হিয়ার টানে পর্ব-১১

0
259

#হিয়ার_টানে
#১১ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

আমাকে আর আবির ভাইয়াকে রেখে এক এক করে সবাই চলে গেলো৷ হিমা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো ভীত মুখে। চাচি ওকে টেনে নিয়ে গেলো আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“তুই একদম হিমার কাছে ঘেঁষবি না! তোকে নিজের মেয়ের মতো ভাবতাম! আর তুই আমার ছেলের জীবনটাই নষ্ট করে দিলি? আজ শুধুমাত্র তোর জন্য আমার আবির আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করছে! আমি কোনোদিনও তোকে ক্ষমা করবো না!”

কথাগুলো বলেই চাচি ওখান থেকে চলে গেলো৷ আবির ভাইয়া চুপচাপ বসে আছে৷ আমার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কেন জানি কান্না করতে পারছি না! একবার আবির ভাইয়ার মুখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটায় আরো হাহাকার করে উঠলো। আমার জন্য আবির ভাইয়াকেও এতো কথা শুনতে হচ্ছে! আমি যেন এসব আর দেখতে পারছি না৷ খুব ইচ্ছে হচ্ছে এইখান থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে! যেখানে এই পরিচিত মুখগুলোর অচেনা রূপ থাকবে না!

সবাই বের হয়ে যেতেই আমি ছুটে আমাদের ঘরের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম আর শুকনো কণ্ঠে মা-বাবাকে ডাকতে লাগলাম। আমাকে ওভাবে ছুটতে দেখে আবির ভাইয়াও আমার পিছু আসলো৷ আমি দরজা ধাক্কাচ্ছিলাম তখন বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে জোরেশোরে বলতে লাগলো,

–“ওই মেয়েকে আমার ঘরের সামনে থেকে চলে যেতে বলো। আমার ঘরের দরজা আজ থেকে ওর জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ! যে মেয়ের জন্য এত অপমান হতে হয় সেই মেয়ে আমার লাগবে না! কাল থেকে যেন ও আমার চোখের সামনে না আসে! যেখানে খুশি যাক! আর এখনতো ওর স্বামী আছে! সে এখন কোথায়! নিজের বউয়ের খেয়াল রাখছে না কেন?”

কথাগুলো শুনেই আবির ভাইয়া রেগে গিয়ে আমাকে টানতে-টানতে তার ঘরে নিয়ে গেলো৷ আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম,

–“সবাই আমাকে এত ঘৃণা কেন করছে? আমি মারা গেলেই ভালো হতো। তাইনা ভাইয়া!”

আমি একথা বলার সাথে-সাথেই আবির ভাইয়া উনার হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলেন। তারপর একটা ধমক দিয়ে বললেন,

–“আর একবার ওইসব আজেবাজে কথা মুখে আনবি না! তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি করবো! আর ভাইয়া কি? হ্যাঁ! এখন থেকে আর কখনো যেন ভাইয়া না শুনি! তোর জন্য আমি নিজের মানুষগুলোর সাথে এভাবে লড়ছি! আর তুই এসব কথা বলছিস!জানিনা এদের কবে বুঝাতে পারবো! ”

এমন সময় দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছিলো। আবির আমাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে দরজা খুলতেই মেজো কাকা বললেন,

–“আজকের রাতটা থাকতে দিলাম! কাল সকালে যেন আমি ওই মেয়েকে আমার বাড়িতে না দেখি! আশা করি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছিস!”

–“চাচ্চু….!”

আমি এটুকু বলতেই কাকা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–“আমি এখানে আমার ছেলের সাথে কথা বলছি। ”

আবির একটু শান্ত হয়ে বলল,

–“বাবা ওকে নিয়ে আমি এখন কোথায় যাবো? তুমি এভাবে আমাদের বের করে দিলে আমাদের রাস্তায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। প্লিজ বাবা!”

–“আমিতো তোকে কোথাও যেতে বলিনি! কিন্তু ওই মেয়েটার জন্য এই বাড়িতে কোনো জায়গা নেই। ওকে ওর বাড়িতে ফিরিয়ে দিবি। কীভাবে দিবি সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না!”

–“বাবা আমি ওকে বিয়ে করে নিয়েছি! ও এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে! ”

আবিরের এই কথাটা শুনে কাকা ভীষণ রেগে গেলেন। তারপর নিজের রাগটাকে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে বললেন,

–“তাহলে আমার আর কিছু করার নেই! তোর মতো অবাধ্য ছেলের আমার দরকার নেই!…. আরেকটা কথা শুনে রাখ, এখন থেকে আমি আর তোর পড়ার খরচ দিতে পারবো না! যে মানুষ বউ চালাতে পারে সে পড়ার খরচটাও যোগাতে পারবে!”

