হৃদয় জুড়ে তার ছায়া পর্ব-১০+১১

0
129

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১০
#আদওয়া_ইবশার

রাফিনের কথায় সকলের উৎসুক দৃষ্টি পাপড়ির দিকে স্থির হয়। যেন চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতেই জানান দিচ্ছে রাফিনের প্রশ্নের উত্তর জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে তারাও। এতো গুলো মানুষের উৎসুক নজরের সম্মুখিন হয়ে তীব্র অস্বস্তিতে পরে যায় পাপড়ি। অস্বস্তিতে গাট হয়ে চঞ্চল দৃষ্টি জোড়া স্থির করে মেঝের দিকে। কন্ঠে অঘাত জড়তা নিয়ে একে একে বিবৃতি দেয় শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার। পুরোটা শুনে অত্যধিক বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে যায় সকলেই। একের পর এক কাকতলীয় ঘটনার বিবৃতি শুনে বাকহারা হয়ে যায় সকলেই। কিছু সময় অতিবাহিত করে কন্ঠে অপরিসীম বিস্ময় নিয়ে লাবিব মুখ খুলে,

” কো- ইন্সিডেন্স বুঝি একেই বলে? ভাগ্যের কি খেল রে বাবা! কয়েক মাসের মাঝেই নাহিদের পর পর দুটো বিপদেই সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে একজন মানুষেই এতো বড় উপকার করল। যার সাথে কি না কখনো সরাসরি দেখাও হয় নি।”

পর পর নাজিম বলে ওঠে,

“তুই ভাবছিস এই কথা আর আমি ভাবছি অন্য কথা। যে ছেলে হাতে গুণা খুব কাছের কয়েকজন মানুষ ছাড়া নিজের ফোনে কারো নাম্বার ও সেইভ রাখেনা। সেই ছেলে কোন চিন্তায় এমন একদম অপরিচিত একজন মানুষের থেকে একদিন সাহায্য পেয়েই নাম্বার সেইভ করে রাখল? এই বুদ্ধি কিভাবে এসেছিল তার মাথায়?”

“এটাই হয়তো সৃষ্টিকর্তার কোনো এক নিরব ইশারা ছিল। কোনো ভাবে হয়তো তার অবচেতন মনে জানান দিয়েছিল এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে আবারও সেই অপরিচিতার সাহায্য লাগতে পারে তার জীবনে। আজকে যদি নাহিদের ফোনে আপুটার নাম্বার সেইভ না থাকত তাহলে কি হতো একবার ভেবে দেখেছিস তোরা? যে লোক গুলো তাকে হাসপাতাল পযর্ন্ত এনেছিল তারা কোনো মতে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েই মানবতা দেখিয়ে ফরজ কাজ আদায় করে চলে গেছে। এর ভিতর যদি নাহিদের ফোনে লোকটা আমাদের নাম্বারের পাশাপাশি ওনার নাম্বার না পেতো তাহলে কি ওনারা আসতো? না সময় মতো আসতে পারতাম আমরা দূরত্বের জন্য। আর না ঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা হতো। তখন নাহিদের অবস্থা আরও কত বাজে হতে পারতো ভেবে দেখেছিস? আমার তো ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।”

রাফিন কথার সমাপ্তি টানতেই শাহিনূর পাপড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এভাবে নিজের সামনে নাহিদের মা’কে দেখে ঘাবড়ে যায় পাপড়ি। ভাবে মহিলা আবার তাকে অবিশ্বাস করল কি না। মনে করল কি না তার ছেলের সাথে অন্য কোনো সম্পর্ক আছে পাপড়ির। মুখের আদলে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট পাপড়ির। শাহিনূর হয়তো বুঝতে পারলেন পাপড়ির মনের শঙ্কিত অবস্থা। দু-হাতের আঁজলায় পাপড়ির ভিতীগ্রস্থ মুখটা তুলে বললেন,

