হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব-৯+১০

0
263

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৯
#রাউফুন

সকল প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনার পর তারা তিন জন মিলে সব কিছু গুছিয়ে ফেলার কাজে লেগে গেলো। ফ্রীজ, দুটো খাট, একটা কাউচ, ডাইনিং টেবিল, গ্যাসের চুলা। বাজারের মধ্যে, মাছ, মাংস, সকল সবজি, রান্না ঘরে রাখার জন্য রান্নার সকল প্রয়োজনীয় গুডস কেনা হয়েছে। তুলিকা আর মিষ্টির জন্য বেশ অনেক গুলো জামা কেনাকাটা হয়েছে। যদি-ও তুলিকা জামা কেনার সময় বার বার বারণ করেছিলো মাইজিনকে এতো সব ড্রেস তার লাগবে না। দুটো হলেই হবে। কিন্তু মাইজিন তার কথা শুনেই নি।

তারা এক সাথে দুটো খাট, ঘর সাজালো! তুলিকা মাছ মাংস সব কে’টে ফ্রীজে তুলে রাখলো। দুপুরের খাবার তারা বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছে। মাইজিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে তুলিকাকে পরখ করছিলো। মেয়েটা এতো কিছুর পরেও ক্লান্ত হয়নি। মাইজিন তাকে দেখে মুচকি হাসে! এরকম একজন মানুষ তার জীবনে আসবে সে কখনোই ভাবেনি। এমন শান্ত শিষ্ট মেয়ে সে তার কল্পনায় রাখতো। সব কাজ শেষ হলে তুলিকা গোসল করে নতুন একটা থ্রি পিস পরলো৷ মিষ্টিও গোসল করে কালো খয়েরি রঙের একটা জামা পরে নিলো। মিষ্টিকে একদম মিষ্টি পরী লাগছে এতে। তুলিকা বোনকে আদর করে রাতের রান্না চাপালো। মিষ্টিও বোনের কাজে সাহায্য করলো৷

রাতের খাবার খাওয়ার পর মাইজিন তুলিকার রান্নার ভীষণ প্রসংশা করলো। মিষ্টি ঘুমানোর পর মাইজিন তুলিকাকে ডাকলো৷ ডেকে তার হাতে একটা ফোন দিলো প্রথমে। ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যায় তুলিকা।

‘ফোন দিয়ে আমি কি করবো?’

‘কি করবেন মানে? আমি অফিস গেলে আমাকে কল করবেন। আর একটা ফোন যে কতটা প্রয়োজনীয় সেটা জানেন না?’

সত্যিই একটা ফোনের প্রয়োজন আছে। কাল যখন মাইজিন আসতে লেট করছিলো তখন তো তার বেশ চিন্তা হচ্ছিলো। ফোন থাকলে কল করে জেনে নেওয়া যাবে এরপর তার অবস্থান। তুলিকা হেসে ফেলে আনমনে।সে প্রস্থান করতে চাইলে মাইজিন আর একটা পিংক কালারের শাড়ী দিয়ে মুচকি হেসে বলে,

‘এটা আপনার জন্য। আপনি যেদিন আমাকে মেনে নিয়ে আমাকে কাছে চাইবেন সেদিন এই শাড়ীটা পরে আমার সামনে আসবেন। সেদিন আমি বুঝে যাবো আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আমাকে গ্রহণ করতে চান সম্পুর্ন রুপে!’

তুলিকা লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘আমি যদি কখনো রাগ করি সে রাগ ভাঙাবেন কীভাবে? আমি তো আপনার ধরা ছোঁয়ার বাইরে!’

তুলিকা জানে না এই প্রশ্ন টা সে কেন করলো। নিতান্তই অবান্তর আর ফালতু একটা প্রশ্ন ছিলো এটা। কিন্তু এমনিতেই মাথায় এসেছে তাই করলো প্রশ্নটা।

‘আপনাকে না ছুঁয়ে, আপনার কাছে না গিয়েও ঠিক আপনার রা’গ, অভিমান ভা’ঙি’য়ে নেবো। সে ক্ষমতা মাইজিন সুলতান রাখে! আপনার মনের অব্যাক্ত কথা বুঝে নেবো আপনার চোখের দিকে তাকিয়েই!’

‘হাউ ইউ অবজার্ভ মাই আইস?’

‘কেন অবজারভ করা নিষেধ?’

