হৃদয় জুড়ে তার ছায়া পর্ব-৬+৭

0
150

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৬
#আদওয়া_ইবশার

নাহিদের পরীক্ষার আর মাত্র একদিন সময় আছে। এরপরই দীর্ঘ চার বছরের ফার্মাকোলোজি কোর্সের অবসান ঘটবে। ছোট বেলা থেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন রেখে নাহিদ স্বপ্ন দেখতো ফার্মাসিস্ট হবার। এই শব্দটার প্রতি ভিষণ দূর্বল ছিল ছেলেটা। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিয় বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবার আশায়। ভাগ্য ফেরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলেও পছন্দের বিষয়টা পায়নি সে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সুযোগ হয়েছিল তার। কিন্তু যে বিষয়ে মন টানেনা সেই বিষয় নিয়ে চর্চা করার যতই সুযোগ আসুক একজন স্বপ্নবাজ ছেলের পক্ষে সেই সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না কখনো। নাহিদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। মাইগ্রেশন চালু রেখেও যখন কাঙ্ক্ষিত বিষয়টা ভাগ্যে আসেনি তখন অনেকটাই ভেঙ্গে পরেছিল নাহিদ।একটা সন্তান যখন কিছু একটা নিয়ে জীবনে সফল হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। তখন সেই স্বপ্নটা শুধু সন্তানের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। ছড়িয়ে পরে বাবা-মায়ের মাঝেও। নাহিদের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ না পেয়ে নাহিদ ভেঙ্গে পরলেও আশাহত হয়নি তার বাবা-মা। সুদূর রাজশাহী থেকে ঢাকায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি অনুষদে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জনের জন্য পাঠিয়ে দেন ছেলেকে। পারিবারিক অবস্থানের কথা মাথায় রেখে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অত্যধিক খরচের কথা ভেবে প্রথমে রাজি হয়নি নাহিদ। বাবা সাইদুর রহমান বনবিভাগের সাধারণ একজন কর্মকর্তা। মা শাহিনূর একটা প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক। মা-বাবার স্বল্প আয়ে নাহিদ’রা তিন ভাই-বোন সহ পাঁচ সদস্যের পরিবারটা সচ্ছলতার সাথে দিন পার করতে পারলেও বুঝতে পেরেছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানো টা বাবা-মায়ের পক্ষে একটু কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু বাবার যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে পাড়ি জমাতে হয়েছিল তাকে অচেনা শহরে স্বপ্নকে পুঁজি করে। সাইদুর রহমান ছেলের আপত্তির বিষয়টা জানতে পেরে ছেলেকে নিজের পাশে বসিয়ে একদিন বলেছিল,

‘আমি একটা ফল গাছ কিনে এনে বাড়ির আঙ্গিনায় রূপন করলাম। গাছটার যত্নে একটুও ক্রটি রাখলাম না। নিয়ম করে গাছের গুঁড়িতে সকাল -বিকাল পানি দিলাম। কিছুদিন পর পর ছেটে আগাছা মুক্ত করে সুন্দরভাবে বাড়তে দিলাম গাছটাকে। সেই গাছটা বড় হয়ে একসময় কি আমাকে ফল দিবে না?’

উত্তরে নাহিদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। ছেলের সম্মতিসূচক আচরণ পেয়ে সাইদুর রহমান পূণরায় বলেছিল,

‘মনে কর তুই আমার একটা ফল গাছ। তোকে এখন আমি যত্ন করে বড় করছি। জৈব সার, পানি হিসেবে টাকা দিচ্ছি সৎ পথে খরচ করে জ্ঞান অর্জন করার জন্য। কঠোর পরিশ্রমের পর মেধা অন্বেষণ শেষে যত্ন দিয়ে বড় করে তোলা গাছের ফল হিসেবে তুই আমাকে সফলতা দিবি। আমি যেন গর্ব করে বুক ফুলিয়ে মানুষের কাছে বলতে পারি আমার ছেলে একজন সফল ফার্মাসিস্ট। আমি আর তোর মা কখনো সেভিংস এর কথা ভাবি না। না ভাবি তোর ছোট দুইটা ভাই-বোনের কথা। শুধু ভাবি তোর কথা। কারণ আমাদের বিশ্বাস তুই জীবনে সফল হয়ে একদিন আমাদের অবসর দিয়ে ছোট ভাই-বোন দুটোর দায়িত্ব নিবি। মানুষ বলে না ”আশায় বাঁচে চষা”। আমি আর তোর মা হলাম সেই চাষা। আর তুই আমাদের এই জরাজীর্ণ পৃথিবীর বুকে এক টুকরো উর্বর জমির ফসল।পারবিনা আমাদের এই আশাটা পূরণ করতে?’

