হৃদয় জুড়ে তার ছায়া পর্ব-৪+৫

0
168

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৪
#আদওয়া_ইবশার

ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই অত্যধিক রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে পাপড়ি। রাগে দুঃখে নিজের চুল নিজেই ছিড়তে ইচ্ছা করছে তার। বড় বোনকে হঠাৎ এমন রেগে যেতে দেখে পালক কিছুটা অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে,

‘কি হলো তোমার? হঠাৎ করে এমন রেগে গেলে কেন?’

কোনো উত্তর দিচ্ছেনা পাপড়ি। এখনো ফোনের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। ফোনের স্ক্রীনে ঝলঝল করছে একটা মেসেজ,

“ভেবেছিলাম জ’ঘণ্য খা’রা’প একটা মেয়ে আপনি। কিন্তু টাকা ফেরত দিয়ে কিন্চিৎ উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ টাকা’টা ফেরত দেওয়ার জন্য মিস বে’য়া’ক্কল। পাঁচশ টাকা আপনার একাউন্টে গিয়েছে নিশ্চয়ই দেখেছেন! ঐটা আপনার ব্যবহারে খুশী হয়ে বকশিস দিলাম আপনাকে।টাকা’টা দিয়ে আ’ক্কে’ল হবার ঔষধ খেয়ে নিবেন। আপনার ভাষায় আমি চি’টা’র,বা’টপা’র, ধা’ন্দা’বা’জ হলেও উপকারের প্রতিদান দিতে জানি। মেয়ে মানুষ, এভাবে আজীবন বে’য়া’ক্কল থাকলে কপালে জামাই জুটবেনা। দ্রুত আ’ক্কে’ল বাড়ানোর চেষ্টা করুন। ভালো থাকবেন।”

পাপড়ি কি কোনো ফ’কি’র না কি? ছেলেটা নিশ্চই টাকা’টা দিয়ে বুঝাতে চেয়েছে পাপড়ি আসলেই একটা অসহায় মেয়ে। কত বড় বে’য়া’দব ছেলে! টাকার গরম দেখায় সে পাপড়িকে! তার উপর ফোনের মতো মেসেজেও বারবার বে’য়া’ক্কেল বলে তি’র’স্কার করছে তাকে।মুখের উপর এভাবে অপমান করে কি না বলে উপকারের প্রতিদান দিয়েছে! এতো বড় অপমান সে মুখ বুঝে মেনে নিবে ? একদম মানা যাবেনা এটা। সাথে সাথেই ছেলেটার নাম্বারে ফোন দিল পাপড়ি। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছেনা। রাগে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে পাপড়ির। এই অপমানের সোধ না তোলা পযর্ন্ত শান্তি হবেনা তার। একবার,দুইবার করে বারবার ফোন দিতেই থাকল পাপড়ি ঐ নাম্বারে। পাঁচ বারের মাথায় ফোনটা রিসিভ হলো। তখনও পাপড়িকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছেলেটাই আগে বলে ওঠল,

‘ অ্যাঁই মেয়ে! এমন অ’স’ভ্যে’র মতো বারবার ফোন দিচ্ছো কেন? দেখছো রিসিভ করছি না তার মানে অবশ্যই ব্যস্ত আছি। সবসময় নিজেকে বে’য়া’ক্কল প্রমাণ করার জন্য এভাবে ওঠে পরে লেগেছো কেন? উপকার করেছ ভালো কথা। তার প্রতিদান হিসেবে টাকা দিয়েছি। আবার কি চায়? না কি টাকার অংক কম হয়ে গেছে?’

আবার ! আবার ছেলেটা তাকে বে’য়াক্ক’ল বলে অ’প’মান করছে।ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ধেয়ে আসা এক একটা বাক্য যেন পাপড়ির শরীরে হোল ফোটাচ্ছে। রা’গ সংবরণ করতে না পেরে মুখ দিয়ে ফুস ফুস শব্দ উচ্চারণ করছে। তড়িৎ লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে রুম জুড়ে হাঁটতে হাঁটতে হিতাহিত জ্ঞা’ন শূণ্য হয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

