হৃদয়ের রং জানে না পর্ব-০৫

0
47

#হৃদয়ের_রং_জানে_না < পঞ্চম পর্ব >
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
এই নতুন খারাপ লাগাকে সঙ্গী করেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো অনন্তর | তবে এর মধ্যে ফিজিওথেরাপিটা কিন্তু রেগুলার করতে হচ্ছে ওকে | আসলে না করে এখন উপায়ও নেই | রূপকথা অতো সহজে ছাড়ার পাত্রী নয় | ও পণ করেছে অনন্তকে ঠিক করিয়েই ছাড়বে | আসলে এই কনফিডেন্সটা রূপকথার ওর ওপর থাকলেও ওর নেই নিজের ওপর | জীবনের এই একটা একসিডেন্ট অনন্তর ভেতরের জোড়টাকে যেন কেমন ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছিলো কয়েক সেকেন্ডেই | আসলে এটাই তো সত্যি | জীবনের চলার ভিড়ে হঠাৎ করে এমন কিছু মিনিট সেকেন্ড চলে আসে সামনে যেটা নিজের জন্য করা পুরোনো সব হিসেবগুলোকে উল্টে পাল্টে রেখে দেয় | আর বদলে ফেরৎ আসে নতুন একটা হিসেব | একটা না মেলা অংক |
৬ মাস আগে হয়া ওই এক্সিডেন্টটাও সেরকম অনন্তর কাছে | একটা না মেলা অংকের মতন | যেটা আজও চোখ বন্ধ করলে মাঝে মাঝে দেখতে পায় ও | আর একটা অদ্ভুত ভয় , যন্ত্রনা এসে ঘিরে ধরে ওকে | এখনও ভেসে ওঠে সেই দিনটার ছবি চোখের সামনে | ঐদিন সন্ধ্যেবেলা হসপিটালে ডিউটি শেষ করে বাইক নিয়ে ফিরছিলো বাড়ি রোজের মতন | কলকাতার ক্লান্ত রাস্তাঘাট , হালকা ট্রাফিক , অল্প ভিড় পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো অনন্তর বাইকটা স্পিডে | বাড়ি পৌঁছতে আর দশ মিনিট বাকি ছিল | কিন্তু তখনই হঠাৎ পেছন থেকে একটা স্করপিও খুব স্পিডে এসে ওর বাইকে ধাক্কা দিলো | অনন্ত কিছু বোঝার আগেই ছিটকে পড়লো রাস্তার ওপর , আর ওর বাইকটা এসে পড়লো ওর কোমরের ওপরেই | ব্যাস, তারপর আর কিছু মনে নেই | আচমকা চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে এসেছিলো ওর সামনে | সেন্স ফিরেছিল তিনদিন পর | কিন্তু ততক্ষনে যা শেষ হবার হয়ে গেছে | ওর কোমরের কাছ থেকে পা অব্দি শরীরটা তখন সাড়হীন | অনন্ত আর নিজের ইচ্ছেই ওর পা এর একটা আঙ্গুলও নাড়াতে পারছিলো না এরপর | যদিও ডাক্তার বলেছিলো এটা টেম্পোরারি প্যারালাইসিস | রেগুলার ট্রিটমেন্ট আর ফিজিওথেরাপি করলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে , কিন্তু অনন্তর কানে সেদিন কোনো কথাই আর যায়নি | হঠাৎ মনে হচ্ছিলো লাইফের যেই রেশটায় ও এতদিন দুরন্ত গতিতে ছুটছিল , আজ হঠাৎ সেটা থেমে গেছে | আর নিজের জীবনের সাথে ‘ইনভ্যালিড’ শব্দটা জুড়ে গেছে পুরোপুরি ভাবে | পাগলের মতন হাত দুটো দিয়ে সেদিন নিজের পায়ে কিল , চড় , ঘুষি মেরেছিলো ও অনেক্ষন | যদি কিছু ফিল হয় ! যদি যন্ত্রনাটা বুঝতে পারে ! যদি একবার পা এর পাতাটা নড়ে ওঠে ওর ! কিন্তু সেসব কিছুই আর হলো না | অনন্ত নিজের ক্লান্ত শরীর আর ক্লান্ত মন নিয়ে আস্তে আস্তে চেষ্টাটা করা বন্ধ করে দিলো |
