হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-২১+২২+২৩

0
262

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২১)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৫২)
তরুনিমা নিলাদ্রের স্মার্ট ওয়াচ থেকে বের করা সিম কার্ড ও মেমোরি কার্ড নিজের ফোনে সেট করার পর কিছুসময় ঘাটাঘাটি করে বোঝার চেষ্টা করে যে নিলাদ্রের আজ এই ক*রু*ণ অবস্থা হওয়ার পিছনে আদেও কোনো ষ*ড়*য*ন্ত্র কাজ করেছে নাকি এটা নিছকই এ*ক্সি*ডেন্ট মাত্র। কিছুসময় ঘাটাঘাটি করার পর তরুনিমা একটি রেকর্ড হওয়া ভিডিও ওর গ্যলারিতে দেখতে পায়। তরুনিমা ১ম ভিডিওটি প্লে করতেই দেখে নিলাদ্র কোনো একটা রুমে বসে আছে। পরক্ষণেই তরুনিমা ডাক্তার খালেকুজ্জামানকেও দেখতে পায় সেই রুমে। তরু নিজের ফোনের ভলিউম কিছুটা বাড়িয়ে ওদের মাঝে হওয়া কথপোকথন গুলো শুনতে শুরু করে। ওদের মাঝের সম্পূর্ণ কথপোকথন গুলো শোনামাত্র তরু যেনো বড়-সড় একটা ধা*ক্কা খায়।
তরু ওর চেহারায় স্ত*ব্ধ ভাব ফুটিয়ে বললো…..

—“বড় বাবার এই দীর্ঘ সময় যাবৎ কো*মায় থাকার পিছনে চৌধুরী পরিবারেরই কারোর ষ*ড়*য*ন্ত্র কাজ করছে! কিন্তু কে বা কারা সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ? নিলাদ্র ভাইয়াকে ডাক্তার আঙ্কেল তার নিজ বাসায়ই যাওয়ার পরেই বা কেনো সব সত্য ঘটনা জানাতে চাইলেন? তবে কি ডাক্তার আঙ্কেলের বাসায় যাওয়ার পর নিলাদ্র ভাইয়া সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা জানতে পেরেছেন জন্যই তাকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে! যদি সত্যিই এমনটা ঘটে থাকে তাহলে তো নিলাদ্র ভাইয়া এখনও বেঁচে আছেন এই খবর চৌধুরী পরিবারের আর কোনো সদস্যের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দেওয়া যাবে না। কে ভালো আর কে মু*খো*শ*ধারী শ*ত্রু সেটা তো আমি জানি না। তাই কাওকেই বিশ্বাস করা উচিত হবে না আমাদের। আমাকে এক্ষুণি কুশলকে এই বিষয় সম্পর্কে জানাতে হবে।”

এই বলে তরুনিমা বসাবস্থা থেকে উঠে দ্রুতপায়ে নামাজঘরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুসময় পর নামাজঘরের সামনে আসতেই দেখে কুশল সেখানে হাঁটুতে মুখ গু*জে বসে আছে। তরু নামাজঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই চিন্তা করে…..

—“না, না এখুনি ওনাকে এসব সম্পর্কে জানানো উচিত হবে না। নিলাদ্র ভাইয়ার অবস্থা নিয়ে উনি এমনিতেই অনেক বেশি আপসেট হয়ে আছেন। এখন যদি নিজের পরিবার সম্পর্কে এসব কিছু শুনেন তাহলে রাগের বশে বিপরীত কিছু করে ফেলতে পারেন। তখন শ*ত্রু*রাও সতর্ক হয়ে যাবে আর নিলাদ্র ভাইয়া সহ বাকি ভালো মানুষগুলোর জীবন ও ঝুঁ*কি*র মাঝে পড়বে৷ আগে নিলাদ্র ভাইয়ার অপারেশন সাকসেসফুল হোক। তারপর যেকোনো একটা ব্যবস্থা করাই যাবে।”

তরুনিমা এই বলে নিজের মনকে আশ্বস্ত করে। অতঃপর লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে পায়ের জুতো খুলে নামাজ ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে কুশলের পাশে এসে হাঁটু ভাজ করে বসে ওর বাম কাঁধে নিজের ডান হাত রাখে। কুশল মাথা তুলে তরুর দিকে শীতল দৃষ্টি স্থির করে। তরু কুশলের দিকে তাকাতেই দেখে কুশলের চোখ এখনও হালকা লাল হয়ে আছে। তরু শান্ত স্বরে বললো…

—“বাহিরে চলুন। এখানে বি*ষ*ন্ন মন নিয়ে আর কতো সময় বসে থাকবেন! মনকে শক্ত ও স্থির করার চেষ্টা করুন। ভরসা রাখুন আল্লাহর উপর, তিনি আপনার আকুল কন্ঠের করা প্রার্থনা ফিরাতে পারবেন না দেখিয়েন। নিলাদ্র ভাইয়া ইনশাআল্লাহ পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

কুশল একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। তরুও বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর দু’জনেই নামাজঘর থেকে বেড় হয়৷ তরু কুশলকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে এসে সেখানে রাখা চেয়ারে বসে।

কিছুসময় নিরব হয়ে বসে থাকার পর কুশল তরুকে বললো….
—“তুমি একটু বাসায় আর নিলাদ্রের বাবা-মাকে ওর অবস্থার কথা জানিয়ে দাও। এই কাজ আমি করতে পারবো না।”

তরু দ্রুততার স্বরে বললো…
—“না, না এখন নিলাদ্র ভাইয়ার অবস্থার কথা কাওকে জানানো যাবে না।”

কুশল ভ্রু যুগল কুঁচকে নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো….
—“জানানো যাবে না কেনো? কি সমস্যা?”

