হাতে রেখো হাত পর্ব-৫+৬

0
205

#হাতে_রেখো_হাত (৫)

আরেকটি বিষণ্ন প্রহর। অরির কব*রের কাছে আসলেই আবরাজের হৃদয় থমকে যায়। চোখ ফেটে কান্না আসে। কখনো কাঁদে আবার কখনো গুমরে ম*রে। সত্যি বলতে মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা নেই। মাছের ঝোল ভীষণ ভালো বাসতো অরি। চাহিদা বলতে তো ঐ টুকুই ছিল। অন্যসব বাচ্চাদের মতো আড়ম্বর নেই ওর চাওয়ায়।খুব সাধারণ আর স্বচ্ছ। মাসের প্রথমেই বাজার থেকে বড় মাছ নিয়ে আসতেন বাবা। ভদ্রলোক জীবনে পরিশ্রম করেছেন। হয়তো আয়ের পরিমান অতিরিক্ত কিংবা বিলাশিতা করার মতো ছিল না তবে সন্তানদের সমস্ত সুখ এনে দেওয়ার প্রয়াস ছিল। অন্যদিকে মায়ের রান্নার হাত অসাধারণ। চুলোর শেষ আগুনে করা মরিচ পোড়া ভর্তাও অমৃত স্বাদ দিতো। যেদিন মাছের ঝোল কিংবা আবরাজের পছন্দের দেশী মুরগির ঝাল রান্না হতো, পরিবারের সবাই এক সাথে খেতো। মা অবশ্য খেতে চাইতেন না। তদারকি করতে চাইতেন সবার। কিন্তু ঐ স্বামী সন্তানের কারণে বসতে হতো তাকে। মাঝে সাঝে তিনি বলতেন ‘ আমি আছি বলেই একটু যত্ন করতে চাই। না থাকলে তো আর এমন যত্ন পাবি না। ‘ এমন কথাতে বেজায় রাগ দেখাতো আবরাজ। মা তখন ছেলের মাথায় হাত বুলাতেন। বলতেন এ জীবনের নিশ্চয়তা নেই। আজ নিশ্বাস আছে কাল না ও থাকতে পারে। অরিতা তখন জড়িয়ে ধরতো মায়ের উদরে। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ হাসি কান্নায় শেষ হতো ওদের ভোজন। ভদ্রমহিলা সর্বদা স্মরণ করাতেন মৃ*ত্যুর কথা। হয়তো সৃষ্টিকর্তা ওনাকে উপলব্দি করিয়েছিলেন সময় শেষ। অরিতার ক*বরে হাত বুলিয়ে ফিরে এলো আবরাজ। মেয়েটার জন্য কষ্ট হয় খুব। সামান্য আঁধার সহ্য হতো না যার সেই মেয়েটা এতোটা মাস শুয়ে আছে আঁধারে! সত্যিই পরিস্থিতি মানুষকে মানাতে শেখায়।

পার্ট টাইম জবটা আর করছে না আবরাজ। সরকার থেকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল সেটা দিয়েই চলছে। তবে টাকা তো ফুরিয়ে আসে। এবার কিছু করা দরকার। খবরের কাগজ, নেট ঘেটে কিছু জব সার্কুলার বের করলো। সবাই চায় এডুকেটেড পার্সন। অনার্স পড়ুয়া হলেও একটা চান্স আছে। আবরাজ তো সবে এইচ এস সি পাস করলো। মন খারাপ হলো ছেলেটার। কিছু রেস্টুরেন্টে সার্ভিসিং জব রয়েছে। এগুলোই শেষ ভরসা।