তবে সেইদিন ওই নিথর শরীর নিয়ে আই.সি.ইউ তে শুয়ে শুয়ে অনন্তর আনমনে হঠাৎ হঠাৎ একটা মুখই বার বার ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে অকারণে |রূপকথাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব সেইদিন | মনে হচ্ছিলো অনন্তর ভেতরে যেই ঝড়টা চলছে সেটা আর কেউ বুঝুক না বুঝুক ওই মেয়েটা ঠিক বুঝবে | সেইদিন হসপিটালে মিথিলা , মা , আত্মীয় স্বজন অনেকেই এসে ভিড় করেছিল | কিন্তু ওর চোখ শুধুমাত্র ওই একটা চেনা মুখকেই খুঁজছিলো বার বার | মনে হচ্ছিলো একবার যদি ওই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটা ফিরে আসতো , একবার যদি ওই বাবা মারা যাওয়ার দিনের মতন ওর হাতটা এসে শক্ত করে ধরতো , তাহলে হয়তো এই লড়াইটা ও ঠিক জিতে যেত !
কথাগুলো আজও হঠাৎ রূপকথাকে দেখে আবার মনে পরে গেলো | একটু বেহিসেবি লাগলো নিজেকে | আজকাল যে কি হয় কে জানে ! এই মেয়েটা সামনে এলেই মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যায় অনন্ত | পুরোনো নতুন সবটাই তখন এলোমেলো লাগে ওর | মিথিলার জন্য কোনোদিনই তো এরকম ভাবনা আসেনি আগে | এই অকারণে এলোমেলো হয়ে যাওয়া , এই বুঝি হারিয়ে ফেলবো এরকম একটা ভয় , আর একসঙ্গে অনেক স্মৃতির ভিড় , এইসব কিছুই অনন্তর মিথিলাকে দেখে মনে হতো না কখনো , যেটা এখন রূপকথাকে দেখলে হয় | আসলে মিথিলার সাথে দু বছরের সম্পর্কটা যেন মনের থেকেও বেশি একটা নিয়ম রক্ষার মতন হয়ে গিয়েছিলো | কেরিয়ার , কাজের চাপের ফাঁকে মাসে একবার ডেটিংয়ে যাওয়াকে কখনোই ভালোবাসা বলে না | সেই টান, সেই ফিলিংস কখনোই দুজনের মধ্যে ছিল না | যেটা ছিল প্রথমে সেটা হলো এট্রাকশন বা মোহো | আর ওই এট্রাকশন দু চার মাস বাদেই কেটে গিয়েছিলো অনেকটা তাল কাটার মতন | আর তারপর একটা তালহীন , ছন্দহীন , লয়হীন রিলেশনশিপকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ওরা | আসলে শুরুতেই দুজনের বাড়ির লোক ব্যাপারটা জেনে গেছিলো | আর তখন তো মিথিলার বাবা মার্ কাছে অনন্ত ছিল সুপাত্র | এতো ব্রাইট ফিউচারের একটা ছেলেকে দেখে ওরা অনেক জামাই আদরই করেছিল এক সময়ে | তাই হয়তো মুখের ওপর না বলে বেড়িয়ে আসতে পারেনি অনন্ত মিথিলার জীবন থেকে | তবে যখন এক্সিডেন্টের পর মিথিলা বেড়িয়ে আসতে চেয়েছিলো অনন্তর কাছ থেকে , ও আটকায়নি একবারও | বরং সেই মুহূর্তে নিজেকে হালকা লাগছিলো অনেক | মনে হচ্ছিলো একটা জোরের লোক দেখানি সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেলো যেন | এইসব কথাই একমন দিয়ে ভাবছিলো অনন্ত | হঠাৎ রূপকথার কথায় সম্ভিত ফিরলো |
” এতো মন দিয়ে কি ভাবছেন আপনি ?”