তরু আমতা আমতা করে বললো….
—“নিলাদ্র ভাইয়ার অবস্থা তো ভালো না শুনলেন ই। এই মুহূর্তে যদি আঙ্কেল-আন্টি বা আমাদের বাসার কাওকে ওনার এমন ক*রু*ণ অবস্থা সম্পর্কে জানাই তাহলে ওনারা অনেক বেশি চি*ন্তা করবেন। আন্টি আবার ভাইয়ার কথা চিন্তা করে কান্নাকাটি করে শরীর খারাপ করে ফেলতে পারেন। তাই ভাইয়া আগে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে উঠুক তারপর সবাইকে ধীরস্থিরে ওনার এ*ক্সি*ডে*ন্টের বিষয় টা জানানো যাবে।”

—“তখন আর না জানিয়েই বা কি হবে? তখন জানালে তো আমাকে কথা শোনাবেন ওনারা যে এতোবড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো আর আমি তাদের সেই সম্পর্কে কিছু জানানোর প্রয়োজন ও মনে করলাম না।”

—“তাহলে তো আরো ভালো। কাওকে জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”

কুশল তরুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে বললো….
—“তুমি কি আমার কাছে কোনো বিষয় লুকাচ্ছো?”

কুশলের এমন প্রশ্নে তরু ভ*র*কে যায়। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো….
—“না, কি লুকাতে যাবো? আচ্ছা আপনি এখানে বসুন আমি একটু রিসেপশনের ওখান থেকে আসছি। কোনো প্রয়োজন পড়ে কি না দেখি।”

—“ঠিক আছে।”

তরু বসাবস্থা থেকে উঠে স্থান ত্যগ করে। তরু চলে যেতেই কুশল দেখে ওর পাশের চেয়ারে তরুর মোবাইল আর নিলাদ্রের ভাঙা ঘড়িটা দেখতে পায়। অতঃপর কুশল তরুর ফোন হাতে নিতেই দেখে একটা ভিডিও স্টপ করে রাখা সেখানে নিলাদ্রের ছবি দেখা যাচ্ছে। কুশল ভিডিওটা প্লে করে। পুরো ভিডিও দেখে নিলাদ্র আর খালেকুজ্জামানের কথপোকথন শোনার পর রাগে কুশলের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। সেইসময় তরুনিমা আবারও সেখানে এসে নিজের ফোনটা খুঁজতে শুরু করে। কুশল তরুর দিকে ওর ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো…

—“এটা খুঁজছো নিশ্চয়ই!”

তরু কুশলের হাতে নিজের ফোনটা দেখামাত্র বুঝতে পারে যেটার ভ*য় ছিলো সেটাই হবে এবার। কুশল শান্ত কন্ঠে বললো….
—“এতো বড় একটা বিষয় জেনেও আমার থেকে লুকানোর কারণ কি তরুনিমা?”

তরুনিমা কুশলের পাশে বসে বললো….
—“আমি সবার ভালোর কথা চিন্তা করেই সত্যটা লুকাইতে চেয়েছিলাম।”

—“সব বিষয়ে বেশি বুদ্ধি খাটানো উচিত না। তুমি বা আমি কেও ই জানি না আসল শ*ত্রু কে বা কারা। নিলাদ্রের অবস্থা দেখেও তোমার বোঝা উচিত ছিলো আমাকে সব সত্য জানিয়ে দেওয়া। এখন যদি আমি তোমার ফোনটা হাতে না নিতাম এই ভিডিওটা না দেখতাম তাহলে তো জানতেই পারতাম না আমার পরিবারেই এমন কোনো মু*খো*শ*ধা*রী আছে যে নিজের স্বা*র্থ হা*সিল করতে যেকোনো ধরনের নিচ পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে।”

—“আপনি রাগের বশে যদি এমন কোনো কাজ করে ফেলেন যার ফলে নিলাদ্র ভাইয়ার কোনো ক্ষ*তি হয়ে যায় সেই ভ*য়ে আমি আপনাকে জানাতে চাই না।”

—“আমি আমার নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে জানি। কোন পরিস্থিতিতে কেমন ভাবে চলা উচিত, কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত তাও আমি খুব ভালো ভাবেই জানি। আমাকে না জানিয়ে অতিরিক্ত বুদ্ধি খাঁটিয়ে কোনো কাজ করতে যাওয়া যেনো না হয়। যদি এমনটা করার ফলে কোনো স*ম*স্যার সৃষ্টি হয় তখন সেই পরিস্থিতি সামলাতে আমি যাবো না।”

কুশলের কথাগুলো শুনে তরু চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললো….

