হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0
888

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব_৪৫ {অন্তিম}
#কায়ানাত_আফরিন❤

”তুমি যেমন তোমাকে আমি তেমনভাবেই ভালোবাসি মাইশু। এই হাত না ছাড়ার কথা যখন দিয়েছি, তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই হাত ছাড়বো না। আমি এক নারীতেই আসক্ত হতে চাই। মনেপ্রাণে বলতে চাই , ‘যত কঠিক পরিস্থিতিই হোক না কেন?এই মাইশুপাখিটা শুধুমাত্র আরহাম আয়াতের❤!”

আয়াতের আড়ষ্ট কন্ঠে এক অন্য জগতে চলে যাচ্ছে মাইশা। বাথরুমে এখন কেবল শোনা যাচ্ছে ঝর্ণা থেকে গড়িয়ে পড়া অজস্র জলধারার প্রতিধ্ধনি। মাইশা আয়াতের বুকে থাকা অবস্থাতেই তপ্ত শ্বাস ছাড়লো কয়েকবার। আয়াত পুনরায় বললো,

–যে ভুল করেছে সে উপযুক্ত শাস্তি পেয়ে যাবে মাইশু। তাহলে তুমি এত কষ্ট পাচ্ছো কেনো? সে তোমায় শুধু কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্ত সে যে সফল হয়নি তা তুমিও জানো এবাং আমিও জানি।

-যা করেছে সেটাও আমি ভুলতে পারবো না আয়াত!

আজ প্রথমবার আয়াতকে ওর নাম ধরে সম্বোধন করলো মাইশা। আয়াতের নির্বিকারভাবে শাওয়ারের নিচে মেয়েটাকে বুকে আগলে রেখেছে। মাইশার শরীর এখন বরফের মতো শীতল। একটু একটু কাপছে তাই। আয়াত তাই একহাত দিয়ে শাওয়ার বন্ধ করে মাইশাকে ভেজা অবস্থায় রেখেই বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।ওর পরনে প্যান্ট থেকেও পানি চুয়ে চুয়ে পড়ে ঘর ভিজে গেলো খানিকটা। আয়াত সেদিকে নজর না দিয়ে দ্রুতহাতে ব্যাগ থেকে জামা আর তোয়ালে বের করে মাইশার কাছে দিয়ে আসলো। বাইরে মৃদু বৃষ্টিমুখর ভাব। তবে আজকে ওয়েদার যা বোঝাচ্ছে, মূলত বৃষ্টি হবেনা। শুধুমাত্র একগুচ্ছ কালো মেঘের আস্তরণ এই নিশি আকাশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। জানালাটা খোলা থাকার কারনে বাতাসের তালে শব্দ সৃষ্টি করছে বারবার । আয়াত রুমে নিজের জামাকাপড় পাল্টে জানালার ধারে অনিমেষ চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

মাইশাও বেরিয়ে এলো ইতিমধ্যে। জানালার কাছে আয়াতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলো না আর। এতক্ষণ পানির সংস্পর্শে থাকার কারনে একটু শীত শীত করছে। হঠাৎ হাচির শব্দেই আয়াত পেছনে ঘুরলো মাইশা দাঁড়িয়ে আছে অপ‍‍্রস্তুতভাবে। আয়াত এবার মৃদু গলায় বললো,

–আমি জানতাম এমন কিছুই হবে।

বলেই আয়াত মাইশার হাত টেনে খাটে বসিয়ে দেয়। মাইশার হাত থেকে তোয়ালে কেড়ে নিয়ে চুলগুলো মুছে দিচ্ছে সন্তর্পণে। মাইশা দুহাতে খাটে রেখে পাথরের ন্যায় বসে রইলো। মনে কাজ করছে জানা-অজানা নানা সুক্ষ্ণ অনুভূতি। চুলগুলো ভালোমতো মুছে দেয়ার পর আয়াত হাটুগেড়ে বসে পড়লো মাইশার কাছে। ওর ফর্সা মুখ অনেকটা বিবর্ণ হয়ে আছে। চুলগুলো ভিজে থাকার কারনে কপালে আটসাট হয়ে রয়েছে। একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো আয়াত । উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

–তোমার এক একটা কথা যে ঠিক কিভাবে আমার বুকে আগুন লাগাচ্ছিলো তুমি জানো? এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারলে তুমি যে মরে যাওয়ার কথা বলা শুরু করেছো এখন? তোমার এক একটা কথার ওজন তো কয়েকশ’ টনের মতো আছড়ে পড়লো আমার বুকে।কষ্ট কি তোমার একা হয়েছে? মোটেও না…………..আমিও কষ্ট পেয়েছি অনেক, আকাশ ছোয়া কষ্ট। তখন বলা তোমার প্রতিটা কথা তীরের মতো বিধেছে আমার বুকে। কিন্ত প্লিজ ! এরকম কথা আর বলো না মাইশু। আমার একটু ভুলের জন্য তোমার যদি আবার ক্ষতি হয় তবে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো।