বলেই দরজাটা খট করে ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে গেলো কাকা। আবির বিষন্নমুখে আমার পাশে বসে পড়লো।

আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না। আজ সারাদিন আমার কীভাবে কেটেছে তা ভুলেই গিয়েছিলাম! তা মনে পড়তেই মাথাটা ঝিম-ঝিম করতে লাগলো। আমি আবিরের বিছানায় শুয়ে কপালে হাত দিলাম। দেখি শরীরের উত্তাপে আমার হাত পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! আমি আবিরকে কিছু বললাম না৷ এমনিতেই বাড়িতে রাবণের চিতা জ্বলছে! তার উপর আমার এই জ্বর!

কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা। চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম যে, আবির আমার কপালে কাপড় ভিজিয়ে দিয়ে রেখেছে৷ আর আমার পাশেই বিছানার উপরে বসে আছে। আমি চোখ খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে বলল,

–“এখন কেমন লাগছে? ঘুম হয়েছে কি একটু? কিছু খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নে।”

আমি মাথাটা তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আবির নিজে আমার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলো৷ তারপর খাবারের প্লেটটা আমার সামনে এনে নিজহাতে মাখিয়ে বলল,

–“দেখি এইবার হাঁ কর। ”

–“ভাইয়া! সরি, মানে আমি বলছিলাম যে, আপনি আমার মাকে একটু ডেকে দিন! আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আর আমি হাত দিয়ে খেতে পারবো! আর এতরাতে আপনি খাবার আর ওষুধ কোথায় পেলেন?”

–“হিমা দিয়েছে৷ আর দেখ হিয়া, এখন তুই অসুস্থ। একদম বেশি কথা বলবি না! তোর মা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে৷ চুপচাপ খেয়ে ওষুধটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়!”

আমি আরকিছু না বলে বাধ্যমেয়ের মতো খাবারটা খেতে লাগলাম। তারপর আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

–“আপনি কি কিছু খেয়েছেন?”

–“আমাকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। আমার অভ্যেস আছে! ”

–“আপনিও খান আমার সাথে! আপনি না খেলে আমিও আর খাবো না।”

–“হিয়া জিদ না করে খেয়ে নে৷ অনেক রাত এখন, বেশি কথা বলিস না!”

অবশেষে আমার জিদের কাছে আবির হেরে গেলো৷ আর ও নিজেও আমার সাথে খেয়ে নিলো। তারপর আমি ওষুধ খেয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।

সকালের আলো ফূটেছে মাত্র। আমার শরীরটা এখন অনেকটা সুস্থ। আমি বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে দেখি যে, আবির ঘুমাচ্ছে। আমি উনার মায়াবী মুখটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এমন সময় দরজায় ধাক্কার আওয়াজে আমার চমক ভাঙে। আমি দরজা খুলতেই হিমা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করেই আশেপাশে দেখে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

–“এত সকালে তুই? কি হয়েছে? এমন হাঁপাচ্ছিস কেন?”

হিমা আমার গালে আর কপালে হাত দিয়ে দেখে বলল,

–“তোর জ্বরতো এখন নেই! শোন তোকে যা বলতে এসেছি! তুই কি সত্যিই আবির ভাইয়াকে ভালবাসিস? না মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে….”

আমি হিমাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

–“আমাদের দেখে তোর কি মনে হয়? আমরা সবাইকে কষ্ট দিচ্ছি নাটক করার জন্য? তোর একটা চিঠি পুরো পরিবারকে ভেঙে দিচ্ছে! আর তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস আমি তোর ভাইকে ভালবাসি কিনা? তোকে বাঁচাতে আমরা চুপ করে আছি৷ আর তুই কিনা….”

–“সরি হিয়া পাখি! আমাকে মাফ করে দে! আমি বুঝতে পারিনি যে, এই বিষয়টা এতদূর গড়াবে! তুই আমাকে হেল্প করছিস আর আমি তোকে হেল্প করবো না!”

–“তুই কি বলতে চাচ্ছিস?”

–“তুই আবির ভাইয়াকে সত্যি ভালবেসে থাকলে এখনি এখান থেকে চলে যা!”

–“হিমা এসব তুই কি বলছিস? আমরা পালাবো কেন? এখনতো সবাই ব্যাপারটা জেনেই গেছে! আজ-হোক আর কাল-হোক সবাই মেনে নিবেই! আমরা তাদের সন্তান!”

–“বড় কাকা এসেছে। কি বলেছে শুনলে তুইও পালাতে চাইবি!”

আমাদের কথা শুনে আবির উঠে পড়েছে। বিছানা থেকে উঠে রুমে হিমাকে দেখে বলল,

–“কিরে হিমু! এত সকালে তুই? কিছু হয়েছে?”

আবিরের কথা শুনে হিমা বলল,

–“ভাইয়া তুমি তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হও। ”

–“রেডি হবো মানে? কি বলছিস তুই এসব? ”

–“হিয়াকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি থেকে চলে যাও। ”

আবির রেগে গিয়ে বলল,

–“হিমু তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নাকি? আর সবার মতো তুইও আমাদের তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস!”

–“বড়কাকা এসেছে। বাবা আর কাকারা সবাই কথা বলছে ওই ঘরে৷ আমি মাত্র শুনে আসলাম।”

আমি আর আবির একসাথে বলে উঠলাম,

–“কি বলছে সবাই?”

চলবে…