—“সুযোগ পেলেই নিজের ঢো*ল নিজে পি*টা*তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই খা*রু*শটা।”

সেইসময় ও.টির দরজার উপর জলন্ত বাতিটা নি*ভে যায়। ও.টির দরজা খুলে ডাক্তার আকরাম বাহিরে বেড়িয়ে আসেন। কুশল আর তরু বসাবস্থা থেকে উঠে ডাক্তার আকরাম এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

(৫৩)
নিজেদের ঘরে কামিনী আর রিজভী বিছানায় বসে আছে। সেইসময় কামিনী নিজের বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে রিজভীকে বললেন…

—“আর কতোকাল তোমার নিজের ভাই-ভাবীর গোলাম হয়ে জীবন কাটাতে হবে আমাদের? তোমার ছেলে যে বড় হয়েছে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কি কোনো চিন্তা-ভাবনা করেছো তুমি?”

চলবে ইনশাআল্লাহ………….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৫৪)
রিজভী কামিনীর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন…

—“তুমি খুব ভালো করেই জানো কুশল যখন ৩০ বছর বয়সে পদার্পণ করবে তখন এই চৌধুরী বংশের ৯০% সম্পত্তির মালিক সে হয়ে যাবে। একবার কুশল সম্পত্তির মালিকানা পেয়ে গেলে যেকোনো ভাবে সব সম্পত্তি আমাদের নামে লিখে নিতে পারবো। তখন আমাদের আর আমাদের ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে কোনোরকম চি*ন্তা করতে হবে না। তাই সেই সময় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মেজো ভাই-ভাবীর কথানুযায়ীই চলতে হবে। আমাদের আচারণে এমন কোনো ভাব প্রকাশ করা যাবে না যার ফলে মেজো ভাই-ভাবী আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এতোটুকুও সন্দেহ করতে পারেন। যদি তারা আমাদের উপর একবার সন্দেহ করতে শুরু করেন তাহলে আমাদের এতো বছরের অপেক্ষা, উদ্দেশ্য সব নিমিষেই ন*ষ্ট হয়ে যাবে। তখন আমরা একূল-ওকূল দুইকূলই হা*রিয়ে ফেলবো। আর তখন আমাদের ঠিকানা হবে গাছের নিচে, রাস্তার ধারে। পেটের দা*য়ে ভি*ক্ষাও করতে হবে। তাই নিজ হাতে নিজেদের সুন্দর সুখময় ভবিষ্যত ন*ষ্ট করার ইচ্ছে না থাকলে মাথা ঠান্ডা রাখো।”

কামিনী মুখ বাঁ*কি*য়ে বিছানা থেকে নেমে বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন…..
—“খুব তো বড় মুখ করে বললে কুশল সম্পত্তির মালিকানা পেয়ে গেলে যেকোনো ভাবে তুমি ওর থেকে সব সম্পত্তির মালিকানা নিজের নামে করে নিবে। বলি কুশলকে কি তোমার এতোই বোকা আর বুদ্ধি*হী*ন ছেলে বলে মনে হয় যে, তুমি চাইলে আর সে সুরসুর করে নিজের সম্পত্তির মালিকানা তোমার নামে করে দিবে!”

কামিনীর মুখে এমন কথা শুনে রিজভী বিরক্তিতে নিজের মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে বললেন….

—“কুশল কি জানে নাকি যে ওর ৩০ বছর পূর্ণ হলে ও এতো এতো সম্পত্তির মালিকানা পেয়ে যাবে তাই সে আমার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে!”

—“যখন মালিকানা পাবে তখন তো জানতেই পারবে। যতোটা সহজ ভাবে নিচ্ছো সম্পূর্ণ বিষয়টা ততোটাও সহজ কিন্তু নয়। শেষে যেনো কুশল তোমার বারা ভাতে ছাই না ঢেলে দেয়।”

—“আহহ, সবসময় এতো অ*লু*ক্ষু*ণে কথা বলবে না তো তুমি কামিনী। কিছু সময় মুখ দিয়ে শুভ কথাও বের করা উচিত তোমার। নয়তো এতো এতো অ*লু*ক্ষু*ণে কথা বলার জন্য তোমার মুখটাও পঁ*চে যাবে একদিন।”

কামিনী ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে বললো….
—“চু*প করো তুমি। আমার এতো সুন্দর মুখটা পঁ*চ*বে না কখনও।”

(৫৫)
সকাল বেলা……..
চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যরা ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে। সেইসময় চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে দু’জন পুলিশ কনস্টেবল স্ট্রেচারে করে সাদা চাদরে আপদমস্তক ঢাকা কাওকে নিয়ে প্রবেশ করে ড্রয়িংরুমের মেঝের উপর রাখে। একজন পুলিশ অফিসার ও ছিলেন তাদের সাথে। চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যের দৃষ্টি সেদিকে পড়লে সকলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ায়। সায়মন পুলিশ অফিসারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন…..

—“অফিসার এভাবে আপাদমস্তক সাদা চাদরে ঢেকে স্ট্রেচারে করে কাকে এনেছেন?”

