হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-২১

0
771

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে ❤️
#পর্ব__২১
#কায়ানাত_আফরিন❤️
মাইশার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আয়াত। চোখের চাহিনীতে কিছুটা গাম্ভীর্যের রেশ। মাইশার ছলছল চোখজোড়াটি যেন বুক তোলপাড় করে দিচ্ছে আয়াতের। যদিও ও এখনও বুঝতে পারছে না যে মাইশার কি হয়েছে কিন্ত পরিস্থিতি দেখে কিছুটা আন্দাজ করে নিলো যে যা হয়েছে তা হয়তো মাইশার জন্য বেশ বিব্রতকর!
মাইশা যে হাত দিয়ে আয়াতের হাত চেপে ধরেছিলো সে হাতটি আরও গভীর ভাবে আকড়ে ধরলো আয়াত।চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলো যে এখান থেকে এখন ও যাবে না। নিভৃত নিস্তব্ধ এই পরিস্থিতিতে আয়াত নিজের কোমল ঠোঁটযুগল হালকা একটু নাড়িয়ে বললো,

“এই হাতটি ছাড়ার জন্য আকড়ে ধরিনি। নিজের হাতের মুষ্টিতে এই হাতের ছোয়া গ্রহণ করেছি হৃদমাঝারে তোমায় গ্রহণ করার জন্য।❤️”

কোনো মানুষের কথায় এত মোহনীয়তা কিভাবে থাকতে পারে? আয়াতের ছোট দু বাক্যের এই কথা যেন সমস্ত মোহ গ্রাস করে নিয়েছে। মাইশা কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিক। সুদর্শন এই মুখশ্রীতে একরাশ ভালোলাগা কাজ করবে যে কারও। আয়াতের হাত চেপে মাইশা তাই নীরব হয়ে বসে থাকলো ।

বেশ কিছুক্ষণ পর অর্পিকে নিয়ে হাজির হলো শাওন। অর্পিকে দেখেই মাইশা এবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শাওন হয়তো অর্পিকে বলেছে মাইশার সমস্যার কথা। তাই এসে তেমন একটা বিচলিত হলো না। মাইশার হাতের বন্ধনী একটু দুর্বল হতেই আয়াত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

” আমরা তাহলে বাইরে দাঁড়াই। তোমাদের প্রয়োজন হলে ডাক দিতে পারো।”

“ঠিক আছে।” [অর্পি]

আয়াত আর শাওন এবার দরজার সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে মাইশা বলে ওঠে,

“শাওন ভাইয়া!”

শাওন পেছনে ঘুরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো মাইশার দিকে। মাইশা মুচকি হেসে বললো,

“থ্যাংক ইউ।”

“মাই প্লেজার।”

বলে বিনিময়ে মিষ্টি হাসে শাওন। উজ্জ্বল ফর্সা ছেলেদের এমন হাসিতে মারাত্মক লাগে। আজকাল এসব পরিস্থিতিতে শাওনের মতো মানুষদের পাওয়া হয়তো দুর্লভ ব্যাপার। এমন পরিস্থিতিতে সবাই বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে পারে না যেটা হয়তো শাওন পেরেছে। মনে মনেও মাইশা তাই শাওনকে একরাশ কৃতজ্ঞতা জানালো।

————————————–

আয়াত শাওন চলে যাওয়ার পরেই অর্পি মাইশার ব্লাউজের পেছনের অংশটি বেশ কয়েকটি সেফটিপিন দিয়ে ঠিক করে দিলো। মাইশার নিজেকে অদ্ভুত লাগছে এভাবে এতগুলো সেফটিপিন লাগানোর কারনে। মিহি কন্ঠে অর্পিকে তাই বললো,

“পেছন থেকে কেমন দেখাচ্ছে রে?”

“উমমমম! কোনোমতে চলবে।”
নিজের চশমা ঠিক করতে করতে বললো অর্পি।

“কোনোমতে চলবে মানে?”

