হৃদয় জুড়ে তার ছায়া পর্ব-১২+১৩

0
135

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১২
#আদওয়া_ইবশার

অকস্মাৎ এমন একটা শক নাহিদকে যেন বোকা বানিয়ে দিয়েছে। বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ মেঝেতে পরে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে এক সময় ফোনটা তুলে নেয়। কানের পাশে ঠেকিয়ে কতক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে জিভের ডগায় ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে অত্যন্ত নম্র স্বরে সালাম জানায় রওশন আরাকে।সালামের জবাব পেয়ে সাথে সাথে আবারও বলে ওঠে,

“আসলে আন্টি আমার পাশে এক কাজিনের বাচ্চা ছিল। তার সাথেই দুষ্টুমি করছিলাম। সেই হাত ছোড়াছুড়ি করে ফোনটা ফেলে দেয়।”

খুব সুন্দর গুছিয়ে একটা মিথ্যা বলে কথাটা ঘুরিয়ে নেয় নাহিদ। মিথ্যেটাকেই বিশ্বাস করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়েন রওশন আরা। বলেন,

“আচ্ছা তাই বলো! আমি আরও ভেবেছিলাম তুমি আবার পরে টরে গিয়ে ব্যথা পেয়ে বসেছো।”

অল্প বিস্তর হাসে নাহিদ। বুঝতে পারে তার মিথ্যে বলার টেকনিকটা অনেক বড় বাচা বাচিয়ে দিয়েছে তাকে।মাঝে মাঝে নিজেকে বাচাতে গিয়ে এমন দুই-একটা মিথ্যে বললে নিশ্চয়ই খুব একটা পাপ হবেনা। কথাটা ভেবে মাথা চুলকে জবাব দেয়,

“না আন্টি আমি ঠিক আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”

“আমি ভালো আছি বাবা। তোমার শরীরের কি অবস্থা? হাতটা কেমন এখন? উন্নতি হচ্ছে কিছু?”

“জ্বি আন্টি আগের থেকে অনেকটা ভালো। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে উঠব।”

টুকটাক কথাবার্তা শেষে শাহিনূরকে ডেকে মায়ের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দেয় নাহিদ। দুজন যেন এক মায়ের পেটের বোন এমন ভাবেই কথায় মজে যায় শাহিনূর রওশন আরা। মিনিট শেষ হয়ে ঘন্টা পেরিয়ে যায়। তবুও তাদের কথা শেষ হয় না। দুই-একদিন পর পর এভাবেই দুই পরিবারের ফোনালাপের মাধ্যমে সময়ের সাথে সাথে বন্ধন আরও গাঢ় হয়। দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো বেশ কয়েকটা দিন। পুরোপুরি সুস্থ্য না হলেও বর্তমানে হাঁটা-চলা করতে পারে নাহিদ। দুর্ঘটনার জন্য যথেষ্ট ছুটি দেওয়া হয়েছে তাকে অফিস থেকে। ইন্টার্ন অবস্থায় এতো ছুটি কাটানো কারো পক্ষেই সম্ভব না। একটু সুস্থ্যবোধ করতেই তোড়জোড় শুরু করে দেয় নাহিদ কর্মস্থলে ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু শাহিনূর ছেলেকে পুরোপুরি সুস্থ্য না হওয়া পযর্ন্ত কোথাও যেতে দিবেনা। এই নিয়ে মা-ছেলের মাঝে প্রতিদিনই বাকযুদ্ধ চলছে। অবশেষে ছেলের জেদ আর যুক্তির কাছে হার মেনে শাহিনূর সম্মতি দেয় ছেলেকে যাবার জন্য। মা’কে মানাতে পেরে হাপ ছেড়ে বাঁচে নাহিদ। পরদিনই সবার থেকে বিদায় নিয়ে আবারও রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। ছেলেকে বারবার করে শাহিনূর – সাইদুর রহমান বুঝিয়ে দেন ঢাকায় গিয়েই যেন একবার রওশন আরার সাথে নিজে গিয়ে দেখা করে আসে। মানুষটা তাদের যে উপকার করেছে তার প্রতিদান কখনো দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু একটা সু-সম্পর্ক তো টিকিয়ে রাখতে পারবে। একে অপরের সাথে সু-সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য ভাত-কাপড় আর দামি দামি গিফটের প্রয়োজন হয় না। মুখের একটা ভালো কথা, মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেওয়ার মাঝেই অনেক সম্পর্ক টিকে থাকে আজীবন। একজন মানুষকে দুটো কথা বলে যতটা সন্তুষ্ট করা যায় ততটা সন্তুষ্ট কখনো এক বেলা পেট পুরে খাইয়েও করা যায় না। বাস্তবীক অর্থেই মানুষ জাত ভালোবাসার কাঙ্গাল। হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ- বিদ্রোহ করেও যে জিনিস জয় করা যায়না সেই জিনিসটাও যত্ন নিয়ে ভালোবেসে জয় করে ফেলা যায় অনায়াসে।