পুলিশ অফিসার নিজের মাথায় থাকা ক্যপটা খুলে হাতে নিয়ে বললেন…..

—“গতকাল রাতে শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে। এ*ক্সি*ডে*ন্টে ভিকটিমের মুখ পুরোপুরি ভাবে থে*ত*লে গিয়েছে। ঘটনাস্থলেই ভিকটিমের মৃ*ত্যু হয়েছে। চেহারা দেখে তাকে চেনার উপায় নেই। ঘটনাস্থলে ভিকটিম এর ফোন পেয়েছিলাম। ফোন আনলক করার পর কললিস্টে ঢুকে সেখানে লাস্ট কল চৌধুরী পরিবারের সদস্য কুশল চৌধুরীর ফোন নাম্বার দেখে আমরা তাকে কল করেছিলাম। অতঃপর তার কথানুযায়ী লা*শ*কে আইডেন্টিফাই করার জন্য আমরা সরাসরি এখানে নিয়ে এসেছি।”

সাগরিকা চৌধুরী সায়মনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“সায়মন কুশল দাদুভাইকে কল করো আর এক্ষুণি বাসায় আসতে বলো। সকাল থেকে তো তাকে আর তরু দিদিভাইকে দেখছি না বাসায়।”

সাগরিকা চৌধুরীর কথানুযায়ী সায়মন কুশলকে কল করতে নিবে সেইসময় কুশল আর তরু চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“আর কল করার প্রয়োজন নেই, আমরা এসেছি।”

সায়মন রাগী স্বরে বললেন….
—“বিয়ের আগে তো নিজে মর্জি মতো হুটহাট বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে। আর এখন বিয়ের পর বউমাকে নিয়েও হুটহাট বাসা থেকে বেড়িয়ে যাও, কাওকে বলে যাওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করো না। নিজের পরিবারের মানুষদের একটু মূল্যায়ন করা কবে থেকে শিখবে তুমি হ্যা! তোমার মতো এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে আমাদের বংশে আর একটা নেই।”

কুশল ওর দৃষ্টি মেঝেতে রাখা লা*শ*টির উপর স্থির করে কমোরের পিছনে দু’হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। সায়মনের বলা কথাগুলো কুশলের কান পর্যন্ত পৌঁছালেও তাতে যে ওর বিন্দুমাত্র যায় আসে না তা কুশলের শান্ত-স্বাভাবিক মুখশ্রীর দিকে লক্ষ্য করলেই সবাই বুঝতে পারবে। কুশলের এমন পাত্তাহীন আচারণ বরাবরই সায়মনের রাগের মাত্রা স্বাভাবিক এর থেকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই সায়মন দাঁতে দাঁত পি*ষে নিজের রাগ নিজের মধ্যেই হ*জ*ম করে নেয় বরাবরই।

কুশল শান্ত কন্ঠে পুলিশ অফিসারকে বললেন…
—“অফিসার আপনি বলেছিলেন এ*ক্সি*ডে*ন্টের কারণে লা*শ*টির মুখ পুরোপুরি ভাবে থে*ত*লে গিয়েছে তাই আমরা তার চেহারা দেখে তাকে চিনতে পারবো না। তাহলে তাকে চেনার জন্য ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা লা*শে*র ব্যবহৃত জিনিসপত্র গুলো আমাদের দেখান।”

(৫৬)
রাতে অনেক দেড়িতে ঘুমানোর কারণে ঘুম থেকে উঠতে আজ বেশ বেলা করে ফেলেছে সন্ধ্যা। নিলাদ্রের প্রতি রাগ থাকায় চেইঞ্জ না করে শাড়িটি পড়েই রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে। আড়মোড়া ভে*ঙে শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসতেই নিচ থেকে সকলের কথা বলার হালকা আওয়াজ শুনতে পেয়ে সন্ধ্যা রুমের বাহিরে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে লক্ষ্য করতেই দেখে পরিবারের সকল সদস্যরা ডায়নিং এ একত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পাশেই পুলিশদের দেখে সন্ধ্যা অবাক স্বরে বললো…

—“সকাল সকাল বাসায় পুলিশ এসেছে কেনো? আর সবাই এভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছে ওখানে। এখানে থেকে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। নিচে যেতে হবে আমায়।”

এই বলে সন্ধ্যা সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে তরুনিমার পাশে দাঁড়াতেই স্ট্রেচারের উপর সাদা চাদরে ঢাকা লাশটি দেখতে পায়। অজানা কারণে সন্ধ্যার বুকটা ধ*ক করে উঠে। সন্ধ্যা তরুর হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়।

পুলিশ অফিসার কুশলের সামনে একটা পলিথিন ব্যগ ধরে বললো….
—“এখানে ভিকটিমের ঘড়ি, মোবাইল, স্বর্ণের একটা আংটি আর ওয়ালেট রাখা আছে। আপনারা এগুলা দেখুন আর ভিকটিমকে চিনতে পারেন কিনা জানান।”

কুশল সেগুলো হাতে নিয়ে দেখামাত্র একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সকলেই লা*শে*র পরিচয় জানার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে কুশলের মুখশ্রী পানে। কুশল থমথমে স্বরে বললো…

—“এই সবগুলো জিনিস দেখেই তো মনে হচ্ছে এগুলো নিলাদ্রের। তারমানে কি এটা নিলাদ্রের লা*শ!”

