হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-০৫

0
288

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৫]

সিদাতের সারা পথ তর্ক এবং দাঁড়ানোর মধ্যেই কাটলো। আর তরী নীরবে সিদাতের কান্ড দেখছিলো। কন্ডাক্টর সিদাতের থেকে ডাবল ভাড়া পেয়ে আর কিছু বলেনি৷ যখন তরীর ভার্সিটির সামনে এসে বাস থামে তখন তরী সন্তর্পণে বাস থেকে নেমে যায়। সিদাতও তরীর পিছু পিছু নামে। সিদাত ভার্সিটির সামনে নেমে এক গাল হেসে বললো,
–“আমার ধন্যবাদটা পুষিয়ে দিলাম।”

তরী থমকে দাঁড়ালো। পিছে ফিরে সিদাতের চোখে চোখ রাখলো। সিদাত থমকে যায়৷ চেয়ে রয় সেই আঁখিদ্বয়ে। ওই চোখ জোড়ায় কিছু একটা আছে, যা সিদাতকে চুম্বকের মতো টানে। হৃদপিন্ডের ওঠা-নামা বাড়িয়ে তোলে। তরী সিদাতের দিকে দুই ধাপ এগিয়ে খুবই শান্ত, শীতল গলায় বলে,

–“এক, ‘ধন্যবাদ’ নয়। আমাকে আপনার “স্যরি” বলা উচিত ছিলো। কারণ, আপনি রাত-বিরেতে আরেকজন মেয়ের ঘরে মাতাল অবস্থায় ঢুকে পরেছেন। আর দুই এত তর্কে লিপ্ত না হয়ে অন্য সিট থেকে একজন মহিলাকে আমার পাশে বসিয়ে দিতে পারতেন।”

এই কথাটুকু বলে তরী লম্বা লম্বা কদম ফেলে ভার্সিটির ভেতরে চলে গেলো। আর সিদাত হতবুদ্ধি হারিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। সিদাতকে এক্সপ্লেইন করার মতো কোনো সুযোগ-ই দিলো না তরী। কীভাবে সিদাতকে বোকা বানিয়ে চলে গেলো! সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রিকশা নিতে যাবেই এমন সময় দুজন মেয়ে এগিয়ে বেশ খুশি হয়ে বললো,
–“আপনি আর-জে সিদাত ফারহান না?”

সিদাত স্মিত হেসে বললো, “জি।”

মেয়ে দুজন তার সাথে ছবি তুলে চলে গেলো। আর সিদাত একটি সিএনজি রিজার্ভ করে কোথাও চলে গেলো। আজ ছন্নছাড়া হয়ে একা একা পুরো শহর ঘোরার ইচ্ছে আছে।

আজ সাইফ চাচ্ছিলো সিদাতকে তার মায়েদের সাথে পাত্রীদের বাসায় পাঠাতে। কিছু কারণ বশত সেদিন পাত্রী দেখতে যাওয়া হয়নি। পাত্রীর মা অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি ছিলো। এজন্যে সাঈদ সাহেব কিছুদিন সময় নিয়েছিলেন। সাইফ সিদাতকে সেখানে যেতে বলায় সিদাত এক কথায় না করে দেয়। সাইফ এমনিতেও প্রচন্ড জেদী এবং নাছোড়বান্দা স্বভাবের। এজন্যে সাইফ তার কোনো কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বেঁকে বসেছিলো। কৌশলে সিদাতের বাইকের চাবিও সরিয়েছে। যাতে করে সিদাত সাইফের কথা শুনতে বাধ্য থাকে। নয়তো এই বাইকের চাবি সে পুরো এক সপ্তাহেও দিবে না। সিদাতও বাইকের পরোয়া না দিয়ে ভাইয়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। এসব মেয়ে দেখতে যাওয়াতে সিদাত একদমই আগ্রহী নয়। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। নিজের জন্যে হলে মানা যায়, তাই বলে বড়ো ভাইয়ের জন্যে? অসম্ভব ব্যাপার।

