হৃদয়ের রং জানে না পর্ব-০৭

0
41

#হৃদয়ের_রং_জানে_না <সপ্তম পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৩>
সেইদিন ঠিক বিকেল পাঁচটায় অনন্ত রেডি হয়ে অপেক্ষা করছিলো ড্রইং রুমে | আজকে কফিশপে গিয়ে পরের সপ্তাহে নতুন নার্সিংহোমে জয়েন করার কথাটাও শেয়ার করবে রূপকথাকে | এসবই ভাবছিলো , তখনই রূপকথা নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো| একটা লাল রঙের শাড়ি , চুলটা খোলা, কপালে একটা ছোট্ট টিপ্ | অনন্ত এতেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো ওর দিকে | রূপকথা খেয়াল করলো ব্যাপারটা | আজকাল মাঝে মাঝে এইভাবে তাকায় কেন অনন্ত ! প্রশ্নটা ওর মনে এসেই মিলিয়ে গেলো | ধুর , যতসব ভুলভাল ভাবছে | অনন্ত কখনো ওর দিকে আলাদা করে তাকাতেই পারে না | এটাই সত্যি | কথাটা যেন আবার জোর করে নিজের মনকে বোঝালো এখন | তারপর কিছু কথা সাজিয়ে অনন্তকে বলে উঠলো আলতো হেসে ,
” আজ একেবারে বিফোর টাইমে রেডি ! কি ব্যাপার ? এরকম তো হয় না কখনো|”
অনন্তও এবার এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে উত্তর দিলো,
” তুই আজ নিজে থেকে আমার সাথে দরকারি কাজ ছাড়া এমনি কফি খেতে চেয়েছিস | এরকমও তো হয়নি এতদিনে ! তাই আজ বিফোর টাইমে|”
রূপকথা এসব শুনে এই মুহূর্তে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | তাই কথা ঘোরানোর জন্য অনন্তকে এবার তাড়া দিয়ে বললো ,
” আচ্ছা , বুঝলাম | এবার চলো তাড়াতাড়ি | নইলে দেরি হয়ে যাবে|”
অনন্ত কথাটা শুনে একটু অবাক হলো! হঠাৎ এতো তাড়াহুড়োর কি আছে ! যাবে তো ওরা দুজনই| আসতে ধীরে গল্প করতে করতে গেলেই হয় ! যাই হোক, এইসব ভাবনার ভিড়ে অনন্ত আর কথা বাড়ালো না | রূপকথার সাথে পা মেলালো শুধু | আর মেন্ রোডে উঠেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেছে ওরা | একদম অপেক্ষা করতে হয়নি | অনন্তর তো ট্যাক্সিতে উঠে মনে হচ্ছে সব দিক থেকে যেন আজ ঈশ্বর সহায় ওর ওপরে | এগুলো সব ওপরওলারই সিগন্যাল |
যাই হোক, আধঘন্টার মধ্যে শহরের জ্যাম, ভিড় রাস্তা কাটিয়ে অনন্ত আর রূপকথা কফিশপে এসে পৌঁছলো অবশেষে | তবে
অনন্ত তো প্রথমে জায়গাটাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো ! এটা তো সেই পুরোনো কফিশপটা! স্কুল লাইফে বাবার সাথে এখানে মাঝে মাঝেই আসতো | কত পুরোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে জায়গাটা জুড়ে| এখানে বসে বাবার সেই পুরোনো হাসি মুখটা হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওর , আনমনে | এখন বুঝতে পারছে রূপকথা কাল ঠিক কি সারপ্রাইজের কথা বলছিলো| এই জায়গাটার ব্যাপারে শুধু মা আর রূপকথাই তো জানতো| তাই আজ ওকে বেছে বেছে এই কফিশপটায়ই নিয়ে এসেছে| এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই অনন্ত বলে উঠলো ,
” বুঝলাম এতক্ষনে | তোর সারপ্রাইজটা কি ! সত্যি অনেক বছর বাদে আজ এখানে এলাম| বাবা মারা যাওয়ার পর তো আর আসাই হয়নি |”
রূপকথা কথাটা শুনে আলতো হেসে বললো,
” জানি | তবে পুরোনো জায়গাগুলোতে মাঝে মাঝে আসা উচিত | তাহলে পুরোনো সময়টাকে খুব কাছ থেকে ফিল করা যায় | যাই হোক , এটা তো একটা সারপ্রাইজ | আর একটাও আছে | কিছুক্ষন পরই জানতে পারবে|”
অনন্ত এসব শুনে এখন একটু অবাক হয়ে গেলো ! নিজের মুখে বিস্ময়টা নিয়েই বললো ও ,
” বাবা ! আরো একটা সারপ্রাইজ ! বিশাল ব্যাপার তো ! যাই হোক, আমারও কিন্তু আছে কিছু বলার | প্রথমটা শুনে হয়তো তুই সত্যি সারপ্রাইজ হয়ে যাবি | আর সেকেন্ডটা তুই নিশ্চয়ই অনেকদিন ধরেই জানিস | ”
রূপকথা এবার একটু কৌতূহল নিয়েই বললো,
” আমার জন্যও সারপ্রাইজ ! কি শুনি একটু?”