কুশলের মুখে এমন কথা শোনামাত্র কামিনী একহাতে নিজের মুখ চে*পে ধরেন বললেন….

—“হায় আল্লাহ!”

উপস্থিত সকলেই যেনো বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। সন্ধ্যা তরুর হাত ছেড়ে কুশলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাত থেকে পলিথিন ব্যগটা নিয়ে সেখান থেকে সবগুলো জিনিস বের করতে নিলে পুলিশ অফিসার বললেন…

—“এগুলা বের করবেন না। জিনিসগুলো এখনও পরীক্ষা করা হয় নি তাই বাড়তি কারোর স্পর্শ করা ঠিক হবে না।”

সন্ধ্যার কান পর্যন্ত যেনো পুলিশ অফিসারের কথাগুলো পৌঁছাতে পারে নি। কুশল হাত উঠিয়ে পুলিশ অফিসারকে থামিয়ে দেয় সন্ধ্যাকে কিছু না বলার জন্য। সন্ধ্যা পলিথিন ব্যগ থেকে আংটিটা বের করতেই আংটির উপর নিলাদ্রের নাম লেখা দেখতে পায়। পরমুহূর্তে ওয়ালেটের ভাঁজ খুলতেই সেখানে নিলাদ্রের আইডিকার্ড দেখতে পেলে সবগুলো জিনিস ওর হাত থেকে নিচে পড়ে যায়। সন্ধ্যা ধ*প করে নিলাদ্রের পাশে বসে পরে। তরুনিমা সন্ধ্যাকে ধরতে গেলে কুশল ওর হাত ধরে থামিয়ে দেয়। নিরুপায় হয়ে তরু কুশলের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়। সন্ধ্যা নিলাদ্রের মুখের উপর থেকে সাদা চাদরটি সরাতেই থে*ত*লে যাওয়া বি*ভ*ৎ*স মুখশ্রী দেখে উপস্থিত বাকি সদস্যরা অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু সন্ধ্যা একদৃষ্টিতে নিলাদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

কামিনী উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখা অবস্থাতেই বললেন….
—“আরে মুখটা ঢা*কো জলদী।”

পুলিশ কনস্টেবল মুখ ঢাকার জন্য এগিয়ে আসলে সন্ধ্যা উচ্চস্বরে বললো…..
—“খবরদার, কেও ওনার মুখ ঢাকার বিন্দুমাত্র সাহস করবেন না। ওনার এতো সুন্দর মুখটা কেনো ঢাকতে হবে! কেও ঢাকবে না, কেও না।”

সন্ধ্যার এমন আচারণের কারণ কেও বুঝে উঠতে পারছে না। সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা হাতে নিলাদ্রের মুখ স্পর্শ করে বললো….

—“আপনার পছন্দ করা শাড়িটা পড়ে খুব সুন্দর করে সেজে আমি ছাদে আপনার আসার অপেক্ষা করছিলাম। আপনি আসলেন না কেনো? ভালোবাসার দাবি নিয়ে ৬বছর ধরে আমার পি*ছু ঘুরেছেন। কাল যখন আমি আপনার ভালোবাসা গ্রহন করবো বললাম আপনি আসলেন না! এখন এভাবে নিরব হয়ে শুয়ে আছেন কেনো? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমি আপনাকে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করিয়ে য*ন্ত্র*ণা দিয়েছিলাম জন্য আজ আপনি নিরব থেকে আমায় য*ন্ত্র*ণা দিবেন বলে ঠিক করেছেন নাকি! এটা কিন্তু ঠিক না। উঠুন তো, আপনাকে এভাবে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। আর মুখে এসব কি লা*গি*য়ে এসেছেন হ্যা! কেমন বি*শ্রী দেখাচ্ছে। উঠে মুখটা ধুয়ে আসুন। আমি জানি আপনি আমার সাথে মজা করছেন। ইচ্ছে করে বি*দ্ধ*স্ত রূপ নিয়ে আমার সামনে এসেছেন যেনো আমি তা সহ্য করতে না পেরে আপনাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেই।”

উপস্থিত সকলেই স্তব্ধ হয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে। নিলাদ্র যে সন্ধ্যাকে এতো বছর ধরে ভালোবাসে তা চৌধুরী পরিবারের কেও জানতো না এমনকি কুশলও না। কুশল তরুর হাত ছেড়ে দিলে তরু সন্ধ্যার পাশে বসে ওর কাঁধে এক হাত রাখে। সন্ধ্যা ঘাড় ঘুরিয়ে তরুর দিকে তাকায়। ওর চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সন্ধ্যা কাঁপা গলায় বললো….