‘ফকির মনে হয় আমাকে আপনার? অসহায় আমি? হাত পেতেছিলাম আপনার কাছে সাহায্য চেয়ে? কোন সাহসে আপনি আমাকে টাকা দিলেন? এই টাকা দিয়ে কি প্রমাণ করতে চেয়েছেন? আপনি কোটিপতি আর আমি ফকির? আপনার ঐ সামান্য পাঁচশ টাকা পেয়ে আমি খুশিতে আ’ত্ম’হা’রা হয়ে যাব? কান খুলে শুনে রাখুন মিস্টার অ’স’ভ্য। আমার বাবাকে সৃষ্টিকর্তা যথেষ্ট অর্থ- বিত্ত দান করেছেন।আপনার ঐ টাকায় আমি থু’থু’ও ফেলি না। আর একবার যদি আমাকে এভাবে টাকা দিয়ে অ’প’মান করার চেষ্টা করেছেন তো খুব খা’রা’প হয়ে যাবে বলে দিলাম। একাউন্ট চেক করে দেখবেন। আপনার এতো ভালো মানসিকতায় মুগ্ধ হয়ে পাঁচশ টাকার সাথে আরও পাঁচ টাকা বেশি দিয়েছি খুশি হয়ে। ঐ পাঁচ টাকা দিয়ে একটা ললিপপ কিনে খেয়ে নিবেন।’

কথাগুলো শেষ করে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলনা পাপড়ি। কল কেটে বিছানায় ছুড়ে মারল ফোনটা। ধুপধাপ পা ফেলে বাথরুমে ডুকে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিল। মনে হচ্ছে ছেলেটার প্রতি তৈরি হওয়া রা’গ পুরোটাই বাথরুমের দরজার উপর ঢেলে দিয়েছে।বোনের এমন হুট করে অস্বাভাবিক আচরণের কারণ কিছুই বোধগম্য হলনা পালকের। ফ্যালফ্যাল নয়নে সে এখনো তাকিয়ে আছে বোনের যাবার পানে।

****

সারাদিন বইয়ের মাঝে ডুবে থেকে সন্ধ্যার আগে চার বন্ধু মিলে একটু বাইরে বের হয়েছিল ঘুরেফিরে মাইন্ড ফ্রেশ করবে বলে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাজনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল তাদের মাঝে। নাহিদের ফোন সাইলেন্ট থাকাই বুঝতে পারে নি কল আসছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেল কল আসছে। বন্ধুদের এগোতে বলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করেছিল সে। বাকী তিনজন হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটাই দূরে চলে এসেছিল। এক সময় রাফিন পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেল নাহিদ এখনো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। পূণরায় তিনজন উল্টো হেঁটে নাহিদের কাছে এসে তাকে থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাফিন ছেলেটাই প্রশ্ন করে,

‘এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথা শেষ হয় নি?’

ফোনটা পকেটে পুরে বিরক্তি ভঙ্গিতে জবাব দেয় নাহিদ,

‘কথা শেষ হয়েছে সাথে মাথাও শেষ হয়েছে। বছরের পর বছর মেয়েদের সাথে কেমনে প্রেম করিস তোরা ভাই? আমি তো চার ঘন্টার মাঝেই একটার পাল্লায় পরে আধ পাগল হয়ে গেছি। এগুলো কি আদও সুস্থ্য ম’স্তি’ষ্কের মানুষ না কি ভিন গ্রহের এলিয়েন! যত্তসব পাগলের কান্ড। ভালো করতে গেলেও খারাপ হয়ে যায় মানুষ।’

বন্ধুর মুখে মেয়েদের সম্পর্কে এমন উক্তি শুনে খ্যাঁক করে ওঠে লাবিব।,

‘ঐ শা’লা সমস্যা কি? মেয়ে মানুষের কথা শুনলেই এমন চু’ল’কানি ওঠে ক্যান তোর? কি করছে ওরা তোরে? কোনো কালে ই’জ্জ’ত হনন করছিল না কি তোর?’