তিনদিনের মাথায় চাকরিতে জয়েন করলো আবরাজ। লম্বাটে দেহ আর সুন্দর মুখাশ্রী হওয়াতে ফাইফ স্টার হোটলে জব পেল সে। বেতন ভালো। পড়াশোনার খরচ চালিয়েও কিছু টাকা বেঁচে যাবে। আগে হলে এই টাকা জমিয়ে রাখতো আবরাজ। বড় হবে অরি। বিয়ে দিতে হবে। ধুমধাম করে মস্ত আয়োজনে শশুর বাড়ি যাবে আদুরে বোনটা। কিন্তু এখন, এখন তো সেসব কিছু কল্পনাও করতে পারে না আবরাজ। রোজ বেলি ফুলের গুচ্ছ কিনে অরিতার ক*বরে দিবে। তারপর ও থেকে যাবে কিছু টাকা। আবরাজের অশান্ত লাগছে। টাকা কখনো সুখ হতে পারে না। তবে টাকা দিয়ে আমরা প্রায়শই সুখ কিনি। সেই সুখ ক্ষণকালের জন্য হলেও কিনি। আবরাজ ও কিনতো। তবে এখন কার জন্য সুখ কিনবে? ভালো লাগছে না কিছুই। শার্টের দুটো বোতাম খুলে গাছের নিচে বসলো। সামনেই অরিতার স্কুল দেখা যায়। মাঠের এক প্রান্ত বরাদ্দ ছিল অরির জন্য। সর্বদা সেখানটায় বসে থাকতো মেয়েটি। অন্য সব বাচ্চারা ছুটোছুটি করতো আর অরি তাকিয়ে থাকতো। একবার আবরাজ বলল ‘ খেলিস না কেন তুই? ‘ অরি বলতো
‘ যদি ব্যথা পাই। ‘ কিছুটা সময় চুপ ছিল আবরাজ। তারপর ই মনে পরে কিছু মাস আগের কথা। বান্ধবীদের সাথে কানামাছি খেলতে গিয়ে পায়ে আঘা*ত লাগে বাচ্চাটার। টানা আট দিন জ্বরে ভুগে। খরচ হয়ে অনেক গুলো টাকা। বাচ্চাটা সেদিন অবিজ্ঞদের মতো করে বলেছিল ‘ শুধু শুধু টাকা গুলো নষ্ট হলো। ইস আমি যদি না খেলতাম। ‘

শিউরে উঠে আবরাজ। মেঘ করেছে। ঠান্ডা হাওয়া বয়। দু চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জলকনা। সেসব পাত্তা দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। চোখে ভাসে ঐ তো অরি আসছে। ভাইয়া ভাইয়া করে ডাকে। এসেই জড়িয়ে ধরে বলবে’খেয়েছো ভাই?’
আবরাজ মিথ্যে বলবে। সে জানাবে ভরপেট খেয়েছে। অথচ সকাল থেকে এক দানা পেটে যায় নি। অরির টিফিন দিয়ে আবরাজ চলে যেতে নিলেই অরি ডাকবে। ভাইকে না খাইয়ে খাইবে না। ঐ টুকু টিফিনের আবার দুটো ভাগ! মেয়েটা কেমন যেন। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে। আমরা আমাদের আপনজনকে খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলি।

বৃষ্টিতে ভিজে গেছে শরীর। হঠাৎ ই মনে হলো মাথার কাছটায় আর বৃষ্টি পরছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সীরাতের দেখা। অপ্রস্তুত বোধ করে ছেলেটা। ” এই ভরা বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? ”

” বসে ছিলাম। ”

” আলসেমি করে আর উঠা হয়নি,না? ”

” তেমনি কিছুটা। ”

” তুমি এই দিকে যে? ”

” বৃষ্টির সাথে বন্ধুত্ব করছি। ”

” মানে? ”

” এই যে বৃষ্টি ঝরছে,যারা ঘরকুনো কিংবা আদুরে এই বৃষ্টি তাদের ভীষণ অপছন্দ করে। ওরা ভিজলেই জ্বর সর্দি লেগে যা তা অবস্থা। আমি তাই বৃষ্টির সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছি। দেশের সুরক্ষায় যাতে এই ঝড় বৃষ্টি আমাকে কাবু না করতে পারে। ”

সীরাতের কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো আবরাজের। উঠে এসে বলল ” তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো। ”

” ভিজেই তো গেছো, চলো এক কিলোমিটার দৌড়ানো যাক। ”