” আমি নেক্সট উইক থেকে আবার প্র্যাকটিস শুরু করবো | বেশ কয়েকটা প্রাইভেট নার্সিংহোমে এপ্লাই করেছিলাম | একটা থেকে কাল রিপ্লাই এসেছে |”
হাসি মুখে কথাগুলো বলে গেলো অনন্ত, আর খেয়াল করলো রূপকথার মুখটা | হঠাৎ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এখন | ও হাসি মুখে এবার বলে উঠলো ,
” সত্যি ! এই কথাটা তুমি এতক্ষন বাদে বললে আমায় ? সকালেই তো বলতে পারতে| তাহলে তোমায় সকালেই মিষ্টি খাওয়াতাম |”
অনন্ত এবার দু সেকেন্ড চুপ থেকে বললো ,
” মিষ্টির দরকার নেই| তার বদলে আমার একটা উত্তর চাই| আসলে তোকে কিছু কথা !”
না , আর কথাটা শেষ করতে পারলো না অনন্ত | কারণ এই কথার মাঝখানেই ওর কফিশপের দরজার দিকে চোখটা চলে গেলো , আর হঠাৎ এই মুহূর্তগুলো থমকে গেলো জীবনের | মিথিলা এখানে কি করছে! প্রশ্নটা মনে আসতেই রূপকথা বলে উঠলো,
” আর এটা ছিল আমার সেকেন্ড সারপ্রাইজ |”
কথাটা শুনে অনন্তর মাথায় যেন একটা বাজ পড়লো | চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেলো হঠাৎ ! এর মাঝেই মিথিলা ওদের টেবিলের সামনে এসে হাজির| অনন্তর কিছু বোঝার আগেই এই মুহূর্তে রূপকথা বলে উঠলো,
“প্লিজ রেগে যেও না অনন্ত | তোমাকে প্রথমে মিথিলার কথা বললে হয়তো তুমি এখানে আসতেই না! কিন্তু আজ তোমাদের দেখা হওয়াটা জরুরি ছিল | মিথিলা সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে | আর ও ফিরে আসতে চায় |’
রূপকথার কথাগুলো শুনে অনন্তর এবার ঘোরটা কেটে গেছে প্রথমের| আর এখন ভেতরে একটা যন্ত্রনা , রাগ সবকিছু এসে জড়ো হয়েছে এক সঙ্গে| রূপকথা নিজে মিথিলাকে ফিরিয়ে আনলো ওর কাছে ! মানে ও অনন্তকে নিজের করে পেতেই চায় না! কথাগুলো মনে হতেই আর নিজেকে সামলাতে পারলো না | টেবিলটা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো ,
” তুই ভাবিস কি নিজেকে ! যখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারবি ? আমার পারমিশন না নিয়ে আমার লাইফের সব ডিসিশন নিয়ে নিবি ! তুই বুঝিস না আমি কি চাই ?”
