হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-০৯

0
262

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৯]

তরীর আজ গা কাঁপিয়ে তীব্র জ্বর উঠেছে। বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পরলেই তরী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। একে তো তরীর জ্বর তার ওপর বাহিরে ভীষণ ঝড়। সাবিয়াও মাদ্রাসা যায়নি। এদিকে তরীর এত জ্বর অথচ ওষুধ আনতে ফার্মেসী যাওয়াও হচ্ছে না। ফুপির দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পরেছে। কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছে না।

দুর্ভাগ্যবশত আজ-ই নাপা এক্সটিনের পাতা সম্পূর্ণ খালি। নয়তো জরুরি, দরকার হতে পারে এই ভেবে আকবর সাহেব সবসময় ঘরে নাপা, নাপা এক্সটিনের পাতা এনে রাখতেন। এখন তো আকবর সাহেব নেই৷ এজন্য ওষুধ বিষয়ক ঘাটাঘাটিও কেউ করে না। তবে এখন ওষুধ ছাড়াও চলছে না। ফুপি বারবার ছোটাছুটি করছে। সে ফার্মেসী চিনে না, ঝড় বৃষ্টি দিয়ে খোঁজাও সম্ভব না। ঘরেও পুরুষ মানুষ নেই, যে ছুটে গিয়ে ওষুধ এনে দিবে।

সাবিয়া বোনের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে নামাজে দাঁড়িয়েছে। সাবিয়া যখন খুব বেশি ভয় পেয়ে যায় অথবা বেশি বিপদে পরে তখন নামাজ পড়া তার অভ্যাস। তরী জ্বরের ঘোরে বিড়বিড়ালো,
–“সাবিয়া, তুই ঠিকাছিস তো? এই ঝড়-বৃষ্টি দিয়ে মাদ্রাসায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রাস্তা-ঘাটে রিকশা, গাড়ি কিছুই পাবি না। ঘরে থাক, আমি হুজুরকে কল করে জানিয়ে দিবো।”

এখন বেলা বারোটা বাজে। তীক্ষ্ণ রোদে পুরো শহর চকচক করে, সেই সময়টায় সন্ধ্যার ক্ষীণ আঁধারী অবস্থা। যেন এখনই সন্ধ্যা নামবে। এতটাই ঝড় হচ্ছে। অথচ টিভি ছাড়লে আবহাওয়া খবর শুনলে বুঝবে দক্ষিণ দিকে ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়েছে। এজন্যে দেশের সব জায়গায় কম-বেশি এরকম ঝড়-বৃষ্টি চলছে।

ফুপি একপ্রকার অশান্ত হয়ে বসা ছেড়ে উঠে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
–“এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসলে চলবে না। পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটার থেকে সাহায্য চাইতে হবে। সে-ই নাহয় এনে দিবে ওষুধ!”

তরীর কানে ফুপির কথাগুলো ভালোভাবেই প্রবেশ করলো। অবচেতন মস্তিষ্কে সিদাতের চেহারা ভেসে উঠলো। ফুপিকে বারণ করে দিতে চাইলো। মিনমিনিয়ে বললো,
–“না, ফুপি। প্রয়োজন নেই। তুমি যেও না। আমি ঠিক আছি!”

আফসোস, ফুপি তার কথা শুনতে পেলো না। সে আগেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো। তরীর হঠাৎ গা কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। জোরে চার-পাঁচবার হাঁভি দিয়ে ওঠলো। সাবিয়া সালাম ফিরিয়ে জলদি বোনের কাছে এলো। তরীর কপালে, গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা চেক করতে করতে বললো,
–“খারাপ লাগছে আপু? কেমন লাগছে আমাকে বলো!”

তরী বহু কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বললো। সাবিয়া তার কান তরীর কাছে আনলো। তরী আটকে গলায় বললো,
–“খুব শীত করছে!”