“এই বৃষ্টিতে? ”

“তো? ” ছেলেটাকে ফের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে নিলো সীরাত। ছুটতে লাগলো বৃষ্টির জল মাথায় নিয়ে। কাঁদা পানির চপচপ শব্দ বিষণ্নতাকে হটিয়ে ফুটিয়ে তুললো এক চিলতে হাসি।
.
এক ভোরে উপস্থিত হলেন আনিসুল সাহেব। আবরাজ বিস্মিত! অরির মৃ*ত্যুর পর ও বাড়িটায় ফিরে যেতে চায় নি মন। তাই মসজিদে ছিল কিছু মাস। তারপর কাছাকাছি এক রুমের বাসা নিলো। আবরাজ কল্পনাও করেনি ভদ্রলোক চলে আসবেন এই অবধি। ছেলেটার মন গলে না। আরও একবার শূন্য হাতে ফিরতে হয় ওনাকে। সে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবরাজ। নাস্তা শেষ করে চলে আসে হোটেলে। ফাইফ স্টার হোটেল। পোশাক পরিবর্তন করতে হলো। ফর্মাল ড্রেসাপে ভালোই দেখায় ওকে। সুদর্শন মুখাশ্রী আর লম্বাটে হওয়াতে অনেকেই তাকিয়ে থাকে। মনে মনে তারা আপসোস করে ইস ছেলেটা গরিব কেন হলো? কেন হোটেলে জব করলো। কোনো এক আলিশান প্রাসাদে জন্ম নিলো না কেন? খুব কি ক্ষতি হতো কোটিপতি বাবার ঘরে জন্ম নিলে? আমাদের সমাজের একটি কমন বিষয় রয়েছে। নারীর রূপ আর ছেলের টাকা। দুটোই খুব বেশি জরুরী। সেসব মেনে নিয়েই বড় লোকের সুন্দরী মেয়ে গুলো চলে যায় তাদের কয়েক মুহুর্তের ভালো লাগাকে ফেলে। আবরাজ খাবারের অর্ডার নিচ্ছিলো। আচানাক রাইয়ের কণ্ঠটা কানে এলো। ও চাইছিল মেয়েটার মুখোমুখি না হতে। তবে লোক না থাকায় যেতে হলো। খুব স্বাভাবিক ওর আচারণ। ” ইয়েস ম্যাম। ”

পরিচিত কণ্ঠে ঘুরে তাকালো রাই। চোখের সামনে দাঁড়ানো ওর প্রাক্তন। যার বুকে মাথা রেখেছে বহুবার। ওভাবেই চলে যায় কিছু সময়। আবরাজ নিশ্চুপ। রাই বলে ” একটা লেমোনেইড দিয়ে যাবে। আর সাথে বেক পাস্তা। ”

নীরবে সম্মতি জানিয়ে চলে যায় আবরাজ। ফিরে আসে খাবার নিয়ে। খাবার রাখার সময় রাই ইচ্ছে করে ফেলে দেয় খাবার। আবরাজ যেন বিহ্বল হয়ে যায়। রাই এমনটা করবে আশা করে নি। মুহুর্তেই চিল্লিয়ে ভীড় করে ফেলে রাই। ম্যানেজার আসেন। প্রথমেই আবরাজকে ধমক দেয় আর তারপর স্যরি বলে রাই কে। রাই ইটস ওকে বলে বসে যায়। খাবারের বাটি উঠানোর সময় আবরাজ বলে ” একটা সময় ছিল যখন তুমি আমার বুকে মাথার রাখার জন্য কান্না অবধি করেছো। আমার ছোঁয়া পাওয়ার লোভে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে নোংরা নর্দমার পাশে। ”

অপমানে শরীর জ্বলে উঠে মেয়েটির। ছেলেটাকে চড় মারার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ ধমকে উঠে। ভরকে যায় রাই। একদম ই নেতিয়ে পরে। ” কিছু বলি নি বলে এই নয় তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা রয়েছে। আমি তোমাকে কেবল করুণা করছি। ”

দুঃখে কষ্টে রাই চুপ হয়ে যায়। খাবার রেখে উঠতে চাইলে ফের ধমকে উঠে আবরাজ। এত লোকের মাঝে প্রচণ্ড অপমানিত হয় মেয়েটি। মাথা নিচু করে বসে থাকে। তবে খাবার নামে না গলা দিয়ে।

চলবে….