বাবার কথা গুলো শুনে সেদিন নাহিদ বিমূঢ় হয়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে। সেদিন থেকেই একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পারে পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতি তার দায়িত্বটুকু। ছোট্ট একটা গল্পের ছলে খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দেয় সাইদুর রহমান ছেলেকে তার দায়িত্ব। সাথে এটাও বুঝিয়ে দেয় তারা বাবা-মা হিসেবে কতটা আশাবাদী বড় সন্তানের প্রতি। এরপর নাহিদ আর একটা বাক্যও উচ্চারণ করেনি। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়েই চিরচেনা শহর ছেড়ে পাড়ি জমায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাবার বলা কথা গুলো প্রতিটা মুহূর্তে স্বরণে রেখে লেগে পরে স্বপ্ন জয়ের যুদ্ধে। এখানে এসেই পরিচয় হয় লাবিব, রাফিন, নাজিমের সাথে। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাবের চারজন যুবক সময়ের সাথে সাথে হয়ে ওঠে একে অপরের প্রিয় বন্ধু। প্রথম কয়েক মাস হোস্টেলে থাকলেও বেশিদিন হোস্টেলের নানান প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে নি তারা কেউ। পরবর্তীতে চারজন একসাথেই খিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় দুই রুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। এরপর থেকেই আরও গাঢ় হয় তাদের চারজনের বন্ধুত্বের বন্ধন।

রাত প্রায় আনুমানিক এগারোটা হবে। নাহিদ, লাবিব, রাফিন তিনজনই এখনো বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে আছে।মাথায় চিন্তা একটাই তাদের যে করেই হোক একদিনের ভিতর সম্পূর্ণ সিলেবাস রিভাইস দিতে হবে। রেজাল্ট ভালো না হলে চারটা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, অর্থ, সময়, স্বপ্ন সব কিছুই জলে যাবে।এসবের মাঝে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা মাথায় নিয়ে রুম জুড়ে পায়চারি করছে নাজিম। বন্ধুদের মাথায় কিভাবে ভালো রেজাল্ট করতে পারবে এমন চিন্তা থাকলেও তার মাথায় একটাই চিন্তা, কিভাবে তার দেড় মাস বয়স হওয়া প্রেমটাকে টিকিয়ে রাখবে। গতকাল নাহিদকে খ্যাপানোর ফলস্বরূপ তার কথা অনুযায়ী প্রাণ প্রিয় বন্ধুদের ইজ্জতে হাত না দিলেও একদিনের জন্য তিনজনের ফোনটাই নিজের জিম্মাই নিয়ে নেই। পরিবারের কোনো সদস্য থেকে ফোন আসলে নিজের হাতে রেখেই ফোন লাউডে রেখে কথা বলতে দেয়। যখনই তিন বন্ধুর তথাকথিত গার্লফ্রেন্ডের কল এসেছে। ঠিক ততবারই কেটে দিয়েছে নাহিদ। ফলস্বরূপ আজ নাজিমের গার্লফ্রেন্ড কল না ধরার অপরাধে ব্রেকআপের মতো চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে তাকে। আর এই ব্রেকআপ শব্দটা শোনার পর থেকেই নাজিমের অবস্থা করুণ। এমনিতেই বেচারার কপালে গার্লফ্রেন্ড জুটেনা। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে যাও একটা ঝুটিয়েছে সেটাও পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়াল দেবার পথে। সন্ধ্যা থেকে এখন পযর্ন্ত নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্যাচআপ করার। কিন্তু তাকে সেই সুযোগটাই দিচ্ছেনা। যত গুলো যোগাযোগ মাধ্যম আছে সব গুলো থেকেই একে একে ব্লক মেরে যাচ্ছে ছেলেটাকে। তিন বন্ধুই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নাজিমের অসহায় অবস্থা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসছে। অবশেষে রাফিন না পেরে বলে ওঠে,

‘কি রে শা’লা! তোর টয়লেট আটকে গেছে না কি? মুখটাকে এমন কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীর মতো করে রাখছিস ক্যান?’

