হৃদয়ের রং জানে না পর্ব-০১

0
86

#হৃদয়ের_রং_জানে_না <প্রথম পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
শান্তিনিকেতনের সকালটা আজ বৃষ্টিতে ভেজা | ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো | রূপকথার ঘরের পড়ার টেবিলে রাখা ডাইরির পাতাগুলোও সেই ঝোড়ো হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাঝে মাঝেই ওলোট পালট হয়ে যাচ্ছে | আজ রবিবার | ও যেই স্কুলটায় পড়ায় তার টিচাররা লেডিজ হোস্টেলটা ফাঁকা করে দিয়ে নিজের নিজের বাড়ি চলে গেছে কাল বিকেলেই | এখন আবার দুদিন স্কুল ছুটি | সোম মঙ্গল কাটিয়েই তাই সবাই ফিরবে | কিন্তু রূপকথা , এই ছুটির দিনগুলোতেও এই ফাঁকা হোস্টেলটা ছাড়েনি | আসলে ফিরে যাওয়ার ঠিকানা বলতে তো কিছু নেই ওর | ছোটবেলায়ই বাবা মা একটা একসিডেন্টে মারা গেছিলো | তারপর মামা মামীর কাছে বড়ো হয়েছে | কিন্তু তারা সব সময়ই ওকে বুঝিয়ে এসেছে যে ও হলো ভাগ্নি , পরের মেয়ে , নিজের সন্তান না | আর এই সত্যিটা বুঝতে বুঝতেই টান জিনিসটা কখনো রূপকথার তৈরী হয়নি ওদের ওপর , বা বলা যায় ওরাই তৈরী হতে দেয়নি , ইচ্ছে করেই | আসলে রূপকথার কাস্টাডিটা নিয়েছিল ওর মামা মামী টাকার লোভে | ব্যাঙ্কে রূপকথার বাবা একটা ভালো এমাউন্টের টাকা এম.আই.এস করে রেখেছিলো মেয়ের নামে | আর রূপকথার আঠেরো বছর হওয়ার আগে অব্দি ওর লিগ্যাল গার্জেন এই টাকাটা তুলতে পারতো প্রত্যেক মাসে | তাই কোর্ট থেকে ভাগ্নির কাস্টাডি নিতে বিন্দু মাত্র দেরি করেনি রূপকথার মামা | তবে রূপকথার আঠেরো বছর হওয়ার দিনই এই টাকার সম্পর্কটাও শেষ হয়ে গিয়েছিলো মামা মামীর সাথে | তখন থেকে এমন ব্যবহার শুরু করেছিল ওরা যেন তাড়াতে পারলেই বাঁচে ! আজও মাঝে মাঝে মনে পরে সেই দিনগুলো | রূপকথার জন্য অনেক সময়ে রান্না হতো না ওই বাড়িতে | কলেজের ক্যান্টিন , বা বাইরের হোটেলই ছিল তখন ভরসা | তারপর পুজোর সময় , মামা এক গাল হাসি মুখে কেনাকাটি করে ফিরতো বাড়ির সবার জন্য | ছেলে , মেয়ে , বৌ , এমন কি কাজের লোকটার জন্যও একটা কাপড় বরাদ্য থাকতো ওনার লিস্ট এ | শুধু বাদ পরে যেত রূপকথাই | এখনো ভাবলে ঘটনাগুলো মাঝে মাঝে চোখের কোণটা চিক চিক করে ওঠে রূপকথার , জলে | তবে সেইসব দিনগুলোতে এই মামা মামীর দেয়া কষ্টগুলো ছাড়াও একজন ছিল , যে ওর এই হঠাৎ ভিজে আসা চোখটা মুছে দিতো অনেক সময়ে , ভালো লাগার কিছু মুহূর্ত নিয়ে আসতো জীবনে | অনন্ত | পাশের বাড়ির ছেলেটা বয়সে ওর থেকে পাঁচ বছরের বড়ো হলেও সেই ক্লাস থ্রি থেকেই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড | আর ওদের বাড়িটা ছিল বলেই হয়তো মামা মামীর ওরকম বকাঝকা , বাজে ব্যবহার সহ্য করেও দিনের কিছুটা সময় রূপকথা একটু হলেও মন খুলে হাসতে পারতো | অনন্তর মা তো সত্যি রূপকথাকে নিজের মেয়ে ভাবতো | মামা মামীর বাড়িতে ওর জন্য রান্না না হলে ওর শুকনো মুখটা দেখে কত সময়েই কিছু না বলতেই বুঝে যেত যে ও কিছু খায়নি | তারপর নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দিতো রূপকথাকে | পুজোর সময়ে ,পয়লা বৈশাখে নিজের বাড়ি না হোক , অনন্তর বাড়ি থেকে একটা নতুন ড্রেস হতোই সব সময়ে রূপকথার | আবার ওর স্কুল প্রজেক্ট , পরীক্ষার আগের ইম্পরট্যান্ট নোটস , রেফারেন্স বই অনেক কিছুই কিছু না বলতেই জোগাড় করে দিতো অনন্ত | আজ দু বছর বাদেও তাই ওই ফেলে আসা মুখটা চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় রূপকথা | খুব স্পষ্ট ভাবে | চঞ্চল দুটো চোখে শান্ত একটা মুখ | অনন্ত |