‘নাহ তা নয়!যদি আপনার সামনে না থাকি আমি তখন? মানে ধরুন আমি সামনে নেই আপনার। তখন কিভাবে অবজার্ভ করবেন যদি আমি ডিসপ্লে এর ওপাশে অবস্থান করি?

‘ইভেন্ট!’

‘ইভেন্ট?’

‘হুম চোখ বন্ধ করে কল্পনা করবো না হয়! আপনাকে শুধুই অনুভব করে, কল্পনায় আপনার অভিমান ভা’ঙা’বো।’

মাইজিনের এমন মিষ্ট ভাষায় লজ্জা পেয়ে যায় তুলিকা। মিষ্টি ঘুমিয়ে গেছে আজ। যদি মিষ্টি জেগে থাকা অবস্থায় মাইজিন তাকে ডাকতো তবে ভীষণ লজ্জায় পরতো মেয়েটা।ছোট বোন যদি কিছু ভেবে বসে তখন লজ্জা পাবে না তুলিকা?তাই মাইজিন মিষ্টি ঘুমানোর পরই তুলিকাকে ডাকে৷

‘চলুন বারান্দায় গিয়ে বসি। কিছুক্ষন গল্প করা যাক।’

‘চলুন।’ তারা দুজন টুলসের উপর বসে! আকাশের পানে তাকায় দুজনেই। তুলিকা বলে,

‘আপনার আর আমার তো হুট করেই এভাবে বিয়েটা হয়ে গেলো। আপনার সম্পর্কে তো তেমন কিছু জানি না আর আপনিও আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না।’

‘আমার বাবার নাম আব্দুর রৌফ সুলতান! মায়ের নাম আসমা সিদ্দিকা! আমি মাইজিন সুলতান! এম এস কোম্পানির মালিক। বয়স সাতাশ। বাবা দেশের বাইরেই বেশি সময় থাকেন। গাজীপুরে আমাদের নিজেদের ছয়তলা বাড়ি আছে! এখান থেকে যেতে দুই ঘন্টা লাগবে। পুরো সম্পত্তি বাবা আমার নামে করে দিয়েছেন কারণ আমি তার এক মাত্র সন্তান। আবার ভাববেন না আমি নিজেকে আপনার সামনে অনেক বড় কেউ-ই প্রুফ করতে চাইছি বা নিজেকে নিয়ে অহংকার করছি। আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম। তাছাড়া আপনার সত্যিই আমার ব্যাপারে জানার ছিলো।’

‘আপনার কোনো বদ অভ্যাস নেই? এই যেমন ধরুন সিগারেট, ড্রিংকস! মানে হয় না বড়লোকের ছেলেরা তো ক্লাব, পার্টি, ডিস্কে যায়।’

‘আমি শুধু মাঝে মধ্যে সিগারেট খায়। সেটাও লোক চক্ষু সামনে না। আমার ইচ্ছে ছিলো বউয়ের সামনে ছাড়া কারোর সামনে সিগারেট খাবো না। আর বাড়ির কেউ-ই জানেও না আমার সিগারেট খাওয়ার বিষয়টা!’

তুলিকা মাথা দুলিয়ে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে। সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই বেশ গুছিয়ে দেয় মাইজিন

মাইজিন তুলিকাকে প্রশ্ন করে, ‘আপনার ইন ফিউচার হাসবেন্ডকে নিয়ে কি রকম ফ্যান্টাসি কাজ করতো?’

‘হাসবেন্ড নিয়ে আবার ফ্যান্টাসি হয় নাকি?’

‘কেন হয় না। প্রতিটি মেয়ের বিয়ের আগে তার হাসবেন্ড নিয়ে আলাদা একটা ফ্যান্টাসি থাকে।’

‘আমার তেমন কিছু কখনোই মাথায় আসেনি। আমার মাথায় শুধুই মিষ্টির সুন্দর একটা ফিউচার নিয়ে ভাবনা চিন্তা থাকতো!’

‘আপনি কখনোই প্রে’মে পরেন নি?’

‘উঁহু! আপনি পরেছিলেন?’

‘উম আমি জীবনে অনেক গুলো প্রেম করেছি মিথ্যা বলবো না। আপনাকে আমি ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেও ঠকাতে চাই না৷ আর মিথ্যা আমি যেমন বলি না তেমন সহ্যও করি না। আমি কিন্তু সত্যি কারের প্রেমে কখনোই পরিনি।’

তুলিকা রেলিঙের উপর হাত ভর দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে, ‘আপনি তো দেখছি গভীর জলের মাছ। আচ্ছা আপনি কি তবে আমার প্রে’মে পরেন নি?’