রাগে ফুসতে ফুসতে বন্ধুর দিকে তাকাল নাজিম। দেখতে পেল তিনজনই ঠোঁট টিপে হাসছে। মুহূর্তেই চটে গেল নাজিম। তিরিক্ষি মেজাজে বলে ওঠল,

‘শা’লা তোদের মতো মিরজাফর আমি জীবনে দেখি নাই। আমার দুঃখ দেইখা তোরা হাসতেছিস। মনে রং লাগছে না?’

‘আগুন লাগাইলো নাহিদ্দেয়া আগুন লাগাইলো।’

নাজিমের কথা শেষ হবার পর পরই লাবিবের গলা ছেড়ে এমন গান শুনে তিন বন্ধু একত্রে অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। চার বন্ধুর এমন হাসি-আনন্দের মাঝেই নাহিদের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ‘মা’ লিখা শব্দটা। সাথে সাথেই ওঠে দাঁড়ায় নাহিদ। বন্ধুদের থেকে সরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকায়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে মমতাময়ী মায়ের কন্ঠ নিঃসৃত আওয়াজ,

‘কেমন আছিস বাবা?’

মুচকি হাসে নাহিদ। দিনের ভিতর না হলেও দশবার কল আসে মায়ের নাম্বার থেকে। প্রতিবারই ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই এই একটা কথা সবার আগে ইথারে ভেসে আসে।,

‘মা, সন্ধ্যায় না বললাম ভালো আছি। এখন আবারও জিজ্ঞেস করছো কেমন আছি!দিনের ভিতর এই এক কথা কতবার জানতে হয় তোমার বলো তো?’

‘যতবার আমি আমার ছেলের কাছে ফোন করব ততবার জানতে চাইবো এই কথা। তোর উত্তর দিতে এতো পরিশ্রম লাগে কেন শুনি? যে মায়ের সন্তান দূরে থাকে সে জানে প্রতি মুহূর্তে সন্তানের জন্য কেমন চিন্তা হয়। প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে মনটা সন্তানের চিন্তায় কেমন ছটফট করে। তুই বুঝবি কি এসবের?’

‘এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো এমনি মজা করে বললাম। আচ্ছা বাদ দাও এসব। খেয়েছো? বাবা কোথায়?’

ছেলের কন্ঠে একটু আহ্লাদের আভাষ পেয়ে বুঝদার মায়ের মনটা যেন মুহূর্তেই বাচ্চাসুলভ হয়ে উঠল। অভিমানে ঠাঁসা কন্ঠে বলল,

‘আমি খেলেই কি আর না খেলেই কি? ছেলে তো এখন বড় হয়ে গেছে। তাকে যেখানে নিজের ভালো মন্দের কথা জিজ্ঞেস করলেই বিরক্ত হয় সেখানে আমার খাওয়া না খাওয়ার খোঁজ জানার কোনো প্রয়োজন আছে তার?’

ঠোঁট কামড়ে কতক্ষণ চুপ থেকে নাহিদ বলল,

‘মাঝে মাঝে না বাবার প্রতি খুব মায়া হয় আমার জানো? তোমার মতো এমন একটুতেই অভিমানে গা ভাসানো একজন মানুষকে আমার শান্তশিষ্ট বাবা’টা এতো বছর যাবৎ কিভাবে সহ্য করছে! ভাবতেই তাজ্জব বনে যায় আমি।’

ছেলের এমন কথায় এবার যথেষ্ট রাগ হয় শাহিনূরের। শত মাইল দূরে থেকেও নাহিদ ঠিকই বুঝে নেই তার মা’টা রেগে মুখ ভার করে বসে আছে চুপচাপ। দিনের অর্ধেক সময় বাচ্চাদের সাথে থেকে থেকে মা’ও কেমন দিন দিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে! কথাটা ভেবেই হেসে ফেলে নাহিদ। মা’কে আর না রাগিয়ে আদুরে স্বরে বলে,

‘ও মা! কয়েকদিন ধরে তোমার হাতের রান্না খুব মিস করছি। বুয়ার হাতের রান্না খেতে খেতে এখন মুখের রুচিই চলে গেছে।কতদিন ধরে তোমার কোলে মাথা রাখি না তার হিসাব রেখেছো? রাখবে কেন? আমি দূরে তো কি হয়েছে? আরও দুই ছেলে-মেয়ে তো আছেই তোমার কাছে।’