আচ্ছা সত্যিই কি কোনো ঠিকানা বাকি নেই আর রূপকথার ! অনন্তর বাড়ির দরজা তো সব সময়েই খোলা ওর জন্য | কাকিমা তো আজও ওকে দেখলে হাসি মুখে জড়িয়ে ধরবে | তা ও কেন আর ওই ঠিকানায় ফেরা হয় না রূপকথার ! তা ও কেন দু বছর বাদেও একা হোস্টেলের ঘরটাকেই নিজের মনে হয় ! শান্তিনিকেতনের এই একাকীত্বটাকেই আঁকড়ে ধরে ও ! তাহলে কি মনের দূরত্ব এতটাই বেশি যে দু বছরেও ফিরে যাওয়া যায় না , ফেলে আসা সময়ের কাছে | না কি যাকে ভালোবেসেও দূর থেকে অন্যের হতে দেখতে হয় , সেই কষ্টটার কাছে এই একাকীত্বটাই অনেক সুখের | আজ আবারও এইসব এলোমেলো ভাবনাগুলো বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার সাথে রূপকথার মনে এসে জমা হলো | আর আজ আবারও নিজের কথাগুলো কাউকে বলতে না পেরে ডায়রিতে লিখে রাখলো রূপকথা | নিজের লোক নেই , কেউ শোনার নেই , আর ওর কাউকে কিছু বলারও নেই | নিজের বলতে শুধু এই শব্দগুলোই তো আছে ওর কাছে | যাদের আঁকড়ে ধরে এক একটা দিন শেষ হয়ে যায় শান্তিনিকেতনে | ভেবে আবারও চোখটা ভিজে এলো | আর এই মুহূর্তেই খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো ওর মুখে আর, আরএকবার আড়াল করে দিলো চোখের জলটা | তখনই হঠাৎ খুব জোড় একটা মেঘ ডেকে উঠলো আকাশে , কিন্তু সেই আওয়াজে রূপকথার ফোনের রিংটোনটা ঢেকে গেলেও আলোটা জলে উঠলো , রূপকথা খেয়াল করলো একটা আননোন নাম্বার ওর মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে | আজকের এই ছুটির দিনে স্কুলের চেনা লোক ছাড়া তো কারোর আর ফোন করার কথা নয় ওকে ! তাহলে এখন হঠাৎ কার মনে পড়লো ! ভেবেই ফোনটা ধরলো রূপকথা , আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকে গেলো |
” রূপকথা ! আমি বলছি | চিনতে পারছিস ? কেমন আছিস মা ?” …… কথাগুলো কানে আসতেই রূপকথার ভেতরটা আবার এলোমেলো হয়ে গেলো যেন | পুরোনো সময় হঠাৎ এসেছে ওর কাছে , নিজে থেকে | কিন্তু কি অদ্ভুত ! দু বছর বাদেও কাকিমার গলার স্বরটা একদম নতুন লাগলো না | মনে হলো যেন কালই কথা হয়েছে ! তাহলে কি এতটা সময় কিছুই না দূরে সরে আসার জন্য ! তাহলে কি ও পারেনি এতোদিনেও মনের দূরত্বটাকে শক্ত করে বাঁধতে ! এসব ভাবতে ভাবতেই উত্তর দিলো , ——- ” কাকিমা ! আমি ভালো আছি | তুমি কেমন আছো ? ”
কথাটা শুনে যেন অনন্তর মার গলার আওয়াজটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেলো | খুব আস্তে গলায়ই বললো , —— ” আছি ! একরকম |”
এবার আর রূপকথা উদাসীন হয়ে থাকতে পারলো না | এইভাবে কেন উত্তর দিলো কাকিমা ! কথাটা মনে আসতেই জিজ্ঞেস করে উঠলো , —– ” কি হয়েছে তোমার ? গলাটা এরকম কেন শোনাচ্ছে ?”