অনন্ত এর উত্তর দিতে গিয়েও এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো এখন | রূপকথাকে এই নীল রংটাই বেশ মানায় তো ! ওর গলায় জড়ানো ওড়নাটা দেখে কথাটা হঠাৎ মনে হলো অনন্তর | আর নিজেই নিজের ভাবনা নিয়ে অবাক হয়ে গেলো ! দু বছর আগে কি কখনো রূপকথাকে এতো মন দিয়ে দেখেছে ও ? প্রশ্নটা আপনাআপনিই নিজেকে করে ফেললো মনে মনে | তবে রূপকথা ওর এই ভাবনার ভিড়ে এবার অসহ্য হয়ে গেছে | তাই নিজের গলার ভলিউমটাকে একটু বাড়িয়েই বললো এবার ,
” কি হলো বলবে ? তুমি যদি তোমার এই ভাবনার সাগর থেকে বেড়িয়ে আসো তাহলে তোমাকে কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা বলতাম | ”
কথাটা শুনে এবার অনন্ত কিছুটা নড়ে চড়ে বসলো | তারপর একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলো ,
” কি ইম্পরট্যান্ট কথা বলবি ? আবার কোনো নতুন ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করতে চাস না কি ? দ্যাখ , এইসব করে কোনো লাভ নেই | আমি এখন উঠে দাঁড়াতে পারছি | কিন্তু হাঁটতে আরো টাইম লাগবে | এর থেকে ফাস্ট রিকোভারি পসিবল নয় | আমি তো একটা সময়ে ডাক্তারি করতাম | তখন আমার মতন কেস অনেক দেখেছি | তাই বলছি |”
রূপকথা এবার আলতো হেসে এর উত্তর দিলো ,
” হয়েছে শেষ ? আচ্ছা তোমরা ডাক্তাররা কি ট্রিটমেন্ট , রোগ , ওষুধ এইসব ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারো না ? অদ্ভুত ! আর আমি কি বলেছি আমি অন্য ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করছি ! আমি একটা অন্য টপিক নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি এখন |”
অনন্ত এসব শুনে এবার দ্বিগুন অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলো ,
” অন্য টপিক ! সেটা আবার কি ?”
রূপকথা এবার মুখটাকে একটু সিরিয়াস করে বললো ,
” তোমার মনে আছে একটা সময়ে তুমি আমাকে কি বলতে ? যে তুমি নর্থ বেঙ্গলের ওপর একটা ট্র্যাভেল বুক লিখতে চাও | যেখানে তোমার তোলা পাহাড়ের সব ছবিগুলো থাকবে |”
কথাটা শুনে অনন্ত এবার একটু হকচকিয়ে গেলো ! এতদিন আগের কথা রূপকথা মনে রেখেছে ! তবে রূপকথা কথা থামালো না | ও বলেই চললো ,
” একটা সময় তো পাহাড়ের জন্য পাগল ছিলে | সুযোগ পেলেই বেপাত্তা হয়ে যেতে নর্থ বেঙ্গলে | তুমি তো মনে হয় ওখানকার অলিগলি চেনো | আর ওই পাহাড়ের ছবিগুলো ! মাঝে মাঝে মনে হতো তোমার ক্যামেরাটাকে আমি চুরি করে নিই , শুধু ওই ছবিগুলো পাওয়ার জন্য | তো যাই হোক, সেই বইটা তুমি এই ফ্রি টাইমটায় লিখে ফেলো | পাবলিশার আমি খুঁজে এনে দেব | সেসব নিয়ে ভেবো না |”