কথাগুলো শুনে এবার রূপকথায় উঠে দাঁড়ালো, তারপর একটু দৃঢ় গলায় বললো ,
” বুঝি আমি তুমি কি চাও | তাই মিথিলা যখন নিজে থেকে ফোন করে আমাকে বললো তোমার সাথে দেখা করতে চায় , তখন আমি না বলিনি | আমি জানি যেই রাগটা এখন তোমার ওর ওপর আছে সেটা বাইরের | ভেতরে ভেতরে তুমি মিথিলাকেই ভালোবাসো |”
অনন্ত এবার রাগে অভিমানে জ্বলে উঠলো ভেতর থেকে | তারপর কিছু না ভেবেই বলে ফেললো ,
” ভালোবাসা ! রিয়ালি ! তুই বুঝিস কিছু এই ফিলিংটার ব্যাপারে ? ভালবেসেছিস কখনো কাউকে যে বলছিস |”
কথাটা শুনে রূপকথার হঠাৎ ভেতর থেকে একটা ধাক্কা লাগলো এখন | এই প্রথম অনন্তর এই প্রশ্নে ও আজ চুপ থাকলো না | কঠিন গলায় উত্তর দিলো,
” বেসেছি ভালো একজনকে| খুব মন থেকে একতরফা | তাই জানি এই ফিলিংটা ঠিক কি | কিন্তু তোমার আর মিথিলার ব্যাপারটা তো আলাদা | তোমরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসো | তাই এই খারাপ লাগা , কষ্টটা নিয়ে না হয় না ই বাঁচলে |”
কথাগুলো শোনার জন্য অনন্ত ঠিক এই মুহূর্তে একদম তৈরী ছিল না | ও থমকে গেলো হঠাৎ| ওর ভেতরের সমস্ত রাগ , কষ্টগুলো যেন এখন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে ! আর সেই এক হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলো নিয়েই ও জিজ্ঞাসা করে উঠলো ,
” তুই ভালোবাসিস ! কাকে? তার জন্যই কি এই দু বছর মাঝখানে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলি না? কলকাতা ছেড়ে দিলি?”
এতগুলো প্রশ্ন যে একসঙ্গে হঠাৎ করে বসবে অনন্ত , রূপকথা এটা ভাবেনি | আর এই সময় ও মিথিলার মুখটাও খেয়াল করলো , কেমন অন্ধকার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এখন | ও কি ভাবছে রূপকথা দু বছর আগের সব সত্যি অনন্তকে বলে দেবে ! এতো সহজে নিজের আড়ালটা শেষ করে দেবে !
কখনোই না | যে ওকে কখনো ভালোইবাসেনি , তার ওর ভালোবাসার ব্যাপারে জানার সত্যি কোনো দরকার নেই| এই ভেবেই রূপকথা কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কিছু কথা সাজিয়ে বললো ,
” তুমি তাকে চিনবে না | আছে একজন| আর ঠিকই , তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্যই আমি কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম | তবে মন থেকে কখনো দূরে যেতে পারিনি | যাই হোক, তোমার লাইফের ডিসিশন তুমিই নিও | আমি কোনো ইন্টারফেয়ার করবো না | তবে পারলে মিথিলাকে আর একটা সুযোগ দিও | আমি আসছি |”
কথাটা শেষ করেই রূপকথা আর পেছনে ফিরে তাকালো না| অনন্ত আর মিথিলাকে একা করে দিয়ে কফিশপের দরজার বাইরে বেড়িয়ে এলো , আবার একটা একলা শহরে| চোখগুলো জ্বালা করছে এখন ওর | না চাইলেও বুকের জমাট বাঁধা কান্নাটা বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে এই মুহূর্তে | কিন্তু রূপকথা জোর করে নিজেকে আটকালো | হাতের মুঠোটা শক্ত করে জলটাকে থামানোর চেষ্টা করলো চোখের | রোজ রোজ তো কাঁদতে ইচ্ছে করে না| অনন্ত যার প্রথম থেকে ছিল , সব সময় তারই থাকবে| ওর মনের গোপন তো জানার দরকার নেই কারোর | এই লুকোচুরিটাই সত্যি রূপকথার জীবনে |