অর্পি তাজ্জব হয়ে বললো,
“তোর কি মনে হয়, ব্লাউজের পেছন দিকে সেফটিপিনের বাহার থাকলে কেমন দেখাতে পারে? একেবারেই ক্ষেত! আমি যে শাড়ির সাথে চশমা পড়ে কানা বান্দর হয়ে ঘুরছি তার থেকেও বেশি ‘ক্ষ্যাত’ ”

শেষের ক্ষেত শব্দটি টিটকারি সুরে বললো অর্পি। মূলত শাড়ির সাথে চশমা পড়াতে মাইশা ওকে থাপ্পর মেরে যে ক্ষেত কথাটি বলেছিলো তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে হয়তো।

মাইশা বললো,
” তো এখন কি করবো?”

” কি আর করবি?একে তো ব্লাউজের ফিতা ছিড়েখুঁড়ে অবস্থা খারাপ করেছিস এখন সেফটিপিন ছাড়া আর ভালো ওয়ে নাই।তবে শাড়ির আচল দিয়ে পিঠ ঢাকলেই হয়ে যাবে হয়তো।”

অর্পির কথামতো এ কাজটিই করলো মাইশা। এখন কিছুটা কম্ফোর্ট ফিল হচ্ছে বিধায় নির্লিপ্ত শ্বাস ছাড়লো।আজকের দিনটাই কেমন যেন অন্যরকম কাটছে। সবদিক দিয়েই যেন এক নতুনত্বের পরিস্থিতি।

—————————————-

অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে সুন্দরভাবে। একে একে সবাই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে থাকলো সবার নিজস্ব গন্তব্য। আকাশে মেঘ জমেছে ভালো। হয়তো যে কোনো সময়ই এ মেঘ চিরে গড়িয়ে পড়বে জলের ছোট ছোট কণা। মাইশা, আনান, পৃথা, সামাদ,অর্পি সবাই উদ্যত হলো নিজেদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কিন্ত মাইশা সেখানেই দাড়িয়ে আছে উদাসীনভাবে। অর্পি বিষয়টি বেশ,ভালোমতো খেয়াল করলো। মাইশার আচার আচরণে বিরাট এক পরিবর্তন দেখতে পারছে। অর্পি তাই আনানকে ফিসফিসিয়ে বললো,

” আচ্ছা আনান, মাইশুর কি কিছু হয়েছে রে? কেমন যেন খটকা লাগছে।”

আনান যতই বন্ধুমহলে মজার মানুষ হয়ে থাকুক না কেন, সবার ব্যপারেই প্রচন্ড খেয়ালি ও। মাইশার এ পরিবর্তনটি আনান অনেক আগেই ধরতে পেরেছিলো। কিন্ত বিষয়টি অর্পিকে বুঝতে না দিয়ে বললো,

“আরে তেমন কিছু না। এই মেয়ে তো আগের থেকেই ভাবুক রাণী, আবারও তেমন কিছু হয়েছে হয়তো।”

“ওওওও।”

“আরে এই মাইশা? পায়ে কি সুপার গ্লু লাগাইয়া রাখসোস? বাসায় যাবি না?”
আনানের উদ্দেশ্যমুলক কন্ঠ।

“তোরা যা, আমি একা যেতে পারবো।”

” দেখ, বৃষ্টি পড়বে মনেহয়। তুই এক্ষুনি আমাদের সাথে যাবি। যদি তোর বদমাইশ ভাইটা শুনে যে তোরে একা রেখে আমরা চলে গেসি আমাদের সবক’টারে জুতা পিটা করবো ওই হালায়।”

আনানের কথায় বিরক্ত বেশ বিরক্ত হলো মাইশা। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” আমার ভাইয়ের জুতাপিটা খাবি নাকি এখন আমার চড় খাবি? বলসি না যে আমি যেতে পারবো। ভালোয় ভালোয় চলে যা নয়তো তোর আকাম কুকাম সব তোর বাপের কানে লাগামু। এখন দূর হ।”

আনানের হাওয়া এবার টাইট হয়ে গিয়েছে। অপামনে থমথমে হয়ে তাই আনানাসহ বাকিরা চলে গেলো ক্যাম্পাস ছেড়ে।