মা-বাবার কথা অনুযায়ী ঢাকায় এসে নাহিদ পরদিনই পাপড়িদের বাড়িতে যায় দেখা করার জন্য। হাতে এক গাদা ফাস্টফুড, ফলমূল সমেত নাহিদকে নিজের বাড়িতে উপস্থিত হতে দেখে খুশির অন্ত থাকেনা রওশন আরার। ভেবে পায়না ছেলেটাকে কি রেখে কি দিয়ে সমাদর করবে। রওশন আরার ব্যকুলতা দেখে মুচকি হাসে নাহিদ। ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসিটা ধরে রেখেই বলে,

“এতো ব্যস্ত হবেন না আন্টি। আমি শুধু আপনাকে দেখার জন্য এসেছি। এখন কিছুই খাবনা। শুধু শুধু কষ্ট করবেন না আমার জন্য।”

“এসব বললে হবে না কি? তুমি এই প্রথম আমার বাসায় এসেছো। শূণ্য মুখে কিভাবে যেতে দেই? কোনো কথা শুনবনা তোমার। দুপুরে খেয়ে তারপর যেতে হবে কিন্তু। এক বেলা না হয় আন্টির হাতের রান্না খেয়ে দেখলে কেমন রাধতে পারি।”

প্রতিত্তরে আবারও এক টুকরো হাসি উপহার দেয় নাহিদ। মায়ের বয়সী মানুষটার আবদারে কেন জানি আর মুখের উপর না বলে দিতে পারলনা। ড্রয়িং রুমে বসেই বাড়িতে রওশন আরা ছাড়া আর কাওকে দেখতে না পেয়ে ইতিউতি করে জিজ্ঞেস করেই ফেলে,

“আপনি বাড়িতে একা আন্টি? আর কাওকে দেখছি না যে!”

হালকা নাস্তার আয়োজন করতে রান্না ঘরে যেতে যেতেই রওশন আরা জবাব দেয়,

“পাপড়ি ভার্সিটিতে। পালক নিজের ঘরেই ফোনে গেইম খেলে। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না বাবা। সবসময় শুধু অকাজ করে বেড়াবে। আর তোমার আঙ্কেল দেশের বাইরে জানোই তো।”

নাহিদের জবাব দিয়ে রান্না ঘরে থেকেই ছোট মেয়ের উদ্দেশ্যে হাক ছাড়ে,

“এই পালক! ফোন রেখে তাড়াতাড়ি দেখে যা কে এসেছে।”

মায়ের এক ডাকে সাড়া দেবার পাত্রী পালক না। দুই-তিনবার ডাকার পরও যখন মেয়ের সাড়া পেলনা তখন রওশন আরা নাহিদের সামনে ইতস্ততঃ বোধ করলেন। এতোবার ডাকার পরও সাড়া দিলনা ছেলেটা নিশ্চয়ই ভাবছে পালক অবাধ্য মেয়ে। সাথে এটাও হয়তো ভেবে নিয়েছে রওশন আরা মেয়েদের আদবকায়দা শিখাতে ব্যর্থ। ঝটপট হাতে কয়েক পদের নাস্তা বানিয়ে সাথে নাহিদের আনা ফাস্টফুড আইটেম গুলো ট্রে’তে সাজিয়ে তার সামনে দিয়ে অপ্রস্তুত হেসে বলে,

“তুমি খাও বাবা। মেয়েটা হয়তো আমার ডাক শুনতে পায়নি। রুম থেকে ডেকে নিয়ে আসছি ওকে।”

অল্প হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় নাহিদ। তৎক্ষণাৎ রওশন আরা ছুটে যায় মেয়ের রুমে। উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে ফোনে গেইম খেলাই মগ্ন পালক। রুমে ডুকেই মেয়ের পিঠে ঠাস করে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দেন রওশন আরা। আকস্মিক পিঠে থাপ্পড় পরায় লাফিয়ে উঠে পালক। অসহায় মুখ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এভাবে অযথা মারলে কেন আমাকে? এখন কি কিছু করেছি? আমি কি ব্যথা পাই না! সবসময় শুধু শুধু মারো আমাকে। এতো অবিচার কিভাবে করো তুমি আমার উপর!”

আগুন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকায় রওশন আরা। কটমট করে বলে ওঠে,

“কখন থেকে ডাকছি তোকে? কানে কথা যায়না ? একজন মেহমান এসেছে তার সামনেও তোর জন্য আমার গলার স্বর উচু করতে হয়। নিজের মানুষের সামনে করিস করিসই। বাইরের মানুষের সামনেও কেন তোর ত্যাড়ামি করতে হয়? সহবত কি একটুও শিখাইনি তোকে?”