মান-অভিমান সব ধুয়ে মুছে হঠাৎ করেই শাহিনূরের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠল ছেলের কথায়। তার ছেলেটা কি জানে, নাড়ী ছেড়া ধনটাকে এতো দূরে রেখে শাহিনূর নিজেও যে শান্তিতে থাকতে পারে না! না পারে ভালো কিছু রান্না করলে মুখে দিতে। খেতে বসলেই মাথায় আসে সবার আগে ছেলেটা খেল কি না এই চিন্তা। ঘুমাতে গেলেও এটাই চিন্তায় আসে ছেলেটা এখনো রাত জেগে আছে না কি ঘুমিয়েছে।’

‘অনেক দিন হলো তো আসিস না। এই বৃহস্পতিবার চলে আয়! শুক্রবার সারা দিন থেকে না হয় শনিবার আবার চলে যাবি!’

‘ভুলে গেছো কাল দিন পরই যে আমার এক্সাম? এই মুহূর্তে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাওয়া আমার পক্ষে পসিবল? দোয়া করো ভালোই ভালোই এক্সাম গুলো শেষ হোক। এরপরই তোমার ছেলে ঠিক তোমার কোলে ফিরে যাবে।’

চলবে……

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৭
#আদওয়া_ইবশার

দেখতে দেখতে দিন পেরিয়ে মাস কেটেছে। জরাজীর্ণ পৃথিবীর বুকে আগমন ঘটেছে ঋতুরাজ বসন্তের। চারিদিকের মাতাল হাওয়া ফিসফিসিয়ে জানন দিচ্ছে প্রকৃতি নতুন যৌবন ফিরে পেয়েছে। সাজিয়ে নিয়েছে নিজেকে বাহারি রঙের পুষ্পপল্লবে। কোনো এক কারণ বসত জীবনের পথচলায় মানুষ থমকে গেলেও থমকায় না কখনও সময়। সে তার নিজ গতিতে এগিয়ে যায় বর্তমানকে অতীতে ফেলে ভবিষ্যতের দিকে। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মানুষকে ধাবিত করে একটু একটু করে জীবনের অন্তিম মুহূর্তের দিকে। নাহিদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে সপ্তাহ খানিক আগেই। চার বন্ধু একসাথেই ঢাকা শহরের মতো ব্যস্ত নগরীকে সাময়িক বিদায় জানিয়ে ফিরে গেছে আপন নীড়ে শেকড়ের টানে। নাজিম, রাফিন আর লাবিবের বাড়ি ঢাকা বিভাগে হওয়াই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই ফিরে গেছে তারা আপন নীড়ে। দীর্ঘ পথ পারি দিতে হয়েছে শুধু নাহিদকে। প্রায় আট ঘন্টার লম্বা জার্নি শেষে পা দিয়েছে জন্মস্থানে। গায়ে মেখেছে চিরচেনা শহরের ধুলোবালি। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিয়েছে নির্মল বাতাস। যে বাতাসে নাহিদ এখনো খোঁজে পায় শৈশবের মিষ্টি গ্রাণ। দুই চোখের দৃষ্টি যতদূর যাচ্ছে শহরের আনাচে কানাচে সব জায়গায় যেন খোঁজে পাচ্ছে ফেলে আসা রঙিন শৈশবের মধুর স্মৃতি। সেই সাথে মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে আফসোস মিশ্রীত একটা প্রশ্ন।”কেন বড় হলাম? কেন হারিয়ে ফেললাম জীবন থেকে সুখের চাদরে মোড়ানো স্মৃতিবিজড়িত শৈশবটাকে? জীবনটা যদি সেই শৈশবেই থমকে যেতো তাহলে আজ আর হয়তো মায়ের কোল ছেড়ে সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় ছুটতে হতনা অচিন শহরে।” কথা গুলো যতই ভাবছে ততই যেন নষ্টালজিক হয়ে পরছে নাহিদ। আপন মনে বিরবির করে যাচ্ছে বুকের ভিতর তোলপাড় সৃষ্টি করা শৈশবের স্মৃতিবজড়িত গানের কিছু লাইন,

এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে
সকাল-বিকেল বেলা
কত পুরোনো-নতুন পরিচিত গান
গাইতাম খুলে গলা
কত এলোমলো পথ হেটেছি দু’জন
হাত ছিলো না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে দু’টো মন
ছিল জড়াজড়ি একসাথে

কত ঝগড়া-বিবাদ, সুখের স্মৃতিতে
ভরে আছে শৈশব
তোকে স্মৃতিতে স্মৃতিতে এখনও তো
ভালোবাসছি অসম্ভব

কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার
বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার
বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন হারাচ্ছে সব, বাড়াচ্ছে ভীড়
হারানোর তালিকায়

আপন ভাবনায় বিভোর হয়ে বেখেয়ালে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ নাহিদের কানে ভেসে এলো চিরচেনা একটা কন্ঠের চিৎকার,

‘ভাইয়া!’