এমন কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকায় নাহিদ। কিন্তু তার চোখ পাকানোকে বন্ধুরা যেন তোয়াক্কায় করলনা। উল্টো লাবিবের কথা শেষ হতেই নাজিম কৌতুক করে বলে ওঠে,

‘আমার তো ভাই মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় এই নাহিদ্দেয়া আবার লে’সবি’য়ান কি না। নইলে ভাই তার মেয়েদের প্রতি এতো বিতৃষ্ণা ক্যান? যেইখানে আমরা তিন বন্ধু রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলেই তাদের প্রেমে উস্টা খেয়ে পরি। সেইখানে তার কি না আজ পযর্ন্ত কোনো মেয়ের প্রতি সামান্য পরিমাণ দূর্বলতাও তৈরি হয় নি! এইগুলা কি স্বাভাবিক মনে হয়?’

আ’গু’ন চোখে তাকিয়ে থেকে বন্ধুদের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে নাহিদ। চোয়াল শক্ত করে যেই কিছু একটা বলতে যাবে এর মাঝেই রাফিন বলে ওঠে,

‘এইজন্যই তো বলি, আমি কাপড় পাল্টাইলে শা’লা আমার দিকে ড্যাবড্যাব কইরা তাকায় থাকে ক্যান? তলে তলে যে আমার ই’জ্জ’ত লু’ট করার চিন্তা করে এইটা তো ভাবনায় ছিল না। দেখ ভাই, আমি একটা মাসুম বাচ্চা। অনেক কষ্টে কপালে একটা গার্লফ্রেন্ড জুটাইছি। তুই যদি এখন আমার ই’জ্জ’তে হাত দিস তো আমার টুনির মা আমার কপালে ঝাড়ুর বারি দিয়া অন্য বেডার হাত ধইরা চইলা যাইবো। ভাই প্লিজ, দয়া কইরা তুই আমার দিকে আর নজর দিস না। আমার থেকেও ডেসিং নাজিম্মেয়া আর লাবিব্বেয়া। আমারে ছাইড়া ওদের দিকে নজর দে ভাই।’

সাথে সাথেই এক লাফে দুই পা পিছিয়ে গেল লাবিব। তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠল,

‘হুশ হুশ ! দূরে থাকবি একদম আমার থেকে। মিলি যদি জানতে পারে তুই আমার দিকে নজর দিছিস তাইলে তোর চোখ তুইলা মারবেল খেলবো সে। জানিস তো মেয়েটা আমার প্রতি কতটা পজেসিভ।’

মুহূর্তেই তেতে ওঠল নাহিদ। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল। না পেয়ে নিজের পায়ের জুতা খুলে হাতে নিল।সাথে সাথেই ছুটতে শুরু করল তিন বন্ধু । সর্বশক্তি দিয়ে হাতের জুতাটা তাদের দিকে ছুড়ে মেরে দাঁত কিড়মিড় করে চেঁচিয়ে বলল,

‘একটাও বাসাই ডুকবি না আজকে সাবধান করে দিলাম। ডুকেছিস তো তোদের ইজ্জত কিভাবে লুট করতে হয় সেটা আমি দেখে নিব। প্রয়োজনে হিজরা ভাড়া করে আনব। তবুও তোদের একটাকেও ইজ্জত নিয়ে পরদিন গার্লফ্রেন্ডের সামনে দাঁড়াতে দিব না। শা’লা বে’ই’মা’ন কত গুলা! নিজেরা ছেলে হয়েও মেয়েদের পক্ষ হয়ে বন্ধুর চ’রি’ত্র নিয়ে এতো গুলো কথা বলে দিল! তোদের মতো বন্ধু থাকার থেকে না থাকা অনেক ভালো।

চলবে…….

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৫
#আদওয়া_ইবশার

রাত প্রায় দশটা। রওশন আরা দুই মেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছেন। শান্ত ভঙ্গিতে পাপড়ি নিচের দিকে তাকিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে। মা-বোনের এমন নিরব থাকাটা বরাবরই অপছন্দ পালকের। যেখানে পালকের দুই মিনিট কথা না বললেই মনে হয় তার পেটের ভিতর কিছু একটা খোঁচাচ্ছে। সেখানে তার মা-বোন এমনও সময় যায় ঘন্টার পর ঘন্টা কথা না বলে চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। কিভাবে পারে এরা কথা হজম করে এভাবে বসে থাকতে? পালকের তো একেবারে দম বন্ধ হয়ে আসে একটুক্ষণ কথা না বলতে পারলেই। যেমনটা এখন হচ্ছে। সেই কখন থেকে উশখুশ করছে কিছু একটা বলার জন্য। অবশেষে মুখটাকে আর বন্ধ রাখতে না পেরে একবার মায়ের দিকে আরেকবার বোনের দিকে তাকিয়ে দুজনের ভাবগতি লক্ষ্য করে মিনমিনে কন্ঠে বলে ওঠে,