প্রশ্নটা করেও ফোনের ওপার থেকে কিছুক্ষনের জন্য নিঃস্তব্ধতা ভেসে এলো | তারপর কান্না ভেজা গলায় অনন্তর মা বলে উঠলো , ——– ” অনেক কষ্টে তোর নাম্বারটা জোগাড় করেছি তোর এক কলেজের বন্ধুর কাছ থেকে | জানি হয়তো যোগাযোগ রাখতে চাস না | তা ও ফোন করলাম | আসলে তুই যদি আসিস তাহলে হয়তো অনন্ত একটু ঠিক হবে | একটু হয়তো কথা বলবে আবার আগের মতন | তাই !”
রূপকথা কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেলো ! কি সব বলছে কাকিমা ? অনন্ত ঠিক হবে মানেটা কি ! ভেবেই আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো , —— ” তুমি কি বলছো ? অনন্তর কি হয়েছে ? আর তুমি কাঁদছো কেন ?”
কথাটা শুনে আবারও কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো অনন্তর মা | রূপকথা বুঝলো কান্নাটাকে কোনোভাবে নিজের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা করছে এই সময়ে | তারপর আবার একটু কথা সাজিয়ে বলে উঠলো , ——– ” অনন্তর ছ মাস আগে একটা একসিডেন্ট হয়েছে রূপকথা | ও আর চলতে পারে না | এখন সারাদিন হুইল চেয়ারে নিজের ঘরেই জীবনটা কাটছে ছেলেটার | দরকার ছাড়া বাইরের কেউ তো দূরে থাক , আমার সাথেও খুব একটা কথা বলে না ও | কেমন যেন নিজের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক দিন | তাই তোকে একবার জানালাম | একটা সময় তো তুই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলিস | হয়তো তুই আসলে একটু নর্মাল হবে ছেলেটা ! তাই যদি পারিস তাহলে একবার দেখা করে যাস | না , জোর করছি না | যদি পারিস , তাহলেই |” … কথাটা বলেই অনন্তর মা আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিলো | রূপকথা তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে | কান থেকে ফোনটা ছাড়তে পারেনি | যেন কিছুক্ষনের জন্য পাথর হয়ে গেছে ও | কিছু ভাবতে পারছে না ! এতদিন বাদে এ কি খবর এলো ওর কাছে ! যাকে এতো ভালোবাসতো , তাকে তো সব সময় ভালোই দেখতে চেয়েছে রূপকথা | দূরে থেকেও সব সময় এটাই চেয়েছে যে অনন্তর মুখে যেন রোজ হাসি থাকে | তাহলে হঠাৎ এসব কি হলো ! ওই প্রাণবন্ত ছেলেটা আজ হুইল চেয়ারে ! কথাটা ভেবেই রূপকথা আঁতকে উঠলো | ভয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেললো | আর তখনি চোখের সামনে ভেসে এলো সেই পুরোনো মুখটা , আবার | সেই চঞ্চল চোখ দুটো যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে এখন | রূপকথা এরপর আর এক সেকেন্ডও দেরি করলো না | আলমারি থেকে ব্যাগটা বার করে কিছু জামা কাপড় আর পার্সটা ঢুকিয়ে ফাঁকা হোস্টেলটাকে পুরোপুরি ফাঁকা করে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো , পুরোনো ঠিকানার উদ্দেশ্যে |
<২>
ট্রেনটা এখন বোলপুর স্টেশন পার করে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে | চলন্ত রাস্তা , ধানক্ষেত , গাছপালা গুলো দেখতে দেখতে রূপকথার হঠাৎ মনে হচ্ছে সময়ও কত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় চোখের পলকে |এই ট্রেনের জানলায় দেখা দৃশ্যগুলোর মতন জীবনটাও কেমন বদলে যায় মিনিট সেকেন্ডে | এই যেমন সেই কলকাতায় থাকা দিনগুলোর সময় | রূপকথা কত বেহিসেবি ছিল | ভাবনাগুলো বাস্তব থেকে দূরে যেন কোনো রূপকথার দেশেই ঘুরে ফিরে বেড়াতো | তখন মামা মামী যতই খারাপ ব্যবহার করুক , সারাক্ষন এইভাবে মন