‘এটাও মিথ্যা বলবো না। প্রথম দেখায় কখনো ভালবাসা হয় না। যা হয় তা হলো ভালো লাগা!
আর সেই ভালো লাগা নিয়ে ভাবতে থাকলে সৃষ্টি হয় ভালবাসার। আমি তো এক মুহুর্তের জন্যও আপনার ভাবনা আমার ব্রেইন থেকে বের করতে পারিনি!’

তুলিকার একটু মন খারাপ হয়ে যায় মাইজিনের কথায়। তবে কি বিয়েটা করে কখনো মাইজিন পস্তাবে?

‘কি ভাবছেন? আমি আপনাকে বিয়ে করে কখনো পস্তাবো কি না? কখনোই পস্তাবো না। এটা মাথায় রাখবেন সব সময়!’

মাইজিন হেসে একটি সিগারেট বের করে নিজের ঠোঁটে চেপে ধরলো। তার ওই সুন্দর ঠোঁটে এই বিষাক্ত জিনিসটা খুবই বেমানান লাগলো। তুলিকা সেটা কে’ড়ে নিয়ে বললো,

‘আপনি আমার সামনে সিগারেট খাচ্ছেন?’

‘আপনি তো আমার নিজের মানুষ খেলে কি হবে? আর বললামই তো বউয়ের সামনে খাবো!’

‘আমি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।’ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো তুলিকা। মাইজিন কিছু বলবে তখনই তার ফোন টা বিকট শব্দ বেজে উঠলো! তুলিকা বললো,

‘আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে মাইজিন। আপনি কথা বলুন আমি আসছি!’

মাইজিন বুঝতে পারলো তুলিকা তাকে স্পেস দিতে চাইছে তাই ঘুমানোর কথা বলছে। তুলিকা চলে গেলে মাইজিন ফোন রিসিভ করে।

‘মাইজিন এসব কি করছো? দুই দিন থেকে বাসায় আসছো না! আজ একাউন্ট চেইক করে দেখলাম দুই লাখ টাকা সেখান থেকে খরচ হয়েছে। তুমি ছাড়া তো কেউ-ই টাকা উঠাবে না?’

মাইজিন সুক্ষ্মভাবে উত্তর দেয়, ‘আমার টাকা খরচ করার রাইট নিশ্চয়ই আমার আছে? আপনাকে বলে কয়ে খরচ করতে হবে এখন?’

‘শাট আপ মাইজিন।এভাবে কথা বলছো আমার সঙ্গে? তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করছো রীতিমতো!’

‘তর্ক করছি না।শুধু আমার কাজে হস্তক্ষেপ কর‍তে বারণ করছি আপনাকে।’

‘তোমার বাবা আসুক দেশে।তোমার বেয়াদবির কথা এবার আমাকে বলতেই হবে!’

‘এই জীবনে আপনার সঙ্গে কবে বেয়াদবি করেছি বলতে পারবেন? আমি তো এই পর্যন্ত কখনোই বিনা কারণে একটা টাকাও খরচা করিনি। তবে আজ যখন করেছি আপনাকে সেটা নিয়ে কেন কৈফিয়ত
দেবো? আপনি যখন হাজার হাজার টাকা আপনার বাবার বাড়ি, আপনার বোনের বাড়ি, বোনের মেয়েকে হাত ভরে টাকা দিচ্ছেন। আমি কি কখনোই এটা জিজ্ঞেস করি যে, আমার টাকা, আমার সম্পত্তির অংশ কেন অন্য বাড়িতে দেওয়া হয়? কেন এতো টাকা অযথা খরচ হচ্ছে? আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করেছি কখনোই? আপনি কি ভেবেছেন আমি আপনার গতিবিধি সম্বন্ধে ধারণা রাখি না?’

রাগ গজগজ করতে করতে কল কেটে দিলেন শাপলা। তিনি সব সময় মাইজিনকে হাতে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু আজকে যখন একাউন্ট চেইক করে দেখলেন মাথায় বা’জ ভেঙে পরেছে তার। ছেলেটা তার বিরুদ্ধে গিয়ে বেকে না বসে। শেষে সব সম্পত্তি হাত ছাড়া হবে! খুব শীঘ্রই শারমিনের সঙ্গে মাইজিনকে বিয়ে দিতে হবে। না হলে আরও হাতের বাইরে চলে যাবে।

তুলিকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতেই দু চোখে ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে মাইজিনের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে সামন তালে। সে উঠে বসলো বিচলিত হয়ে! মাইজিন তার মায়ের নাম আসমা সিদ্দিকা কেন বললো? এটা তো তখন সে ভাবে নি? সে যতটুকু জানে মাইজিনের মা মানে তার শাশুড়ীর নাম শাপলা! হ্যাঁ তার স্পষ্ট মনে আছে মাইজিনের মায়ের নাম শাপলা! তবে আসমা সিদ্দিকা কার নাম?নাকি আসমা সিদ্দিকা মাইজিনের মায়ের ভালো নাম।শাপলা নামটা সবাই জানে?

