হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-১০

0
439

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১০]

সিদাত তরীদের বৈঠকঘরে বসেছে। চারপাশে কতক্ষণ চোখ বুলালো। ঘর মোটামুটি সাধারণভাবেই গোছানো। সাথে একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ পাচ্ছে সিদাত। আতরের ঘ্রাণ। কিন্তু এ ঘরে আতর কে দিবে? হয়তো-বা রুম স্প্রে’র ঘ্রাণ। টিভিটা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ টিভি দেখতে আগ্রহী না। এজন্যই তো ওটা অবহেলায় পরে আছে।

সিদাতের ভেতরটা তবুও অস্থির লাগছে। একজন বন্ধু অসুস্থ হলে মানুষ যেমন উদ্বিগ্ন হয়, তেমনই উদ্বিগ্ন সিদাতও। তার বারবার ইচ্ছে করছে তরীর কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু মেয়েটা যে ব্যতিক্রমধর্মী। সিদাত একদম-ই চায় না নিকাব রাণীর পর্দা ভঙ্গ হোক। থাকুক না আড়ালে, আবডালে। সিদাতের তাতে কোনো অভিযোগ নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যে অধরে বিনয়ী হাসি ফুটিয়ে ফুপি আসলো। হাতে তার চা এবং বিস্কুট। চায়ের ট্রে-টা সিদাতের সামনের টি-টেবিলে রেখে সিদাতের মুখোমুখি বসলো ফুপি। সিদাত কন্ঠ কিছু নমনীয় করে বললো,
–“এসবের কী প্রয়োজন ছিলো আন্টি?”

ফুপি হাসলো। সাবিয়া সিদাতের ব্যাপারে বলেছে। সিদাত নাকি এমপির ছোটো ছেলে। অথচ তার ব্যবহার, কাজ দেখো। কী সুন্দর। বাবার বিগড়ে যাওয়া ছেলের কাতারে সিদাতকে সে কিছুতেই ফেলতে পারছে না৷ বরং ফুপি ভীষণ সন্তুষ্ট সিদাতের উপর। ফুপি হাসি বজায় রেখে বললো,

–“তুমি যেই উপকার করেছো তাতে এটুকু আপ্যায়ন তো করতেই পারি তাই না?”

সিদাত কিছু বললো না। চুপ করে বসে রইলো। কথা বলতে কেমন আড়ষ্ট অনুভব হচ্ছে। সিদাত বললো,
–“এটা প্রতিবেশি হিসেবে আমার কর্তব্যের মধ্যে পরে আন্টি। প্লিজ এভাবে বলে বারবার লজ্জা দিবেন না।”

–“আচ্ছা, তা না দিলাম। কিন্তু তুমি তো এমপি সাহেবের ছেলে। তুমি পাশের ফ্ল্যাটে কী করছো?”

সিদাত কিছুটা দমে গেলে পরমুহূর্তে হেসে বললো,
–“বন্ধুর বাসা আন্টি। রাতে এখানেই ছিলাম!”

ফুপি এবার সব বুঝতে পারলো। সিদাত চায়ের কাপ হাতে তুলে নিতেই ফুপি বিনয়ী কন্ঠে বললো,
–“এমপি সাহেব আর যাই করুক, তার ছেলেদের সুন্দর শিক্ষা দিয়েছে।”

সিদাত চায়ে চুমুক দিয়ে চাইলো ফুপির দিকে। ফুপির কথার পিঠে শুধু মুচকি হাসি দিলো। কোথাও নিজের জন্যে বাবা-মায়ের প্রসংশা পাওয়াটা সত্যি-ই হৃদয়ে শান্তি বয়ে আনে। সিদাতও এই মুহূর্তে সেই শান্তি অনুভব করলো। চা শেষ করে আলতো কন্ঠে বললো,
–“আন্টি… আপনার ভাইঝি..?”

–“খাবার এবং ওষুধ খাইয়েছি। এখন ঘুমোচ্ছে।”

সিদাত আড়ালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ফুপির সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সিদাত বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। ফুপি সিদাতের আন্তরিকতায় বরাবরই মুগ্ধ। আজ তরীর উছিলায় এই চমৎকার চরিত্রের ছেলেটাকে স্ব-চক্ষে দেখতে পেয়ে ভেতরটা প্রফুল্লতায় ভরে যাচ্ছে।

সাবিয়া এতক্ষণ দরজার আড়াল থেকে সবটা দেখলো এবং শুনলো। সিদাতের মিষ্টিভাষী কথাবার্তায় সাবিয়া ভীষণ চমকে গেছে। সেদিন সিদাতকে নিয়ে যা ধারণা ছিলো, আজ তো তা একদমই বদলে গেলো। বড়োলোকের ছেলেরাও বুঝি এতটা নম্র, ভদ্র হয়? তাহলে সেদিনের মাতাল হওয়ার ঘটনা কী?