এই আয়াতকে অস্থির দেখাচ্ছে। মাইশার চোখ গিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের অবাধ্য ধারা। আয়াত কাল বিলম্ব না করে হুলস্থূলভাবে নিজের ওষ্ঠ্যদ্বয়ের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললো মাইশার ওষ্ঠ্যে। এই প্রথম ! এই প্রথম একটা নতুন ছোয়ায় হারিয়ে গেলো দুজনে………..যেখানে শুধু ভালোবাসার অস্তিত্বই প্রবলভাবে রয়েছে। মাইশা আবেগে জর্জরিত নিজের হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কাপাকাপা হাতে স্পর্শ করলো আয়াতের চিবুক।

বেশ কিছুক্ষণ পর আয়াত জরিয়ে ধরলো মাইশাকে। এতটাই জোড়ে চেপে ধরেছে যে ওর হাড্ডিগুলো বোধহয় ভেঙ্গে যাবে। আয়াত তা বুঝতে পারলো কি-না কে জানে? তবুও কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলো,

–আমার স্পর্শে তোমার সমস্ত যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেবো মাইশু। কতটা সীমাবদ্ধতায় আমায় থাকতে হয়েছিলো জানো?তোমার উদ্ভট পাগলামিতে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লেও কখনও সাড়া দেইনি। কিন্ত তোমার এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না ! আজকের এই খারাপ দিনটাকে আমি সুন্দর মুহূর্তে পরিণত করতে চাই।

মাইশার কি হলো সে জানেনা। শুধু নির্বিকারভাবে আয়াতের বুকে মিশে ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকলো। বুকে অজস্র বার ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,

–আমি ভালোবাসি তোমায় আয়াত! এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারবো না।

আয়াত স্তব্ধ হয়ে আছে। মাইশার মাথায় হাতের বিচরণ চালাচ্ছে আলতো ভাবে।বাইরে হালকা হাওয়া বহমান। ফুলের একটা তীব্র ঘ্রাণ পরিবেশটাকে মোহনীয় করে তুলছে। আজই হয়তো গাজীপুরে শেষ রাত। মাইশার সাথে এই রাতের প্রহরটা আকষ্মিক হলেও আয়াত মুগ্ধতার সাথে তা সামলে নিলো।

~”এই বৃষ্টিময় রাত্রিতে তোমায় প্রবলভাবে আঁকড়ে রাখবো ‘মাইশুপাখি’!”

—————————————

একটি প্রবাদ আছে , ‘সময় আর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করেনা’। ঠিক তেমনিভাবে সময়ের তালে সবকিছু এগিয়ে চলেছে নিজস্ব গতিতে। মাসুদ তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে এবং অর্পির মা আমেনা বিবিও সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের নিচু মনমানসকিকতার জন্য। যারা মাইশাকে দোষারোপ করেছিলো পরবর্তীতে নিজেরাই তারা অনুতপ্ত হয়েছেন ব্যাপারটিকে এত রসালো করে তোলাতে। পরবর্তী এ বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বাড়াবাড়ি হয়নি, বা কেউ চেষ্টা করেও যেন পারেনি। মাইশার সাথে প্রতিটা মুহূর্তে ছিলো ওর পরিবার, বন্ধুমহল আর সবচেয়ে কাছের মানুষ, আয়াত। যার সাপোর্ট ছাড়া হয়তো মাইশা এতদূর এগিয়ে আসতে পারতো না।

ওদের বিয়ে হওয়ার পরপরই আয়াত কাজে মন দেওয়া শুরু করেছে। বাবার ব্যবসাটা সামলানো প্রথমে ওর জন্য কষ্টকর হলেও নুহাশের সাহায্য নিয়ে তা অনেকটাই এগিয়ে নিতে পেরেছে।বিয়ে করেছে শাওনও। বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে। মেয়েটার নাম নিশি। অ্যারেন্জ ম্যারিজ হলেও প্রথম দেখাতে যে কেউ বলতে বাধ্য ওদের লাভ ম্যারিজ। কেননা অল্প সময়ের মধ্যেই একে অপরকে ওরা মানিয়ে নিয়েছে। সামাদ-পৃথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে শীঘ্রই। শুধু বাকি রয়ে গেলো আনান। মেয়ে দেখতে নিয়ে গেলে এতটাই উদ্ভট প্রশ্ন করে বসে যে মেয়ে পড়ে হাতে পায়ে ধরে বলে,