#চলবে

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১০
#রাউফুন

সকালে কিছু পোঁড়ার গন্ধে ঘুম ভাঙে তুলিকার। ঠিক পোঁড়া গন্ধ নয়। কিছু রান্নার গন্ধ মো মো করছে রুম জুড়ে। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। কোনো কিছু রান্না করা হচ্ছে মনে হয়? সে ঝটপট রান্না ঘরে আসে। গিয়ে যা দেখে এতে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে! সে কি স্বপ্ন দেখছে? ভালো ভাবে চোখ কচলে দেখে, না সে ভুল দেখছে না। ঠিক দেখছে। মাইজিন রান্না করছে! বেলা কইটা বাজে? সে কি এতোটাই দেরিতে উঠলো আজ? মাইজিন তুলিকার উপস্থিতি টের পেয়ে কড়াইয়ে তেল দিতে দিতে বলে,

‘ওহ আপনার ঘুম ভেঙে গেছে? মিষ্টিকে ডেকে তুলুন ব্রেকফাস্ট রেডি! আরেকটু কষ্ট করে শুধু অপেক্ষা করুন!’

‘একি করছেন আপনি? আপনি কেন কাজ করছেন? আমি আছি কি জন্য? বেলা কইটা বাজে?’

‘সারে ছয়টা কি সাতটা মতো বাজবে হইতো। নামাজ পড়ে আসার পর আর ঘুম ধরেনি তাই কাজ করতে বসে গেছি। এতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই?’

‘আমাকে ডাকবেন না? এভাবে কেউ মেয়েদের কাজ করে? পেয়াজ মরিচ কে’টেছেন যদি হাত জ্বালা করে! কি যে করেন আপনি!’

‘কাজ, কাজ ই হয় তুলিকা। আপনি এটা নিয়ে ভাববেন না আমার অভ্যাস আছে।’

‘আপনার তো কষ্ট হচ্ছে।’ কাঁন্না করে ফেলে তুলিকা।

মাইজিন পেছনে ঘুরে তাকালো তুলিকার কান্নারত গলায়। রুমাল এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনার চোখের পানি মুছে দিতে গেলে আপনাকে স্পর্শ করা হবে তাই এখন আমি পারলাম না মুছে দিতে। কিন্তু খবরদার আর যেনো কাঁদতে না দেখি। এই সামান্য ব্যাপারে কেউ কাঁদে? রান্না-বান্না করার অভ্যাস আছে আমার। একটুও কষ্ট হচ্ছে না!’

‘মানে আপনি রান্না-বান্না সব পারেন?’

‘ হ্যাঁ, সব রান্নায় তো আমি করি। আমার বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই তেমন না। আমার নিজেরই রান্না করতে ভালো লাগে। আমি বাসায় ভোর ছয়টাই ঘুম থেকে উঠে সকালের রান্না করি। এরপর ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অফিস চলে যায়।সন্ধ্যায় ফিরে রাতের রান্না করি।খেয়ে দেয়ে আবার অফিসের কাজ করি!’

‘আপনি এতো সব কাজ কেন করেন? আপনার মা করেন না এসব কাজ?’

‘মা-হ? হাসালেন! আসুন আসুন খাবার রেডি। মিষ্টিকে ডেকে তুলুন!’

বলেই গ্যাস অফ করে মাইজিন ফ্রেশ হতে যায়।
তুলিকা আবারও ভাবনায় বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাইজিন কি বললো এটা? ওভাবে হাসলো কেন? তার হাসিতে এতো বেদনা কেন দেখতে পেলো সে?হাসিটা জীবন্ত কেন নয়?শুধু নিজের রান্না করতে ভালো লাগে বলেই রান্না করেন বাসায় নাকি অন্য কারণে?