চেনা কন্ঠের ডাক শুনে এলোমেলো ভাবনা গুলোকে একপাশে রেখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায় নাহিদ। দেখতে পেল হাতে ব্যাট-বল নিয়ে ছোট ভাই নাফিস বাড়ির রাস্তার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। বন্ধুদের সাথে আজকে একটা চূড়ান্ত ম্যাচ খেলার কথা ছিল নাফিসের। কিন্তু রাস্তায় বের হতেই এতোদিন পর প্রাণপ্রিয় বড় ভাইকে আসতে দেখে খেলার কথা যেন বেমালুম ভুলে গেল ছেলেটা। ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি টেনে ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। ছোট ভাইটাকে এতোদিন পর দেখে নাহিদের ঠোঁটের কোণেও খেলে গেল মুচকি হাসি। হাতের ব্যাট-বল রাস্তায় ফেলেই এক প্রকার হামলে পরল ভাইয়ের বুকে নাফিস। ছোট ভাই-বোন দুটোর সাথে সেই ছোট বেলা থেকেই নাহিদের গলায় গলায় ভাব। ভাই-বোন দুটো যেন তার দুই চোখের মণি। প্রতিটা পরিবারেই সন্তানদের শাসন করার পাশাপাশি আদর করে কাছে টেনে নেওয়ার জন্যও একজন অভিভাবক থাকতে হয়। নাহিদের পরিবারে বাবা-মা ভাই-বোন গুলোকে শাসনের দায়িত্ব নিলেও নাহিদ নিয়েছে আদর দিয়ে আগলে রাখার দায়িত্ব টুকু। নাফিস, নাদিয়ার যত আবদার, ভালোবাসা, খুনশুটি সব কিছুর উৎসই যেন বড় ভাই। ছোট বেলা থেকেই তারা বাবা-মায়ের থেকে শাসনমিশ্রীত বকা খেয়ে বড় ভাইয়ের ছায়াতলে এসে অভিমানটুকু দূরে ছুড়ে মেতে উঠতো আনন্দের লহরে। খুলে দিতো অভিযোগ- অনুযোগ, আবদারের ঝুলি। নাহিদ’ও নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করতো ভাই-বোন দুটোর আবদার রাখতে। সেই আদর-ভালোবাসার উৎস ভাইটাকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে একদম ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে ওঠে নাফিস। ভেবে পায়না মনের আনন্দ অনুভূতি গুলোকে ঠিক কিভাবে প্রকাশ করবে। উৎফুল্ল চিত্তে ভাইকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে প্রশ্ন করে,

‘তুমি আজকে আসব আগে বলনি কেন? সকালেও কথা বলেছো। তখনও তো বলতে পারতে না কি?’

ভাইয়ের অভিযোগে হেসে ওঠে নাহিদ। দু-হাত দিয়ে নাফিসের ঝাকড়া চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,

‘বলে আসলে কি আর এতো বড় সারপ্রাইজ পেতি গাধা!’