সাবিয়া সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ঘরে গিয়ে আলমারি খুললো। আলমারি থেকে দুটো মোটা কম্বল টেনে আনলো তাদের ঘরে। অতঃপর সেগুলো তরীর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে থার্মোমিটার আনলো। এতক্ষণ খেয়ালে আসেনি থার্মোমিটারের কথা।

থার্মোমিটার এনে সেটা তরীর মুখে দিয়ে রাখলো। ওদিকে ফুপি ব্যস্ত হয়ে অনয়ের ফ্ল্যাটের দরজা ধাক্কাচ্ছে। সিদাত হাই তুলতে তুলতে দরজার দিকে এগুচ্ছে। চোখ জোড়ায় এখনো ঘুম লেপ্টে আছে৷ অনয় সেই সকালেই অফিস চলে গেছে।

সিদাত সকাল সকাল তরীর জন্যে চিঠি লিখে সেটা তাদের ঘরের সামনে রেখে কতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো তরীর জন্যে। যখন টের পায় তরীদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলেছে তখন সিদাত দরজা আলতো ফাঁক করে দেখতে পায় তরী তার লেখা চিঠিটা কুড়িয়ে নিচ্ছে। দরজা আগেই খুলে রেখেছিলো বিধায় তরী দরজা খোলার শব্দ পায়নি। তরীকে দেখে সিদাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভেবেছিলো, যাক ঠিক মানুষের হাতেই চিঠিটা পরেছে। এরপর খুব সাবধানে দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গিয়েছে। অনয় তখনো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলো।

সিদাত দরজা খুলতেই তরীর ফুপিকে দেখতে পেলো। তবে তাকে সিদাত চিনতে পারেনি৷ ঘুমটাকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক গলায় বললো,
–“জি, কিছু দরকার?”

ফুপি দ্রুত করে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। অতঃপর ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
–“আমি পাশের ফ্ল্যাট থেকে এসেছি বাবা। আমার বড়ো মেয়েটা খুব অসুস্থ। জ্বরে কাবু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় বাসায় ওষুধ-পত্র নেই। ফার্মেসী থেকেও যে আনবো সেই পরিস্থিতিও নেই। তুমি একটু সাহায্য করো বাবা।”

ফুপির কথা শুনে সিদাতের ঘুম উবে গেছে। সিদাত চোখ কপালে তুলে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
–“সে কী! এমন হলো কী করে? দাঁড়ান, আমি দেখি বাসাতে ওষুধ আছে কী না!”

বলেই সিদাত উলটোদিক ফিরে লম্বা লম্বা কদম ফেলে ভেতরে চলে গেলো। ফুপির কথা শুনে সিদাতের বুঝতে বাকি নেই তার নিকাব রাণী-ই কঠিন জ্বরে কাবু। এজন্যে ভেতর থেকে চাপা অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা কাজ করছে। কপালে ভাঁজ পরেছে নিজের অজান্তেই। সিদাত তন্ন-তন্ন করে ওষুধের বক্স খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। সিদাতের খুব রাগ হলো অনয়ের উপর। কোনো রকমে রাগ সামলে আবার দরজার সামনে আসলো। ফুপি এখনো একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সিদাতের মনে পরলো, সে তো এই বড়ো মানুষটাকে ভেতরে এসে বসতে বললো না। নিজের বোকামীতে নিজেই বিরক্ত এবং লজ্জিত হলো।

ফুপির উদ্দেশ্যে খুবই ম্লান গলায় বললো,
–“দুঃখিত আপনাকে ভেতরে আসতে বলিনি। আপনি এক কাজ করুন, ওনাকে কিছু খাওয়ান আগে। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি!”

এতক্ষণে যেন আশার আলো দেখতে পেলেন ফুপি। তার এখানে আসার সিদ্ধান্তটা বিফলে যায়নি। ফুপি শুকনো হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“সমস্যা নেই। তুমি ওষুধটা তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো বাবা। দুঃখিত, তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি!”

সিদাত সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে কন্ঠস্বর কিছুটা উঁচিয়ে বললো,
–“আরে নাহ। এভাবে বলে লজ্জা দিবেন না আন্টি। আমরা আমরাই!”