এতকিছু একসঙ্গে বলে রূপকথা এবার একটু থামলো অনন্তর উত্তরের অপেক্ষায় | কিন্তু অনন্ত তার বদলে হঠাৎ একটু প্রশ্ন করে উঠলো ,
” হ্যাঁ, ঠিক | নর্থ বেঙ্গলের অলিগলি আমি চিনি | অনেক ছবিও তুলেছি | কিন্তু এইসব ছাড়াও বই লেখার জন্য তো আর একটা জিনিস লাগে |সুন্দরভাবে কথা সাজিয়ে লেখার ট্যালেন্ট | যেটা আমার নেই | তাই বই করাও পসিবল নয় |”
রূপকথা এবার অনন্তর কথাটা শুনে একটু বিরক্ত হলো | তারপর কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললো ,
” ওহ হো , সব কথার শেষ কথাই তোমার ‘পসিবল নয়’ | আমি বাংলার স্টুডেন্ট আছি কি করতে শুনি তোমার সামনে ! তুমি লিখতে পারো না জানি | কিন্তু বলতে তো পারো | তোমার এক্সপিরিয়েন্সের কথা , জায়গাগুলোর নাম , যাওয়ার রাস্তা , অন্য ইনফরমেশন | এইসব কিছুকে লেখার দায়িত্ব আমি নিলাম , হয়েছে |”
<১০ >
সেইদিন রূপকথার কথাগুলো শেষ হওয়ার পর আপনাআপনিই একটা হাসি চলে এসেছিলো অনন্তর মুখে | আসলে এরকম একটা বই করার ইচ্ছা ওর সেই কলেজ লাইফ থেকে ছিল | তবে ভাবেনি কখনো সেটা লেখা হবে হুইল চেয়ারে বসে | না , এর জন্য এখন দুঃখ হচ্ছে না , তবে অদ্ভুত লাগছে খুব| এই আগের ছ মাস তো এতটা পজিটিভলি ভাবতে পারেনি কখনো | তখন তো বরং মনে হতো ওর পা এর মতন জীবনটাও নিথর, প্রাণহীন | আসলে একটা রাতেই যখন সব কিছু পাল্টে যায়, ‘ইনভ্যালিড’ এর মতন একটা শব্দ এসে জুড়ে যায় জীবনে, তখন চারিদিকটা অন্ধকারই লাগে | যেই অনন্ত একটা সময়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ট্রেক করতো , তার যখন একদিন বিছানা থেকে হুইল চেয়ার অব্দি পৌঁছতে গেলেও মায়ের ওপর ভর করতে হতো , তখন সত্যি মনে হতো মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা| মনে হতো আর হয়তো কখনো উঠে দাঁড়ানো হবে না ওর এই জীবনে|
আর শেষ করে দেয়ার চেষ্টাও যে করেনি নিজেকে তা না | কত রাত হাতের শিরার ওপর ব্লেডটা ধরে বসে থেকেছে | কতবার ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপটা পুরোপুরি শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে ; কিন্তু চেষ্টাটা সফল করতে পারেনি কিছুতেই | নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনার মতন সাহস জোগাড় করতে পারেনি মনে | মৃত্যুভয় এসে শেষ মুহূর্তে ঘিরে ধরেছে ওকে | আর হাত থেকে তখনই ওই ব্লেড, ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপগুলো ছিটকে পরে গেছে দূরে| আর হঠাৎ করে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই চেনা মুখটা , রূপকথার হাসি, গলার আওয়াজ সব কিছু | এক্সিডেন্টের পর যেন আরো বেশি করে মনে পরতো মেয়েটাকে | মনে হতো নিজের শেষ হয়ে যাওয়ার আগে কি আর একটাবারের