“কে এসেছে? আর কখন ডেকেছো আমি শুনিনি তো।”

“শুনবেন কিভাবে? ফোন হতে থাকলে তো দিন দুনিয়ার সব কিছু ভুলে এটাতেই ডুবে থাকেন। বাড়িতে কেউ মরে গেলেও মনে হয় জানতে পারবিনা। আর একটা অতিরিক্ত কথাও বলাবিনা আমাকে দিয়ে। চুপচাপ ড্রয়িংরুমে যা। নইলে আবারও পিঠে লাগাব দুই-তিন ঘা।”

দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিয়ে বেরিয়ে যায় রওশন আরা। আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে পালক নিজেও ছুটে মায়ের পিছন পিছন। ড্রয়িং রুমে যেতেই নাহিদকে সোফায় বসে থাকতে দেখে উৎফুল্ল চিত্তে এগিয়ে যায় সেদিকে। এক গাল হেসে বলে,

“আরে নতুন কুটুম যে! তা কেমন আছেন আপনি?”

পালকের দিকে তাকিয়ে নাহিদ নিজেও হেসে জবাব দেয়,

“ভালো আছি দেখেই তো নতুন কুটুম হয়ে চলে এলাম তোমাদের এখানে। তা তুমি কেমন আছো তিড়িং বিড়িং ফড়িং?”

নিজের সম্পর্কে এমন একটা বাক্য শুনে ভ্রু কুঁচকে নেয় পালক। কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

“ইট’স নট ফেয়ার নতুন কুটুম। আপুকে বেয়াক্কল ডাকেন সেটা না হয় মেনে নেওয়া যায়। কারণ আপুটা একটু বোকাসোকা টাইপ। কিন্তু আমাকে তিড়িং বিড়িং ফড়িং ডাকলেন কেন? কি তিড়িং বিড়িং করেছি আমি? আপনি জানেন আমি কতটা ভদ্র?”

শ্লেষাত্মক কন্ঠে জবাব দেয় নাহিদ,

“আপনি যে কত ভদ্র একটা মেয়ে তার প্রমাণ তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। যেভাবে আসলে আমার সামনে মনে তো হচ্ছিলো কোনো মানুষ না ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে আমার দিকে। তাছাড়া আন্টির মুখেও কিছুটা শুনেছি তোমার গুণের কথা। সব মিলিয়েই মনে হলো তিড়িং বিড়িং ফড়িং নামটা তোমার জন্য পারফেক্ট। ঠিক যেমন পারফেক্ট তোমার আপুর জন্য বেয়াক্কল নামটা।”

এতোক্ষনের ফুরফুরে উৎফুল্ল মেজাজটা মুহূর্তেই চটে যায় পালকের। কোমরে হাত রেখে চোখ-মুখ শক্ত করে বলে ওঠে,

“আপনি তো দেখছি খুবই অভদ্র কুটুম। আমার বাড়িতে বেড়াতে এসে আমার নামেই এতো গুলো বদনাম করছেন! তাও আবার আমার সামনেই ! সাহস আছে বলতে হয় আপনার।”

” দ্যা গ্রেট পালক রানীর নামে বদনাম করে যে লোক তার তো আসলেই সাহস আছে বলতে হয়। তা কে সেই সাহসী মানুষ শুনি? কাকে এসব বলছিস?”

অর্ধেক দিনের দৌড়ঝাঁপের পর ক্লান্তশ্রান্ত দেহটা নিয়ে বাড়িতে আসতেই ছোট বোনের মুখের কথা শুনে জবাব দেয় পাপড়ি। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে জুতা খোলায় ব্যস্ত বলে দেখতে পারেনি ড্রয়িং রুমেই সয়ং সেই সাহসী লোকটা বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পাপড়িকে দেখে নাহিদ ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলে,

“আরেহ, মিস বেয়াক্কল যে! কেমন আছেন? আন্টির কাছে শুনলাম আপনি না কি ভার্সিটিতে ছিলেন! বেয়াক্কলরাও বুঝি ভার্সিটিতে পড়তে পারে ! তা অ আ পারেন তো কিছু?”

মাথা তুলে নাহিদকে চোখের সামনে দেখে তব্দা খেয়ে যায় পাপড়ি। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিস্মিত কন্ঠে জানতে চায়,

“আপনি এখানে!”

“কেন? আসতে পারিনা বুঝি?”

