হৃদমোহিনী পর্ব-০৪

0
493

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

-অসহ্য।
বলেই আমি নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। ওনি রাগী চোখে তাকিয়েই রইলেন। আমার মাথাব্যথা হচ্ছে প্রচুর। ঘুমের কারণে চোখ বন্ধ করার আগে দেখলাম ওনি বোতল নিয়ে বসেছেন। রাগ হলেও আমি কিছু বললামনা! নেশাখোরের সাথে একঘরে থাকা! ও মাই গড। যা কখনো কল্পনা করিনি সেটাই আজ বাস্তব হচ্ছে।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ওনি আমার পাশে। কাঁথার ভিতর ঢুকে আমায় জড়িয়ে ধরে আছেন। আমার চুলে মুখ গুঁজে চোখেমুখে হাত বুলাচ্ছেন। আচমকা পেটের ওপর থেকে শাড়ি সরিয়ে চুমু খেতেই আমি ফ্রিজড হয়ে গেলাম। ঘোরের মাঝেই অর্নি অর্নি বলে ডাকছেন। বিশ্রি মদের গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। আমি ওনাকে দূরে ঠেলে দিলাম। কিন্তু ওনি নিজের কাছে টেনে নিলেন আমায়। ভয়ে, বিস্ময়ে আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলামনা। কোনোমতেই চাইছিলাম না দুজনের মধ্যে কিছু হয়ে যাক। প্রাণপণে ওনাকে সরানোর চেষ্টায় মত্ত হলাম। কিন্তু ওনার শক্তির সাথে আমি পেরে ওঠলামনা। আমাকে কোলে তুলে বিছানার দিকে অগ্রসর হতেই আমি ওনার বুকে,পিঠে কিল-ঘুষি দিতে লাগলাম। ওনি আমার হাতদুটো মুঠোয় আটকে বললেন, ‘হুশশশ..শব্দ করোনা।’
আমি ব্যহত কন্ঠে বললাম,
-আমি অর্নি নই।
-তুমিই অর্নি।
-আমি আরুণী।
ওনি আমার কোনো কথাই কানে ঢুকালেননা। তখন অবশ্য কানে ঢুকানোর মানসিক অবস্থাতেই ছিলেন না। আমার শত অনুরোধ, আর্তনাদ কিছুই ওনাকে আদিম খেলায় মেতে ওঠা থেকে আটকাতে পারলোনা। ওনার শক্তির কাছে আমাকে হার মানতেই হলো। জমজ হওয়ার কী যন্ত্রণা আমি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিলাম। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিলো, ঘৃণা হচ্ছিলো খুব। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি অর্নির জায়গায় এসে পড়েছি, ওর অধিকার কেড়ে নিয়েছি, ওর ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছি। নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হচ্ছিলো। ধূসর তো স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলোনা, কিন্তু আমি? আমিতো ছিলাম! এবং সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ওনার মনেও থাকবেনা, ভুলে যাবে! তখন দোষ আমার হবে। এর দায় আমারই হবে। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না এই বিষয়টা। ওনি আমায় শক্ত করে জাপটে ধরেছিলেন। আদুরে বেড়ালের মতো বুকে নিয়ে ঘুমালেন। যেন ছাড়লেই আমি পালিয়ে যাবো, না না..আমি নয়, ওনার অর্নি! আরুণীকে তো ওনি পছন্দই করেননা। সারারাত চোখের পানি ফেললাম, আমার বুঝি এমন নিষ্ঠুর নিয়তি? ভাগ্যে এটাই লিখা ছিলো? এতোটা অসহায় কখনো বোধ করিনি আমি!