“তোমাকে হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার ছেলের জীবনে শুভার্থিনী হিসেবেই পাঠিয়েছিল মা। যার কারণে একদম অপরিচিতা হয়েও বারবার আমার ছেলের বিপদে তুমিই আমাদের আগে পাশে দাঁড়িয়েছো। এভাবে যে এক মায়ের সন্তানের জীবন বাচিয়ে মা’কে অনেক বড় ঋণী করে দিলে তুমি। তোমার এই ঋণ আমি কিভাবে শোধ করব মা? আজীবনের জন্য যে তুমি আমাকে ঋণী বানিয়ে দিলে।”

তৎক্ষণাৎ মনের ভয় দূর হয়ে পূণরায় নিজের থেকেও বয়সে এতো বড় একজন মানুষের মুখে এসব কথা শুনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেল পাপড়ি। উৎকন্ঠা নিয়ে বলে ওঠে,

“এভাবে বলবেন না প্লিজ আন্টি। আমি তো কিছুই করিনি। আজকে যা করার সব তো আমার মা’ই করেছে। তাছাড়া মানুষ এর থেকেও কত বড় বড় উপকার করে। কিন্তু কয়জন এমন ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে! আপনি এভাবে বলে আমাকে আর ছোট করবেন না আন্টি।”

মুচকি হাসলেন শাহিনূর। পাপড়ির কাছ থেকে সরে রওশন আরার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। কৃতজ্ঞতা স্বরুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

“এই দুনিয়ায় রক্তের সম্পর্কের থেকেও বড় সম্পর্ক হয় আত্মার। আমি আজকে থেকে আপনাকে সেই আত্মিক সম্পর্কের দিক থেকেই বোনের স্থান দিলাম আপা। কৃতজ্ঞতার কথা বলে আর অস্বস্তিতে ফেলবনা আপনাদের। কিন্তু বোন তো হতে পারেন আমার!”

রওশন আরা নিজেও মুচকি হাসলেন। আনন্দের সাথেই গ্রহণ করলেন শাহিনূর এর আবদার। হাসি মুখেই বললেন,

“আমার বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি আপা। চার ভাইয়ের মাঝে এই এক আমিই মেয়ে ছিলাম। ভাইদের আমাকে পেয়ে বোনের অভাব পূরণ হলেও আমার হয়নি। আজকে থেকে না হয় আপনাকে বোন হিসেবে পেয়ে সেই অভাবটা পূরণ করব। কিন্তু মাঝ পথে আবার বোনকে ভুলে যাবেন না যেন।”

দুই পরিবারের নতুন একটা সম্পর্কের সূচনায় ক্ষণকালের জন্য সবাই যেন দুঃখটাকে ভুলে গিয়ে এক চিলতে আনন্দকে সাদরে গ্রহণ করে নিল। সবার মুখেই খেলে গেল তৃপ্তির হাসি। জীবনে চলার পথে এমন হাজারটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয় যে সম্পর্ক গুলো সত্যিই রক্তের সম্পর্ককেও হার মানায়। রক্তের সম্পর্ক গুলো সময়ের সাথে সাথে মলিন হয়ে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে এই আত্মার সম্পর্ক গুলো মলিন হয় না কখনো। বরং সময়ের সাথে সাথে আরো গাঢ় হয় সেই সম্পর্ক গুলোই। দুই পরিবারের মিলন মুহূর্তের মাঝেই নার্স এসে জানায় জ্ঞান ফিরেছে নাহিদের। কথাটা শুনেই তড়িৎ ছেলের কাছে ছুটে যায় শাহিনূর। পেছন পেছন এগিয়ে যায় সকলেই।

চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় পরে আছে নাহিদ। মুখের আদলে স্পষ্ট বেদনার ছাপ। সারা শরীরের অসহনীয় ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে আছে নাহিদের। দূর্বল শরীরটা ব্যথার যন্ত্রণায় চৈতন্যহীন হয়েই যেন লেগে আছে বিছানার সাথে। শাহিনূর নিরবে ছেলের মাথার পাশে একটা টুল টেনে বসেন। সাদা বেন্ডেজে মোড়ানো মাথাটায় মমতাময়ী স্পর্শ এঁকে দিবেন কি দিবেন না সংকোচে আছেন এই ভাবনাতে। পাছে যদি ছেলেটা আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে নতুন করে ব্যথা পায়! ভেবে আর সাহস করে মাথায় হাত দিলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার দরুন শক্ত হয়ে থাকা চোয়ালটাতেই হাতের স্পর্শ এঁকে ডাকলেন ছেলেকে,

“আব্বা!”