ফুপি চলে গেলেন। ফুপি যেতেই সিদাত ভেতরে এসে অনয়কে কল লাগালো। কিন্তু এই মুহূর্তে এসে অনয়ের ফোন বন্ধ। সিদাত রাগে, ক্ষোভে নিজের অজান্তেই অনয়কে কঠিন গা*লি দিয়ে বসলো। এরপর মিনমিন করে বললো,
–“শালা! দরকারের সময় এরে পাওয়া যায় না!”

সিদাত উপায় না পেয়ে গায়ে রেইনকোর্টটা জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। কাছাকাছি এক ফার্মেসীতে গেলো ওষুধ আনতে। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে ফার্মেসীর শাটার অর্ধেক নামিয়ে রাখা হয়েছে। সিদাত জ্বর, ঠান্ডার মেডিসিন নিয়ে আবার ফিরে এলো। অনয় এই রেইনকোর্টটা ঘরে রেখে ভালো একটা কাজ করেছে। ছাতা টানার ঝামেলা পোহাতে হলো না।

সিদাত বিষণ্ণ চিত্তে ওষুধের প্যাকেটটা নিয়ে তরীদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে সকালেও সুস্থ-সবল দেখেছিলো। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এমন কী হলো যে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পরে গেলো? বাই এনি চান্স, বৃষ্টিতে ভিঁজেছিলো? সিদাত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা নক করলো। দরজা খুলে দিলো ছোটো, অল্প বয়সী একটা মেয়ে। সাবিয়া সিদাতকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সে হয়তো ভেবেছিলো সিদাত নয়, অনয় থাকবে। কিন্তু এ যে দেখছি সিদাত। দ্বিতীয়বারের মতো তাদের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে আজ স্ব-জ্ঞানে।

সাবিয়াকে দেখে সিদাত অনুমান করলো, এটাই তরীর ছোটো বোন। তাই তার দিকেই ওষুধের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“ওষুধের পেছনে লেখা আছে, কোনটা কয় বেলা খেতে হবে।”

সাবিয়া মাথা নিচু করে ওষুধের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বললো,
–“ঠিকাছে। ধন্যবাদ।”

সাবিয়া দরজা লাগিয়ে দিবে, এমন পর্যায়ে সিদাত প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“তরী এখন কেমন আছে?”

সাবিয়া ভারী অবাক হলো সিদাতের মুখে তরীর নাম শুনে। সে নিজের বিস্ময় চেপে বললো,
–“সেরকম ভালো না। তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রী! দোয়ায় রাখবেন আপুকে।”

সিদাত চোখে-মুখে বেদনা ফুটিয়ে আপনমনেই বিড়বিড়ালো,
–“ফি-আমানিল্লাহ্। নিকাব রাণী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাও!”

সাবিয়া দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গেলো। সিদাত কিছুক্ষণ সেভাবেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। অতঃপর অনয়ের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রেইনকোর্টটা প্রথমে খুললো। রেইনকোর্ট চুইয়ে চুইয়ে বৃষ্টির পানি পরছে। সিদাত রেইনকোর্ট খুলে অনয়ের ফ্ল্যাটের তালা খুলতেই যাবে ওমনি ফুপি দরজা খুলে বললো,
–“সাবিয়া বুঝি মুখের ওপর দরজা লাগিয়েছে? ওর কাজে আমি সত্যি লজ্জিত। তুমি ভেতরে এসো, চা খেয়ে যাও! এত কষ্ট করলে!”

সিদাত পিছে ফিরে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় বললো,
–“আরে না, না। এত ব্যস্ততার প্রয়োজন নেই। আপনি রোগীর খেয়াল রাখুন!”

ফুপি শুকনো হেসে বললো,
–“তুমি আসো তো। আমার ভালো লাগবে। “না” করো না, অনুরোধ।”

সিদাত অনুরোধ ফেলতে পারলো না। বললো,
–“ঠিকাছে।”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]