#হাতে_রেখো_হাত (৬)

কাজ শেষে বাড়ি ফিরে অবাক ই হলো আবরাজ। ওর এক রুমের বাসাটার সামনে বসে থাকা চারজন মানুষ। আনিসুল সাহেব, ওনার স্ত্রী রেবেকা বেগম আর দুই মেয়ে রুবি আর রুস্মি। বিস্মিত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভদ্রমহিলার কণ্ঠ “আব্বা, কেমন আছিস তুই?”

“ভালো আছি চাচি।”

“শুকায় গেছে শরীর। কেমন ভালো আছিস দেখাই যাচ্ছে।”

“এটা এমনিই। আপনারা কখন এসেছেন?”

“সেই বিকেলে।” পাশ থেকে উত্তর দেয় রুস্মি। আবরাজ ফিরে তাকায় ওদের পানে। দুই বোন বড় হয়েছে। অনেক বছর আগে দেখা হয়েছিল। তখন ওরা খুব ই ছোট। রুস্মির এখন কলেজে পড়ার কথা।
ইষৎ হেসে ওদের ভেতরে নেয় আবরাজ। খুব ছোট একটা ঘর। তবে নেই কোথাও বাহ্যিক সৌন্দর্যের অভাব। একজন মানুষের জন্য পার্ফেক্ট। তবু কোথাও একটা বিষণ্ণতার দেখা মিলে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেসব ই দেখে রুশ্মি। এক পর্যায়ে আবরাজের ছোট বুক স্লেফে নজর আসে। কতগুলো উপন্যাসের বই। একদম ই নতুন। পাশে থাকা বাবল পেপার বলে দিচ্ছে বেশি দিন হয়নি অর্ডার করেছে। রুস্মি বুদ্ধিমতি। সে খুব দ্রুতই বুঝে গেল। আবরাজ নিয়ম করে উপন্যাস পড়ে। কাজের শেষে বাড়ি ফিরে। আপন বলতে কেউ নেই। সেই একাকিত্ব দূর করতেই বই পড়ে ছেলেটা। রুবা একটু খিটখিটে। এই সুন্দর রুমটা ও ওর মন ছুঁতে পারল না। বরং মুখ ফসকে বলে ফেলল ‘
খুব ই ছোট একটা রুম। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

চা নিয়ে ফিরছিল আবরাজ। রুবির কথা স্পষ্ট শুনতে পেল। রেবেকা বেগম মেয়ের উপর ভীষণ বিরক্ত। সব সময় এমন করে রুবি। ফলে বিব্রত হতে হয় ওনাদের। এই তো কিছুদিন আগের কথা। আনিসুল সাহেবের এক বন্ধু বাড়ি এলেন। ভদ্রলোককে নাস্তা দেওয়া হয় রুবির জন্য বরাদ্দকৃত প্লেটে। সেই জন্য সে প্লেট ব্যবহার ই ছেড়ে দিলো মেয়েটা। প্লেট না ব্যবহার করাটা দোষের না। কারো স্বভাবে এমন বৈশিষ্ট্য থাকতেই পারে। তবে সমস্যা হলো যখন ভদ্রলোকের সামনেই চেচিয়ে উঠে রুবি। শুধু তাই নয় চাপা স্বরে কিছু কথাও বলে। সেসব কানে আসে লোকটার। তারপর থেকে তিনি আর এ বাড়িতে আসেন নি কখনো। এর কারণ কারোই অজানা নয়। এমন নানান ঘটনা রয়েছে। ভদ্রমহিলা রাগ হয় এসবে। আজ ও তেমনি হলো। তিনি কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ বলল “রুমটা ১৮০ স্কয়ার ফিট। তাই তোমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু একটা সত্য জানো রুবি,আমাদের শেষ স্থান মাত্র সাড়ে তিন হাত।” নড়েচড়ে উঠে রুবি। ক্লাস নাইনে পড়ে সে। এই সময়টায় মানুষ বাস্তবতা থেকে বহু দূরে হারিয়ে যায়। চোখে ভাসে বিলাশবহুল জীবনযাপন। রুবি বোধহয় ভয় পেল। সে আর একটি কথাও বলল না। এরই মাঝে কিছু বই তুলে নিল রুস্মি। বই গুলো দেখিয়ে বলল “ভাইয়া এগুলা কি আমার পড়ার জন্য নিতে পারি?”