প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায় নাহিদ। এর মাঝেই রান্নাঘর থেকে ড্রয়িং রুমে ছুটে আসে রওশন আরা। নাহিদের কিছু লাগবে কি না দেখার জন্য। এসে বড় মেয়েকেও দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“এসে গেছিস! আমি আরও ভেবেছিলাম বোধহয় দেরি হবে আসতে। যাক ! ভালোই হয়েছে। ছেলেটা এই প্রথম এলো বাড়িতে। একটু কথা বলার মতোও কেউ নেই। ফ্রেশ হয়ে এসে দুবোন ওর সাথে বসে গল্প কর। আমি রান্নাটা শেষ করে নেই।”

জোরপূর্বক হেসে জবাব দেয় পাপড়ি,

“আমি আবার কি গল্প করব?তার থেকে বরং তুমি বসে গল্প করো। ঐ বাড়ির সবার খোঁজখবর নাও। রান্নাটা আমিই করি।”

” সবে বাইরে থেকে এসেছিস। চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ক্লান্ত তুই। রান্না আমিই করছি। তুই নাহিদের পাশে বসে রেস্ট নে আর গল্প কর।”

গল্প করবে পাপড়ি ! তাও আবার এমন একটা ছেলের সাথে। যেই ছেলের এক একটা কথায় মনে হয় তার শরীরে ফোস্কা পরে। এমন ছেলের সাথে আদও কোনো গল্প থাকতে পারে পাপড়ির! প্রথম দেখায় যে মানুষটা খোঁচানো ভঙ্গিতে হালচাল জিজ্ঞেস করতে পারে সেই মানুষের সাথে দু-দন্ড বসে কথা বলেই যে তার কেমন পাগল দশা হবে সেটা সে নিজেও জানেনা। তবুও মুখ বুঝে পালন করে নেই মায়ের আদেশ। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আধার মুখে বসে থাকে নাহিদের বিপরীতে। দুই বোনেই চুপচাপ। সবসময় মুখে কথার খই ফুটতে থাকা পালক’ও নাহিদের থেকে পাওয়া অদ্ভূত নাম শুনে অবুঝ মনে কিন্চিৎ অভিমান নিয়ে বোনের মতো চুপ করেই বসে আছে। দু-বোনকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নাহিদ ঠেস দিয়ে বলে ওঠে,

“বাড়িতে মেহমান আসলে যে কারো গালে পানি আসে আগে জানতাম না তো। এভাবেই কি গাজীপুরে মেহমানদের সমাদর করা হয়? আমাদের রাজশাহীতে তো এমন হয় না। কত সুন্দর করে কন্ঠে মধু মিশিয়ে কথা বলে আদর-যত্নে ভালো-মন্দ খাইয়ে মেহমানদের সমাদর করা হয়! আর এখানে মেহমান দেখলে মানুষের গালে পানি আসে। এ কেমন আজব এলাকায় আত্মীয় করলাম রে ভাই! নূন্যতম মনুষ্যত্ববোধ টুকুও নেই।”

ফট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে পরে পাপড়ি। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁতে চেপে তিরিক্ষি মেজাজে বলে ওঠে,

” নূন্যতম মনুষ্যত্ববোধ না থাকলে ঐদিন নিশ্চয়ই হাসপাতালে ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা হতনা আপনার। উল্টো কথা না বলে এটা বলুন যে আপনার মাঝেই কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। রাজশাহীর মানুষ যে এতো অকৃতজ্ঞ হয় সেটা আমারও জানা ছিল না।”

“কৃতজ্ঞতা বোধ না থাকলে নিশ্চই বাড়ি বয়ে এভাবে অপমানিত হতে আসতাম না!”

কপাল কুঁচকে জবাব দেয় নাহিদ। প্রতিত্তরে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে পাপড়ি। বলে,

“বাড়ি বয়ে এসে কে কাকে অপমান করছে সেটা তো আপনার কথাতেই স্পষ্ট। দুনিয়ার সবাই আপনার কাছে বেয়াদব অভদ্র বেয়াক্কল আরও কত কি। শুধু একমাত্র আপনিই ভালো তাই না? আচ্ছা !আপনাকে কি ভুল করেও কেউ কখনো বলেনি আপনি আসলে ঠিক কতটা চরম লেভেলের অভদ্র?”

কিছু একটা মনে করার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠোঁট চেপে হেসে নাহিদ উত্তর দেয়,

“বলেছে তো। কয়েক মাস আগেই ভুল করে একজন ফোনে আমাকে বেয়াদব, অভদ্র এসবের সাথে বাটপার উপাধিও দিয়েছিল। যার খেসারত বর্তমানে হারে হারে টের পাচ্ছে সে। ভবিষ্যতে আরও পাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

চলবে….