—“ভাবী…ও-ওনাকে উঠতে বলো না। আমার সহ্য হচ্ছে না সত্যি। ওনার তো কিছু হয় নি বলো! আমি ওনাকে ভালোবাসি বলি নি তাই তো উনি আমার সাথে এমন করছেন বলো! আমি ভালোবাসি বললেই উনি উঠে যাবেন তাই না! আচ্ছা আমি বলছি।”

এই বলে সন্ধ্য নিলাদ্রের দিকে তাকিয়ে চাদরের নিচ থেকে র*ক্তে মাথা হাতটি ধরে কান্না করতে করতে বললো….
—“আমি আপনাকে ভালোবাসি নিলাদ্র। সত্যি বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি। অনেক অনেক বেশিই ভালোবাসি। উঠুন এবার, প্লিজ উঠুন না!”

সন্ধ্যা নিলাদ্রের হাত ছেড়ে দিয়ে বসাবস্থাতেই কিছুটা পিছিয়ে কুশলের পায়ের কাছে এসে একহাতে কুশলের পা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বললো…

—“ও মেজো ভাইয়া ওনার হাতটা এতো ঠান্ডা হয়ে আছে কেনো? ও ভাইয়া উনি তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুমি উনাকে উঠতে বলো না। আমার ভিষণ ক*ষ্ট হচ্ছে মেজো ভাইয়া। আমি ওনার এমন বি*দ্ধ*স্ত চেহারা দেখতে পারছি না। আমার বুকের ভিতরটা য*ন্ত্র*ণায় ছিঁ*ড়ে আসছে। ওনাকে বলো না আমায় এভাবে য*ন্ত্র*ণা না দিতে। আমি ওনাকে ভালোবাসি বললাম তো। আমার ভালোবাসি শব্দটি কি ওনার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি!”

সন্ধ্যার এমন আচারণ আর কান্নায় কুশলের বুকের ভিতরটা যেনো মো*চ*ড় দিয়ে উঠছে। পরক্ষণেই সন্ধ্যা সে*ন্স*লে*স হয়ে যায়। তরু সন্ধ্যার কাছে এসে ওকে ধরতেই সে তরুর উপর হেলে পরে যায়। তরু অস্থির কন্ঠে বললো….
—“কুশল….ও তো সেন্স*লে*স হয়ে গিয়েছে।”

অতঃপর কুশল তরিৎগতিতে সন্ধ্যাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে ওর রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো….

—“বাবা…ডাক্তার আঙ্কেলকে কল করো আর বাসায় আসতে বলো জলদী।”

সায়মন ডাক্তারকে কল করে। তরুনিমা, সাবরিনা, কামিনী কুশলের পিছন পিছন অগ্রসর হয়। পুলিশ কন্সটেবল নিলাদ্রের মুখটি সাদা চাদর দিয়ে আবারও ঢেকে দেয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ………

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৫৭)
সন্ধ্যাকে ওর রুমে শুইয়ে দিয়ে কুশল আবারও নিচে চলে আসে৷ সায়মন, রিজভী, সাগরিকা চৌধুরী ড্রয়িংরুমেই উপস্থিত আছেন। কুশল পুলিশ অফিসার এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…

—“নিলাদ্র গতকাল সন্ধ্যায় আমাকে কল করেছিলো। বিশেষ কিছু কাজে শহরের বাহিরে যাওয়ার ছিলো ওর। কিন্তু এরপর চোখের পলকে কি থেকে কি হয়ে গেলো! যদি জানতাম আজ এমন একটা দিন দেখতে হবে তাহলে গতকাল আমি ওকে একা কোথাও যেতে দিতাম না। আমি আমার সবথেকে ভালো বন্ধুকে এভাবে হারিয়ে ফেলতাম না।”

রিজভী কুশলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে একহাত রেখে আফসোসের কন্ঠে বললেন…..

—“যার মৃ*ত্যু যেখানে লেখা আছে, থাকবে তার মৃ*ত্যু
সেখানেই হবে বাবা। তুমি আমি সাথে থাকলেও মৃ*ত্যু*র হাত থেকে আমরা কাওকে কখনও বাঁচাতে পারবো না। নিলাদ্রের এমন আকস্মিক মৃ*ত্যুর কারণে আমরা ভিষণ ব্যথিত। ওকে তো আমরা আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য হিসেবে মনে করে এসেছি সবসময়। তোমার মনের অবস্থাও আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। তবুও বলবো মনকে শক্ত করো। এভাবে ভে*ঙে পড়ো না। আল্লাহ নিলাদ্রকে জান্নাত বাসী করুণ।”

কুশল নিরব হয়ে দাড়িয়ে নিজের দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। সায়মন শান্ত স্বরে বললেন…..

