো মেয়েটির নাম সীরাত। পুরো নাম সিদ্রাতুল সীরাত।

সীরাত বেশ ফ্রেন্ডলি কথা বলে। আবরাজ হেসে বলল
” আপনার নাম টা বেশ ইউনিক? ”

সরস হাসলো মেয়েটি। এক পলক তাকিয়ে বলল
” আপনার নাম টা আরো বেশি ইউনিক। বাই দ্যা ওয়ে আমরা আপনি করে কেন বলছি? সেম ব্যাচ সেম এইজ ওহ তাহলে তো তুমি করেই বলা যায়। ”

আবরাজ ও সম্মতি জানালো। কথা বলতে বলতে আসরের আজান পরে গেল। আবরাজকে বিদায় জানালো মেয়েটি। যাওয়ার পূর্বে বলল ” খুব ভালো হলো তোমার সাথে পরিচয় হয়ে। পরে দেখা হবে। মসজিদে থাকছো তাই না? ” ”

” হ্যাঁ। ”

” আচ্ছা বাই। ”

মৃদু হাসলো আবরাজ। সীরাত চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে।
.

অনেকক্ষণ ধরেই মসজিদের বাইরে অপেক্ষা করছেন ভদ্রলোক। লম্বা দেহ চওড়া বুক। মুখের ভঙ্গিমা শক্ত। আবরাজকেই দেখেই উঠে এলেন। প্রথমে খেয়াল করে নি আবরাজ। পা ধোয়ার সময় দেখতে পেল।
” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস বাবা? ”

” ভালোই। ”

” বাড়ি যাবি না? ”

” কোন বাড়ি? ”

” আমার বাড়ি। তোর চাচি অপেক্ষায় আছে। ”

” যাবো না আমি। চাচিকে অপেক্ষা করতে বারণ করবেন। ”

” আবরাজ, বাবা রাগ করিস না তুই। ছোট সময়ের ঘটনা নিয়ে কেউ মন খারাপ করে থাকে? ”

” মন খারাপ নেই চাচা। যদি তেমনি হতো তাহলে আমি বা বাবা লিগ্যাল অ্যাকশন নিতাম। এর কিছুই যেহেতু করি নি সেহেতু আপনারা নিশচিন্তে থাকতে পারেন। ”

মন খারাপ হলো লোকটির। তিনি আবরাজের কাঁধে হাত রেখে বললেন ” সময়ের সাথে সাথে মানুষ পরিবর্তন হয়। আমরা নিশ্চয়ই তদের ভালোবাসি। ”

” মাফ করবেন চাচা। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমি নামাজে যাবো। ”

আনিসুল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। আবরাজ নামাজে গেলে তিনি ও গেলেন। নামাজ শেষে বললেন
” অরির জন্য খারাপ লাগছে। তবে ভাগ্যে হয়তো এটাই ছিল। তোর চাচি অসুস্থ। তাই আসতে পারে নি। কখনো যদি মনে হয় সব ভুলে…. ” থামলেন তিনি। গলায় আটকে আসে কথা। আবরাজ মৌন রইলো পুরোটা সময়।

রাতে ফোন করলো সীরাত। ” ঘুমাচ্ছিলে তুমি? ”

” না। ”

” আমার কিছু জানার ছিল। ”

” কোন বিষয়ে? ”

” তোমার নানা বাড়ির বিষয়ে। ”

” কেউ নেই। ” সীরাত বুঝলো এ বিষয়ে কথা বলার উপযুক্ত সময় নয় এখন। তাই ফোন রেখে দিলো মেয়েটি। আবরাজ আকাশে দিকে তাকিয়ে। বড় চাঁদ উঠেছে। হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে যেন। অরি চাঁদ দেখতে ভালোবাসতো। এখনো কি চাঁদ দেখে না অরি? আগের মতো রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে নির্লিপ্ত চাহনিতে?

চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