জন্য দেখা হবে না ওর সাথে ! এই জীবনে কি সত্যি আর কখনো অনন্ত দেখতে পাবে না রূপকথাকে | এসব ভেবে ভেবে মাঝে মাঝে খুব রাগও হতো| কেন এইভাবে কিছু না বলে চলে গেলো রূপকথা ! কেন যাওয়ার আগে অন্তত একটা ফোন নাম্বারও দিয়ে গেলো না নিজের ! প্রশ্নগুলো নিজেই নিজেকে করতো বার বার | আর তখন চারিদিকটা যেন আরো বেশি অন্ধকার লাগতো অনন্তর | মনে হতো এই অন্ধকারটা কোনোদিনই আর কাটবে না| নতুন সকাল আসবে না আর জীবনে| তবে হঠাৎ ওই দুপুরে ওর সব হিসেবকে ভুল সাজিয়ে একটা আলো এসে ঢুকেছিলো অনন্তর ঘরে| যার নাম রূপকথা| হ্যাঁ, প্রথমে যদিও খুব রাগ হয়েছিল দেখে , তবে সেই পুরোনো অভ্যাসের মতন রাগটাকে রূপকথার ওপর জমিয়ে রাখতে পারেনি অনন্ত | ফিরে গিয়েছিলো ওই বন্ধুত্বটার কাছে সব ভুলে | তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারটা কাটতে শুরু করেছিল ওর জীবনে |
হয়তো এতদিন ধরে একা লড়াই করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো অনন্ত! রূপকথা আসতে মনে হলো দলটা এবার একটু ভারী হয়েছে নিজের | এখন ঠিকঠাক লড়তে পারবে | এই সময় ফিজিওথেরাপিগুলোর প্রত্যেকটা সেশন এ অনন্ত যখন ক্লান্ত ,নিস্তেজ হয়ে যেত, রূপকথা এসে শক্ত করে ওর হাতটা ধরতো | যখন উঠে দাঁড়ানোর পর এক পা এগোতে গিয়েই আর জোর পেতো না , রূপকথা তখন পাশে দাঁড়িয়ে বার বার মনের জোর দিয়ে যেত | যখন রোজ রোজ ওষুধ খেতে খেতে বিরক্তি চলে আসতো মনে, রূপকথা তখন বাচ্চাদের মতন বুঝিয়ে হলেও ওষুধটা ঠিক খাইয়ে দিতো | এইভাবে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে চালাতেই অনন্ত একটা সকালে নিজে চলতে শুরু করলো | অনেকদিনের পরিশ্রম , চেষ্টা , ট্রিটমেন্ট সব কিছুকে সত্যি করে অনন্তর এই চলার শুরু হয়েছিল| তবে সেদিন ও রূপকথাকে এই শুরুর ব্যাপারে এমনি এমনি জানতে দেয়নি | একটা সারপ্রাইজ দিয়েছিলো ওকে| সকাল সকাল লাঠির ওপর ভর করে এক কাপ কফি নিয়ে ওর ঘর অব্দি গিয়েছিলো | ঘুমন্ত রূপকথা তখনও একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিল| অনন্তর গলার আওয়াজই সেই স্বপ্নে আলতো করে ভেসে এসেছিলো একবার , দুবার , তিনবার| আর এই শেষবারের ডাকটা সব থেকে জোরে ছিল | তাই রূপকথার স্বপ্ন ভেঙে আচমকা চোখ খুলেছিলো , আর তারপর যা দেখেছিলো সামনে , সেটা দেখে মনে হচ্ছিলো ও হয়তো এখনও স্বপ্নের ভেতরেই আছে! অনন্ত নিজে দাঁড়িয়ে ওর সামনে ! দৃশ্যটা দেখেই ও লাফিয়ে উঠে বসেছিল খাটে| চোখগুলো কেমন বড়ো বড়ো করে তাকিয়েছিলো অনন্তর দিকে | কাল অব্দি জানতো যে অনন্তর চলার জন্য শুধু লাঠিই না , অন্য একজনের কাঁধে ভরও করতে হয় | কিন্তু আজ তাহলে এটা কি দেখছে !