—“অফিসার আপনারা নিলাদ্রের লা*শ ওর পরিবারের কাছে পৌঁছে দিন। লা*শে*র যে বি*ভ*ৎ*স অবস্থা হয়েছে দ্রুতই দা*ফ*ন কার্য সম্পন্ন করতে হবে। আমি আপনাকে নিলাদ্রের বাসার ঠিকানাটা বলে দিচ্ছি।”

অতঃপর পুলিশ কনস্টেবল দু’জন নিলাদ্রের লা*শ নিয়ে চৌধুরী মেনশনের বাহিরে চলে যায়। পুলিশ অফিসার ও সায়মন ও তাদের পিছন পিছন বেড়িয়ে যায়। রিজভী নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। সাগরিকা চৌধুরী সোফায় গিয়ে বসে পরে। কুশল নিজের জন্য নির্ধারিত সোফায় গিয়ে বসে পরে। কিছুসময় পর একজন মধ্যবয়সের ডাক্তারকে নিয়ে সায়মন মূল দরজা ভিতরে প্রবেশ করে। কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ডাক্তারকে নিয়ে কুশল ও সায়মন সিঁড়ি বেয়ে উপরে সন্ধ্যার রুমের যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে।

(৫৮)
সন্ধ্যা এখনও সেন্সলেস হয়ে আছে। সন্ধ্যার মাথার একপাশে বসে আছে সাবরিনা, আরেকপাশে বসে আছে তরুনিমা। সাবরিনার পাশে দাঁড়িয়ে কামিনী নিজের বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন….

—“আজ এমন একটা ঘটনা না ঘটলে তো জানতেই পারতাম না নিলাদ্র ৬ বছর ধরে সন্ধ্যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই কারণেই সন্ধ্যার পরীক্ষার রেজাল্ট সবসময় খারাপ এসেছে। ছেলেটা আমাদের মেয়েটার মাথা চি*বি*য়ে খে*তো সবসময়। ম*রে গিয়েও তো আমাদের মেয়েটার পিছু ছাড়লো না, ওর শোকে আমাদের ভো*লা-ভা*লা মেয়েটা পা*গ*ল না হয়ে যায়।”

সাবরিনা রাগী স্বরে বললেন….
—“আহহহ কামিনী, থা*মো তুমি এবার। বাড়িতে একটা শো*কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আর তুমি কিনা এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও নিজের নিচ চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছো।”

সাবরিনার কথায় কামিনী কোনো প্রতিত্তুর না করে মুখ বাঁ*কিয়ে জোরে জোরে বিনুনী নাড়াতে থাকে। তরুনিমা সন্ধ্যার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে।

সেইসময় কুশল আর সায়মন ডাক্তারকে নিয়ে সন্ধ্যার রুমে প্রবেশ করে। তরুনিমা সন্ধ্যার মাথার পাশ থেকে উঠে কুশলের পাশে এসে দাঁড়ায়। ডাক্তার সন্ধ্যাকে চেকআপ করে একটা ইনজেকশন পু*শ করে দিয়ে বললেন…….

—“যেহেতু খুব বড় একটা শ*কড পেয়েছেন তাই পেশেন্টের মানসিক ভাবে সেরে উঠতে লম্বা সময়ের প্রয়োজন। এমন অনেক পেশেন্ট আছেন যারা মানসিক ভাবে ভে*ঙে পড়লে নিজের শারীরিক বড়-ছোট ক্ষ*তি করে ফেলেন। তাই এইসময় ওনাকে একলা ছাড়া উচিত হবে না। বিভিন্ন আনন্দদায়ক, মন ভালো হওয়ার মতো বিষয় গুলো ওনার সামনে বেশি করার চেষ্টা করবেন। এতে পেশেন্ট মানসিক ভাবে দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারবে। আমি আপাতত একটা ঘুমের ঔষধ ইনজেক্ট করে দিয়েছি। তাই উনি এখন কিছুসময় ঘুমাবেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই।”

এই বলে ডাক্তার বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সায়মন ডাক্তারকে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।

(৫৯)
তরুনিমা কুশলের হাত ধরে সন্ধ্যার রুম থেকে বেড়িয়ে নিজেদের রুমে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজা আটকে দেয়। কুশল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়া নিজের চুলগুলো ঠিক করতে থাকে। তরু কুশলের পাশে এসে ওর উপর নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বললো….

—“নিলাদ্র ভাইয়া যে এতো বছর ধরে সন্ধ্যাকে ভালোবাসতো এই কথা আপনি জানতেন না?”

কুশল তরুর দিকে ঘুরে ড্রেসিং টেবিলের পাশের দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…….

—“না। নিলাদ্র কখনও আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলে নি। আর সন্ধ্যার বয়সও কম। এতো তাড়াতাড়ি ওর বিয়ের বিষয় নিয়েও কেও চিন্তা করবে না। তাই হয়তো নিলাদ্র আমাদের কারোর কাছে সন্ধ্যাকে ঘিরে ওর মনের ভিতরের অনুভূতিগুলোর বহিঃপ্রকাশ করে নি।”

—“কিন্তু এখন তো জানতে পারলেন সন্ধ্যাও নিলাদ্র ভাইয়াকে ভালোবাসে। নিলাদ্র ভাইয়ার জীবন বাঁচাতে আর আসল কা*ল*প্রি*টকে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে সকলের সামনে নিলাদ্র ভাইয়াকে মৃ*ত প্রমাণ করতে যে মিথ্যে নাটক করালেন এর জন্য সন্ধ্যার মন তো বা*জে ভাবে ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত হয়ে গেলো। অতিরিক্ত ডি*প্রে*স*ড হয়ে সন্ধ্যা যদি নিজের বড় কোনো ক্ষ*তি করে ফেলে তখন কি হবে?”

