হৃদমোহিনী পর্ব-১৬

0
579

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬

তারপর নীরবতায় কেটে গেলো অনেকটা সময়। আমি ভাবলাম, ভাবতে ভাবতে ঘাম ঝড়িয়ে ফেললাম। ধূসরের প্রতি একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছে। ভালোবাসা, মায়া না করুণা জানিনা। ধূসরমানব যে এতটুকু বুঝতে পেরেছে তাতে কি আমার খুশি হওয়া উচিৎ? অর্নি সত্যিই চায় আমি ওনার কাছে ফিরে যাই? সেও কী আরুণী হিসেবেই আমাকে চায়? অন্য স্বত্ত্বার কাউকে ভেবে নয়? তাঁর হৃদয়ের দ্বিতীয় মোহিনীটার জায়গা কি সত্যিই পেয়ে গেছি! সেদিনের কথা মনে হলো। ছাদে বসে থাকার সময় অর্নির কন্ঠস্বরে বলা কথাটা, ভালোবাসিস ধূসরকে! আমার চোখ ভিজে গাল বেয়ে পানি পড়লো। কিন্তু এতো সহজে যে ধূসরমানবের কাছে ফিরবোনা আমি। আমাকে যে এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো তার জন্য তো তাঁকে শাস্তি দিতে হবে! সেতো বাচ্চা চায়না, আমিও তো ঠিক করেছিলাম কোথাও যাবোনা ওনার সাথে। ধূসরের অভিব্যক্তি পরীক্ষা করার জন্য খুব সহজভাবেই ওনার হাতটা নিয়ে পেটের ওপর রাখলাম আমি। ওনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
-কিছু টের পেলেন? বুঝতে পারছেন কিছু?
-তোমার পেটব্যথা করছে?
-না।
-তাহলে?
-গেস করুন।
কিছুক্ষণ পর ওনি ভূত দেখার মতো চমকে বললেন, ‘আর ইউ প্রেগন্যান্ট আরুণী?’
আমি মিষ্টি হেসে বললাম, ‘জি। এখন অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমি কেন আপনার কাছে ফিরবোনা।’
ধূসরের গলায় যেন জোর নেই। কোনোমতে বললেন, ‘এটা কী সত্যি?’
-ইয়েস আই এম প্রেগন্যান্ট এন্ড আ’ম গোয়িং টু বি দ্যা মাদার অফ ইউর চাইল্ড ও’ম ইউ ডু নট ওয়ান্ট!