সিদাতের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে তরীর কথাগুলো। কন্ঠ তার চোখের মতোই নরম, স্নিগ্ধ, মোহনীয়। কিছু কন্ঠস্বর আছে না, একবার শুনলে বারবার শুনতে ইচ্ছে হয়? তরীর কন্ঠস্বরও সিদাতকে সেরকম অস্থির করে তুলেছে। সবচেয়ে বেশি মাত্রায় অস্থিরতা কাজ করছে তরীকে উত্তর দিতে না পারায়। এজন্যে সিদাত পকেট থেকে ফোন বের করে হাতে নিলো। মোবাইলের নোট প্যাডে গিয়ে নিজে নিজেই উত্তর লিখলো,
–“এইযে, নিকাব রাণী। তুমি তো আমায় ভুল বুঝলে। বাসে তখন খুব ভীড়। এমন অবস্থায় কোনো মহিলাকে অনুরোধ করে আমার সিটে বসতে বললে হয় আমার সিট অন্য জনের দখলে চলে যেত নয়তো সেই মহিলার সিট। তাহলে লাভের লাভ কী হতো? কিছুই না। তার চাইতে বরং সিট খালি থাকুক, আমিও নাহয় দাঁড়িয়ে-ই থাকবো। আর সে-রাতে আমার হুঁশ ছিলো না। স্ব-জ্ঞানে এই ধরণের কাজ আমি কখনোই করতাম না। তবে তুমি যদি চাও, ঠিক আছে তাহলে আমি ‘স্যরি’। স্বল্পভাষী নিকাব রাণী!”

এটুকু টাইপিং করে ক্ষান্ত হলো। চেপে থাকা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলে আবার সেই লেখাগুলো কেটে দেয় সে। ফোনে বারবার সাইফের কল আসছে। সিদাত চুপ করে দেখে ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিলো।
সিএনজি ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো,
–“কোথায় যাবেন স্যার?”

সিদাত সিটে পিঠে এলিয়ে বাইরে চেয়ে আনমনে বললো,
–“চলতে থাকুক সিএনজি। আজ শহর ঘুরতে ইচ্ছে করছে।”

————————–
সাঈদ সাহেব চোখে চশমা পরে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন। তার সামনের মূর্তির মতো বসে আছে সাইফ। হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে হাঁটুর কাছে শক্ত করে চেপে বসে আছে। পা জোড়া কাঁপছে কেন যেন। বাবার ভয়েই বোধহয়। সাঈদ সাহেব মুখখানা যেরকম গম্ভীর করে আছে, তাতে সাইফ কিছুটা দমে আছে। মিনিট পাঁচেক পরপর সাঈদ সাহেব পত্রিকা রেখে চোখের চশমা খুললেন। সাইফ সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। সাঈদ সাহেব হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–“বিয়ে নিয়ে তোমার কোনো আপত্তি আছে সাইফ?”

সাইফ আমতা আমতা করে বললো,
–“না, বাবা। নেই। তবে..”
সাইফ থেমে গেলো। সাঈদ সাহেব ডান দিকে মাথা মৃদু এলিয়ে ভ্রু কুচকে চাইলো ছেলের দিকে। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,
–“তাহলে? কাউকে পছন্দ করে রেখেছো?”

সাইফ তাতেও “না” জানায়। সাঈদ সাহেব বললেন,
–“সব ঠিক থাকলে মাঝে আবার “তবে” আসে কেন? কেন এমন আচরণ করছো? অবশ্যই সত্য বলবে। তুমি জানোই, আমি মিথ্যে পছন্দ করি না।”

সাইফ বিব্রত হয়ে বললো,
–“আমার বিয়েতে আপত্তি নেই বাবা। তবে আমি চাই, যাকে স্ত্রী করবো তাকে আগে আমার পছন্দ হোক, তার ব্যবহার-আচরণ সব বিবেচনা করেই আমি আমার স্ত্রী বেছে নিবো। আর কিছু না বাবা!”