<১৪>
আজকে কলকাতার বুকে মেঘ করেছে | সারা আকাশ জুড়ে ছাই রং এর শেডিং | সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া চারিদিকটা এলোমেলো করে দিচ্ছে | আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হয়তো মেঘ ভেঙে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেবে শহরটাকে | কিন্তু তা ও অনন্ত গঙ্গার ধারের বেঞ্চটা ছেড়ে উঠছে না কিছুতেই | মনে হচ্ছে এইভাবেই সময়টা থমকে থাক এখানে | কারণ, আজ আর ওর সত্যি চলতে ইচ্ছা করছে না | বাড়ি ফিরে আর রূপকথার মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছে না | ওকে দেখে এই নকল বন্ধুত্বের অভিনয়টা করতে ইচ্ছে করছে না একদম | আর হয়তো পারবেও না এইসব ! নিজের ফিলিংসগুলোকে নিজের মনে রেখে দিতে | কিন্তু ওকে বলেই বা কি লাভ ! রূপকথার মনে তো অন্য একজন আছে | যাকে আবার অনন্ত চেনে না ! কথাটা ভেবেই ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে ওর | রাগ কষ্ট অভিমান সব কিছু একসঙ্গে এসে বুকে জমাট বাঁধছে এই মুহূর্তে | সব থেকে বেশি রাগ হচ্ছে রূপকথার ওপর | ওর মনের ওপর |
ছোটবেলা থেকে স্কুলের প্রজেক্ট থেকে আরম্ভ করে পরীক্ষার আগে পেন কিনে দেয়া , সবেতে অনন্ত | কলেজের ফ্রম ফিল আপ থেকে মাস্টার্সে ভর্তির লাইন , সেখানেও শুধুই অনন্ত | নিজের ছোট বড়ো কথা শেয়ার থেকে অষ্টমীর সকালের অঞ্জলি , সেসবেও একমাত্র সঙ্গী অনন্ত ; আর ভালোবাসার বেলায় কোথাকার কে অন্য একজন ! বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না কিছুতেই | মনে হচ্ছে ওই না চেনা ছেলেটাকে যদি একবার সামনে পেতো ! হয়তো শেষ করে দিতো আজ |
এর মধ্যেই বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়তে শুরু করেছে শহরে | টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি কয়েক সেকেন্ডেই অঝোর ধারায় বদলে গেছে | আর সেই জল এসে পুরোপুরিই ভিজিয়ে দিয়েছে অনন্তকে | তবুও যেন ওর ভেতরের জ্বালাটা মিটছে না এখন | যতবার ভাবছে রূপকথা একটা অন্য ছেলের জন্য এতো ভাবে যে দু বছর ধরে নিজের শহর, অনন্ত , সবার সাথে যোগাযোগ শেষ করে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে থাকতে পারে , ততবার ভেতর থেকে শেষ লাগছে নিজেকে | মনে হচ্ছে সে কি এমন ছেলে ! যার জন্য রূপকথার গোটা পৃথিবীটাই বদলে গেলো ! যার জন্য এতো আড়াল চলে এলো ওর মধ্যে ! কি এমন আছে সেই ছেলের মধ্যে , যেটা অনন্তর মধ্যে নেই | আচ্ছা , দোষটা কি ওরই ছিল প্রথম থেকে ! রূপকথাকে ভালোবাসে এই কথাটা বুঝতে কি ওর অনেক দেরি হয়ে গেছে ! আর দু বছর আগে মিথিলাকে ওদের মধ্যে এনে অনন্তই কি বুঝিয়ে দেয়নি যে ওর আর রূপকথার মধ্যে যা