মায়ের ভেজা কন্ঠের ডাক শুনে নাহিদের বেদনার্থ হৃদয়টা যেন এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পেল। ভারি হয়ে আসা চোখ দুটো খুলে তাকাল মায়ের মুখের দিকে। ব্যথাতুর কন্ঠে ডেকে ওঠল,

“মা!” ছোট্ট একটা ডাক। এতেই যেন এতোক্ষণের অশান্ত মনটা শান্ত হলো শাহিনূরের। টুপটাপ অশ্রু ঝরে পরল দু-চোখের কুল বেয়ে। মায়ের ব্যকূল চিত্ত দেখে শুকনো মুখেই অল্প হাসে নাহিদ। ব্যথাতুর কন্ঠে নিচু স্বরে বলল,

” আমি তো সুস্থ্য আছি মা। তবুও এভাবে কাঁদছো কেন? তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না জানো না! প্লিজ কান্না থামাও।”

কথা গুলো বলতেও যেন নাহিদের জান বেরিয়ে আসার উপক্রম এতোটাই কষ্ট হচ্ছে। সেটা দেখে আরও ভেঙ্গে পরেন শাহিনূর। ঘন ঘন কয়েকটা ঢোক গিলে নিজেকে কোনোরকমে শান্ত করে বললেন,

” আমার কথা ভাবিস তুই? ভাবলে কিভাবে এতোবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে? একটু সাবধানে চলাফেরা করলে কি এমন হতো? চোখের সামনে সন্তানের এমন অবস্থা দেখে মায়ের কেমন লাগে সেটা তুই কি বুঝবি?”

পূণরায় ব্যথাতুর কন্ঠে জাবাব দেয় নাহিদ,

“আমার অসাবধানতায় হলে তো আর পুরো বাস দুর্ঘটনার স্বীকার হতো না মা। এখানে তো আমার একার ক্ষতি হয় নি। বরং আমার থেকেও আরও অনেক খারাপ অবস্থা হয়তো হয়েছে অন্যদের। ভাগ্যে যেটুকু ব্যথা পাওয়া লেখা ছিল সেটুকু পেয়েছি। ভাগ্য সহায় হলে আবার খুব দ্রুত সুস্থ্য হয়ে যাব। তুমি আর কেঁদো না প্লিজ।”

একেকটা শব্দ উচ্চারণ করতে নাহিদের ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। টান পরছে কাটা জায়গা গুলোতে। বিষয়টা সাইদুর রহমান বুঝতে পারলেন। বুঝিয়ে স্ত্রীকে শান্ত করালেন। কথা বলতে বারণ করলেন নাহিদকে। বাবার কথায় সায় দিয়ে নাহিদ দুই চোখের পাপড়ি ঝাপটায়। চোখ ঘুরিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বন্ধুদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রওশন আরা, পাপড়ি পালক। চিনতে পারেনি নাহিদ। বাবার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,

“ওনাদের ঠিক চিনলাম না বাবা!”

সাইদুর রহমান কিছু বলার আগেই মুখ খুলে নাজিম। উচ্চ কন্ঠে বলে ওঠে,

“শালা মিরজাফর! যে মানুষ গুলোর জন্য এখন পযর্ন্ত দুনিয়ার আলো-বাতাস খাইতেছিস তাদেরই চিনতে পারতেছিস না! তোর মতো অকৃতজ্ঞ মানুষ দুইটা আছে দুনিয়ায়?”

