হিয়ার টানে পর্ব-১২

0
289

#হিয়ার_টানে
#১২ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

হিমা বিছানার উপরে বসে বলল,

–“বড় কাকারা সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এখনকার মতো তোদের মেনে নেবে। কিন্তু কাউকে কিছু জানাবে না। তারপর আবির ভাইয়া চলে যাওয়ার পর তোদের ডিভোর্স পেপার রেডি করবে৷ আর সেখানে যেভাবেই হোক একবার তোদের সাইন পড়লেই সব শেষ! হিয়া! তোকে আবার বিয়ে দিয়ে দিবে। আর বিয়েটা তখনি দেবে যখন আবির ভাইয়া শহরে থাকবে। আবির ভাইয়া যেন তা জানতে না পারে তার জন্য! আর একবার বিয়েটা হয়ে গেলেই খেল খতম! আর বাবা আর মেজো কাকা বড় কাকার এই আইডিয়ার সাথে একমত হয়েছে। আমি সাধারণত এত সকালে উঠিনা। কিন্তু সবার চেঁচামেচি শুনে উঠেই এসব শুনতে পাই। ওরা এখনো সবকিছু প্ল্যান করছে। কীভাবে কি করবে! আমি তোদের কাছে ছুটে এলাম এসব জানানোর জন্য! ”

আমি আর আবির হাঁ হয়ে গেছি হিমার কথা শুনে৷ আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। আবির রেগে গিয়ে বলল,

–“মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি! আমরা কি ছোট বাচ্চা নাকি যে, উল্টাপাল্টা বোঝাবে আর তাই বুঝবো! আমি কিছুতেই এসব হতে দেবো না! আর আমাদের ডিভোর্স পেপার কি করে পাবে! আমাদেরতো…”

এটুকু বলেই থেমে যায় আবির। হিমা অবাক হয়ে বলে,

–“ভাইয়া? আসলেও কি তোমরা বিয়ে করেছো? নাকি সব…. ”

–“তুই চুপ করবি! এত বেশি কথা কেন বলিস! বিয়ে না করলে এতবড় মিথ্যে কথা বলার সাহস আছে আমাদের! আমরা বিয়ে করেছি তবে….”

আবিরের কথা শুনে হিমা বলে উঠে,

–“তবে কি?”

আবির কিছু বলতে যাচ্ছিলো। আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

–“আসলে আমাদের কাগজ এখনো হাতেই পাইনি! তাইনা?”

বলেই প্রশ্নাতুর চোখে আবিরের দিকে তাকালাম। আবির আমার সাথে একমত হয়ে উত্তর দিলো,

–“হ্যাঁ, আর আমরা কিছুতেই বড় কাকার ফাঁদে পা দেবো না। তার আগে বল, তুই কি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর?”

–“হান্ড্রেড পার্সেন্ট মানে! হাজার পার্সেন্ট সিওর! আর কিছুক্ষণ থাকলেই ওরা চলে আসবে। আর ওদের হাতে পড়লে পালানোর রাস্তা খুঁজে পাবেনা! তখন না পারবে বাড়ি থেকে বের হতে! আর না পারবে উনাদের মুখের উপর কথা বলতে। বাবাতো সকালে চলে যেতেই বলেছিল! তাই এখন যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত! বাড়িতে থাকলেই ঝামেলায় পড়তে হবে! পরে সব ঠিকঠাক হলে বাড়ি চলে এসো ভাইয়া! এখন তুমি হিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পরো। কি যাবে?”

আবির কিছু একটা চিন্তা করে বলল,

–“আচ্ছা ঠিক আছে৷ আমরা এখনকার মতো চলে যাচ্ছি। তুই আমাদের আপডেট জানাস!”

আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবির আমাকে বলল,

–“কিরে তুই কথা বলছিস না কেন? যাবি না আমার সাথে? নাকি তুই….”

আমি কিছু না ভেবেই উত্তর দিলাম,

–“অবশ্যই! আমি এখানে থাকলেইতো আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে! আমি একাই আপনার কাছে চলে গিয়েছিলাম! আর এখনতো আপনার সাথেই যাবো! এখন আর ভয় কি!”

–“ভয় হচ্ছে না?”

–“কিসের ভয়?”

–“আমি কোথায় নিয়ে যাবো? কীভাবে রাখবো? কী খাওয়াবো? এসব ভেবে চিন্তা হচ্ছে না?”

–“আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানেই যাবো! আপনি যেখানে থাকবেন আমিও সেখানেই থাকবো! আর আপনি যা খাবেন আমিও তাই খাবো!”

–“কষ্ট হলে সহ্য করতে পারবি?”