তবে ওর কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই অনন্ত বলে উঠেছিল হাসতে হাসতে ,
” রূপকথা তুই কি ভুত দেখলি ? চোখটাকে আর বড়ো করিস না | আর একটু হলে নিচে খুলে পরে যাবে |”
রূপকথা এসব শুনেও কোনো উত্তর দেয়নি সেই মুহূর্তে | ও অবাক চোখে অনন্তর দিকে তাকিয়েই ছিল| কোনো কথা আসছিলো না মুখে | তখন অনন্তই আবার বলে উঠলো ,
” আরে তুই কি সত্যি কিছু বলবি না ? ঠিক আছে ছার্ | বলতে হবে না | কফি খা| এটা তো নিশ্চয়ই করতে পারিস |”
কথাটা শেষ করেই অনন্ত হাতে ধরা কফির কাপটা রূপকথার দিকে এগিয়ে দিলো| আর এই সময়ই রূপকথার ঘোরটা কাটলো একটু | তা ও বিস্ময়টাকে সঙ্গে নিয়েই ও জিজ্ঞেস করেছিল,
” এসবের মানে কি? তুমি চলতে পারো? তাহলে কাল অব্দি ঐভাবে ধরে ধরে হাঁটছিলে যে !”
প্রশ্নটা শুনে অনন্ত এবার কিছুক্ষন পজ নিলো , হাসার জন্য| ও রূপকথার ঠিক এই রিয়্যাকশনটাই দেখতে চাইছিলো | তারপর একটু কথা সাজিয়ে বললো,
” বেশ কয়েকদিন ধরে তোর সামনে এক্টিং করছিলাম | নইলে এই সারপ্রাইজটা কি দিতে পারতাম ! তোর জন্মদিনে | এনিওয়েজ হ্যাপি বার্থডে… মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে ..”
রূপকথা এতকিছু জানার পরও চুপ এখন| কিছুতেই কি বলবে বুঝতে পারছে না! আসলে কিছু কিছু মুহূর্তে জীবনে এমন হয় , যখন শব্দেরা কম পরে যায়, আর নির্বাক হয়েই মুহূর্তটা কাটিয়ে দিতে হয় | এরকম একটা সকাল , এরকম একটা জন্মদিন রূপকথার জীবনে আসবে , সেটা ও এই দু বছরে কখনো ভাবতেই পারেনি! সেই সময় তো এই দিনটা ক্যালেন্ডারের অন্য ডেটগুলোর মধ্যে হারিয়ে যেত কোথাও | রূপকথা নিজেও আলাদা করে মনে রাখার চেষ্টা করতো না | আর আজ কেউ একজন ওর এই দিনটাকে মনে রাখার মতন করবে বলে এতো প্ল্যানিং করেছে ! ভেবেই চোখটা চিক চিক করে উঠলো হঠাৎ জলে | তবে সঙ্গে মুখে একটা হাসিও ছিল | অনন্ত এই মুহূর্তে এসে ওর হাতটা শক্ত করে ধরলো | ও বোঝে অনেক ভিড়ের মধ্যে রূপকথার একাকীত্বটা | আগে কখনো এতো মন দিয়ে ভাবেইনি এই মেয়েটাকে নিয়ে | কিন্তু ওই দু বছরে সব হিসেবই উল্টে পাল্টে গেছিলো ওর| কেউ হারিয়ে গেলেই হয়তো আলাদা করে মনে আসে তাকে! জানে না অনন্ত, ঠিক এই কারণের জন্যই কি না; তবে এখন রূপকথাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতে ইচ্ছা করে খুব | রূপকথার ভেতরের কথাগুলো বুঝতে ইচ্ছে করে ওর | এই মাঝের দু বছরের হারানো কথাগুলোকে বলতে ইচ্ছে করে ভীষণ| কিন্তু অনন্ত জানে, এখন রূপকথার মধ্যে একটা আড়াল চলে এসেছে | আগের মতন সহজ, বেহিসাবি ব্যাপারটা আর নেই | এখন ও অনন্তর খুব কাছে থাকলেও মন থেকে অনেক দূরে| তাই হয়তো