কথা শেষ হতেই ধুমধাম পিঠে কিল বসিয়ে দিল লাবিব। চোখ-মুখ কুঁচকে মুখে ব্যথাতুর শব্দ উচ্চারণ করে কিছু বলতে যাবে সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরে মুখ চেপে ধরে লাবিব পূণরায়। চোখ গরম করে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“শালা ভাঙ খাইয়া মাতাল হইয়া হাসপাতালে আইছিস না কি? চারিদিকে কি কিছুই দেখোস না না কি সব শুধু ডানা কাটা পরী দেখা যায়? আঙ্কেল- আন্টির কথা না হয় বাদই দিলাম। আজকেই মাত্র পরিচয় হইলো এমন তিনজন মানুষের সামনে তোর বিটলামি করার সাহস হইলো কেমনে? মানুষ-গরু ভাসেনা চোখে?”

মুহূর্তেই যেন বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথার এলো নাজিমের। চোরের মতো দৃষ্টি দিয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে মুখটাকে কাঁচুমাচু করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। দুই বন্ধুর মাঝ খানে দাঁড়িয়ে কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“শালা তোরা তো আসল মিরজাফরের বংশধর। কথা গুলো বলার আগে সাবধান করবিনা আমারে! মান-সম্মান প্লাস্টিক কইরা খান্ত হবার পর সাবধান করার কি দরকার? তোদের মতো এমন শত্রুও যেন কারো না থাকে।”

চলবে…….

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১১
#আদওয়া_ইবশার

তিন বন্ধুর কান্ডে সকলেই মুখ চেপে হাসছে। ব্যতিক্রম শুধু পালক। শব্দ করে হাসি ছাড়া সে বোধহয় হাসতেই জানেনা। যথাসাধ্য হাসি আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফিক করে হেসে দেয়। পালকের হাসির শব্দে তিন বন্ধু যেন আরও বেশি লজ্জায় পরে যায়। পরিস্থিতি বদলানোর জন্য লাবিব বোকা হেসে নাহিদের দিকে তাকায়। পাপড়িকে ইশারা করে বলে,

“দুস্ত এই আপু’ই তোর প্রকৃত শুভাকাঙ্খী। যার নাম দিয়েছিস তুই মিস বেয়াক্কল। আর পাশের দুজন ওনার মা আর ছোট বোন। যাদের কারণে আজকে তুই সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা পেয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে পারছিস।”

ফের এমন কথায় অস্বস্থিতে পরে যায় পাপড়ি। আড় চোখে তাকায় নাহিদের দিকে। দেখতে পায় পূর্ণ দৃষ্টিতেই নাহিদ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে পেছন ঘুরে তাকায় পাপড়ি। মানুষটার দেওয়া নামে যেমন অস্বস্তি হচ্ছে তার। তেমন তার দৃষ্টির তোপে পরেও বড্ড অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেছে সে। ভেবে নিয়েছে পাপড়ি নাহিদের বাবা-মা ছাড়া উপস্থিত অন্য একটা মানুষের মাঝেও কৃতজ্ঞতা বোধ এর ছিটেফোঁটা’ও নেই। যদি থাকতোই তাহলে এখনো কিভাবে তাকে আগের কাহিনীর জেড় ধরে মুখের উপর এভাবে বেয়াক্কল বলে যাচ্ছে! পাপড়ি কি বাচ্চা? যথেষ্ট বড় একটা মেয়ে সে। সেই হিসেবে তার মান-সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। তার এইটুকু জীবনে যতটুকু মান-সম্মান ছিল সবটাই হয়তো ধুলোয় মিশিয়ে দেবার পায়তারা করছে এই হিটলার বন্ধুমহলটা। লাবিবের কথা পুরোটা নাহিদ বুঝতে না পেরে মাথার কাছে বসে থাকা মায়ের দিকে তাকায়। শাহিনূর ছেলের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরে শুকনো হেসে খুলে বলে পুরো ঘটনা। সবটা শুনে কিছুক্ষণ আগে উপস্থিত সবাই যেমন বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল এই মুহূর্তে নাহিদের অবস্থাটাও ঠিক তেমন হয়েছে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পাপড়ির মুখের দিকে। আড় চোখে একটু একটু করে পর্যবেক্ষণ করে নাহিদের ভাব- ভঙ্গি পাপড়ি। এক পর্যায় নিজেকে ধাতস্থ করে নাহিদ মুচকি হেসে রওশন আরার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপক করে। উত্তরে রওশন আরা নিজেও হাসেন। নাহিদের কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে জবাব দেন,