ধূসর নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। চেহারায় খুশি খুশি ভাব। ওনার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। তাঁকে বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। সে কখন কী চায় সে-ই ভালো জানে। আমি উঠে চলে আসলাম। নিচে এসে রান্নাঘরে মোড়া ফেলে বসলাম। সেদ্ধ আলোর খোসা ছাড়াচ্ছি আর ছোটচাচীর সাথে বকবক করছি। এর মধ্যে বনরুটিতে জেলি মাখিয়ে কয়েক টুকরো পেটে চালান করে বসে আছি। আজ ছোটমাছের ঝোল আর মুড়িঘণ্ট হবে। জিভে জল চলে আসার মতোন অবস্থা আমার। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতে হতে দুপুর তিনটে বেজে গেলো। ধূসরমানব খেতে আসেনি, তার খাবারটা দিয়ে আম্মু জোর করে আমাকে পাঠালেন। আমি ঘরে গিয়ে দেখি তিনি শূন্য দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। আমি ডাকতেই চমকে উঠলো। ওনার খাবারগুলো সামনে রেখে বললাম, ‘খাওয়ার ইচ্ছে হলে খান, নয়তো ফেলে দিন। ভুলেও ফেরত পাঠাবেন না।’
-কেন?
-উফফ…
-বিরক্ত লাগছে? শরীর খারাপ হচ্ছে?
-আপনার এতো ভাবতে হবেনা।
-হবে।
আমি ঠোঁট টিপে হেসে ফেললাম। তাচ্ছিল্য করে বললাম, ‘হবে? তো কেন হবে?’
ওনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বোকার মতো বললেন,
-কারণ আমার একটা বাবু আসবে। তাই।
আমি অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বাবু?’
-হুঁ।
-আপনার বাবু কোথা থেকে আসবে। আপনি তো মেয়ে নন। অতিরিক্ত নেশাভাং করার ফল এটা বুঝলেন? নিজেকে এখন মেয়ে ভাবা শুরু করেছেন।
ওনি ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে রইলেন।
-ফাজলামো করো আমার সাথে?
-সেই দুঃসাহস আমার নেই।
-আবার মজা করো!
-রাগলে আপনাকে কেমন দেখায় জানেন? একটা গন্ডারের মতো, যাঁর নাকের ওপর শিং আর দেখতে ভীষণ কুৎসিত।
ওনি ক্যাটকেটে স্বরে বললেন, ‘একটা অবলা প্রাণীকে তুমি কুৎসিত বলতে পারোনা!’
-আল্লাহর সৃষ্টি সবই সুন্দর। আমিতো ওটা আপনাকে বললাম।
ধূসর রেগে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে হুমকি দেওয়া গলায় বললাম, ‘নেক্সট টাইম আমাকে ছোঁয়ার আগে দশবার ভাববেন। নয়তো যা করিনি কখনো তাই হবে।’
-কী করবে তুমি?
-নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেব। একেবারে চৌদ্দবছরের জেল। বলবো যে, প্রেগ্ন্যাসি টাইমে ধূসর নামক নেশাখোর এক লোক আমার গলা চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলার জঘন্যতম ষড়যন্ত্র করেছে।
-তোমার এই সো কল্ড কথাবার্তা কেউ শুনবে কেন? তাছাড়া তোমাকে মেরে ফেলার কোনো কারণই তো নেই। অলরেডি দু-দুটো বিয়ে করে বসে আছি আর যন্ত্রণায় ভুগছি। থার্ড টাইম বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে তা নয়তো একটা কথা ছিলো, তোমার যুক্তিটা মেনে নেওয়া যেতো। বাট আমি তো এখন তোমাকে নিয়ে যেতেই এসেছি। এছাড়া… উম..আর কোনো কারণ তো নেই…
আমি শক্ত গলায় বললাম,
-কারণ আছে। এই বাচ্চার বাবা আর তাঁকে মেনে নিতে চায়না। তাই আমাকে মেরে প্রমাণ লোপাট করতে চায়!
ধূসর একটা হম্বিতম্বি ভাব নিয়ে বলল, ‘কে বললো?’
-এক নিষ্ঠুর লোক।
-তাই বুঝি?
-হুঁ।
ধূসর আমাকে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। আমি নিজেকে সামলানোর আগেই ওনি আমার ঘাড়ে মুখ রেখে বললেন, ‘আমার একটা ছোট্ট বেবি থাকবে যাকে আমি কোলে নিয়ে ঘুরবো, বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াবো তাইনা আরুণী?’
আমি বিরক্তিতে কটমট করে বললাম, ‘ইনডাইরেক্টলি বোঝাতে চাইছেনটা কী আপনি?’
ধূসর ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘ওই তোমার পেটের ভেতর থাকা ছোট্ট পুঁচকুটাকে আমার লাগবে।’
-বললেই হলো? এতো সহজ?
-বাচ্চার বাবা আমি, বুঝলে?
-না। তাছাড়া কোনো প্রুফ তো নেই যে আপনি আমার বেবির বাবা। আপনার তো কিছুই মনে নেই। এটাতো নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকা আপনার একটা ফল্ট। দায়টা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকে! ছাড়ুন আমায়..

ধূসর আমাকে ছেড়ে দিলো। বলল, ‘যত যা-ই হোক বাচ্চাটা আমার।’
আমি তেড়ে উঠে বললাম, ‘মেলোড্রামা বন্ধ করুন আপনি। রেডিমেড বাচ্চা পেয়ে এখন দরদ উতলে পড়ছে বুঝি? একটা সন্তান হলো বাবা-মায়ের ভালোবাসার ফসল, কোনো ভুলের ফসল নয়। আর আ..আমি যদি ওকে নষ্ট করে ফেলি তাহলেও আপনার কিছু বলার থাকতে পারেনা। আপনার বরং খুশি হওয়া উচিৎ, কারণ আপনি যা চেয়েছেন তাই হচ্ছে…’