সাঈদ সাহেবের মুখশ্রী জুড়ে থাকা গম্ভীর ভাব মিলিয়ে যেতে শুরু করে। তিনি আলতো হেসে বললো,
–“সেটা তো অবশ্যই আমার বড়ো আব্বু। সব দেখে-শুনেই তোমার স্ত্রী নির্বাচন হবে। চিন্তা করো না। এখন বড়ো’রা যা করছে তা করতে দাও। সিদাতকে এদিকে টেনো না। ও তোমার ছোটো। তবে মনে রেখো, তোমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। সব তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। তোমার বিয়েটা তোমার মায়ের ইচ্ছেতে হচ্ছে। তাই মাকে নিরাশ করো না!”

শেষ কথাগুলো বলে সাঈদ সাহেব চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাবার কথা শুনে সাইফ কিছুটা দমে গেলো। অধরে অধর চেপে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থেকে বললো,
–“বাবা, আমি আসছি!”
সাঈদ সাহেব অনুমতি দিলেন। সাইফ সোজা চলে গেলো তার মা অর্থাৎ জয়ার ঘরে। সাঈদ সাহেব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আপনমনে শুধালো,
–“কেন আমাকে প্রতিনিয়ত পোড়াচ্ছো জয়া? আমি তো তোমাকে নিয়েই দিব্যি ছিলাম। তাহলে তুমি কেন আমায় তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলে? ফিরোজাকে আর ঠকাতে পারছি না। কাঁধে থাকা পাপের বোঝা দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটুও বুঝলে না তুমি আমাকে? আমাকে বাধ্য করলে আগুনে ঝাপ দিতে! কেন?”

————————
রাজনীতি নিয়ে তরীর মামা রাজিবের খুব বেশি-ই আগ্রহ। তার ফেসবুক ভর্তি বিভিন্ন নেতাদের ব্যানার ছবি দিয়ে। সে বোধহয় ফেসবুক চালানো শিখেছেই এসব কীর্তি করার জন্য। সুদূর জামালপুর থেকেও সাঈদ সাহেবকে নিয়ে তার ভীষণ চর্চা। সাঈদ সাহেবের বড়োই অন্ধভক্ত সে। সাঈদ সাহেব এবং তার দুই ছেলের প্রসংশা বার্তা সবসময় তার ঠোঁটে ঝুলে থাকে। যখন তখন যার তার সাথে সেসব ছেড়ে দেয়। তরী মামাকে নিয়ে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত। ফেসবুকে প্রবেশ করলেই মামার ওসব আপলোড করা ব্যানারের ছবি চোখের সামনে ভাসবে। কখনো না দেখা সিদাতকেও মামার এসব ছবির মাধ্যমেই দেখেছে। তবে বিরক্তির ব্যাপার এটা না। ব্যাপার হচ্ছে যতবার আপলোড করবে ততবার তরীকে মেসেজ করে বলবে,
–“ভাগনি, সুন্দর করে লাইক মেরে আসো তো। আমি পুস্ত দিছি!”

পোস্ট বানানটা সবসময় “পুস্ত” লেখা থাকে। মামা গুরুজন মানুষ। তরী চাইলেও তাকে এড়িয়ে চলতে পারে না, তার অবাধ্যও হতে পারে না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই মামার বদ্ধ পাগলামি সে নীরবে গিলে নেয়। এখনো একই ভাবে গিলে নিলো। আজকের ব্যানারে সাইফ রয়েছে। সাবিয়া তো মাঝেমধ্যে মামার লেখা ভুলভাল বানান পড়ে খুব হাসে। যখন আবার শুদ্ধ বানান দেখা যায় তখনও সাবিয়া হেসে হেসে বলে,
–“নির্ঘাত এগুলা মৌসুমি আপু টাইপ করেছে।”

তরী চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মৌসুমি মামার একমাত্র মেয়ে। বড়ো ছেলে একজন ছিলো। কিন্তু কোনো এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। যেদিন ছেলে পরিবার ছাড়লো সেদিন-ই মামা রাজিব ঘোষণা দিলো, আজ থেকে তার কোনো ছেলে নেই। তার ছেলে মৃ*। মৌসুমি আপু এখন বিয়ের উপযোগ্য। মামাও তাই পাত্র খুঁজতে ব্যস্ত।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]