বিকাল অবধি ঝড়-বৃষ্টি চললো। আছরের পর থেকে মেঘলা আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। বৃষ্টিতে নিমজ্জিত শহর আবার নতুন করে ব্যস্ত জীবনে ফিরছে। বৃষ্টির পরে সারা শহরে অদ্ভুত, স্নিগ্ধ একটা গন্ধ ছড়িয়েছে। কিন্তু আফসোস, বেশিরভাগ যান্ত্রিক মানবের নাকে সেই গন্ধ নাকে লাগছে না। সিদাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বুজে সেই ঘ্রাণ নিলো। ক্ষণে ক্ষণে খুব লম্বা নিঃশ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করলো। হাত দুটো ব্যস্ত সিদাতের শার্টের বোতাম লাগাতে। অফিসের জন্যে রেডি হচ্ছে সিদাত। বোতাম লাগাতে লাগাতে ভেতরে এসে চুল ঠিক করে কালো ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

তালা লাগাতে লাগাতে তরীর কথা ভাবলো সিদাত। তালা লাগিয়ে তরীর ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইলো। কিছু একটা ভবতে ব্যস্ত সে। কিছু একটা জানতে চাচ্ছে। হয়তো-বা তরী কেমন আছে তা জানতে চাইছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সদর দরজায় নক করে তাদের বিরক্ত করতে চাইছে না। তার ওপর অফিসেও যেতে হবে। তাড়া আছে। এজন্য সিদাত দরজায় চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আপনমনে আওড়ালো,
–“সুস্থ হয়ে যাও নিকাব রাণী!”

——————–
বিকালের দিকে তরীর জ্বর কিছুটা কমেছে। গা জুড়ে ঘাম দিয়েছে। জ্বরটা নেমে গেলেও মাথা প্রচন্ড ভার, খাবারে অরুচি, ঠান্ডায় গলা খুঁশখুঁশ করে। তাতেও বিশেষ সুস্থ লাগছে না তরীকে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে চোখ জোড়া অবশ, হালকা লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে ভাঁজ পরেছে। সাথে ডার্ক সার্কেল তো আছেই। মুখটাও শুকিয়ে ছোটো হয়ে গিয়েছে। বড়ো বোনের এমন অবস্থা দেখে সাবিয়ার চোখ জোড়া বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাবিয়া নিজেকে সামলে নিচ্ছে। যতটা পারছে বোনের সেবা করছে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। তরী শোয়া থেকে উঠে বসেছে।

পিটপিট করে সাবিয়ার দৌড়াদৌড়ি নীরবে দেখলো সে। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। জ্বরে কাবু হয়ে নিজেকে রোগী করে ফেলেছে সে। তরী তাও বহু কষ্টে সাবিয়াকে ডাকলো। ডাকতে গিয়ে বুঝলো গলায় বিদঘুটে খশখশ করছে যেন। গলার স্বরটাও কেমন বদলে গিয়েছে। তরীর নিজের কন্ঠ চিনতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও পরমুহূর্তে বুঝলো এটা তারই গলা।

তরীর ডাক শুনে সাবিয়া ছুটে এলো বোনের কাছে। হাতের উলটোপিঠে তরীর গাল, গলা, কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা চেক করতে করতে বললো,
–“বলো আপু!”

তরী ঘোলা চোখে বোনের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আবারও ভাঙা গলায় বললো,
–“এত ছুটতে হবে না। তোর পড়াশোনা আছে। পড়তে বস।”

তরী পুরো কথা শেষ করার আগেই সাবিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“আমার কাছে তোমার সুস্থতা আগে জরুরি আপু। পড়ালেখার জন্যে সময় পরে আছে প্রচুর।”

তরী আর কিছু বললো না। পিছের বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো! সাবিয়াও আর কিছু বললো না। চলে গেলো ফুপিকে সাহায্য করতে। কতটুকুনি বোন তরীর। অথচ সে ব্যস্ত পায়ে বোনের জন্যে ছোটাছুটি করছে। ফুপিকে সাহায্য করছে। বোনটা তরীর ভীষণ আদরের। নীরবে কিছুক্ষণ সেভাবেই চুপ করে বসে থাকলেও পরমুহূর্তে কী ভাবে চোখ বুজেই বালিশের নিচে হাতড়ালো। হাতের নাগালে কিছু না পাওয়ায় চোখ মেলে চাইলো। আবার খুঁজতে গিয়ে খামটা আঙুলে লাগলো। তরী তখনই খামটা বের করে নিলো। আবার উলটে পালটে দেখে বুঝলো সকালে যা দেখেছে তা ভুল দেখেনি। আসলেই এই চিঠিটা তার জন্যে।

খাম থেকে চিঠিটা নিয়ে দেখলো পুরো পেজ খালি। তরী ভীষণ চমকালো। এটা কী হলো? শুধু মাঝে একটা লাইন লেখা। তাও ছোটো করে। তরী তার ঝাপসা চোখ ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে ভালোভাবে চোখ বুলালো লেখাটাতে। সেখানে লেখা,
–“নিকাব রাণী, আমার নীরব বন্ধু হবে তো?”

তরী হতভম্ভ। এইটুকু একটা লেখার জন্যে এত আয়োজনেএ কী আছে তরী বুঝলো না। অবাকের রেশও কাটলো না। বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজ কার!

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]