“সন্তানেরা মায়ের প্রতি কখনো এভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনা বাবা। সন্তানের ভালো চাওয়াটা বাবা-মায়ের কর্তব্য। আপনার মতো আমার একটা ছেলে থাকলেও আমি এটুকুই করতাম।”

ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হাসে নাহিদ। মনে মনে ভাবে মায়ের ব্যবহার এতো মিষ্টি তাহলে মেয়ের ব্যবহার এমন তিতা কেন? ঐ পাগল কার মতো হয়েছে? নিশ্চয়ই বাবা এমন হাফ পাগল। আর ঐ মেয়ে বাবার মতোই হয়েছে তারছেড়া। মায়ের মতো হয়নি এটার জলজ্যান্ত প্রমাণ তো রওশন আরার মার্জিত ব্যবহারেই নাহিদ পেয়ে গেছে।,

“বলছেন আমি আপনার সন্তানের মতো তাহলে আবার আপনি করে ডাকছেন কেন? নিজের সন্তানকে কি মা-বাবা আপনি করে ডাকে?”

প্রশান্তিময় হাসি খেলে যায় রওশনা আরার ঠোঁটে। সন্তুষ্ট চিত্তে বলেন,

“এভাবে হুট করেই তো আর কাওকে তুমি করে বলা যায়না বাবা। তবে চেষ্টা করব পরবর্তীতে তুমি করেই ডাকতে।,

নাহিদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে পূণরায় শাহিনূরের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“আজ তাহলে আসি আপা। রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। বাড়িতে কেউ নেই। নিরিবিলি গ্রাম সাইটের এলাকায় চোর-ডাকাতের ভয়। কখন কোন জিনিস চুরি হয়ে যায় বলা তো যায়না। আর আপনারা সবাই তো হাসপাতালে থাকতে পারবেন না। এখানে দুই-এক জন থেকে বাকিরা না হয় আমাদের বাড়িতে চলুন! রাতটা থেকে কাল সকালে আবার চলে আসবেন।”

“অসুবিধা নেই আন্টি। পাশের কেবিনে রুগী নেই। ঐটা আজ রাতের জন্য নিয়ে নিয়েছি। থাকার কোনো অসুবিধা হবেনা। এই রাতের বেলায় একা যেতে হবেনা আপনাদের। এখন তো আন্টি-আঙ্কেল আছেন নাহিদের পাশে। চলুন আমরা গিয়ে আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি।”

আর কথা বাড়ালেন না রওশন আরা। রাত অনেক হয়েছে। বাড়ির জন্য টেনশন হচ্ছে সাথে মেয়ে দুটো’ও সেই দুপুর থেকে না খেয়ে। সাইদুর রহমান, শাহিনূর নাহিদের থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন লাবিব আর নাজিমের সাথে। নাহিদের পাশে রাফিন, নাফিস নাদিয়াকে রেখে সাইদুর রহমান শাহিনূর ও সাথে গেলেন হাসপাতাল গেইট পযর্ন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে। কেবিন থেকে একে একে সবাই বেরিয়ে যেতেই রাফিন একটা চেয়ার টেনে এগিয়ে বসে নাহিদের দিকে। কৌতুক করে বলে ওঠে,

“তোর কপালটা দে তো ভাই আমার কপালের সাথে একটু ঘষা দেই।”