আছে সেটা শুধুই বন্ধুত্ব | অনন্তর মনের স্পেশ্যাল জায়গাটা অন্য কারোর জন্যই দখল করা | তাই হয়তো রূপকথাও কখনো অনন্তকে নিয়ে আলাদা করে ভাবেনি | এসব ভাবনার ভিড়ে সবকিছু কেমন ওলোট পালট লাগছে ওর | এবার রূপকথার সঙ্গে নিজের ওপরও রাগ হচ্ছে খুব | কেন নিজের মন , নিজের ফিলিংসগুলোকে বুঝতে এতটা সময় নিলো অনন্ত ! কেন যখন রূপকথা ওর খুব কাছে ছিল , তখন ওকে আলাদা করে দেখলো না ! ওকে ভালোবাসলো না ! তাহলে হয়তো আজ দিনগুলো অনেক অন্য রকম হতো !ওকে এই গঙ্গার ধারের বেঞ্চটায় এই সময় একা বসে ভিজতে হতো না এইভাবে |
সেইদিন অনন্তর এইসব এলোমেলো ভাবনার আড়ালেই রাত হয়ে গিয়েছিলো অনেকটা | বাড়ি যখন ফিরেছিল ও তখন ঘড়িতে এগারোটা বেজে গেছে | তবে বাড়ি এসেও আর কারোর সাথে কোনো কথা বলেনি | চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলো সেইদিন | আসলে সত্যি আজ আর জোর করেও কোনো কথা আসবে না ওর | চুপচাপ নিজের মধ্যে একা একা শেষ হয়ে যাওয়ার দিন আজ | একতরফা ভালোবাসা তো অনন্তও বেসেছিলো | কিন্তু রূপকথা বুঝলো না |
অনন্ত সেই রাতটা জেগেই কাটিয়েছিলো এরপর | ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখেছিলো অনেকক্ষণ | মনে হচ্ছিলো এতো কালো মেঘ ও বোধ হয় একসাথে কখনো আগে দেখেনি ! এতো বৃষ্টি ও কখনো এর আগে খেয়ালই করেনি | মেঘের ডাক , ঝোড়ো হাওয়া , বিদ্যুৎ এর ঝলকানি সবটাই আজ কেমন নতুন | আসলে এই বৃষ্টিটা কি শুধু বাইরের , না কি ওর মনেরও ! এই প্রশ্নটাকে ও সঙ্গে নিয়েই খুব ভোরে চোখটা লেগে গেছিলো অনন্তর| ঘুম আর স্বপ্নের মাঝে একটা মুখ ভেসে উঠেছিল তারপর |দুটো বড়ো বড়ো অভিমানী চোখ , কপালের মাঝে ছোট্ট সেই টিপ্ , আর মিষ্টি একটা হাসি , রূপকথা | আলো আঁধারি একটা পথ ধরে ওর দিকেই যেন এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে | কিন্তু তারপর হঠাৎ চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেলো | আর রূপকথা সেই কালো অন্ধকারের ভিড়ে কোথায় একটা হারিয়ে গেলো যেন | অনন্ত সেই অন্ধকারটার মধ্যে হাতড়াতে থাকলো , রূপকথা বলে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো | কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না | বদলে শুধু খুঁজে পেলো নিঃস্তব্ধ একটা অন্ধকার| আঁতকে উঠলো অনন্ত | ঘুমও মাঝে মাঝে মানুষকে শান্তির বদলে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা দিয়ে দেয় | এটা যে কোনো হারানোর স্বপ্ন দেখেছে , সে ই একমাত্র জানে |
কথাটা ভাবতে ভাবতেই পাশে রাখা ঘড়ির দিকে চোখ চলে গেলো ওর | সকাল দশটা বাজে | এতক্ষন ধরে ঘুমোচ্ছিলো আজ ! কথাটা মনে আসতেই দরজা ধাক্কানোর শব্দ এলো কানে | মা ডাকছে | না , আর দেরি না করে অনন্ত সটান উঠে দরজাটা খুললো | মা কফির কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে , আর এক হাতে একটা ভাঁজ করা ছোট কাগজ | অনন্ত ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলো না | তবে ওর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মা বলে উঠলো,
