#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤️
#পর্ব ১৯+২০
#কায়ানাত_আফরিন❤️
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ রমরমা ভাব। চারিদিকে যেন আনন্দের ছড়াছড়ি। ঢাকার বিভিন্ন পাবলিক আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সমাগমে যেন অনুষ্ঠানটি আরও মুখরিত হয়ে উঠেছে। অদম্য কৌতুহল নিয়ে তাই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো মাইশা আর ওর বন্ধুরা। অর্পির সাথে ম্যাচিং করে নীল শাড়ি পড়েছে মাইশা । আর নীল রং বরাবরই নিজের প্রিয় রং বলে দাবি করে ও। মুখে মেকআপ, চুলটা খোপা করে বেলী ফুলের মালা দিয়ে গাঁথা এতে এককথায় অপ্সরী মনে হচ্ছে ওকে। এদিকে অর্পির মুখ থমথমে। মুখ কালো করে একপ্রান্তে বসে আছে। সামাদ তা দেখে বললো,
“এভাবে মুখ কালো করে আছিস কেন?”
আনান টিটকারি মেরে বললো,
“মাইশা এর গালে হাত দিয়ে আদর করসে তাই!”
অর্পি এবার ন্যাকা কান্না করে বললো,
“আর বলিস না সামাদ! আমি শাড়ির সাথে চশমা পড়ে ছিলাম বলে এই অসভ্য মেয়েটা আমায় থাপ্পড় মেরেছে! ”
মাইশা ওর কথায় ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললো,
“তো তোর গালে চুম্মা দিতাম নাকি। ফাজিল মেয়ে, শাড়ির সাথে কেউ কি চশমা পড়ে। পুরাই ক্ষেত লাগে দেখতে।”
“চশমা ছাড়া আমি তো কিছুই দেখতে পারিনা। তো কি করবো বল?”
মিনমিন করে বলে ফেললো অর্পি। মাঝে মাঝে অর্পির এসব ছিচকান্দুনে ভাবগুলো অতিষ্ঠ করে ফেলে সবাইকে। আনান এবার তাই বিরক্ত হয়ে বললো,
” এল্লেগাই আমার দাদি বলতো বেশি কইরা পুঁটি মাছ খাইতে। তাহলে এই জীবনে কখনোই চোখে সমস্যা হইবো না। আর তুই? পুটিমাছ দেখলেই তো পালাই পালাই করস। আন্টি কান মলা দিয়াও তোরে পুটিমাছ খাওয়াইতে পারে না। এখন শাড়ির সাথে পড় চশমা! পুরাই কানা বান্দর লাগবো।”
আনানের টিটকারি শুনে চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো অর্পির। পৃথা তাই বললো,
“হইসে আর কথা বাড়াতে লাগবো না। এবার বল তো আমায় কেমন লাগছে?”
“তোরে সুন্দর লাগলেই বা কি হইবো?তুই হলো সামাদের বুকিং জিনিস। আর এসব জিনিসের রিভিউ আমি দেই না।” (আনান)
দমে যায় পৃথা। এখন কোনো কথা বললেই এই ছেলেটা ওর মানসম্মান সব জলে ভাসিয়ে দেবে। ওদের কথার মাঝেই মাইশার হঠাৎ চোখ গেলো ক্যাম্পাসের অন্য একটি প্রান্তে। আয়াতকে দেখা যাচ্ছে ওখানে। কালো পান্জাবি পড়াতে যেন ওর সমস্ত সৌন্দর্য উপচে পড়ছে শরীর থেকে। আর কথা বলার ভঙ্গিমাও মাশাল্লাহ! এমন ছেলের প্রেমে কি না পড়ে আর পারা যায়।
মাইশাকে এভাবে উদাসীন হতে দেখে অর্পি বলে ওঠলো,
” কি রে? এভাবে কি দেখছিস?”
“তেমন কিছু না, আয়াত ভাইকে দেখছিলাম।”
অর্পির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো মাইশার এ কথা শুনে। তাজ্জব হয়ে বললো,
” তুই…….আর আয়াত ভাইরে দেখছিস?”
“ওমা! আয়াত ভাই যদি দেখার জিনিস হয়, মানুষ তারে দেখবো না? আফটার অল এই ছেলেটা এখন মাইশার কাজিন ব্রাদার হয়েছে, আর যাই হোক এখন আর থাপড়া-থাপড়ি, ছুঁড়াছুড়ি চলবো না।”
পৃথার এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে মাইশা কিছুই বললো না। আর তাছাড়া অনুষ্ঠানের সময় হয়ে যাচ্ছে বিধায় সবাইকেই যেতে হলো স্টেজের সামনে।
অডিটোরিয়ামে যেতেই শাওনের মুখোমুখি হলো মাইশা। আজ শাওনও কালো পান্জাবি পড়েছে। তবে ওর বুকের কাজটা আয়াতের পান্জাবির ডিজাইন থেকে কিছুটা ভিন্ন। চুলগুলো সুন্দরভাবে পেছনে সেট করে রাখাতে ভালো লাগছে দেখতে।শাওন মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“হ্যালো মাইশা!”