রূপকথার হাতের রান্না খেয়ে অনন্ত যখন প্রশংসা করে, তখন ওর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না আর আগের মতন, বা, কোনো ভয়ের সিনেমা দেখতে দেখতে আনমনে অনন্তর হাতটা শক্ত করে ধরে না আর ও কখনো , বরং নিজের মধ্যেই কুঁকড়ে থাকে কেমন | এখন কোনো বৃষ্টি ভেজা দিনে হাসি মুখে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে সেই জলের ছাট দিয়ে ভিজিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে না আর অনন্তকে | এখন বর্ষা নামলে রূপকথা জানলার পাশে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ | বৃষ্টি দেখে আর ওর মুখে হাসি আসে না, বরং ওই কালো মেঘগুলোর মতন গম্ভীর, থমথমে হয়ে থাকে রূপকথা | অনন্ত সবই খেয়াল করে | বুঝতে পারে | কিন্তু চাইলেও কিছুতেই এই দু বছরের তৈরী কাঁচের দেয়াল ভাঙতে পারে না |
<১১>
যাই হোক , আজকের এই সারপ্রাইজটা হয়তো ওদের মধ্যে থাকা ওই কাঁচের দেয়ালটা একটু হলেও ভাঙতে পেরেছে | আর তারপর সন্ধ্যেবেলা অনন্ত মায়ের সঙ্গে মিলে কেকও বানিয়েছিলো রূপকথার জন্য| শুধু তাই নয়, বিকেলে বেড়িয়ে নিজে পছন্দ করে একটা শাড়িও কিনে এনেছে ওকে গিফ্ট করবে বলে| তবে আজ হঠাৎ শাড়ির দোকানে গিয়ে অনন্তর সেই দুর্গাপুজোর দিনটার কথা মনে পরে গেলো | মিথিলার জন্মদিনের জন্য ওরা দুজন শাড়ি কিনতে গিয়েছিলো একটা দোকানে| রূপকথা নিজে পছন্দ করে দিয়েছিলো সেই শাড়িটা | আচ্ছা , সেদিন কি অনন্তর উচিত ছিল রুপকথাকেও কিছু কিনে দেয়া ! ওর মুখটা কি ফেরার সময় থমথমে হয়ে যায়নি সেইবার ! প্রশ্নগুলো অনন্তর মনে এসে ভিড় করেছিল আনমনেই আজ | যাই হোক, এসব ভাবনার ভিড়েই রূপকথা এসে হাজির ড্রইং রুমে | সেন্টার টেবিলে রাখা কেকটা দেখে এই মুহূর্তে একটা হাসি চলে এলো ওর মুখে| তার ওপরে অনন্তর মা নিজের হাতে ওকে সাজিয়ে দিয়েছে| নিজের একটা লাল রঙের সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে জোর করে | এতো কিছুর পর সত্যি আজ খুব স্পেশ্যাল লাগছে নিজেকে | এইসব ভাবনার ভিড়েই রূপকথা খেয়াল করলো অনন্তর দিকে | অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে এখন | হাতে আবার একটা গিফ্ট | রূপকথার এবার লজ্জা লাগছে একটু | অনন্ত নিজের হাতে কেক বানিয়েছে ওর জন্য ! তারপর আবার গিফ্টও কিনে এনেছে ! এতকিছু কখনো কারোর কাছ থেকে পায়নি তো একসঙ্গে| আর এই দু বছরে কারোর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার ইচ্ছে , অভ্যাস , দুটোই চলে গেছে | তাই এখন একটু অস্বস্থি হচ্ছে ওর | কিন্তু এসবের মধ্যে অনন্ত ওর সামনে এসে শাড়িটা দিয়ে বলে উঠলো ,
” এটা তোর জন্য এনেছি | দ্যাখ পছন্দ হলো কি না শাড়িটা | ”
রূপকথা কথাটা শুনে হঠাৎ থমকে গেলো যেন | পুরোনো সেইদিনটা না চাইতেও মনে পরে গেলো ওর| সেইদিন ওই নীল রঙের শাড়িটা তো ও নিজের ভেবেই পছন্দ করেছিল | কিন্তু অনন্ত বোঝেনি | যাই হোক , এই স্মৃতির ভিড়েই রূপকথা একটু জোর করে হেসে শাড়িটা নিলো | তারপর কিছু কথা সাজিয়ে আস্তে গলায় বললো,
” এসবের কি দরকার ছিল ! আর পছন্দ কেন হবে না! তুমি কিনেছো যখন ভালোই হবে | থ্যাঙ্ক ইউ | ”