” প্লিজ রেগে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় কথাটা শুনিস | রূপকথা আজ ভোরবেলায়ই বেড়িয়ে গেছে | ওর বোলপুর যাওয়াটা খুব আর্জেন্ট ছিল | তুই ঘুমোচ্ছিলিস বলে তোকে আর ডাকেনি | তবে তোর জন্য এই চিঠিটা রেখে গেছে | পড়ে দেখিস|”
কথাটা শেষ করেই অনন্তর হাতে ওর মা চিঠিটা ধরিয়ে দিলো | তবে ওর মুখের এক্সপ্রেশন দেখে এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কোনো কিছু খাওয়ার মুডে আর অনন্ত নেই | তাই কফির কাপটা ওর মার্ হাতেই রয়ে গেলো এই মুহূর্তে | আর এর মাঝেই অনন্ত থমথমে মুখে নিজের ঘরে চলে এলো আবার |
খুব রাগ হচ্ছে এখন | রূপকথা ঠিক অনন্তকে কতটা টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নিয়েছে ! যে যাওয়ার আগে একবারও নিজের মুখে বলার প্রয়োজন মনে করলো না | শুধু একটা চিঠি হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো | কথাগুলো ভেবে রাগে মুখটা লাল হয়ে গেলেও চিঠিটা না খুলে থাকতেও পারলো না | কি লিখেছে রূপকথা ? প্রশ্নটা মনে আপনাআপনি এসে ভিড় করছে | যাই হোক , উত্তরটা খোঁজার জন্য অনন্ত চিঠির পাতায় চোখ রাখলো , আর রূপকথা কিছু শব্দ হয়ে বলে উঠলো ,
” চিঠিটা খোলার আগে নিশ্চয়ই তোমার খুব রাগ হচ্ছিলো অনন্ত আমার ওপর | তবে আমি জানি তুমি এটা না পড়েও থাকতে পারবে না | আসলে প্রিন্সিপাল ম্যামের ফোন এসেছিলো দুদিন আগে | উনি আমাকে খুব ভালোবাসেন বলে পাঁচ মাসের লিভটা নিতে পেরেছি | তবে এর বেশিদিন আর ওরা পার্ট টাইমার দিয়ে কাজ চালাতে পারবে না | তাই এরপর যদি না জয়েন করি তাহলে চাকরিটা হয়তো আর থাকবে না | আর তোমাকে এইসব কিছু বলিনি কারণ আমি জানি তুমি এইসব আগে থেকে জানলে কিছুতেই আমায় শান্তিনিকেতন ফিরতে দিতে না | জোর করে হলেও কলকাতায় রেখে দিতে | আর আমিও হয়তো তোমার মুখের ওপর না বলতে পারতাম না ! যাই হোক , তবে এবার একেবারে নিরুদ্দেশ হওয়ার জন্য যাচ্ছি না | কাকিমার কাছে আমার স্কুলের এড্রেসটা দিয়ে গেলাম | রাগ পরলে ওটা নিয়ে নিও | আর ফোন তো আছেই | আর যদি সময় হয় কখনো তো দেখা করতেও চলে আসতে পারো শান্তিনিকেতন | আর সব শেষে একটাই কথা , আমার নিজের গল্পটা তো ইনকমপ্লিট রয়ে গেলো | কিন্তু তুমি পারলে তোমার গল্পটা কমপ্লিট কোরো | ভালো থেকো মিথিলার সঙ্গে | ”
না, এরপর আর কিছু লেখেনি রূপকথা | শব্দগুলো এখানেই শেষ | কিন্তু অনন্ত তা ও চিঠিটা হাতে ধরে বসে আছে এখন | চিঠির লেখা শেষ লাইনগুলো বার বার মনে এসে ধাক্কা মারছে, আর একটাই কথা মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে , রূপকথার মতন ওর নিজের গল্পটাও তো ইনকমপ্লিট থেকে গেলো ! আর যার জন্য এই ইনকমপ্লিটনেস , সে ই বুঝলো না |

চলবে।