খারাপ হয়ে থাকতো না ওর | আসলে মনে হতো এতো খারাপের ভিড়ে একটা ভালো তো সব সময় আছে সঙ্গে , যার নাম অনন্ত | যার সাথে সারাদিনে দশ মিনিট কথা হলেও ভালো লাগা ছড়িয়ে যায় মনটায় | এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না অনন্তর এই এক্সিডেন্টটার কথা ! ওকে গিয়ে সত্যি একটা হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখতে হবে ! ওই ছেলেটাই তো আর কিছুটা সময় আগেও কত একটিভ ছিল | এখনো মনে আছে রূপকথার মাস্টার্স এর জন্য ফর্ম তোলার দিনের কথাটা | এক ইউনিভার্সিটি থেকে আরেক ইউনিভার্সিটি , সমানে দৌড়েছিলো ছেলেটা ওর সাথে | রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে লাইন দেয়া থেকে শুরু করে ফর্ম জমা দেয়ার দিন অব্দি , সব সময় পাশে ছিল ওর | নিজে তখন এম.বি.বি.এস শেষ করে এম.ডি তে সবে ঢুকেছে | কিন্তু তা ও নিজের পড়াশুনা ছেড়ে শুধু রূপকথার জন্য তিনটে দিন নষ্ট করেছিল অনন্ত | তবে সারাদিন অতো দৌড়াদৌড়ির পর রূপকথা যখন একটু ইতঃস্তত করে ওকে বলেছিলো , —— ” তুমি আর আমার জন্য কত করবে বলো তো ? তুমি সঙ্গে না থাকলে তিনটে ইউনিভার্সিটির ফর্ম একদিনে কখনো জমা দিতে পারতাম না | সত্যি |” … তখন অনন্ত একটু সময় নিয়ে ভেবে হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলো , ——– ” এমনি এমনি তো করিনি | তোর থেকে পাওয়ানাটা আমি ঠিক বুঝে নেবো | এই রবিবার আমাদের বাড়িতে কষা মাংসটা তুই রাঁধবি , ওকে | সত্যি বলছি , ওই ফার্স্ট জানুয়ারির দিন করেছিলিস , আজও মুখে লেগে আছে | ওটা খাওয়ার জন্যই তো এতো দৌড়াদৌড়ি করলাম |”…সেইদিনের মতন আজও কথাটা মনে হতেই রূপকথার মুখে একটা হালকা হাসি চলে এলো এখন | আর ট্রেনটা তখনই গুশকরা স্টেশনে এসে থামলো | রূপকথা আবার অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো যেন | তবে এই থমকে যাওয়া স্টেশনটাকে দেখে আরেকটা ঘটনা মনে পরে গেলো হঠাৎ আবার | যেইদিন অনন্তর বাবার হার্ট এটার্কটা হলো ! সেইদিন অনন্তও তো এইভাবে যেন থমকে গেছিলো কয়েকদিন | মেডিক্যাল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারটা সবে শেষ হয়েছিল ওর | রূপকথার তখন ক্লাস নাইন | ওদের পাড়ায় একটা বিয়ে বাড়ি ছিল সেই রাতে , এখনো মনে আছে রূপকথার | সুস্থ সবল হাসি খুশি মানুষটা ওর সামনেই বিয়ে বাড়ি খেয়ে এলো | তারপর রাতে হঠাৎ বুকে ব্যাথা | কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব শেষ | অনন্ত মুখাগ্নি করে এসে ওই সাদা কাপড়টা জড়িয়ে কেমন যেন থম মেরে বসেছিল ওদের সেই চিলেকোঠায় | এলোমেলো চুল, স্থির দৃষ্টি , দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো ঝড় থেকে উঠে এসেছে | সেদিন বাড়ির একটা লোকের সঙ্গেও কোনো কথা বলেনি ছেলেটা | কান্নাটাও যেন আসছিলো না ওর | রূপকথার সেই দৃশ্য দেখে জীবনে প্রথম একটা ভয় এসে জড়ো হয়েছিল মনে | অনন্তকে হারিয়ে ফেলার ভয় | ওর কথাগুলো , ওর হাসি , ওর রাগ সবকিছুকে হারিয়ে ফেলার ভয় | সেইদিন তাই রূপকথা ওই চিলেকোঠার ঘরটায় অনন্তর পাশে এসে বসেছিল | চুপচাপ |তারপর খুব শক্ত করে অনন্তর হাতটা আঁকড়ে ধরেছিলো | কোনো কথা , কোনো স্বান্তনা আসছিলো না ওর | শুধু মনে হচ্ছিলো আজ অনন্তর যা হারিয়েছে , সেটা অনেকদিন আগেই রূপকথার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে | বাবা , মা জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে থাকে , সেটা রূপকথা নিজের ফাঁকা জীবনটা দিয়ে রোজ বুঝতে পারে | অনন্তও তাই হয়তো আর কারোর সাথে কোনো কথা না বললেও শুধু রূপকথাকেই বলেছিলো প্রথম , ———- ” বাবাকে ছাই হয়ে যেতে দেখলাম চোখের সামনে | তারপর ভাসিয়ে এলাম | আমার সত্যি আজ সব শেষ হয়ে গেলো রূপকথা | সব কিছু |”