‘আম্মু! তোমাকে একটা জরুরি কথা জানানোর ছিল।’

খাবার সময় মেয়েকে হাজার দিন কথা বলতে নিষেধ করেছেন রওশন আরা। কিন্তু এই মেয়ে কথা শুনলে তো! যেটা করতে নিষেধ করা হবে তাকে। সেটা আরও বেশি করে আগ্রহ নিয়ে করবে সে। নিষেধ-উপদেশ গুলো যেন সে এক কান দিয়ে শুনে সাথে সাথেই অপর কান দিয়ে বের করে দেয়। শক্ত চোখে ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘কতবার বলেছি, খাবার সময় কথা বলবেনা!তোমার কি কোনো কথা কানে যায় না?’

চোখ বন্ধ করে মায়ের ধমকটাকে হজম করে নেয় পালক। দমে না গিয়ে পূণরায় অসহায় মুখে বলে,

‘কথাটা জরুরি দেখেই তো তোমাকে এখন জানাতে চাইলাম। খেতে বসার আগে মনে ছিলনা। এখন মনে পরেছে। পরে যদি আবার ভুলে যায়। তাই এখন বলতে চাচ্ছি।’

খাওয়া থামিয়ে রওশন আরা,পাপড়ি দুজনেই পালকের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চাইলেন রওশন আরা,

‘কি কথা?’

বন্ধ হয়ে আসা দমটা যেন ফিরে পেল পালক। ফটাফট বলে ওঠল,

‘তোমার বড় মেয়ে প্রেম করছে। শুধু প্রেম’ই না। রীতিমতো বয়ফ্রেন্ডের থেকে টাকাও নিচ্ছে। অথচ তুমি আমি কিছুই জানি না। ভাবো একবার, কত গভীর জলের মাছ তোমার বড় মেয়ে। এই মেয়েকে নিয়ে আবার তুমি গর্ব করো! সবসময় বলে বেড়াও যা কিছুই হয় সবার আগে তোমার মেয়ে তোমার কাছে বলে। এই তার নমুনা?’

মুহূর্তেই ভিষম খেল পাপড়ি। কাশতে কাশতে নাকে-মুখে খাবার ঢুকে যা’তা অবস্থা। পালকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বড় মেয়ের দিকে দ্রুত নজর দিলেন রওশন আরা। পানি খাইয়ে পিঠে চাপড় দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। পাপড়ি কিছুটা শান্ত হয়েই ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল পালকের দিকে। অত্যাধিক রাগে চেঁচিয়ে বলল,

‘তোর কি মনে হয় না দিন দিন একটু বেশিই ই’ত’রামি করে ফেলছিস! কার সাথে প্রেম করি আমি? কখন প্রেম করেছি আর কখন টাকা নিয়েছি?’

অবাক হবার ভান করে বড় বড় চোখে বোনের দিকে তাকাল পালক। কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘তুমি কি আমার নিজের কান নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে বলছো আপু? বিকেলে কথা বলোনি তুমি একটা ছেলের সাথে? ছেলেটা তোমাকে টাকা দেয়নি বিকাশে? সেটা নিয়ে ঝগড়া করো নি ছলেটার সাথে?’

অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকায় পাপড়ি। কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে,

‘মা তুমি এটার কথা বিশ্বাস করো? দুপুরে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ভুল করে আমার একাউন্টে টাকা চলে আসে। আমি সেই টাকা’টা ফেরত দেওয়াই লোকটা আমাকে পাঁচশ টাকা দিয়ে বলেছিল খুশি হয়ে দিয়েছে। তুমিই বলো, আমি কেন অযথা ঐ লোকের টাকা রাখব? টাকা’টা আমি সাথে সাথেই ফেরত দিয়ে লোকটাকে ফোন করে বলেছিলাম যাতে আর কখনো আমার একাউন্ট এ টাকা না পাঠায়। সেটাই তোমার মেয়ে এখন এভাবে রসিয়ে রসিয়ে বলছে।’