–ভাই আপনার পায়ে পড়ি। আমারে বিয়ে করবেন না।

অতঃপর আনানের এসব কান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ধরেই নিলো এই ছেলে আর মনের মতো বউ খুঁজে পাবে না। এভাবেই দিন চলে যাচ্ছে সবার। মাইশা এখন অনেকটা প্রাণবন্ত। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে, আয়াত অফিস থেকে এলে ওর সবকিছু গুছগাছ করে রাখে, এককথায় আগের তুলনায় বন্ধন যেন আরও গভীর হয়েছে। কিন্ত আয়াতের একটি বিষয় নিয়ে বড্ড অতিষ্ঠ মাইশা। ছেলেটা কাউকে না বলে এখনও হুটহাট করে শাওনের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে যায়। মাইশা এ নিয়ে প্রচুর অভিমান করলেও আয়াত পরবর্তীতে এমনভাবে ওকে বোঝায় যে মাইশা না হেসে পারেনা। তবুও আয়াত বারবার একই কাজ করে চলছে। আজ বিকেলেও ঘটলো এমন ঘটনা। আয়াত ওর মোবাইলে টেক্সট করলো যে , আজ আসতে আসতে ভোর ৪ টা কি ৫ টা বাজবে। লং ড্রাইভে যাবে শাওনের সাথে।

এটা থেকে মনে পাহাড় সমান অভিমান জমে ওঠলো মাইশার। আজ ওদের বিয়ের এক বছর হতে চলছে আর এই ছেলেটা কি তবে তা ভুলে গেলো। আজ সারাদিন রাহেলা বেগমের সাথে খেটে কত কিছু রান্না করেছে আয়াতের পছন্দের খাবার ছেলেটার আদৌ সেটার হদিস আছে? এতদিন তো ঠিক ছিলো তবে আজ এই কাজটা না করলে পারতো না? এত নিষ্ঠুরের মতো কিভাবে মেসেজ দিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গেলো? না! আয়াতকে একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। এতদিন আয়াত না বলে হুটহাট ঘুরতে গিয়েছে না! আজ মাইশাও সেই কাজ করবে। কথামতো তাই কল দিলো আনানকে।

—————————————

ট্রেনের ঝকঝক শব্দে আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে চারিপাশে। রাতের আধারে বাহিরে দেখা যাচ্ছে মস্ত বড় একটা চাঁদ। কি ফুরফুরে এখানকার হাওয়া! যেন সেই স্পর্শে মানুষ অন্যত্র হাড়িয়ে যাবে। ট্রেনের বগিতে ক্লান্ত ভাবে বসে আছে অর্পি , আনান আর মাইশা। অর্পির ঘুমুঘুমু শরীর এলিয়ে পড়েছে মাইশার কাধে। আর আনান মনে মনে দরূদ পড়তে ব্যস্ত। অর্পি তা দেখে বললো,

–কি রে আনাইন্না? এমনে দরূদ পড়ছোস যে! তুই তো ট্রেনে ভয় পাওয়ার মতো মানুষ না!

–আমি তো আছি আমার চিন্তায়।একে তো নুহাশ ভাই আমারে বললো তোদের দুটারে পৃথার বাসায় নিয়ে যেতে । শেষে কি ওয়ার্নিং দিলো, ব্যাডার পরানের বউ আর বইনের যদি কিছু হয়……….আমারেও তবে কিছু করে ফেলবে ! এদিকে এই মাইয়াটায় আয়াত ভাইরে না বইলা আইসে। যদি আয়াত ভাই ওদিকে জানে আমি তার বউরে নিয়া ভাগছি, আমার তো তবে গর্দান কাটা যাবো। ওগুলা কি তোরা বুঝবি? পড়সি তো আমি মাইনক্যার চিপায়।