“রুস্মি কি হচ্ছেটা কি।” আনিসুল সাহেবের রাশভারী কণ্ঠ! রুস্মি তবু তাকিয়ে রয় জবাবের অপেক্ষায়। সাতটা বই নিয়েছে রুস্মি। আবরাজ বই গুলো থেকে ফিপটি সেড অফ গ্রে বইটি সরিয়ে নিল। তারপর বলল “এগুলা নিতে পারো।”

সবাই গল্পে মজেছে। রেবেকা বেগম বার বার বলল আবরাজ যেন একটি বারের জন্য হলেও আসে ওনাদের বাড়িতে। পুরনো দিনের ক্ষত ভুলে যেন আপন করে নেয় ওনাদের। অন্তত এই অনুরোধটা রাগে যেন।না হলে ভীষণ কষ্ট পাবে ওনারা। আবরাজের মন সায় দিচ্ছিল না। তবে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই বলল’সে যাবে।’

অবশ্য সন্ধ্যাটা মন্দ কাটে নি আবরাজের। এই সময়টা খুব সামান্য হলেও সুখ দিয়েছে। অরির জন্য মন কাঁদে সারাক্ষণ। কোনো ভাবেই স্বস্তি মিলে না। এই সময়টুকু হয়তো খুব দরকার ছিল। একটু বেশিই দরকার। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে হলেও সময় করে চাচার বাড়ি ঘুরতে যাবে আবরাজ।

.

উইকেন্ডের দিনগুলোতে শুয়ে বসে পার করে আবরাজ। কিন্তু আজ হঠাৎ ই বের হতে হচ্ছে হয়। কাছে পিঠেই লেক। আসা যাওয়ার পথে চোখে পরলেও সময় নিয়ে যাওয়া হয়নি কখনো। যেহেতু নতুন বই গুলো রুস্মি নিয়েছে সেহেতু বই পড়ার মতো সুযোগ ও নেই। আর না আছে ইচ্ছা। হাল্কা হাল্কা শীত পড়েছে। ধোঁয়া উঠা বিকেলে লেকের পারে নেমেছে কপোত কপোতির দল। কেউ কেউ হাত ধরে ডুবে আছে প্রেমনেশায়। কখনো কখনো সেসব দেখতে ভালোই লাগে। মনে হয় এই তো জীবন। পরিবার পরিজনের বাহিরেও হয়তো একটা নিজের মানুষের খুব দরকার। অন্তত এই বয়স তেমনি বলে। আবার কখনো বা বুজে আসে চোখ। বিষাদের তরী এসে নিয়ে যায় ওকে। মনে হয় এই দুনিয়ার মিছে সব। না হলে রাই কেন ফাঁকি দিবে ওকে? তবে কি সত্যিই সামান্য টাকার কাছে হেরে যায় ভালোবাসা! নাকি এসব কেবল ভালোলাগার মোহটাকে আবডাল করার প্রয়াস। আবরাজের বয়স খুব বেশি নয়। সেই হিসেবে জীবনকে অনেক ভাবে উপলব্দি করা হয়ে গেছে। চোখের সামনে দিয়ে নেমে গিয়েছে কতো সব ভালোবাসার স্রোত। আবার কত বিচ্ছেদ বেদনার সঙ্গী সে।