“হ্যালো।” (মাইশা প্রতিউত্তরে বললো)
“বাহ! তোমাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে। তো তুমি আর অর্পি কি সেম শাড়ি পড়েছ নাকি? দুজনকেই চমৎকার লাগছে।”
“আপনি আর আয়াত ভাইও তো সেম পান্জাবি পড়েছেন।”
“উহু! আমাদের কালার সেম হলেও ডিজাইনে একটু ভিন্নতা আছে। আচ্ছা, এখন এসব কথা থাক। তোমরা বসো সবাই। আর মাইশা? তুমি আমার সাথে স্টেজে চলো। একটু পড়েই তোমার উপস্থাপনা করতে হবে। introduction টা তুমি দিবে আর বাকিগুলো স্টেপ বাই স্টেপ অন্যরা করবে।”
“জ্বি ঠিকাছে।”
তারপর শাওনের সাথেই স্টেজের পেছন দিকে গেলো মাইশা৷ উত্তেজনায় বুক কিছুটা ধুকধুক করছে। এমন না যে উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা ওর প্রথম কিন্তু এবার মনের মধ্যে অন্যরকম সব ভাবনাগুলো কাজ করছে। কয়েকদম শুকনো ঢোক গিয়ে নিজের মনকে স্থির রাখলো মাইশা৷ হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
“এত স্ট্রেস নিচ্ছ কেনো ?”
মাইশা পেছন ফিরে দেখলো আয়াত। দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে একধরনের প্রেমময় হাসি। চোখের চাহিনীও তীব্র। এমন দৃষ্টিতে মাইশা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আয়াত আবার বললো,
“তুমি জানো স্ট্রেস নিলে তোমাকে ঠিক কেমন লাগে?উমমমম, পুরাই একটা কিউট বিড়ালের মতো। তাই এত স্ট্রেস নিও না। কেউ বিড়াল ভেবে আবার ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।”
আয়াতের এমন কথাবার্তায় মাইশা মাথা নিচু করে ফেললো। মাঝে মাঝে আয়াতকে মাইশার বড্ড রহস্যময় মনে হয়। আয়াত ওকে বিভ্রান্ত হতে দেখে কিছুটা এগিয়ে এলো মাইশার কাছে। তারপর ক্ষীণ গলায় কানের কাছে বললো,
“এভাবে সাজার মানে কি ম্যাম? আমাকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছো নাকি?
” মোটেও না।”
“মনে তো হয় না। আচ্ছা এসব কথা এখন থাক। টেনশনে মুখটা আতুম ভুতুম বানিয়ে রেখো না। Take a deep breath and best of luck..❤️”
এ কথা বলে নিঃশব্দে চলে গেলো আয়াত। মাইশা কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এখন আয়াতের মায়াবী কথার জালে ভাবুক হয়ে গেলে চলবে না। নিজের মনকে স্থির রাখতে হবে।
—————————————–
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনটি সুন্দরভাবে হয়েছে। দেশের অনেক বরেণ্য ব্যাক্তিবর্গ এসেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অনুষ্ঠানটিতে। উপস্থাপনার প্রথম ভাগ নিপুনভাবে করলো মাইশা৷ আপাতত তার কাজ শেষ। বাকি ভাগগুলো অন্য শিক্ষার্থীরা সম্পন্ন করবে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধীরপায়ে স্টেজের পেছন সিড়ি দিয়ে মাইশা নেমে গেলো। এখন আনান,সামাদ, পৃথা আর অর্পিকে এই মানু্ষের ভীড়ে খুঁজে বের করতে হবে।
বেশ কিছুদূর এগিয়েই আশপাশে মাইশা খুজতে লাগলো সবাইকে। কিন্ত বিশাল এই মানুষের সমারোহে এতটাও তা সহজ না। মাইশা সামাদকে কল কল করতে গিয়ে দেখলো যে মোবাইলে ব্যালেন্স নেই৷ মুখে তাই বিরক্তিকর আভাস ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্ত এর মধ্যে এতটা বেখেয়ালি যে মাইশা হয়ে যাবে এটা ও বুঝতে পারেনি। স্টেজের সাথে থাকা সরু লোহার রডের সাথে ব্লাউজের ফিতা পেচিয়ে যাওয়াতে হুট করেই ফিতার এক অংশ ছিড়ে আটকে গেলো ওই রডটিতে। বিষয়টি বোঝা মাত্রই শঙ্কা ঢুকে যায় ওর মনে। রাগে দুঃখে নিজের অসাবধানতার জন্য গালি দিতে ইচ্ছে করছে নিজেকে৷ শাড়ির আচলটি দিয়ে তাই সাবধানে নিজের পিঠ ঢেকে নিলো। তবুও কাঁধের পাশটির ঢিলটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
আশপাশে তাকালো মাইশা। পরিচিত কেউই নেই। আর থাকলেই বা কি উপায় আছে। দুটো ফিতার একটি তো ছিঁড়েই গিয়েছে। এখন অর্পি বা পৃথাকে খুব দরকার। কিন্তু অর্পি বা পৃথা তো দূরে থাক, আশপাশে তেমন কোনো মেয়েকেই দেখা যাচ্ছে না। এক অজানা আশঙ্কায় ছলছল করে উঠলো মাইশার চোখজোড়া।
ঠোঁট চেপে নিজের এই করুন পরিস্থিতিটা মানিয়ে নেয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছে। তখনই হঠাথ শাওনকে দেখে মনে আশার আলো জাগলো মাইশার। গলাটি হালকা উচিয়ে বললো,
“শাওন ভাইয়া…!”