চোখ-মুখ কুঁচকে নেয় নাহিদ। বুঝতে পারে লাগামছাড়া বন্ধুটা ছোট ভাই-বোনের সামনেই এখন কিছু না কিছু একটা নিয়ে তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“বিরক্ত করবি না একদম। এমনিই ব্যথার চোটে কথা বলতে পযর্ন্ত কষ্ট হচ্ছে। এর মাঝে আবার কোনো ফালতু বিষয় নিয়ে আমার মাথা চিবাতে আসলে ভাঙ্গা পায়েই এক লাথি দিয়ে হাসপাতালের বাইরে ফেলব।।”

কাথাটা শেষ করে চোখ-দুটো বন্ধ করে নেয় নাহিদ। হতাশ হয় রাফিন সফল হতে না পেরে। অসহায় কন্ঠে নাফিসের দিকে তাকিয়ে বলে,

“বুঝলি ভাই আজ-কাল কারো ভালো করতে নেই। গেছিলাম ভালো কথা কইতে দিয়া দিছে উল্টো ধমক। ঐযে কথায় আছে না “গেছি নামাজের জন্য দিয়ে দিছে রোজা” ঐ টাইপ আরকি।”

রাফিনের দুঃখে নাফিস খুবই মর্মাহত। চোখে-মুখে এমন একটা ভাব ফুটিয়ে রাফিনের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

“দুনিয়াটাই বেঈমান হয়ে গেছে ভাই। থাক কষ্ট পাইয়ো না। তোমার কষ্ট আমি বুঝি। গেছিলা নিশ্চয়ই এই কথা কইতে যে, “মাইয়া পটানোর আগেই মাইয়ার মা পটায় ফেলছিস”। কথাটা আমার মনেও ঘুরতেছিল। কিন্তু সাহস করে বলার আগেই তুমি বলতে গিয়া আমার ভাগের ধমকটা খেয়ে আসছো নিজে। বন্ধুর ভাই হইয়াও তুমি আমার এতো বড় উপকার করছো ভাবতেই আবেগে চোখে পানি চইলা আসছে।”

দুজনের কান্ডে কিটকিটিয়ে হেসে ওঠে নাদিয়া। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে থাকা নাহিদের ঠোঁটেও উকি দেয় অস্পষ্ট হাসি। বাঁদর দুটোর সাথে এখন কথা বলতে গেলেই কথার প্যাঁচে ফেলে তার শান্তি বিনষ্ট করবে। তাই কথা গুলো শুনেই কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে।

******
সেদিনের পর কেটে যায় আরও এক সপ্তাহ। নাহিদকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে দুদিন আগেই। হাসপাতালে থাকা কালীন আরও একদিন এসে দেখে যায় তাকে রওশন আরা। পালক-পাপড়ি আর আসেনি। পালকের পরীক্ষা থাকায় ইচ্ছে হলেও যেতে পারেনি মায়ের সাথে। আর পাপড়ি অভদ্র বন্ধুমহলের কথায় আর অপমানিত হতে চায়না বলেই যায়নি মায়ের জোরাজুরির পরও।