তারা যখন খেতে বসলো তখন খাবার মুখে দিয়ে মিষ্টি অবাক হয়ে যায়। তুলিকা রুটি হাতে নিয়ে নেরেচেরে দেখলো। মাইজিন রেডি হয়ে এসে এক সাথে বসলো। তুলিকা মাইজিনের প্লেটে রুটি দিতে দিতে বললো,

‘এতো গোল গোল আর সুন্দর করে রুটি বেলতে পারেন আপনি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। একটাও রুটি আঁকাবাকা হয়নি।’

‘আপনার স্বামী সব পারে মেডাম। আমি এসব কাজে ভীষণ অভিজ্ঞ বলতে পারেন।’

‘আপনি আমার চেয়েও দারুন করে রুটি বানিয়েছেন। ইভেন অনেক ভালো বেলতে পারেন!’

‘ভাইয়া এতো মজার খাওন এর আগে আমি কহনোই খায় নাই। আফনের হাতে জায়াদু আছে।’ বললো মিষ্টি।

‘তাই? তা মিষ্টি তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?’

‘ভাইয়া আমি ক্লাস এইটে। বই গুলা তো সব পুঁইড়াই গেছে। কেমনে পড়ুম আমি।’

‘তুমি চিন্তা করো না আমি আরেক সেট বই এনে দেবো। কোন স্কুল বলো আমি নিজে গিয়ে সব বই আনবো।’

মিষ্টি সুন্দর করে হাসে। স্কুলের নাম বলে বললো, ‘মাইজিন ভাইয়া আফনে খুব ভালা। থ্যাংক ইউ!’

তুলিকা এক ধ্যানে মাইজিনকে দেখছিলো। মানুষটার চোখে মুখে আলাদা একটা মাদকতা আছে। তুলিকা তখনকার কথাও ভুলতে পারছে না। মানুষটা রান্না করে তারপর অফিস যেতো আবার এসেও রান্না করতো। কেন? তবে কি উনার মা রান্না করে দিতেন না সকালে উঠে? কেন দিতেন না? এতোটা কষ্ট করেছে মাইজিন? মা হয়ে ছেলের কষ্ট কেন বুঝতে পারেন নি? মাইজিন যতোই বলুক সে অভিজ্ঞ এসব কাজে তাও মনে মনে যে মানুষটার কতটা ব্যথা, কষ্ট লুকিয়ে আছে সেটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে তুলিকা। এসব ভাবনায় যখন মত্ত সে তখনই মিষ্টির কথায় ধ্যান ভাঙে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

‘এই নাম ধরে ডাকছিস কেন মিষ্টি? শুধু ভাইয়া বলবি। উনি কতটা বড় তোর জানিস? আর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে কি হয় হ্যাঁ?

‘আহা তুলিকা ওঁকে বকছেন কেন? ওর মুখ থেকে এই ডাক শুনতে ভালো লাগে। আর কথা গুলোও ভীষণ ভালো লাগে আমার।’

‘মাইজিন ওঁকে লাই দিয়েন না। বা’দ’র মেয়ে একটা!’

খিলখিল করে হাসে মিষ্টি। মাইজিন ও হাসে। শুধু হাসে না তুলিকা।

মাইজিন অফিসে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘তুলিকা আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে। কেউ আসলে না দেখে দরজা খুলবেন না।’

‘হুম!’

‘আসছি। আপনি আর মিষ্টি সাবধানে থাকবেন। বেশি মন খারাপ করলে দরজা লক করে ছাদে যাবেন মিষ্টিকে নিয়ে!’

‘আচ্ছা!’

হঠাৎই মাইজিন ফ্লাইং কিস ছুঁড়লো তুলিকার দিকে। চোখ পিট পিটিয়ে তাকিয়ে থাকে সে। মাইজিন মিষ্টি হেসে বলে, ‘আপনাকে ছোঁয়া যাবে না কিন্তু এটা তো করতেই পারি তাই না? আপনাকে না ছুঁয়ে আদর করাটা কেন মিস করবো?’

মাইজিন দরজা খুলে চোখের আড়ালে চলে যায়। আর তুলিকা তখনও অস্বস্তিতে বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষটা এতো ভালো কেন? ঠিক কতটা ভালো হলে মানুষ এমনটা করতে পারে? মাইজিনকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে তুলিকা!