মিটমিটিয়ে হাসলো দুজনে। আনানের এরকম অবস্থায় যেন ওরা না হেসে পারছে না। ট্রেন ঢাকা ছেড়ে অনেক দূরে এগিয়ে এসেছে। আর দু’তিন ঘন্টা পেরোলেই তা পঞ্চগড় স্টেশনে গিয়ে থামবে। তাছাড়া বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তে পঞ্চগড় হওয়ার এখানে ঠান্ডার প্রকোপ অনেকটাই বেশি। তাই যতই উত্তরে এগোচ্ছে তারা……………..ততই শীতল অনুভূতি হচ্ছে। আচ্ছা, আয়াত যদি জানে যে সে বাসায় নাই , তাহলে আয়াতের রিয়্যাকশন কেমন হবে? ছেলেটা কি আদৌ বুঝতে পারবে ওর রাগের কারন? শীতের কারনে চোখে ঘুম ভর করেছে মাইশার। এখন ঘুমোলে মন্দ হয় না।
.
.
রাত্রির শেষ প্রহর কেটে ঘনিয়ে এলো ভোর। আকাশ পরিষ্কার হওয়া শুরু করেছে। ট্রেনের জানালার ফাঁক দিয়ে হয়তো কিছুমুহূর্ত পড়েই আলো আছড়ে পড়বে।ট্রেন এখন থেমে আসে পঞ্চগড় স্টেশনে। পিটপিট করে চোখ খুললো মাইশা। অর্পি ওর কাধে মাথা দিয়েই ঘুমিয়ে আছে। চশমা আর আগের জায়গায় নেই। নিচে পড়ে যাওয়াতে ভেঙে গিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাইশা। এবার এই মেয়ে যে ঘুম থেকে উঠেই ”কিছু দেখতে পাচ্ছিনা” গান শুরু করবে এটা নিশ্চিত।

–উঠেছো তাহলে?

কারও শক্ত পুরুষালি কন্ঠে সাথে সাথে সেখানে তাকালো মাইশা। বিস্ময়ের একেবারে চরম পর্যায়ে উপনীত মেয়েটা। আনানের পাশে আয়াত বসে আছে। আনান সিটে মাথা এলিয়ে নাক ডাকতে মগ্ন। আর আয়াতের চোখ-মুখ দুর্বল………চুলগুলো এলোমেলো, পরনে গতকালের সেই অফিসের জামা। মাইশা চেচিয়ে বলে উঠলো,

–আনান ! জলদি উঠ !

মাইশার চিৎকারে আনানসহ অর্পিও উঠলো। বগিতে থাকা বাকি লোকজনও ব্যাগ নামাতে নামাতে বিরক্তি ভঙ্গিতে মাইশার দিকে তাকালো।আনান পাশে ফিরে আয়াতকে দেখতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। কাপাকাপা গলায় বললো,

–ভাই আ-আপনি?

–ইচ্ছে তো করছে নুহাশ ভাইয়ের মতো ঠেসে ঠেসে দুটা চড় মারি। আমার পার্মিশন ছাড়াই আমার বউরে নিয়ে আসছো তুমি!

আনান বেচারা পারছে না শুধু কাদতে।বিচলিত হয়ে বললো,

–আমারে কি আপনাগো মানুষ মনে হয় না ?বউ কয় ওরে না নিয়া গেলে মারবো এদিকে জামাই কয় নিয়া আসছে দেইখা মারবো! আমার গালরে কি সরকারি সম্পদ পাইসেন নাকি?

আয়াত চোখ গরম করে মাইশার দিকে তাকালো। তারপর বললো,

–একটু লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম অফিস থেকে ।তোমার যাওয়ার তিন-চারঘন্টা পর শুনি যে তুমি নাকি পঞ্চগড় যাচ্ছো।তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে হাইওয়ে দিয়েই এখানে আসতে হলো। একফোটাও ঘুমাইনি টেনশনে। এই মেয়ে ! এমন বাচ্চামোর মানে কি? তুমি কি জানো না যে রাতে তোমায় ছাড়া আমার ঘুম হয় না?

শুকনো কাশলো আনান আর অর্পি। মাইশা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেনের বগি আর স্টেশনও জনশূণ্য হয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। কেমন যেন একটা সুনসান অনুভূতি। মাইশা উঠে দাঁড়ালো ব্যাগ নিয়ে। আয়াতের দিকে না তাকিয়েই বললো,

–ঘুম না হলে ঘুমানোর অভ্যাস করো। তুমি যেমন শাওন ভাইয়ের সাথে এদিক ওদিক ঘুরো আমিও এখানে আমার বন্ধুদের সাথে এক প্রিয় বন্ধুর বাড়িতে এসেছি। আর খালামণিও পার্মিশন দিয়েছে। এখন যেভাবে এসেছো , ওভাবেই ফুট হও। আনানরে আর একটা ভয় দেখালে আমাদের প্রথম দেখার মতো গাল লাল করে দিবো।

ট্রেন থেকে নেমে পড়েছে মাইশা। সাথে পেছন পেছন আয়াত-আনান আর অর্পিও। পুরো প্ল্যাটফর্ম একেবারে জনশূণ্য। দূর দূর কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছেনা যেন অনায়াসেই দিন-দুপুরে zombie movie এর শুটিং করতে পারবে। আয়াত হাত চেপে ধরলো মাইশার। আনান আর অর্পিকে বললো,