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৩
#আদওয়া_ইবশার

নিকষ কালো রজনী। মাথার উপর নীল সামিয়ানাটা মেঘে ঢাকা। লক্ষ কোটি উজ্জ্বল নক্ষত্র গুলো’ও যেন গা ঢাকা দিয়েছে পুঞ্জীভূত মেঘের আড়ালে। কুচকুচে আধারে পাপড়িও বোধহয় দূর আকাশের নক্ষত্র গুলোর মতোই নিজেকে আড়াল করতে প্রয়াস চালাচ্ছে। ঘরের কৃত্রিম আলো টুকু নিভিয়ে চুপচাপ বসে আছে বারান্দার মেঝেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। উত্তরে বাতাস এসে সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছে আলতো পরশে। হিম শীতল বাতাসের স্পর্শে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে দেহটা। জ্বলজ্বল করা চোখের মণি দুটো ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝেও সামনের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। মাথার ভিতর ভনভন করে ঘুরছে শুধু দুপুরের ঘটনা গুলোই। ক্ষণেক্ষণে মনে পরছে নাহিদের বিদায় বেলার আগ মুহূর্তে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে যাওয়া কিছু কথা। বাতাসের দাপটে যেমন কেঁপে উঠছে পাপড়ির দেহের বাহ্যিক দিকটা তেমন ভিতরটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে নাহিদের বলা শেষ কথা গুলো স্বরণে আসতেই। কানের কাছে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এখনো সেই কথা গুলো।

দুপুরে তখন নাহিদের কথা গুলো শুনে আর কোনো উত্তর দেয়নি পাপড়ি। তবে চোখ পিটপিট করে পালক কিছুক্ষণ নাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল,

“আপনাকে দেখতে ঠিক আমার ফেভারিট এক্টর ওয়াহাজ আলির মতো নতুন কুটুম। ভেবেছিলাম আপনার উপর ক্রাশ খাব। আমার বাস্তব জীবনের ওয়াহাজ ভেবে আপনাকে নিয়ে প্রতি রাতে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখব। কিন্তু আপনি যতটা সুন্দর আপনার কথা ঠিক ততটাই বান্দর টাইপ। তাই আপনার উপর ক্রাশ খেতে খেতেও খেলাম না। স্বপ্ন’ও দেখবনা ওয়াহাজ ভেবে। দেখা যাবে প্রতিদিন স্বপ্নে এসেও আপনি এমন মেজাজ গরম হওয়া কথা বলে আমার স্বপ্নের বারোটা বাজিয়ে দিবেন। আপনার থেকে আমাদের পাড়ার বোকাসোকা সজল ভাই আরও বেশি ভালো। দরকার পরলে আমি তাকেই ওয়াহাজ ভেবে স্বপ্ন দেখব। সজল ভাই বোকা হলেও আশা করি আপনার মতো এরকম মেজাজ গরম হওয়া কথাবার্তা বলবেনা। আপনার থেকে ঐ সজল ভাই ঢের ভালো।”

এতটুকু একটা মেয়ের মুখে তার ফেভারিট এক্টরের সাথে নিজের তুলনা আবার ক্রাশ খাওয়া, স্বপ্ন দেখা কথা গুলো শুনে ভড়কে যায় নাহিদ। পাপড়ি নিজেও বোনের মুখের এমন কথায় হা হয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে দুজনেই তাকিয়ে থাকে পালকের মুখের দিকে। এতো গুলো অপ্রত্যাশিত লাগাম ছাড়া কথা বলে দুজন মানুষের হার্ট অ্যাটাক করানোর উপক্রম করেও পালক নির্বিকার। বোনের এমন বেলেহাজ কথার ধরনে বিস্ময় ভাব কাটিয়ে পাপড়ি কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুকনা কেশে নাহিদ বলে,

“সাধে কি আর তিড়িং বিড়িং ফড়িং বলেছিলাম? বয়স কত তোমার? ক্লাস এইট এ পড়া তেরো-চৌদ্দ বছরের পিচ্চি একটা মেয়ে অথচ কথার ধরন কি সাংঘাতিক! হাত-পায়ের সাথে দেখছি অপরিনত বয়সেই মন’ও তিড়িং বিড়িং করে। আন্টিকে জিজ্ঞেস করে দেখো তোমার বয়সে হয়তো তোমার বেয়াক্কল বোনের নাক দিয়ে সর্দি পরতো। আর তুমি কি না ফেভারিট এক্টরের সাথে বাস্তব জীবনের কোনো ছেলেকে তুলনা করে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাও শুরু করে দিয়েছো!

“এখনো শুরু করিনি তো স্বপ্ন দেখা। তবে দেখব বলেছি।”

নির্লিপ্ত কন্ঠের জবাব পালকের। তৎক্ষণাৎ রাগ সংবরণ করতে না পেরে নাহিদের সামনেই ধুম করে পিঠে কিল বসিয়ে দিল পাপড়ি। চোখ-মুখ খিঁচে ধমকে ওঠে,

” নির্লজ্জের মতো আর একটা শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে তোর গলা টিপে ধরব আমি। বেহায়া মেয়ে কোথাকার! লজ্জা করেনা বড় বোনের সামনে একটা ছেলেকে নিয়ে এসব বলতে?”