—“আশা রাখছি সন্ধ্যা এমন কোনো কাজ করবে না।”

—“যদি করে তখন কি হবে? এতোটা রি*স্ক না নিয়ে সন্ধ্যাকে সত্যিটা জানিয়ে দিলেই ভালো হয় না কি?”

—“আমাদের চারপাশেই ঘোরাফেরা করছে সেই নি*ম্ন-মানসিকতার মু*খো*শ*ধা*রী শ*ত্রু। যতোক্ষণ না পর্যন্ত জানতে পারছি সেই অজানা শ*ত্রু আসলে কে ততোক্ষণ পর্যন্ত নিলাদ্রের বেঁচে থাকার খবর তুমি আমি ব্যতিত এই পরিবারের কাওকে জানানো সম্ভব না।”

তরুনিমা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে।

(৬০)
রাত ৯টা…..
নিজের রুমে জানালার গ্রি*ল ধরে দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে সন্ধ্যা। সেইসময় তরুনিমা খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে সন্ধ্যার রুমে প্রবেশ করে। খাবারের ট্রে টা বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে সন্ধ্যার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে এক হাত রাখে। তরুর উপস্থিতি বুঝতে পেরে সন্ধ্যা ফুঁ*পাতে শুরু করে। সন্ধ্যার এহেনু অবস্থা দেখে তরুর বুকটা ফে*টে নিলাদ্রের বেঁচে থাকার সত্যটা বেড়িয়ে আসতে চাইছে কিন্তু কুশলের কড়া নি*ষে*ধা*জ্ঞাকে অ*মান্য করার শক্তি সে পাচ্ছে না। সন্ধ্যা ফুঁ*পাতে ফুঁ*পাতে বললো…..

—“ভাবী….যাকে সারাজীবন পাশে পাওয়ার তীব্র আ*কা*ঙ্ক্ষা এই মনের ভিতর খুব করে কাজ করে, আমরা তাকে পাওয়ার আগেই কেনো হারিয়ে ফেলি? সৃষ্টিকর্তা আমার সাথেই কেনো এমন নি*ষ্ঠু*র বিচার করলেন বলতে পারবে? একটা মানুষ ৬টা বছর ধরে আমাকে ভালোবেসে আসলেন, আজ যখন সেই মানুষটার ভালোবাসা আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম তখন সেই মানুষটাকে ভালোবাসি শব্দটুকু জানানোর আগেই আমার থেকে কে*ড়ে নিলেন!”

সন্ধ্যার বলা প্রতিটি শব্দ যেনো তীরের মতো তরুনিমার বুকের ভিতর গিয়ে আ*ঘা*ত হাঁ*ন*ছে। তরু একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার হাত ধরে বিছানায় এনে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশে বসে শান্ত স্বরে বললো…

—“সন্ধ্যা…আমার জান…তোমাকে বুঝানোর বা শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। শুধু এতোটুকুই বলবো এভাবে ভে*ঙে পড়ো না তুমি। তোমার এই ভে*ঙে পড়া রূপ দেখা যে তোমার কাছের মানুষদের সহ্য ক্ষমতা বাহিরে।”

সন্ধ্যা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তরুনিমাকে জড়িয়ে ধরে ডু*করে ডু*করে কাঁদতে কাঁদতে বললো….

—“ভাবী…ও-ওনাকে আ-আমার ক-কাছে এনে দ-দাও না…! আ-আমার স-সত্যি খ-খুব ক*ষ্ট হচ্ছে। ও-ওনার শ-শূণ্যতা আমি ক-কিছুতেই মেনে নিতে প-পারছি না। এ-এনে দ-দা……..”

পুরো কথা শেষ করার আগেই সন্ধ্যা নিরব হয়ে যায়।তরুনিমা সন্ধ্যার মাথা তুলে ওর বুঁজে যাওয়া মুখশ্রী দেখে ওকে বিছানায় শুয়ে দিতেই নিজের পিঠের জামার অংশ ভিজা অনুভব করে ভিজা অংশে হাত বুলিয়ে সামনে আনতেই তা*জা র*ক্ত দেখে ভ*র*কে উঠে। তরুনিমা সন্ধ্যার দিকে লক্ষ্য করতেই ওর ডানহাতে ছোট একটা ব্লে*ড আর বাম হাতের শিরা কা*টা অংশ থেকে র*ক্ত ঝ*ড়*তে দেখতে পায়। চোখের পলকে সন্ধ্যা এমন একটা কাজ করে ফেলবে তা বুঝতে পারে নি তরুনিমা। তরু দ্রুত বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এক ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে রেলিং ধরে নিচে ড্রয়িংরুমে বসারত সবাইকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বললো…..

—“সন্ধ্যা…..সন্ধ্যা ও বাম হাতের শিরা কে*টে ফেলেছে। অনেক র*ক্ত ঝরছে সেখান থেকে….!”

তরুর মুখে এমন কথা শোনামাত্র নিচে বসারত সবাই উঠে দ্রুত কদমে সিড়ি বেয়ে উপরে আসতে শুরু করে।

চলবে ইনশাআল্লাহ…………..