–তোমরা যাও। আমি ওকে নিয়ে আসছি।

–মোটেও না। আমি ওদের সাথেই যাবো।

আনান মলিন সুরে বললো,”ভাই! ওরে নিয়ে যাই…………”

আয়াত কঠোর চোখে তাকাতেই তপ্তশ্বাস ছাড়লো আনান। অর্পিকে নিয়ে একাই তাই চলে গেলো পৃথার বাড়ির উদ্দেশ্যে। মাইশা কাদো কাদো সুরে বললো,

–তুমি অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছো। আমি আসাতে তোমার খারাপ লাগে আর তুমি যখন হুটহাট করে ফুড়ুৎ হয়ে যাও তখন আমার খারাপ লাগে না!

আয়াত হাসলো বিনয়ী ভঙ্গিতে। মেয়েটা যে মনে ক্ষোভের পাহাড় পুষিয়ে রেখেছে এ নিয়ে আর দ্বিমত নেই। আর ওদের বর্ষপূর্তির কথাও তো ভুলে গিয়েছিলো আয়াত। মাইশা যখন রাগ করে চলে যায় পরে আরিয়া ফোন করে জানিয়ে দেয় সবকিছু। আয়াত এক হাত মাইশাকে কাছে টেনে আনলো। মাথা নিচু করে এক কানে আলতোভাবে হাত স্পর্শ করে বললো,

–সরি মাইশু?

আয়াতের কোমল কন্ঠ। এই কন্ঠে মাইশার মনের বরফ গলে যেতে থাকলো নিমিষেই। মুখের রাগীভাব কর্পূরের মতো উড়ে গিয়ে বিরাজ করলো মোহনীয়তা। হাওয়ার তালে আয়াতের এলোমেলো চুলগুলো উড়ে চলছে।

পূব আকাশে দেখা মিলল সূর্যের। লালাভ আকাশের সাদা মেঘের আস্তরণে প্রতিফলিত রশ্নিগুলো আয়াতের কালচে বাদামী চোখজোড়াকে অপূর্ব করে তুলছে।সেই চোখের সৌন্দর্য যেন ছড়িয়ে পড়েছে পঞ্চগড়ের সুন্দর এই দৃশ্যপটে।আয়াত অন্য হাত দিয়ে মাইশার কোমড় চেপে টেনে আনলো নিজের কাছে। মাইশা এখনও সম্মোহনী দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটার চোখের গহীনে ডুবে আছে।

— আমাদের প্রথম দেখা পঞ্চগড়ের এই স্টেশনেই হয়েছিলো আর বিয়ের আজ এক বছর পর আমরা এখানেই দাড়িয়ে আছি।প্রকৃতি কত অদ্ভুত তাই না?

মাইশা অবাক হলো আয়াতের কথায়। আসলেই তো! এখানেই তো একটা বড়সড় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওদের দেখাটা হয়েছিলো। সেদিনকার ঘটনাগুলোর কথা পুনরায় স্মৃতিচারণ হওয়াতে ঠোঁটের কোলে হাসি ফুটে ওঠে মাইশার। আয়াত মাইশার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।অতঃপর খুব গভীরভাবে মাইশার কপালে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করলো। চমকে উঠে মাইশা। বিভ্রান্তি নিয়ে আশেপাশে তাকায় যে কেউ আছে কি-না। কিন্ত কেউই এখানে নেই। আকাশেই তো সূর্য ওঠলো সবেমাত্র। ট্রেনও স্টেশন ছেড়ে বহুদূর চলে গিয়েছে।

তবুও লজ্জার আবরণ ঘিরে ধরে মাইশাকে। আজ এতসময় পর এখনও আয়াতের কথায় কাজে ওকে সর্বত্র যেন মোহনীয়তা গ্রাস করে ফেলে।আয়াত তা দেখে অল্পবিস্তর হাসলো। সাথে মাইশাও। মুখের ওপর পড়ে থাকা খুচরো চুলগুলো কানে পিঠে গুজে আয়াত নেশাগ্রস্থ কন্ঠে বলে ওঠলো,

~”তোমার এই হাসিতে উন্মাদ হয়ে যাই গো বউ। বদ্ধ চিলেকোঠায় বারবার স্মৃতিচারণ করতে তাই #হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে………আছো, এবং থাকবে।ভালোবাসি”❤
.
.
.
~সমাপ্ত~
_________________________________