কথাটা শুনে অনন্ত এবার আলতো হাসলো| তবে ওই শাড়িটা পাওয়ার পরে রূপকথার কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমথমে হয়ে যাওয়া মুখটা খেয়াল করেছিল ও | কিছু পুরোনো কথা কি মনে পরে গেলো রূপকথার! প্রশ্নটা নিজের মনে এসেই ভিড় করলো| যাই হোক , এরপর সেইদিনের সন্ধ্যেটা বেশ ভালোই কেটেছিল | রূপকথা আজ মন থেকে খুশি সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো | আর অনন্তরও সেটা দেখে ভালো লাগছিলো | তবে সেই সন্ধ্যেতে ওর আর একটা কথাও মনে হচ্ছিলো খুব | আচ্ছা, এই ভালো লাগাটার নামই কি ভালোবাসা ! ও কি রূপকথাকে এখন ভালোবাসে ! বন্ধুর থেকে বেশি কিছু মনে করে ! না কি এই ফিলিংসটা ওর মধ্যে অনেকদিন ধরেই ছিল ; একদম শুরু থেকে | অনন্ত আজ বুঝলো | আর যদি ভালো না বাসতো তাহলে রূপকথার চলে যাওয়ার পর ওর কেন মনে হতো যে ভেতর থেকে কিছু একটা শেষ হয়ে গেছে! কেন ভিড় রাস্তায় কারণে অকারণে অচেনা মুখের আড়ালে ও শুধু ওই একটা মুখকেই খুঁজে যেত বার বার ! কেন এক্সিডেন্টের পর নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা মাথায় এলেও, সেই কাজটা করতে পারতো না ! থামিয়ে রাখতো মৃত্যুকে ! শুধু রূপকথাকে আর একবার দেখার ইচ্ছের জন্যই তো | আজ ওদের মধ্যে যতই কাঁচের দেয়াল থাক , না দেখা দূরত্ব থাক, তবে একটা কথা তো সত্যি , রূপকথাকে না দেখলে ওর দিনটা কমপ্লিট হয় না | ওর হাসি, ওর কথা মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে কানে শুনতে পায় অনন্ত | রূপকথা ওর হাতটা শক্ত করে ধরলে আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে অনন্তর | এটাই তো ভালোবাসা | এটাই তো এমন একটা ফিলিং যেটা শুধু একজনের জন্য হয় | যার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করা যায় | আর সেই অপেক্ষার মুহূর্তগুলোকেই ভালোবাসা যায় |
তবে এই ফিলিংসটাকে আর বেশি দিন রাখবে না অনন্ত নিজের মধ্যে | রূপকথাকে এবার ও সব বলে দেবে | ওর এতদিনের জমানো ভালোবাসার কথা | আর ও জানে , উত্তরটা কখনোই ‘না’ হবে না | রূপকথা হয়তো কখনো কিছু বলে না ! তবে চুপ থেকেই ভালোবাসে | নইলে এই খারাপ সময়ে অনন্তর পাশে এতো শক্তভাবে দাঁড়াতে পারতো না ! ওর এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া জীবনটাকে এতো সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিতে পারতো না |
কিন্তু এখন শুধু একটাই অপেক্ষা | আবার প্র্যাকটিস শুরু করবে অনন্ত | তার জন্য বেশ কয়েকটা হসপিটালে এপ্লাইও করেছে | আর এক্সিডেন্টের আগের তিন বছরে ওর সার্জেন হিসেবে কলকাতায় বেশ ভালোই নাম হয়েছিল | সেই ডক্টর অনন্ত বোসকে এতো সহজে নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যায়নি | ও জানে খুব তাড়াতাড়িই কোথাও থেকে একটা রেসপন্স ঠিক চলে আসবে | আর একবার প্র্যাকটিসটা শুরু করেই অনন্ত রূপকথাকে নিজের ফিলিংসের ব্যাপারে বলবে |

চলবে।