–“আপন মানুষদের থেকে এত কষ্ট যে মেয়ে হজম করতে পারে সে অন্য যেকোনো কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতে পারবে! আপনি শুধু আমাকে এখান থেকে দূরে নিয়ে চলুন! আমি আর এদের এমন ঘৃণার চাহনি সহ্য করতে পারছি না!”

হিমা দরজা খুলে এদিক-সেদিক দেখে আবিরক্ব উদ্দেশ্য করে বলল,

–“আমি হিয়ার ঘরে যাচ্ছি। ওর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসছি! সবাই এখন বসার ঘরেই আছে! তোমরা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও! বেশি দেরি করা যাবে না!”

আবির ফ্রেস হয়ে আসতে-আসতে হিমাও একটা ছোট-খাটো ব্যাগ নিয়ে হাজির হলো৷ ওই ব্যাগে কি আছে আমি নিজেও জানিনা! ব্যাগের সাথে-সাথে হিমা কিছু টাকাও তুলে দিলো আবিরের হাতে। আর বলল,

–“কিছু আমার জমানো টাকা! কিছু মায়ের জমানো টাকা! আরকিছু বাবার টাকা থেকে নিয়েছি! কত আছে জানিনা! তবে ১৫-২০হাজার হবে হয়তো!”

আবির হিমাকে একটা ধমক দিয়ে বলল,

–“তুই সবার টাকা চুরি করেছিস কেন?”

–“এসব নিয়ে এখন তোমার ভাবতে হবে না! মা-বাবা যা বলে সেটা পরে দেখা যাবে! তারা এমনিতেই বুঝবে যে, টাকাগুলো তুমি নিয়ে গেছো! আমার কিছু হবে না! আর তুমি না থাকলে গালাগালি কাকে করবে! তোমরা তাড়াতাড়ি বের হও! আর হিয়ার খেয়াল রেখো! ও বাইরে কখনো থাকেনি!”

–“সেটা তোকে বলে দিতে হবে না! তুই নিজের খেয়াল রাখিস! আর এমন কোনো ভুল করিস না যা পুরো পরিবারের জন্য অভিশাপ বয়ে আনে! ”

আমরা বের হবো আর তখনি দেখি যে আমার মা আমার দিকেই আসছে। তারপর কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল,

–“হিয়া! সবাই তোদের মেনে নিয়েছে! আবিরের পড়াশোনা শেষ হলেই তোদের ধুমধামে বিয়ে দিয়ে দিবে! ”

মায়ের আসা দেখে আবির ব্যাগটা খাটের তলায় লুকিয়ে ফেললো! হিমাও দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম৷ তারপর বললাম,

–“সবাই কোথায় মা? আমি জানতাম সবাই আমাদের ক্ষমা করে দেবে!”

–“সবাই বসার ঘরে তোদের নিয়েই আলোচনা করছে। আমি তোকে জানাতে আসলাম কথাটা! চল মা, ঘরে চল!”

–“মা তুমি আমার জন্য এক কাপ চা বানাওতো। যাও! আমি আসছি একটু পরে!”

মা খুশিমনে ওখান থেকে চলে যেতেই আমি আর আবির পা টিপে-টিপে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। হিমা বারবার দেখছিলো যে কেউ আসছিলো কিনা! অবশেষে আমরা সফলভাবে রাস্তায় পৌঁছে গেলাম।

রাস্তায় কোনো রিকশা ছিলো না। আমরা হেঁটেই কিছুদূর এগোলাম।তারপর আবির কেউ একজনকে ফোন করে আসতে বলল। কিছুক্ষণ পর একটা রিকসাওয়ালা আসতেই বুঝতে পারলাম যে, আবির এই রিকশাওয়ালাকেই আসতে বলেছিলো! আবির তাড়াতাড়ি রিকশা চালাতে বলল। কেউ এসে পড়লে সব পন্ড হয়ে যাবে!

বাসে উঠার আগে আবির হালকা কিছু নাস্তা আর পানীয় কিনে নিলো দোকান থেকে। তারপর বাসে উঠেই আমরা নাস্তা করে নিলাম। আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কিন্তু আবিরকে দেখলাম গোগ্রাসে গিলছে! হয়তো অনেক ক্ষুধা লেগেছে!

আমরা দুজনেই চুপচাপ বসে আছি। আমি নিরবতা ভঙ্গ করে বললাম,

–“আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”

–“সর্ব প্রথম কোনো কাজী অফিসে যেতে হবে।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,

–“কিন্তু আমরাতো অলরেডি বিয়ে করে নিয়েছি। তাহলে আবার কাজী অফিসে কেন? এইভাবে বিয়ে করে কি আমরা স্বামী-স্ত্রী হইনি? আবার বিয়ে করতে হবে?”