“সত্যি কথা বললেই মানুষ নির্লজ্জ হয়ে যায় তাইনা! ভুল কি বলেছি আমি? প্রায় সব মেয়েরাই নিজেদের ক্রাশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর তুমিও তার ব্যতিক্রম না। ব্যতিক্রম শুধু এটুকুই, আমি ভালো মানুষ তাই সবটা স্বীকার করে দিয়েছি। আর তোমরা গোপন করে রেখেছো।”

মুখের উপর জবাব দিয়েই চোখের পলকে বসা থেকে ওঠে চলে যায় পালক। হতবাক দৃষ্টিতে বোনের যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে পাপড়ি। ফিচেল হাসে নাহিদ। পাপড়ির থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিদ্রুপ করে বলে,

” আবারও প্রমাণ হয়ে গেল দুজনকে আসলেই আমি ঠিক নামটাই দিয়েছি। যে মেয়ে নিজের ছোট বোনের সাথেই কথায় পারেনা। হাঁটুর বয়সী বোন মুখের উপর চটাং চটাং জবাব দিয়ে চলে যায় আর সে জবাব দিতে না পেরে বোনের যাবার পানে হা করে তাকিয়ে থাকে। এটা দেখার পর আসলেই যে আপনি বেয়াক্কল না এটা ভাবার আর কোনো অবকাশ থাকেনা।”

একদিকে বোন আর একদিকে নাহিদ। কারো সাথে না পেরে রাগে দুঃখে পাপড়ির চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। তিরতির করে কাঁপতে থাকে ঠোঁট দুটো। কথার তালে সাথে কাঁপে কন্ঠনালী’ও। হাত দুটো মুঠো করে গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা কান্নাটা গিলে নিয়ে বলে,

“আপনার কি মনে হয় না এখন একটু বেশিই ফাজলামি করে ফেলছেন! আমি বোকা হই আর
যাই হই না কেন। অন্তত আপনার মতো মানুষের মনে কষ্ট দেবার মতো কোনো কথা বলিনা।”

কথা গুলো বলার মাঝেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে পাপড়ির গাল বেয়ে। যেটা দেখে থমকে যায় নাহিদ। থমকে যায় পাপড়ি নিজেও। বুঝতেই পারেনি কখন নিজের অজান্তেই চোখে জমে থাকা জল টুকু কান্না হয়ে গড়িয়ে পরেছে গাল বেয়ে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সে। দ্রুত হাতে চোখ মুছে চলে যায় নিজের রুমে।পাপড়ির যাবার পানে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে নাহিদ বিরবির করে বলে ওঠে,

” এতোদিন ভাবতাম শুধু বেয়াক্কল। এখন তো দেখছি বেয়াক্কলের সাথে সাথে ছিচকাঁদুনেও।”

খুব অল্প সময়েই বিভিন্ন পদের রান্না শেষ করে নিয়েছে রওশন আরা। একে একে সব কিছু ডাইনিং এ সাজিয়ে নাহিদের সাথে মেয়েরও তাড়া দেয় খেয়ে নেবার জন্য। খাবার টেবিলে আর কোনো কথা হয় না। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার নাহিদ চোখ তুলে পাপড়ির দিকে তাকালেও পাপড়ি তাকায় না একবারও। পুরোট সময় নিচের দিকে তাকিয়েই একমনে খেয়ে যায়। বুঝতে পারে নাহিদ মেয়েটা হয়তো একটু বেশিই আবেগী। এভাবে মজা করাটা আসলেই হয়তো ঠিক হয় নি তার। সব মানুষ তো আর সবসময় মজা বুঝেনা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মজাটাকেই সিরিয়াস নিয়ে গন্ডগুল পাকিয়ে দেয়। পাপড়ি’ও হয়তো ঐ মানুষ গুলোর মতোই। খাওয়া শেষে নাহিদ জানায় তার একটু ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। রওশন আরা পাপড়িকে বলে নাহিদকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। কোনো উচ্চবাচ্য করেনা পাপড়ি। মাথা নিচু করেই চুপচাপ নাহিদকে সাথে আসতে বলে এগিয়ে যায় আগে আগে। রওশন আরা পালকের থেকে একটু দূরে গিয়ে নাহিদ পাপড়ির থেকে অল্প দূরত্ব রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,

” আপনি চান আমি যেন আর কখনো আপনাকে বেয়াক্কল না ডাকি তাই তো!”

হঠাৎ কানের কাছে নাহিদের গরম নিঃশ্বাস আঁচড়ে পরাই ঘাবড়ে যায় পাপড়ি। দ্রুত পায়ে দূরে সরে গিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে নাহিদের দিকে। পাপড়ির এমন কান্ডে কপাল কুঁচকে কন্ঠে বিরক্ত ভাব নিয়ে বলে,

” টিকটিকির মতো এমন লাফিয়ে সরে গেলেন কেন? বাঘ না কি ভাল্লুক আমি? নিশ্চয়ই খেয়ে ফেলতাম না আপনাকে!”