ভোরের আলো ফোটার আগেই আমি ওনাকে অনেক কষ্টে সরিয়ে উঠে পড়লাম। শাড়িকাপড় প্যাঁচিয়ে এক দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিলো আমার সাথে এটা কি হলো! দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সেরে বেড়িয়ে এলাম। নামাজ পড়ে নিলাম। ঘরটাকে ভালোমতো গুছিয়ে দিলাম। ওনার বুকে, পিঠে নখের আঁচড় দেখে আঁৎকে উঠলাম। এসব দেখলে ভাববে আমি ওনার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়েছি! চাদর দিয়ে ভালোকরে ওনাকে ঢেকে দিলাম। এলোমেলো চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দেওয়ার সময় আমার মনে হলো, ওনিতো আমারই স্বামী! ওনার ভালোবাসা প্রয়োজন! এবং সেই মুহূর্তে মনের কোণে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো অর্নির জায়গা অর্নিরই থাকুক, আমার নিজের একটা জায়গাও তৈরি করতে হবে আরুণী হিসেবে।

ধূসর ঘুম থেকে উঠার আগেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে ছিলো, মা আমায় চা বানিয়ে দিলেন। ধূসরের খোঁজ নিলেন। রাতে কোনো নেশা করেছে কিনা আর আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা বাবা জানতে চাইলেন। যদিও দুটোই ওনি করেছেন কিন্তু আমি ওনাদের বুঝতে দিলামনা কিছু। চা খেতে খেতে বাবা জানালেন ওনারা দুজন আজ বোনের বাড়ি বেড়াতে যাবেন। কয়েকদিন থাকবেনও। আমি সবকিছু একা সামলাতে পারবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমিও হ্যাঁ বলে দিলাম। মজার ব্যাপার হলো ওনাকে ছাড়া সামলানোর মতো আর কিছুই নেই!
অবশ্য কাল রাতের পর ওনার প্রতি একটু হলেও আমার অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে তবে সেসবের কোনো দাম ওনার কাছে নেই। মায়ের কাছ থেকে জেনে ওনার পছন্দের খাবার তৈরি করলাম। খিচুড়ি আর অমলেট। এগুলো কর‍তে অনেকসময় লেগে গেলো। কিন্তু আমার অতি যত্নে রান্না করা খাবারগুলো ওনিতো মুখেই তুললেন না, উল্টো সেগুলো নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। আংকেল রেগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফেললে কেন?’
-ওর রান্না করা খাবার আমায় দিলে কেন? কোনো স্বার্থপর মেয়ের রান্না আমার গলা দিয়ে নামবেনা। আর কখনো এরকম ভুল যাতে না করে সেটা ওকে বলে দাও, নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে!
-ও তোমার স্ত্রী, সেটা ভুলে যেওনা ধূসর।
বাবা কড়া গলায় ধমকি দিয়ে ওনাকে বেশকিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে
ওনি না খেয়েই ঘরে চলে গেলেন। আমার কান্না পেয়ে গেলো। ওনার জন্য আমার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপর তকমা পেলাম? এটাই আমার প্রাপ্য? যার জন্য সকাল থেকে কষ্ট রাঁধলাম আর সে-ই ফেলে দিলো? এই কাজটা যদি অন্য কেউ করতো তাহলে তাঁকে কড়া কথাও শুনিয়ে দিতে পারতাম। ওনি বলেই কিছু বলতে পারিনি। মা আমাকে বললেন, ‘ওর কথায় কষ্ট পেওনা মা। ওর মাথার ঠিক নেই।’
আমি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিলাম। হাসি ফুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম,
-আমি কিছুই মনে করিনি।
বাবা হতাশ হয়ে বললেন, ‘আমাদের কোথাও যাওয়া বোধহয় ঠিক হবেনা।’
কথাটা শুনে আমি উৎকন্ঠিত হয়ে বললাম, ‘না না আপনারা যান।’
-কীভাবে যাবো বলোতো? ধূসর তোমার সাথে প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার করেই যাচ্ছে।’
-এটা এমন কিছুই নয়। আসলে হঠাৎ করেই অর্নির জায়গায় এসে গেছি সেটা তিনি মানতে পারছেননা।
-পারবে ওকে সামলাতে?
-চেষ্টা করতে দোষ কি!