তুলিকা ঘর মুছে, বিছানা সুন্দর করে গুছিয়ে নিলো। দুপুরে মিষ্টি গোসল করে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছে। তুলিকাও গোসল করে বারান্দায় বসে চুল শুকাচ্ছে। সে ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে মাইজিনকে কল করবে কি করবে না। নিজের মন মস্তিষ্কের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে এক প্রকার। মন বলছে ফোন করে জানতে সে খেয়েছে কি না। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে ফোন দিতে হবে না। যদি কিছু মনে করে মাইজিন! এসব ভাবতে ভাবতেই তার ফোন বেজে উঠে। ফোনে চোখ বুলিয়ে দেখলো এম দিয়ে সেইভ করা নাম্বার টা। নিশ্চয়ই মাইজিন সেইভ করে দিয়েছে তার নাম্বারটা। সে মাইজিনের ফোন পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। মনে যেনো রঙিন প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে। ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই পরিচিত কন্ঠঃস্বর কানে এলো।

‘হ্যালো তুলিকা খেয়েছেন?’

‘হুম আপনি খেয়েছেন?’

‘ হ্যাঁ খেয়েছি! কি করছেন?’

‘এইতো বসে আছি। মিষ্টি ঘুমাচ্ছে!’

‘ওহ আচ্ছা। আপনিও ঘুমাতেন।’

‘নাহ ঘুম আসছে না। আমার দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। একা একা লাগছে। আপনি এখানে থাকলে—!’

নিঃশব্দে হাসে মাইজিন। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই বলে, ‘আমি ওখানে থাকলে কি?’

‘কিছু না তো। গল্প করতাম আর কি।’

‘তাই? এখনো তো গল্প করা যাবে!’

‘আপনি তো অফিসে। কাজে ব্যস্ত নিশ্চয়ই?’

‘ উঁহু ব্যস্ত না তো। এই মাইজিন সুলতান তার বউয়ের জন্য জা’ন দিয়ে দিতে পারে। শুধু একবার বলুন আপনি কথা বলতে চান বউ।’

‘বউ!’ ডাকটা শুনে তুলিকার সারা শরীর কেমন শিউরে উঠে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালো লাগা কাজ করে৷ একই সাথে লজ্জায় ফোন কে’টে দিলো সে। সে আর একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারবে না। লজ্জায় কানের লতি গরম হয়ে গেছে একদম। মাইজিন কান থেকে ফোন নামিয়ে আলতো করে হেসে ফোনেই চু’মু একেঁ দিলো।

অফিস থেকে সন্ধ্যা ছয়টাই বাড়ি ফিরলো মাইজিন৷ অফিস ব্যাগ রেখে, জুতা, মুজা, খুলে জুতার রেকে রাখলো। রান্না ঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ আসছে। মাইজিন রান্না ঘরে গেলো।

‘আপনি এসে গেছেন। ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি কফি দিচ্ছি!’

‘আল্লাহ আমার বউ দেখি অনেক ঘেঁমেছে। আপনার কাজ করতে হবে না। সারাদিন অনেক কাজ করেছেন। এখন আমি কাজ করবো। সরুন সরুন!’

‘এমা আপনি কি বলছেন এসব? আপনি এই মাত্র অফিস থেকে এসেছেন ক্লান্ত লাগছে না? আমাকে কি হার্টলেস মনে হয় আপনার?’

‘সর্বনাশ! আমি কেন আপনাকে হার্টলেস ভাববো? আপনি হলেন কোমল হৃদয়ের একজন মানুষ! এখন যান রেস্ট করুন। সারাদিন অনেক কাজ করেছেন!’

‘আপনি আমার চেয়েও বেশি কাজ করেছেন। আমি এখন কিছুতেই আপনাকে কাজ করতে দিবো না।’

‘উম বললেই হলো কাজ করতে দেবেন না। মিষ্টি কই ওর আওয়াজ শুনছি না!’

‘আপনার শালিকা এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।’ হেসে বললো তুলিকা!

‘উম উম শালিকা বলবেন না। ওঁ আপনার যেমন আদরের ছোট্ট বোনটি ঠিক আমারও!’

‘আপনি কি দিয়ে তৈরি বলুন তো? আপনি ক্লান্ত হোন না তাই না?’

‘ উঁহু ক্লান্তি আমাকে ছুঁতেই পারে না। আচ্ছা আপনি মোচা চিংড়ি খেয়েছেন এর আগে?’

‘নাহ খাওয়া হয়নি!’

‘ওকে চলুন আজকে আমি রান্না করে খাওয়াবো। আপনি শুধু আমাকে এসিস্ট করুন!’

‘ বুঝতে পেরেছি! আপনি আমার কথা শুনবেন না?’ গাল ফুলিয়ে বলে তুলিকা। আর মাইজিন সুন্দর করে দাঁত বের করে বলে,

‘নাহ!’

#চলবে