একে একে দুপুর থেকে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনায় খুলে বলে পাপড়ি মা’কে। সবটা শুনে রওশন আরা ছোট মেয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকায়।রাগি কন্ঠে বলে,

‘খাওয়া’ই বসে বেঁচে গেলি তুই। নইলে আজকে তোর পিঠে চ্যালা কাঠ ভাঙতাম আমি। দিন দিন তোর ঐদ্বত্যতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফোন করুক আজকে তোর বাপ। আদর দিয়ে দিয়ে বাঁদর বানাচ্ছে দিনকে দিন। আমার পক্ষে আর তার এই বে’য়া’দব মেয়েকে সামলানো সম্ভব নই। হয় সে মেয়েকে নিজের সাথে নিয়ে যাক। না হয় দেশে থেকে সামলাক।’

মায়ের হুমকিতে একটুও দমলনা পালক। বোনের দিকে তাকিয়ে শাসানো স্বরে বলল,

‘তোমার জন্য আজকে আমাকে এই বকা গুলো শুনতে হল না! দেখবে আমার মনের অভিশাপে ঐ ছেলের সাথেই তোমার প্রেম হবে। এরপর ব্রেকআপ। সেই দুঃখে তুমি নার্গিস পাগলির মতো বনেবাদরে ঘুরে বেড়াবে। ছোট ছোট বাচ্চারা তোমার পিছনে ছুটতে ছুটতে পাগল বলে খ্যাঁপাবে। ছোট বোনের মনে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকেনা।’

পালকের এমন অভিশাপে পাপড়ির পেট ফেঁটে হাসি আসার উপক্রম। কোনো মতে ঠোঁট চেপে হাসি আটকে মুখ ঝামটে বলল,

‘শকুনের দোয়ায় কখনো গরু মরে না জানিস নিশ্চয়?’