ধূসর অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকলো। আমি প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বলে উঠলাম, ‘খেয়ে নিন।’
-তুমি যে এসব বললে একবারও খারাপ লাগলোনা?
-আপনার কী একবারও বুক কাঁপেনি? যখন বলেছিলেন বাচ্চা দরকার নেই? বলুন..
-রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। তখন আমি নিজের মধ্যে থাকতাম না ভালো করেই জানো তুমি…
-বাহ! আপনি সবকিছু অজান্তেই রেগে রেগে বলেন তাইতো। রাগের মাথায় কাউকে আঘাত করে কথা বলা ঠিক নয়। হয়তো বলতে চাননি, কিন্তু বলে তো ফেলেছেন। আপনাকে মেনে নিতে গেলে প্রতিবার এই কথাটাই মনে আসে আমার। কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারিনা।

বলেই আমি চলে আসি। এখনো বাড়ির কাউকে ঘটনাটা বলা হয়নি। কিন্তু জানানোটা দরকার। প্রথমে মেজচাচীকে খুলে বললাম। বলতে গিয়ে লজ্জায় আমার কন্ঠরোধ হয়ে আসছিলো, কোনো শব্দ বেরুচ্ছিলোনা। মেজচাচী হেসে ফেললো আমার অবস্থা দেখে। বাড়ির সবাইকে যখন সবটা খুলে বললো আমি লুকিয়ে রইলাম। বিশেষ লাভ হলোনা, কারণ পুনম খুঁজে খুঁজে ঠিকই বাথরুম থেকে বের করলো আমায়। সবাই তো দারুণ খুশি। আমাকে নিয়ে সে কী আহ্লাদীপনা। ধূসরবাবু হৈচৈ শুনে উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন৷ মুখ গম্ভীর। আব্বু আমাকে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন, ‘এবার তো নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে মা।’
আমি মাথা নাড়লাম। আব্বু মাথাটা নিচু করে প্রশ্নভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘এবার আর রাগ করে থেকোনা আরু’মা। বাচ্চার বাবা হিসেবে ধূসরের কিন্তু একটা অধিকার আছে। আর তুমি ভুলেও ভেবোনা যে বাচ্চা নিয়ে একা জীবন পার করে দেবে। ধূসরকে তোমার না-ই দরকার হতে পারে, কিন্তু যে আসতে চলেছে তাঁর দরকার আছে। বুঝতে পারছো তো আমি কী বলছি?’
-জি বুঝতে পেরেছি।

আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এই খবরটা পেয়ে পরদিনই আমাদের বাড়ি এসে পড়লেন, আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি বিভিন্ন কৌশলে আম্মুকে রাজি করিয়ে এ বাড়িতে রয়ে গেলাম। যদিও আমার ওই বাড়িতে ফিরে যাওয়া নিয়ে অন্য একটা প্ল্যান আছে। ভালোবেসে তো ক্ষমা করে দিলাম ধূসরকে; কিন্তু কিছুটা শাস্তি তো ওনার প্রাপ্য! ওই যে বললাম দিনদিন বড্ড সেলফিশ আর আবেগী হয়ে যাচ্ছি। চাইলেও বাস্তবতা দেখাতে পারছিনা। ভালোবেসে মানুষ নাকি অনেকক্ষেত্রে পাগল হয়ে যায়, আমার হয়েছে সেই দশা। ওফ…আরুণী তুই এমন কেন হয়ে যাচ্ছিস? প্রেমে মরা জলে ডুবেনা টাইপ প্রেমিকা হয়ে যাচ্ছিস যে, ধূসরের শত শত ভুল ক্ষমা করে দিয়ে একটা আত্মসম্মানবোধহীন নারীর পরিচয় দিচ্ছিস! এমনটা কি হওয়ার ছিলো আদৌ? ছিঃ আরুণী ছিঃ! মনের কোণে উঁকি দেয় অর্নির ডায়েরিতে কালো কালিতে লিখা, সেই ধূসর চিরকুটের পঙক্তিমালা,

‘বৃষ্টিস্নাত বর্ষা
সাত রঙের রংধনু,
তুমিই ধূসর মেঘের
নিঝুম ধারার বৃষ্টি…’

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!