ক্লান্ত অবসান্য বিকেল।ড্রয়িং রুমে বসে মায়ের মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে পাপড়ি। কিছু দিন পর পর মাথায় তেল মালিশ করাটা রওশন আরার এক প্রকার বাজে স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এটা না করলে না কি ওনার এখন ঘুম আসেনা। মাথা ধরে যায় অল্পতেই। চিটচিটে তেল নিয়ে মাথায় মাখিয়ে দুই হাত দিয়ে ম্যাসাজ করে দেওয়ার বিষয়টা পাপড়ির বিরক্ত লাগে অত্যাধিক। এ ব্যাপারে মা’কে কিছু বলতেও পারেনা সে। পাছে যদি আবার মা কষ্ট পায়! সেই ভেবে তেল নামক বিরক্তিকর জিনিসটাকেই দুই হাতে মাখিয়ে ঢলে দেয় মায়ের মাথায় কিছুদিন পর পর। পালক শরীর ছেড়ে সোফার সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে এক মনে টিভিতে কার্টুন দেখে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর হাসির কান্ড দেখে নিজে নিজেই উচ্চস্বরে হেসে যাচ্ছে। পালকের হাসির আওয়াজে ক্ষণে ক্ষণে রওশন আরা ধমকে যাচ্ছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! মায়ের ধমক গুলো পালকের গায়ে লাগলে তো থামবে সে। গতকাল বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে তার। হাতে এখন অফুরন্ত সময়। নিজের মন যা চাইবে এই অবসর সময়ে সে ঠিক সেটাই করবে। সারা বছর তো মায়ের বকাঝকা শুনেই পার করে। বছরের শেষ কয়েকটা দিন না হয় একটু নিজের মতো করে প্রাণ খুলে বাচলো। ধমকে মেয়েকে চুপ করাতে না পেরে রওশন আরা নিজেই বিরক্ত হয়ে একসময় ধমকানো বন্ধ করে দেয়। মাথায় তেল মালিশ করে দেওয়াই চোখে ঘুম চলে আসছে ওনার। ঘুম ঘুম ভাব নিয়েই পাপড়িকে বলে ওঠে,

“ছেলেটার এখন কি অবস্থা একটা খোঁজ নিয়ে দেখ তো মা।”

কোন ছেলের কথা বলছে মা বুঝতে পারেনা পাপড়ি। কিছুক্ষণ ভেবেও বুঝতে না পেরে জানতে চায়,

“কোন ছেলে মা?”

“নাহিদের কথা বলছি। একটা ফোন করে খোঁজ নেওয়া কি উচিৎ না আমাদের?”

বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে পাপড়ি। তিক্ত কন্ঠে বলে,

“আমি পারবনা। এতো দরদ নেই আমার। পারলে তুমি খোঁজ নাও। সেই কোন ছেলেকে হেল্প করেছো এখন আবার খোঁজ নিতে হবে কেন? শুধু খোঁজ না একেবারে বোন পাতিয়ে বসে আছো। মানুষ গুলো ভালো না কি খারাপ জানো তুমি কিছু?”

শান্ত মেজাজটা গরম হয়ে যায় নিমিষে রওশন আরার। খিটখিটে রাগের সাথে জবাব দেয়,

“তুই আমার মা না কি আমি তোর মা? বয়স কার বেশি তোর না কি আমার? মানুষ চেনার অভিজ্ঞতা আমার থেকে তোর বেশি? মায়ের বিশ্বাসের উপর আঙ্গুল তুলিস দুই দিনের মেয়ে হয়ে! আর একটা অতিরিক্ত কথা বললে থাপ্পড় লাগাবো ধরে। চুপচাপ এক্ষুনি ফোন দিবি তুই।”

সামান্য একটু কথার জেড়ে এতো গুলো কথা শুনতে হবে ভাবেনি পাপড়ি। দিন দিন মনে হচ্ছে তার মা’ও বেঈমানি করা শুরু করে দিয়েছে তার সাথে। নিজের সন্তানের থেকে অন্যের সন্তান আপন হয়ে গেছে বেশি। কি অবলীলায় দুদিনের পরিচিত একটা ছেলের জন্য নিজের মেয়েকে এতো গুলো কথা শুনিয়ে দিল! হতাশামিশ্রিত একটা দির্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পাপড়ির বুক চিড়ে। পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে না চাওয়া সত্বেও ডায়াল করে সবথেকে অপছন্দের ব্যক্তির নাম্বারে। রিং হতেই পাপড়ির চোখের তারায় ভেসে ওঠে নাহিদের ফোনের স্ক্রীকে জ্বলজ্বল করছে “Beyakkhol is Calling”। সাথে সাথেই মুখটা আধারে ছেয়ে যায় পাপড়ির। অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,

“কোন দুঃখে নিজের সন্তানের মান-ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করছো মা?”