–“আরে গাধী কাগজ-কলমে আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি না থাকলে কেউ কি বিশ্বাস করবে যে আমরা বিবাহিত? তার জন্য।”

আমি বোকার মতো বললাম,

–“ওহ আচ্ছা! ”

–“এখন কেমন লাগছে? খারাপ লাগছে খুব?”

–“না। ভালই লাগছে৷… আপনি পাশে থাকলে খারাপ লাগা আমার ধারে-কাছেও ঘেষঁতে পারে না!”

শেষের কথাগুলো বিড়বিড় করে বলায় হয়তো আবির শুনতে পায়নি। তাই আবার বলল,

–“ওমন বিড়বিড় করছিস কেন? যা বলার জোরে বল। ”

আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে বললাম,

–“না কিছুনা!”

বাড়ি থেকে আবিরকে কল করেই যাচ্ছে! করেই যাচ্ছে! আবির কল রিসিভ করছে না৷ একটু পরেই হিমা কল করলো৷ আবির ফোনটা রিসিভ করতেই চাচির কণ্ঠ ভেসে এলো,

–“আবির? কোথায় তুই বাবা? তোর বাবা-কাকারা সব মেনে নিয়েছে৷ বাড়ি আয় বাবা! তুই আমাদের কিছু না জানিয়ে এভাবে চলে যেতে পারলি? কোথায় তুই বাবা? তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়৷ সবাই তোদের জন্য অপেক্ষা করছে৷ আর কেউ কিছুই বলবে না!”

আবির আমতা-আমতা করে বলল,

–“মা আমরা চলে এসেছি। অনেকদূর এসে পড়েছি! এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়! তুমি সবাইকে বলো যে, কিছুদিন পর আমি হিয়াকে নিয়ে চলে আসবো! ”

–“কিন্তু বাবা তুইতো হোস্টেলে থাকিস! হিয়াকে নিয়ে কোথায় থাকবি? পাগলামি করিস না বাবা। ফিরে আয়!”

আমি পাশে থাকায় আবির আর চাচির সব কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম। চাচি কথাগুলো বলা শেষ করতে না করতে ফোনের ওপাশ থেকে একটা মোটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে, এটা বড় কাকা।

–“আবির? তুই যেখানেই থাকিস না কেন হিয়াকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি চলে আয়। তোর সাহস হয় কি করে বাড়ির মেয়েকে নিয়ে পালানোর?”

আবির শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

–“আমিতো পালাইনি! বাবা আমাকে বের করে দিয়েছেন!”

–“আমি বলছি ফিরে আয়! যা করার বাড়ি থেকেই করা যাবে!”

–“আমাদের আজকেই বিয়ে দিবেন কি বাড়ি গেলে?”

বড় কাকা রেগে উত্তর দিলেন,

–“বেহায়া ছেলের কথা দেখো! আগে নিজের পায়ে দাঁড়া! তারপর বিয়ের কথা বলিস! লজ্জা করছে না আমার সামনে বিয়ের কথা বলতে! ”

–“আপনারা হিয়ার অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চান। তাই না?”

–“এসব তোকে কে বলল? ”

–“সত্যি কিনা তাই বলুন?”

–“তারমানে তুই সবটা জেনেই পালিয়েছিস?”

–“হ্যাঁ, আমি সব শুনে ফেলেছি! আমাকে আর বোকা বানাতে পারবেন না!”

বড় কাকা আরো রেগে যায়। তারপর বলে,

–“আমি তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি আবির! হিয়াকে নিয়ে ফিরে আয়! এর ফল কিন্তু ভালো হবে না! ”

–“সরি কাকা! আমি আপনার এই অনুরোধটা রাখতে পারলাম না!”

–“আজকের মধ্যে বাড়ি না ফিরলে এই বাড়ির দরজা তোদের দুজনের জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে! এই আমি বলে রাখলাম!”

বলেই রাগে ফুসতে-ফুসতে বড় কাকা কল কেটে দেয়। তারমানে হিমার কথাই ঠিক ছিলো! আবিরের মুখটা চিন্তাভাবনায় ডুবে আছে! আমার নিজের চোখেই পানি চলে আসে আবিরকে দেখে!

জানিনা আবির আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে! আর আমরা কীভাবেই বা থাকবো! এই অচেনা শহরে আমি আদৌ থাকতে পারবো কিনা জানিনা! শেষ পর্যন্ত আমার ভাগ্যে এই ছিলো! সাথে আবিরের জীববটাকেও আমি কোন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছি জানিনা!

চলবে…?