মাইশার কন্ঠ পেয়ে শাওন সেদিকে তাকিয়েই যেন অবাক৷ মেয়েটা স্টেজের এক কোণে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পানি যেকোনো সময়তেই যেন উপচে পড়বে। শাওন সেদিকে গিয়েই বললো,
“এনি প্রবলেম মাইশা? এতটা প্যানিক দেখাচ্ছে কেনো?”
“এখানে কোথাও রেস্টরুম আছে? ”
“আছে তবে সেটা volunteer দের জন্য। তবে তুমি চাইলে ম্যানেজ করে দিতে পারবো।”
“তাহলে করে দিন না ভাইয়া! আমি অনেক বড় প্রবলেম এ পড়েছি।”
মাইশার চোখে মুখে উদ্ভ্রান্ত ভাবটা স্পষ্ট ফুটে ওঠাতে শাওন বিনাবাক্যে ওকে রেস্টরুমে নিয়ে গেলো। রেস্টরুমে আসতেই মাইশা শাওনকে বললো,
“ভাইয়া অর্পি বা পৃথাকে দেখেছেন?”
“না তো! তবে আমি ডাক দিয়ে নিয়ে আসি? কেননা বাইরে এত সাউন্ড যে কল দিলেও ওরা শুনতে পারবে না!”
মাইশা সাথে সাথেই চেচিয়ে বলল
“প্লিজ যাবেন না। আমি একা এখানে সেকিউর থাকবো না।”
শাওন নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মাইশার দিকে।মিহি কন্ঠে বললো,
“আমায় নিজের ফ্রেন্ড মনে করো মাইশা। মনে করো আনান বা সামাদের মতো আমি তোমার একজন ফ্রেন্ড। ”
মাইশা নীরব।
“বলোতো, কি হয়েছে তোমার?”
“আ-আমার ব্লাউজের ফিতে ছিড়ে গিয়েছে ভাইয়া……..”
মাইশার এই কথার মাঝেই দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“কি রে শাওন, কল দিচ্ছি ধরছিস না কেন?”
মাইশা, শাওন দুজনেই মাথা ঘুরিয়ে দেখলো আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। আয়াত ইতিমধ্যে কিছুটা অবাক। মিহি কন্ঠে বললো,
“এনি প্রবলেম?”
“আয়াত, তুই এখানে মাইশার সাথে থাক। আমি অর্পিকে নিয়ে আসছি। ”
” কিন্ত হয়েছেটা কি?”
শাওন একটা নির্লিপ্ত শ্বাস নিয়ে বললো,
“আমি অর্পিকে নিয়ে আসছি।”
শাওনের কথার আগামাথা আয়াত যেন কিছুই বুঝলো না। তাই শাওনের পিছু পিছু আয়াত যেতেই ওর হাত চেপে ধরলো মাইশা। আয়াত এবার অবাকের শীর্ষে। কেননা মাইশা কখনোই এভাবে আয়াতের হাত স্পর্শ করেনি। মাইশা কাতর কন্ঠে বললো,
” আমায় একা রেখে যাবেন না প্লিজ!”
মাইশার কন্ঠে প্রকাশ পাচ্ছে আয়াতের প্রতি বিশ্বাস। এই দৃষ্টি অনুভব করে অদ্ভুত এক অনুভূতির জোয়ার তৈরি হলো আয়াতের মনে। যেন মুখে না বললেও মাইশার অন্তরে অন্তরে আয়াতের জন্য লিখা #হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤️
,
,
,
#চলবে……ইনশাল্লাহ
প্রত্যেককেই মতামত দেয়ার জন্য অনুরোধ রইলো।