চো-মুখ কুঁচকে ফেলে নাফিস। নাক ফুলিয়ে বলে,

‘এমন সারপ্রাইজের থেকে বলে আসলেই তো বেশি ভালো হতো। তুমি আসার খবর পেয়ে মা সারাদিন রান্নাঘরে পরে থাকতো। আমাকেও আর স্কুলে না যাওয়ার জন্য বকা শুনতে হতনা। ইদানিং মা একটু বেশি বেশি করছে জানো? একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠলেই ঘুমের মাঝেই ধুপধাপ লাগিয়ে দেয় চড়-থাপ্পর। স্কুলে যাবনা একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেই হলো। সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে বকতে বকতে। এইযে এখন খেলতে বেরিয়েছি চোরের মতো লুকিয়ে নিজের বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে। যেভাবে বেরিয়েছি কেউ দেখলে নির্ঘাত চোর ভেবে দুই-তিনটা লাগিয়ে দিতো। এতো অত্যাচার মানা যায় বলো? আমি তো মাঝে মাঝে ভাবি স্কুলের বাচ্চা গুলো না জানি মা’কে কতটা ডায়নি ভাবে। নিজের ছেলে-মেয়ের সাথেই যে মানুষ সবসময় এমন খ্যাঁকখ্যাঁক করতে থাকে সে না জানি স্টুডেন্টেদের সাথে কেমন করে! নির্ঘাত সবসময় রিনা খানের মতো আচরণ করে। খোঁজ নিয়ে দেখো বাচ্চা গুলো হয়তো তোমার মা জননীকে ‘রিনা খান’ নিকনেম ও দিয়ে দিয়েছে।’

ভাইয়ের সব গুলো অভিযোগ নিরব হয়ে শুনে নাহিদ। নাফিসের কথা শেষ হতেই ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘বুঝলাম আমার মা রিনা খান হয়ে গেছে। সে খুবই অত্যাচার করে তার ছোট পুত্রধনকে।কিন্তু ছোট সাহেব কি এটা ভুলে গেছে তার যে সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা? মা তার ভালোর জন্য বকে না কি খারাপের জন্য বকে এটা কি একবার ভেবে দেখেছে সে? পড়াশোনা বাদ দিয়ে সবসময় শুধু খেলা নিয়ে পরে থাকলে রেজাল্ট যে বড়সড় একটা ঘোড়ার ডিম আসবে সেটা বুঝতে পারিস না?’

‘তাই বলে কি সবসময় খেলা রেখে বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে পরে থাকব? পড়াশোনার পাশাপাশি যে খেলাধুলাও করতে হয় মাইন্ড ফ্রেশের জন্য সেটা কি তোমার শিক্ষিকা মা জানে না?’

এবার নাহিদ একটু চোখ গরম করে তাকায় ভাইয়ের দিকে। পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বলে,

‘পড়াশোনা, খেলাধুলা দুটো ব্যালেন্স রেখে করলে মা তোকে বকতে যাবে কখনো? চরকির মতো সারাদিন ঘুরলে,খেললে তো বকবেই। সব কিছুই একটা নির্ধারিত সময়-নিয়ম মেনে করতে হয়। খেলাধুলা যেমন মাইন্ড ফ্রেস করে শরীর ভালো রাখে তেমন অত্যাধিক খেলাধুলা ক্ষতিও করে। আর আমার শিক্ষিকা মা মানে কি হ্যাঁ? মা কি আমার একার? আদর দিয়ে দিয়ে বাঁদর করে ফেলছি না তোকে! দিন দিন বেয়াদবির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস কিন্তুু।’

নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলায় ভাইয়ের প্রতি কিছুটা রুষ্ট হলো নাফিস। তাড়া দিয়ে বলল,

‘হয়েছে! আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্ঞান দিতে হবেনা। বাসায় চলো।’

অলস বিকেল। সাইদুর রহমান, শাহিনূর দুজনেই অনেক আগেই নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে ফিরে এসেছে। দুই কাপ চা নিয়ে স্বামী- স্ত্রী দুজনে ড্রয়িং রুমে বসে পারিবারিক খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। সংসার, সন্তানের কথা ভেবেই নিজেদের সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিয়েছেন দুজন মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। তবুও যেন মানুষ দুটোর শরীরে এখনো ক্লান্তিরা এসে ভর করতে পারেনি। অবিশ্রান্ত ভাবে ভেবে যাচ্ছে এখনো সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা। বাবা-মা মানুষ গুলো মনে হয় এমনই হয়। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত তারা নিজেদের কথা বাদ দিয়ে সন্তানের ভালোটাই চিন্তা করে যায়। কখনও ক্লান্তিরা এসে ভর করতে পারেনা তাদের শরীরে। শাহিনূর কথার ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সদর দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ছোট ছেলের সাথে হাসি মুখে বাড়ির ভিতর এগিয়ে আসছে বড় ছেলে নাহিদ। সাথে সাথেই ওঠে দাঁড়ালো শাহিনূর। তড়িৎ বেগে দরজার কাছে ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। ব্যস্ত হয়ে পরে মায়ের তৃষ্ণার্ত মনটা ছেলেকে বুকে নিয়ে তৃষ্ণা মিটাতে। নাহিদ’ও ছোট বাচ্চাদের মতোই মিশে থাকে মায়ের সাথে। অর্ধাঙ্গীনির পেছন পেছন এগিয়ে আসেন সাইদুর রহমান। নাফিসের হৈহুল্লোর শুনে একমাত্র বোন নাদিয়াও বেরিয়ে আসে রুম থেকে। চোখের সামনে বড় ভাইকে এতোদিন পর দেখতে পেয়ে মেতে ওঠে উৎফুল্লতায়। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই যেন সাইদুর রহমানের বাড়িটাতে আনন্দ উৎসব ছড়িয়ে পরে। মায়ের বুকের সাথে মিশে থেকেই কিছু সময় অতিবাহিত করে নাহিদ বলে,