মাইশা এবার আশপাশে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটতে শুরু করেছে।জাহাঙ্গীরনগরের ক্যাম্পাসটি এককথায় বিশাল। সাথে বেশ সুন্দরও। এখানে আসলে যে কারওই মনটা কাব্যিক হওয়ার জন্য আনচান করবে। সেই সুন্দর পথের ভেতর দিয়ে আপনমনে হেটে চলছে মাইশা। মুখ দিয়ে গুনগুন করে বের হচ্ছে মিষ্টি কিছু সুর। কেমন যেন একধরনের বৃষ্টিময় সুবাসে সর্বত্র মেতে ওঠেছে।

“এখনও বাসায় যাওনি তুমি?”

এত সৌন্দর্যের ভীড়েও এই কন্ঠ শুনে বুকে তোলপাড় শুরু হলো মাইশার। সামনেই আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। মাইশা উদাসীনভাবে বললো,

“উহু! যেতে ইচ্ছে করছে না।”

“যেতে ইচ্ছে করছেনা আবার কেমন কথা? একটু পর বৃষ্টি পড়বে তো।”

“পড়ুক। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই বাড়ি যাবো।”

আয়াতের ভ্রু আপনাআপনি কুচকে কেন মাইশার এই কথাটি শুনে। তাই অবাক নয়নে বললো,

” হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে তোমার? ”

“ইচ্ছে তো হচ্ছে, কিন্ত,”

“কিন্ত কি? ”

“আজ বৃষ্টি হবে না।”

আয়াত গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকলো মাইশার দিকে। এমন চাহিনীতে বেশ মজা পাচ্ছে মাইশা। ছেলেটার অবাকমিশ্রিত চাহনিটা আসলেই ঘায়েল করার মতো। আয়াত এবার বললো,

“আর ইউ ফাইন মাইশা?এত উদ্ভট কথা বলছো কেন? এই বললে বৃষ্টিতে ভিজবে আর এই বললে বৃষ্টি হবেনা? মানে?”

“আজকে আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি আজকে হবে না। গুগলে ওয়েদার চেক করেছি, তাই বললাম আরকি।”

ঠোঁট কামড়ে কথাটি বললো মাইশা। আয়াত এবার বলে ওঠলো,

” উহ! তুমি আমায় বিভ্রান্ত করার পরিকল্পনা নিয়েই মনে হয় আমার কাছে এসেছ। অনেক হয়েছে উদ্ভট কথবার্তা। এখন বাসায় যাও। ওয়েট! আমিই তোমাকে দিয়ে আসছি।”

“আপনি কেনো দিয়ে আসবেন? আমি একাই যেতে পারবো। ছোটো বাচ্চা নাকি আমি?”

মুচকি হাসলো আয়াত। চোখের দৃষ্টিতে দুষ্টুমির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নিজের মাথাটি হালকা নিচু করে মাইশার মুখের কাছাকাছি আসলো আয়াত। মাইশা পিছতে চেয়েও পারলো না অনুভূতির বেড়াজালের কারনে। আয়াত ঠোঁট নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে ওঠলো,

“আরহাম আয়াত নিজের পছন্দের জিনিসটা একা ছাড়ে না ম্যাম!আর তুমি তো নিতান্তই আমার হার্টবিট তাহলে তো একা ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি মরে যাবো যে!”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মাইশা।আয়াত সপ্রতিভ দৃষ্টিতে ইশারায় আসতে বললো ওর সাথে। মাইশাও তাই করলো বিনাবাক্যে। আর করবেই না বা কেন? সর্বত্র যেন “আরহাম আয়াত” নামের এক মায়াবী জাল ওকে ঘিরে ধরেছে। আপনমনে তাই মৃদু কন্ঠে বললো,

“ইসসসস, আপনার এমন নেশাজড়ানো কন্ঠে পাগল হয়ে যাই তো আমি। আপনি কি তা বুঝেন না?❤️”

#চলবে……ইনশাল্লাহ