প্রতিদিন দুই মেয়ের এমন ছোট ছোট খুনশুটি দেখতে দেখতেই রওশন আরার দিন কাটে। রওশন আরা সবসময় চাইতো কোনো এক যৌথ পরিবারে তার যেন বিয়ে হয়। মনের ইচ্ছেটা পূরণ করেছিল সৃষ্টিকর্তা। নজরুল সাহেবের পাঁচ ভাই তিন বোন আর বাবা-মা নিয়ে সুন্দর একটা যৌথ পরিবার ছিল। চার ভায়েরা ছোট ছিল নজরুল সাহেব। বড় ভাই গুলো বিয়ের পর দশ সদস্যদের পরিবারটা আরও বড় হয়ে উঠে। সেই সাথে আস্তে আস্তে সুখী পরিবারে ভর করে অশান্তি। চার ভাইয়ের বউ হয় চার রকম। ভিন্ন মানসিকতার মানুষ গুলোর একেক জনের মনে ছিল একেক রকম কূটিলতা। দিন-রাত কিছু না কিছু একটা নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত তাদের মাঝে। ফলস্বরূপ যত দিন যাচ্ছিল ততই সংসারে বাড়ছিল অশান্তির আগুন। সেই অশান্তির আগুনেই একসময় নজরুল সাহেবের বউ হয়ে আসেন রওশন আরা। দু-চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল এমন একটা যৌথ পরিবারে এসে সবার সাথে মিলেমিশে পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিবে হাসি আনন্দের মাঝে। কিন্তু বউ হয়ে আসার কিছুদিন পর থেকেই চার জা’য়ের কূটিলতার স্বীকার হন তিনি। বড় চার জনের থেকে শিক্ষিত, নম্র-ভদ্র ছিল রওশন আরা। ছোট বড় সবাইকে সম্মান করে চলতো। যার ফলস্বরূপ অল্প দিনেই বড় বউদের থেকে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন শশুর শাশুড়ির কাছে রওশন আরা। আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। হিংসার আগুনে পুড়ে চার জা মিলে প্রতিনিয়ত রওশন আরা’র বিরুদ্ধে সরযন্ত্রের জাল বুনেছেন। নজরুল সাহেব প্রবাসে চলে যাবার পর চারজন যেন আরও বেশি সুযোগ পেয়ে যায় রওশন আরা’কে অপদস্থ করার। প্রতিনিয়ত শারীরিক- মানসিক যন্ত্রনার স্বীকার হয়ে একটা সময় ধৈর্য্যহারা হয়ে ওঠেন রওশন আরা। কিন্তু বাবা-মা সমতুল্য শশুর-শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা হজম করে নেন। এমন পরিস্থিতিতেই জন্ম হয় পাপড়ির। পাপড়ির জন্মের আড়াই বছরের মাঝেই পর পর শশুর-শাশুড়ি দুজনেই মারা যান কিছু মাসের ব্যবধানে। রওশন আরা’র কাছে তখন আর কোনো মানেই ছিল না চার জা’য়ের সরযন্ত্রের স্বীকার হয়ে ছোট মেয়েটাকে নিয়ে এ বাড়িতে পরে থাকার। নজরুল সাহেবকে বাড়ি ছাড়ার কথা জানানো হলে তিনি অসম্মতি জানান। ভাই অন্তপ্রাম নজরুল সাহেব কিছুতেই ভাইয়ের ছেড়ে আলাদা হতে রাজি ছিলেন না। এই নিয়ে আরেক অশান্তির সৃষ্টি হয় নজরুল সাহেবের সাথে মঠুফোনে রওশন আরা’র। এভাবে পালকের জন্মের সময় দীর্ঘ দিনের ছুটিতে নজরুল সাহেব বাড়িতে এসে যখন স্ব-চোক্ষে ভাইয়ের বউদের বিভিন্ন কূটিল মানসিকতাপূর্ণ কাজ লক্ষ্য করেন। সাথে ভাইদের ছেলে-মেয়ের উশৃঙ্খল আচার-আচরণ। তখন দুই মেয়ের মানসিক বিকাশের কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি ছাড়ার। এরপর গাজীপুরের মেইন শহরের থেকে কিছুটা দূরে নিরিবিলি পরিবেশে নিজের টাকায় জায়গা-জমি কিনে বাড়ি করে বউ-সন্তান রেখে যায়। এমন নিরিবিলি পরিবেশে প্রথম প্রথম রওশন আরা’র দুই মেয়ে নিয়ে একা থাকতে ভয় হতো খুব। একা একজন মহিলা মানুষ বাচ্চা দুটো মেয়ে নিয়ে থাকবে এটা নজরুল সাহেব’ও যথেষ্ট চিন্তিত ছিল। এরপর পরিচিত একজনের সাথে আলোচনা করে দুই ইউনিট এর মাঝারি আকৃতির বাড়িটাতে এক ইউনিটে বউ-সন্তান রেখে আরেক ইউনিট ফ্যামিলি ভাড়া দিয়ে দেয়। সেই ভাড়াটিয়া ছিল নজরুল সাহেবের পরিচিত বন্ধুর এক ভাইয়ের পরিবার। বাচ্চা দুই মেয়েকে সামলে মাঝে মাঝে ঐ ভাড়াটিয়াদের সাথে টুকটাক গল্পগুজব করেই কাটত রওশন আরা’র সময়। তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একা মনে হতো রওশন আরা’র। যে মানুষটা সবসময় চেয়ে এসেছিল তার একটা যৌথ পরিবার হোক। প্রতিনিয়ত পরিচিত মানুষের কলরবে মুখরিত হোক বাড়ির আঙ্গিনা। সেই মানুষটার পক্ষে শুধু বাচ্চা দুই মেয়ে নিয়ে সংসার করা একটু কষ্টসাধ্যই ছিল। আস্তে আস্তে মেয়ে দুটো বড় হবার সথে সাথে যেন তার সেই কষ্টটাও লাঘব হয়। বড় মেয়েটা একটু চুপচাপ স্বভাবের থাকলেও ছোট মেয়েটা তার হয় যথেষ্ট চঞ্চল। এক পালক এই নিরব বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখতে শুরু করে। মেয়ের দূরন্তপনায় ঘুচে যায় রওশন আরা’র একাকিত্ব। এক সময় কথা বলার মানুষ খোঁজে না পাওয়া রওশন আরা’র মুখ ব্যথা হয় এখন দস্যু মেয়ের দস্যিপনা কমানোর জন্য বকতে বকতে।

চলবে…..