বাবা-মাকে অভয় দিলেও আমার নিজেরই ভয় করতে লাগলো। যে লোকটা আমাকে দুচোখে দেখতেই পারেনা ওনাকে কি করে ঠিক করবো আমি? বিকেলে ধূসর ওনাদের ড্রপ করে দিয়ে এলো। আমি একটু অবাকই হলাম। আসার পর থেকে দেখছি ওনি যতই পাগলামো করুক না কেন বাবা-মায়ের প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা আছে। সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়িতে নিজেকে খুব একা একা লাগছিলো। নিচে বসে টিভি দেখছিলাম হঠাৎই আমার ফোন বেজে উঠলো। নিকিতা আন্টি ফোন দিয়েছেন। রিসিভ করে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললাম। মা সবকিছু রান্না করে দিয়ে গেছে। কোথায় কি রাখা আছে, ধূসরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কোথায় আছে সবকিছু আমাকে জানিয়ে দিলেন। আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটা কথা বলি মা?’
-জি বলুন।
-আমার কাছে কিছু লুকাবেনা কিন্তু।
-জি আচ্ছা।
-কাল রাতে ধূসরের সাথে তোমার কিছু হয়েছে? আই মিন..আমি যা মিন করছি তুমি বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?
মায়ের কথায় আমি বিষম খেলাম। ওনি বলতে থাকেন..আসলে আজ সকালে দেখলাম তোমার গলায় দাগ। তখন আসলে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আমার ছেলেকে তো আমি চিনি, ওর সম্মতিতেই হয়েছিলো?
আমি শুকনোকন্ঠে বললাম, ‘না।’
-মানে?
-ওনি নেশারঘোরে ছিলেন। অর্নি ভেবেই..
নিকিতা আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের ক্ষমা করে দিও মা। শুধুমাত্র আমাদের কথা রাখতেই তুমি এতবড় স্যাক্রিফাইস করলে!’
-এসব কথা থাক মা। এবার বলুন, বোনের বাড়িতে কেমন লাগছে?
-ভালোই। তবুও তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব।
-চিন্তা করবেননা তো। সব ঠিক হয়ে যাবে!

ফোন রেখে উঠতেই উপরের ঘর থেকে ধূসরের চিল্লানি শুনতে পেলাম। চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে যেন। আমি তড়িঘড়ি করে ওপরে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই অগ্নিদৃষ্টি বর্ষিত করলেন আমার উপর। গোসল সেরে বেরিয়েছে, পরণে টাওয়াল। আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললেন, ‘এসব কী?’
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷ মিনমিন করে বললাম, ‘কী?’
ওনি ওনার বুকেপিঠের নখের আঁচড় দেখিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, ‘হোয়াট..??’
-আমি কী করে বলবো? আমি কি আপনাকে খিমচি দিয়েছি নাকি! আজব।
আমার গলায় দৃষ্টি পড়তেই বললেন, ‘ওখানে কী?’
আমি দাগটা ঢেকে নিলাম দু’হাতে। চশমাটা নাকের ডগায় এনে সরাসরি বললাম, ‘আপনার নজর তো খুব বাজে।’
ওনি থতমত খেয়ে বললেন, ‘মানে?’
আমি সন্দেহজনক গলায় বললাম,
-আপনি আমার দিকে বাজে নজরে তাকাচ্ছেন আর বাজে ইঙ্গিত ও দিচ্ছেন। ছিঃ!
-কীসব বলছো আরুণী? মাথা গেছে পুরাই?
আমি ভাব নিয়ে বললাম, ‘ধরা পড়ে এখন..?’
ওনি রেগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসের ধরা?’
-এইযে আপনি খালি বাড়িতে, গায়ে শুধুমাত্র টাওয়াল পরে আমাকে একা ঘরে ডেকেছেন। আবার আমাকে কীসব দেখাচ্ছেনও। ছিঃ লজ্জ্বা করছেনা আপনার? সারাদিন অর্নি অর্নি করে মরে যান আর রাতেরবেলা নিজের আসল রুপ দেখান। আবার আমাকেই বলেন আমি মুখোশধারী। আজ প্রমাণ হয়ে গেলোতো কে মুখোশধারী..?
ওনি বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগামাথা কিছুই ওনার মস্তিষ্কে ঢুকছেনা। আমি হতবিহ্বল করে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!