‘অনেক দূর থেকে এসেছি মা। ধুলাবালিতে শরীর একদম নাযেহাল হয়ে আছে। একটু ফ্রেস হয়ে আসি আগে? তারপর না হয় যতক্ষণ ইচ্ছে জড়িয়ে ধরে বসে থেকো।’

ছেলের কথায় যেন হুস ফিরে পেলেন শাহিনূর। নাহিদকে ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে চোখে আনন্দ অশ্রু নিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। হাত বাড়িয়ে নাহিদের গালে স্পর্শ করে বললেন,

‘শুকিয়ে কি অবস্থা করেছিস শরীরের? খাস নি না কি? তোর থেকে তো আমার নাফিসকেই শরীর স্বাস্থ্যের দিক থেকে কেউ দেখলে বলবে সে বড়। যা তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি। খেয়ে তারপর বিশ্রাম নিবি।’

মায়ের এমন কথায় নাহিদ হতাশ হয়। অভিযোগের স্বরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দেখো তো বাবা কোন দিক থেকে মনে হচ্ছে শুকিয়ে গেছি আমি? আগের থেকে ওজন কতটা বেড়েছে জানো তোমরা? এভাবে ওজন বাড়তে থাকলে আর কয়েক মাসের মাঝেই পেট মোটা দারগা হয়ে যাব। দুনিয়ার সব মায়েদের মনে হয় এটা একটা কমন রোগ। সন্তান যতই স্বাস্থ্যবান হোক তবুও তাদের চোখে মনে হবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এটা কেমন ধারণা মায়েদের?’

অল্প হাসলেন সাইদুর রহমান। ছেলের কাধে হাত রেখে বললেন,

‘ঐসব মহিলা মানুষের কথায় কান দিস না তো। এরা সবসময় দু-লাইন বেশি বুঝে। যা, আগে ফ্রেস হয়ে কিছু খেয়ে রেস্ট নে। রাতে যা কথা হবার হবে।’

স্বামীর প্রথম কথায় কিছুটা রুষ্ট হলেন শাহিনূর। চোখ গরম করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘এই দুই লাইন বেশি বোঝা মেয়ে মানুষ যদি দুনিয়ায় না থাকতো তাহলে তোমাদের পুরুষদের কি হাল হতো একবার ভেবে দেখেছো? সবসময় মেয়েদের দোষ না দিয়ে তোমরা পুরুষ জাতি যে অকৃতজ্ঞ সেটা স্বীকার করে নিলেই হয়।’

নাহিদ, নাফস নাদিয়া তিনজন ছোট বেলা থেকেই দেখে এসেছে মাঝে মাঝে বাবা-মায়ের মাঝে এমন মিষ্টি ঝগড়ার সূচনা হয়। তবে তার স্থায়ীত্ব বেশিক্ষন থাকেনা। বাবা ঠিকই মা’কে কথার ছলে মানিয়ে নেয়। হঠাৎ হঠাৎ তাদের মাঝে এমন ছোট ছোট বিষয়ে ঝগড়াটা হয় দেখেই হয়তো তারা একে অপরের প্রতি ভালোবাসার গভীরতাটুকু বুঝতে পারে। যে ভালোবাসার জোরেই একে অপরের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে ত্রিশটা বছর। বাবা-মায়ের এমন ঝগড়ায় আর দাঁড়ায় নি তারা ভাই-বোন। চুপচাপ তাদের একান্তে মান-অভিমানের পালা শেষ করতে দিয়ে চলে যায় যে যার রুমে।

চলবে….