কথাগুলো শুনে রূপকথার সেদিন আর কোনো কথা আসছিলো না যেন | শুধু চোখের সামনে মাঝে মাঝে নিজের মা বাবার আবছা মুখ দুটো ভেসে আসছিলো , বার বার | চোখটা জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো ওর | রাগ , কষ্ট , খারাপ লাগা সব কিছু এসে একসাথে জড়ো হচ্ছিলো মনে | যেই যন্ত্রটাকে ও রোজ নিজের মধ্যে নিয়ে বাঁচে , আজ থেকে সেই যন্ত্রটা অনন্তকেও ভোগ করতে হবে | এটা ভেবেই চোখটা জলে ভিজে যাচ্ছিলো | আর সঙ্গে একটা ভয় হচ্ছিলো শুধু , যে এই শেষটা দেখে অনন্ত নিজে শেষ হয়ে যাবে না তো ! ও যদি আর কক্ষনো সামলে উঠতে না পারে ! এলোমেলো হয়ে যায় ! তাহলে কি হবে ! কথাগুলো মনে হতেই তাই সেদিন শক্ত করে ধরে রেখেছিলো ও অনন্তর হাতটা, নিজের হাতের মধ্যে | তারপর প্রায় এক মাস অনন্তর পাশে ছায়ার মতন ছিল রূপকথা | অনন্ত তো প্রথম দু দিন কিছুই খায়নি এরপর | একটা ভাতও মুখে তোলেনি | সবাই জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি ওকে | তবে তিন দিনের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ খেয়াল করেছিল রূপকথার শুকনো মুখটা | কেমন যেন ফ্যাকাসে লেগেছিলো মেয়েটাকে | হঠাৎ তাই নিজের কষ্টটা ভুলে সেই মুহূর্তে রূপকথার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল , ——- ” তোকে এরকম কেন লাগছে ? তোর মামা মামী কালও কি রান্না করেনি তোর ?”
রূপকথা কথাটা শুনে একটু থেমে উত্তর দিয়েছিলো , —– ” করেছিল |” ..
অনন্ত এবার একটু অবাক হয়েই বলেছিলো , —— ” তাহলে তোকে এরকম কেন লাগছে ? তুই খাসনি ?”
রূপকথা এটা শুনেও একটা শব্দেই উত্তর দিয়েছিলো , —— ” না |
অনন্ত এবার আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল , ——- ” কিন্তু খাসনি কেন ?”
রূপকথা এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো , ——– ” তুমি খাওনি , তাই খাইনি |”
না , এরপর আর সেদিন অনন্ত কোনো প্রশ্ন করেনি ওকে | শুধু রূপকথার হাতটা শক্ত করে ধরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এসেছিলো | তারপর মা কে ডেকে বলেছিলো , —— ” আমাদের দুজনকে খেতে দাও | আর সরি | এরপর আর কখনো এইভাবে না খেয়ে থাকবো না |” … আসলে সেদিন অনন্ত কথাগুলো মা কে শুনিয়ে রূপকথাকেই বলেছিলো | হয়তো ও বুঝেছিলো যে ওর ভালো খারাপ থাকার ওপর রূপকথার ভালো খারাপ থাকাটা নির্ভর করে | আচ্ছা , অনন্ত কি সত্যিই কখনো বুঝেছে রূপকথাকে ! ওর পছন্দ , অপছন্দ , মন খারাপ , আনন্দ সব কিছু বুঝলেও ওকে কি কখনো বুঝেছে ! আজও মাঝে মাঝে প্রশ্নটা এসে মনে ভিড় করে রূপকথার | আর উত্তরে শুধু একটা ‘না’ ই ভাবতে হয় ওকে | আর সত্যিই তো , বুঝলে কি আর এই দু বছর এতো দূরে থাকতে হতো রূপকথাকে !কথাটা মনে হতেই আনমনে খেয়াল করলো ট্রেনটা গুশকরা স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা দূর , অনেক্ষন আগেই | তবে রূপকথা এখনো যেন ওই থমকে যাওয়া স্টেশনের মতন সেই থমকে যাওয়া পুরোনো দিনগুলোতে আটকে আছে ,বহু সময় ধরেই |

চলবে।