“আক্কল যাওয়ার সাথে সাথে মাথার তার’ও ছিড়ে গেছে না কি? একজনের নাম্বারে ফোন দিয়ে নিজ মনে কি বিরবির করছেন এভাবে?”

আচমকা ফোনের অপর পাশ থেকে ধেয়ে আসা এমন বাক্যে বুকের ভিতরে থাকা হৃৎপিণ্ডটা যেন তড়াক লাফিয়ে ওঠে পাপড়ির। নিজের ভাবনায় এতোই মশগুল ছিল যে টেরই পেলনা কখন ফোনটা রিসিভ হলো। না পারছে পাপড়ি নাহিদের এমন কথা হজম করতে আর না পারছে মায়ের সামনে কড়া ভাষায় কিছু বলতে। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে,

“কেমন আছেন?”

“চোর-বাটপারদের আবার ভালো থাকা খারাপ থাকা আছে না কি? যেকোনো এক রকম থাকলেই হলো। তা বেয়াক্কলের মাথায় আজ এতো আক্কেল মার্কা কথা কিভাবে এলো? হরলিক্স খেয়ে বুদ্ধি বাড়িয়েছেন না কি?”

এরকম আর দুই-একটা বাঁকা কথা শুনলে নির্ঘাত পাপড়ি মায়ের সামনেই কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলবে। বিনিময়ে মায়ের কাছ থেকে ঝাড়ুর বারিও উপহার হিসাবে পেতে পারে। যেভাবে হোক এখান থেকে কেটে পরতে হবে তার। ভেবেই ফোনটা বাড়িয়ে দিল মায়ের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“তোমার আদরের নম্র-ভদ্র দুইদিনের পাতানো বোনের ছেলে তোমার খোঁজ করছে। নাও ধরো কথা বলো।”

ফোনটা কোনোমতে মায়ের হাতে দিয়ে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না পাপড়ি। ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় নিজের রুমে। রওশন আরা ফোন কানে চাপতেই শুনতে পায় নাহিদ বলছে,

“কি ব্যাপার, বললেন না তো হরলিক্স খেয়ে বুদ্ধি বাড়ালেন কি না! বললে আমার উপকার হতো একটু আরকি। এক্সিডেন্টের পর মনে হচ্ছে আমারও বুদ্ধি কিছু হারিয়ে গেছে। ভাবছিলাম আপনার থেকে সাজেশন নিয়ে আমিও হরলিক্স খেয়ে বুদ্ধি বাড়াবো একটু । তা কি হরলিক্স খেয়েছিলেন? জুনিয়র হরলিক্স না কি মাদার হরলিক্স? মাদার হরলিক্স খেলে প্রেগনেন্ট মহিলাদের মতো আমার পেট’ও ফুলে যাবেনা তো আবার!”

এমন কথা শুনে ফোন কানে ঠেকিয়ে বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রওশন আরা। নাহিদের কথা শেষ হতেই কন্ঠে অস্বস্তি নিয়ে বলে,

“আমি তোমার আন্টি বলছিলাম বাবা। এখন কেমন আছো তুমি?”

সাথে সাথেই অপর পাশ থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসে স্পিকারে। পাপড়ির বদলে রওশনা আরার আভাষ পেয়ে নাহিদ হয়তো শকটা সামলে উঠতে পারেনি। হাত ফসকে ফোনটা পরে যায় মেঝেতে। হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকে মেঝেতে পরে থাকা ফোনটার দিকে। যেটার ভিতর থেকে ভেসে আসছে রওশন আরার উদ্বিগ্ন কন্ঠ। ভেবেছে হয়তো নাহিদ ইনজ্যুরড পা নিয়ে কোনোভাবে পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। অথচ নাহিদ যে ওনার নিজের শান্তশিষ্ট মেয়েটাকে বোকা বানাতে গিয়ে সে নিজেই বোকা হয়ে বসে আছে এটা বুঝতে পারেনি।

চলবে….