” তো আপনি আমার এতো কাছে আসলেন কেন?একদম দূরে থাকবেন। আ. .

পাপড়ির পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে পূণরায় নাহিদ বলে ওঠে,

” মুখে ব্রেক কষেন। ঐ বেশি বোঝা মস্তিষ্ক নিয়ে এখন আবার এটা বলবেন না, আমি খারাপ মতলব নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছি। আমার চরিত্র খারাপ এই সেই। ফর ইউর কাইন্ড ইনফোরমেশন আপনার এতোটাও কাছে কিন্তু যায়নি আমি। কথা গুলো আমার মুখ আর আপনার কান পযর্ন্ত সীমাবদ্ধ রাখার জন্য আমার যতটুকু কাছে যাওয়া প্রয়োজন আমি ঠিক ততটুকুই কাছে গিয়েছি। এর বেশি না।”

একটু থেমে আবারও বলে,

“সে যায় হোক। এখন বলুন আপনি আসলেই চান কি না আমি আপনাকে আর বেয়াক্কল না ডাকি!”

নাহিদের দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থেকেই পাপড়ি মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। পাপড়ির সম্মতি ধরতে পেরে নাহিদ পূণরায় পাপড়ির কানের কাছে এগিয়ে আসে। চমকে ওঠে আবারও দূরে সরে যায় পাপড়ি। দ্বিতীয়বার পাপড়ির এহেন কান্ডে যথেষ্ট বিরক্ত হয় নাহিদ। মুখ দিয়ে ‘চ’কারান্ত উচ্চারণ করে শাসিয়ে বলে,

” আর এক পা দূরে সরে গেলে কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে যেমন ভাবছেন ঠিক তেমন রূপটাই দেখিয়ে দিব। ভদ্র আছি ভদ্র থাকতে দিন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন এখানেই। একদম নড়চড় করলেই খবর করে ছাড়ব,

এমন শাসানো বাক্যে কি বলবে পাপড়ি ভেবে পায়না। ক্ষণেক্ষণে অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই থাকে নাহিদের মুখের পানে। এই ফাঁকে নাহিদ আবারও একটু কাছে এগিয়ে আসে পাপড়ির। সাথে সাথেই আতঙ্কে পিটপিট করা চোখ দুটো বুজে ফেলে পাপড়ি। কানের কাছে নাহিদের আঁচড়ে পরা গরম নিঃশ্বাস গুলোর তালে তালে কেঁপে ওঠে পাপড়ির সর্বাঙ্গ। তার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে মজা পায় নাহিদ। পাপড়ির ভিতু মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসতে থাকে মিটমিট করে। কিছুক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে মিহি কন্ঠে বলে,

“বলুন তো কার্বনের সাথে হাইড্রোজেনের কখনো ঝগড়া হয় না কেন?”

এমন অদ্ভূত প্রশ্নে বন্ধ চোখ জোড়া মেলে পিটপিট করে তাকায় পাপড়ি। কাঁপা কন্ঠে জানতে চায়,

“কেন?” হাস্যজ্জ্বল মুখটা নিমিষে গম্ভীর হয়ে যায় নাহিদের। চোখ-মুখ কুঁচকে বলে,

“এই প্রশ্নের উত্তর তো একটা এইট-নাইনের বাচ্চাও পারবে। এটুকু’ও জানেন না অথচ অভিযোগ করেন কেন আপনাকে বেয়াক্কল ডাকি!”

নাহিদের এতোটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছে পাপড়ি। দূরে সরে যাবার হাজার পায়তারা করেও লাভ হচ্ছেনা। তখন নাহিদের থেকে দূরে সরতে গিয়ে ওয়াশরুমের সামনর দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তার। ঠিক সেটার সুযোগটাই নিয়েছে নাহিদ। দু-হাত দেয়ালের দুপাশে রেখে আটকে দিয়েছে পাপড়িকে। দূরে যাবার কোনো উপায় রাখেনি তার। ঘরে মা-বোন আছে। একটু জোরে কথা বললেই তারা শুনে নিবে। এমন পরিস্থিতিতে নাহিদকে কিছু বলতে গেলে মা শুনে এগিয়ে এসে এই পরিস্থিতি দেখে আবার না জানি তাকেই অন্য কিছু ভেবে নিয়ে তাকেই ভুল বুঝে। মনের মাঝে তাদের এমতাবস্থায় কেউ দেখে ফেলার আতঙ্ক নিয়ে ভিতু কন্ঠে জবাব দেয়,

“কারণ আমি সাইন্সের স্টুডেন্ট না। তাই এসব জানাও আমার কাম্য না। এবার প্লিজ দূরে সরুন।”

“আমার গা থেকে কি কোনো বাজে স্মেল আসছে?”

দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে না জবাব দেয় পাপড়ি। জবাব পেয়ে নাহিদ আবারও বলে,

“তাহলে এমন দূরে সরুন দূরে সরুন করছেন কেন? খেয়ে ফেলছি না তো আপনাকে। আরে ভাই আমার কথা শেষ করেই তো চলে যাব আমি। এতো হাইপার হবার কি আছে? সবসময় বেশি বোঝা পাবলিক। সাধে কি আর বেয়াক্কল বলি আপনাকে! সে যায় হোক। যে প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম সেদিকে আসি। ঐ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে কাওকে সাইন্সের স্টুডেন্ট হতে হয় না। বেসিক নলেজ থাকলেই উত্তরটা বলা যায়। কিন্তু আপনি সেটাও পারছেন না। না পেরে দোহাই দিচ্ছেন সাইন্সের স্টুডেন্ট না। এবার বুঝেছেন তো বুদ্ধি আপনার হাঁটু না সোজা টাকনুর নিচে নেমে গেছে! আচ্ছা থাক! আপনার বুদ্ধির প্রসঙ্গেও আর না যায়। প্রশ্নের উত্তরটা আমিই দেই। কার্বনের সাথে হাইড্রোজেনের কখনো ঝগড়া হয় না কারণ তারা সবসময় একে অপরের সাথে ফেবিকলের মতোই আটকে থাকে। যে কারণে তাদের মাঝে ঝগড়া হবার কোনো অবকাশেই থাকেনা। এখন আমরাও যদি তাদের সম্পর্কের সূত্র ধরে এগিয়ে যায় তাহলে কিন্তু আমাদের মাঝেও ঝগড়া হবার কোনো সম্ভাবনা থাকেনা। আর না থাকবে আমার আপনাকে বেয়াক্কল বলে ডাকার কোনো ইচ্ছে। কারণ যত যায় হোক, নিজের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষটা যদি জগত বিখ্যাত বেয়ক্কল’ও হয় তবুও তাকে বেয়াক্কল ডেকে নিজেই নিজেকে অপমান করা যায় না।”

কথার মাঝে একটু থামে নাহিদ। পাপড়ির স্তম্ভিত মুখের দিকে কিছু সময় শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে মুখটা আর একটু কাছাকাছি নিয়ে মন্থর স্বরে জানতে চায়,

“মিস বোকা রানী! হবেন কি আমার ফেবিকল? কথা দিচ্ছি আজীবন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখব নিজের সাথে। সম্মানের সাথে মনের রাণী করে রাখব। কখনো কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করার কোনো সুযোগ দিবনা। আর না দিব ঐ বোকা চাহনীর চোখ দুটো দিয়ে অশ্রু ঝরার কোনো সুযোগ।”

কথা গুলো শেষ করেই দূরে সরে যায় নাহিদ। পাপড়ির থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে ভাবলেশহীন কন্ঠে পূণরায় বলে,

“এই একটা সুযোগ। এটা কাজে লাগাতে না পারলে কিন্তু আজীবন আপনাকে বেয়াক্কল নামেই ডেকে যাব। শুধু আমিই না। সবাই যাতে আপনাকে বেয়াক্কল নামেই চিনে সেই ব্যবস্থাই করব। আপনার ছবি সহ পোস্টার ছাপিয়ে দিব। যেটাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকবে “পাপড়ি নই। আমাকে বেয়াক্কল বলে ডাকুন। আমার আচার আচরণের সাথে এই বেয়াক্কল নামটাই পারফেক্ট। তাই বাপ-মায়ের আকিকা করে রাখা নাম বদলে নতুন করে বেয়াক্কল নাম রেখেছি।” দেয়ালে, রাস্তার পাশে, মোড়ে মোড়ে, আপনার ভার্সিটির আনাচে কানাচে সব জায়গায় এই পোস্টার লাগিয়ে দিব। তখন কিন্তু পরিচিত থেকে শুরু করে অপরিচিত সবার মুখেই এই বেয়াক্কল নামেই শুনতে হবে। আর একটা কথা, আমি কিন্তু খালি কলসি বাজায় না। যা বলি তাই করি। আজ রাতের মাঝে আমার প্রশ্নের জবাব না পেলে কাল সকালেই কথার প্রমাণ দেখতে পারবেন বাইরে বের হলেই। সো যা করবেন একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে। কেমন!”

কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না নাহিদ। পাপড়িকে অবাকের সাগরে ডুবিয়ে রেখেই বড় বড় পা ফেলে চোখের আড়াল হয়ে যায়। রওশন আরার থেকে বিদায় নিয় চলে যায় একেবারে বাড়ি থেকেই।

চলবে……

( তাড়াহুড়োয় রিচেইক দেওয়া হয় নি। ভুল গুলো ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।)