একটু দূরেই ভীড় জমেছে। আগ্রহ জাগে। দু পা এগিয়ে যায় ছেলেটা। শুটিং চলছে। কোনো নতুন প্রডিউসারের সিনেমার। সেই জন্য প্রচারণাও বেশি। আবরাজ দেখে বেশ স্বাস্থ্যবান এক লোক চেচাচ্ছেন। বার বার নির্দেশনা দিচ্ছেন। ভুল হলেই বেশ রাগ দেখাচ্ছেন। আবরাজ বুঝতে পারে লোকটা রগচটা। চারপাশে থাকা মানুষ হেসে চলেছে অবিরত। সরে এসে একটা বেঞ্চেতে বসে। পাতা ঝরেছে কিছু। পায়ের নিচে সারি সারি। একটা পাতা তুলে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পরে ছেলেটা। খানিক বাদেই চোখে পরে রাই আর রকিকে। বেশ ঘনিষ্ঠভাবে। বিষয়টা চোখে পরাতে আবরাজের রাগ হলো। হাজার হোক, মেয়েটার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল ওর। খারাপ লাগা স্বাভাবিক। ছেলেটা উঠে যেতেই একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলে’ভাইয়া ভাইয়া দশ টাকা দিবা? একশ টাকা জমিয়ে ভাইরে নিয়া বিরিয়ানি খাবো।’ চমকে তাকালো আবরাজ। একবার দেখে নিয়ে ফের পিছে তাকালো। রাই আর রকি একে অপরে হাত ধরে। ফুচকার স্টলের সামনে নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলে। ছেলেটার গলা শুকিয়ে এসেছে। আর তারপর ই নিজেকে সামলে ফেলে। ফেলে আসা অতীতের দিকে তাকানো মানে এক পা পিছিয়ে আসা। যা গেছে তা নিয়ে ভেবে ভবিষ্যৎ কিংবা বর্তমানকে বিষণ্ণ করার মানেই হয় না। সকল কষ্টকে লুকিয়ে ইষৎ হেসে বলে ‘কি?’

“দশ টাকা দিবা? একশ টাকা জমিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে বিরিয়ানি খাবো। ছোট ভাই বিরিয়ানি খাইতে চাইছে। দিবা দশ টাকা?”

“বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে?”

“হুম। দিবা দশ টাকা?”

“চলো আমার সাথে আমি তোমাকে বিরিয়ানি কিনে নেই।”

“বিরিয়ানি কিনে দিবা ভাইয়া?” ছেলেটার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। আবরাজ বলে”হুম দিবো আসো আমার সাথে।”

পাশেই স্টল। বাচ্চা ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে দশ কি এগারো হবে। চলতে চলতে বাচ্চাটি বলে ‘দুইটা বিরিয়ানি কিনা দিবা?’

“দুইটা? আচ্ছা ঠিক আছে।”

ফের চলতে থাকে ওরা। ছেলেটার পায়ের গতি বেশ। মনে হচ্ছে চাঁদ পেয়েছে হাতে।মনের ভেতর ভালো লাগা কাজ করে আবরাজের। অন্যকে সহযোগিতা করার অভ্যাসটা বাবার থেকে পাওয়া। ভদ্রলোক মানুষ হিসেবে খুব ই ভালো ছিলেন। আর তাই হয়তো জীবনের অর্ধেক সময়েই চলে যেতে হলো। শ্বাস ফেলে আবরাজ। মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করে “বাসায় কে কে আছে তোমার?”

“মা আমি আর ছোট ভাই। বাবা গাড়ির নিচে চাপা পরে মা*রা গেছে।”

থেমে যায় আবরাজ। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। আবরাজ তিন প্যাকেট বিরিয়ানি পার্সেল করে দিতে বলে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা। পার্সেল হাতে দিতেই বলে “একটা কোক।”

কোক দেয় আবরাজ। ছেলেটা চলে যায়। বিল মিটিয়ে একবার পেছন ঘুরতেই আবরাজের চোখে পরে ছেলেটার ছোট ছোট পায়ের পথচলা। মানুষের জীবন কতো বিচিত্র!

চলবে।