ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-০১+০২

0
355

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০১+০২

গতকাল রাতে আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ এনেছে। নতুন বউ বয়সে আমার বড় আপার সমান হবে। বড়ো লজ্জার বিষয়। অথচ এই ভয়ঙ্কর লজ্জা জনক কাজ করা আমার আব্বার মুখটা হাসি হাসি। বিন্দুমাত্র অস্বস্তি নেই। চেহারায় সুখী সুখী ভাব। তিনি বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে রোজকার মত আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘আইজ কি মাছ আনা যায় ক তো দোয়েল?’

আমার নাম দোয়েল না। সুন্দর একটা নাম আছে আমার। ফুলের নামের নাম। যে ফুলে গন্ধ প্রচুর। ধরতে পেরেছেন তো? হ্যাঁ। জুঁই আমার নাম। কিন্তু বাবা আদর করে দোয়েল বলে ডাকেন। শুধু আমাকে না। আমার সব বোনদেরকে তিনি ডাক নাম দিয়েছেন। সব পাখির নামে নাম। সব বোন বললাম কারণ আমার ভাই নেই!

আব্বা এখনো যাননি। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে মাছের নাম না শুনে তিনি যাবেন না। আমি শীতল সুরে বললাম,

‘নতুন মায়ের থেকে মাছের নাম শুনে আসবো? কোন মাছ তার পছন্দের?’

‘হুনবি? তাইলে তাই কর! হুনে আয়।’

আব্বার চোখে মুখে গদগদ ভাব। থাকার কথা-ই! কারণ নতুন বউ নিয়ে তিনি গতরাতে ফিরেছেন প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে। ভেবেছিলেন অনেক হইচই হবে। কান্নাকাটি হবে, নাটক হবে। তার কিছুই হয়নি। আমরা বেশ স্বাভাবিক! আব্বার বিশাল বড়ো দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। আমি বারান্দা দিয়ে ঢুকে নিজের রুমে এলাম। মাথা ঝিমঝিম করছে সকাল থেকে। অথচ আব্বার আকস্মিক কাজটি আমাকে তেমন বিস্মিত করেনি। তিনদিন আগে বাজার করার কথা বলে তিনি বের হয়েছিলেন। কাল রাতে ফিরেছেন বউ নিয়ে। যেনো এমন হওয়ার কথা ছিল। আব্বা যে বদলে গিয়েছিল তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি। বুঝতে পারেনি আমার বাকি বোনেরা। আর আমার রুগ্ন মা! তারা গতরাত থেকে শ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেন। বাকরুদ্ধ সবাই! তাদের মুখে এখনো ভাষা ফুটেনি।

বেলা গড়াচ্ছে। আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের মতো বড়ো মাপের খবরটা দুপুর পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা গেলো। সময় বাড়ার সাথে সাথে সেটা সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। তারপরের অংশ স্বাভাবিক। গ্রামের আনাচে কানাচে থেকে সবাই আমাদের বাড়ি মুখী হওয়া শুরু করলো। সামনের ছোট্ট উঠোনে তখন তুমুল ভিড়। লোকে লোকারণ্য! এক চোখে দেখতে না পাওয়া মজিদার মা থেকে শুরু করে বাদ যায়নি টুটুলের বয়স্কা দাদী। আমি বারান্দার এক কোণা থেকে সবাইকে লক্ষ্য করছিলাম। নতুন বউ উঠোনের মাঝে চেয়ারে বসে আছে। পাশের বাড়ির চাচী সবার দেখার সুবিধার্থে তাকে খোলা জায়গা বসিয়ে দিয়েছে। তাকে ভীত দেখাচ্ছে না। বড় লাজুক চেহারা। ঝলমল দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সে কি জানতো না , যে লোকটিকে সে বিয়ে করছে তার ঘরে বড় বড় চারটে কন্যা আছে? আছে রুগ্ন দেহের এক স্ত্রী?

ওড়নায় টান পড়ায় নিচের দিকে তাকালাম। পুতুল মুখে আঙ্গুল দিয়ে ডাকছে আমায়। কোলে তুলে নিলাম ওকে। আমার সবচেয়ে ছোট বোন পুতুল। বয়স আড়াই হবে। সবেমাত্র কথা বলা শিখেছে। ওকে কাছে টেনে বললাম,

‘পুতুল খিদে পেয়েছে?’

ও দুই দিকে মাথা নাড়ল। তার উত্তর হ্যাঁ নাকি না বুঝতে বেগ পেতে হলো। ওকে নিয়ে মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। পুতুল এখনো বুকের দুধ খায়। দেখি মা একটু কাছে নেয় কিনা!

মা রুম অন্ধকার করে রেখেছে। দক্ষিণের জানালাটা পর্যন্ত বন্ধ। অথচ ওই জানালা মা কোনোদিন বন্ধ করে না। ঝড় বৃষ্টির রাতেও না! ওটা বন্ধ করলে নাকি মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসে। আজ মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসছে না? নিঃশ্বাস আটকে আসছে না? মায়ের কাছে এগিয়ে গেলাম। মা একা নেই। তার সাথে বড়ো আপা আর সেজো আপা বসে রয়েছে। সবার মুখ শুকনো। বড়ো আপাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

‘আপা, দুপুরে খাবে না?’

আপা আগের মতো নির্বিকার রইলো। আপা অন্তঃসত্ত্বা। এখন খালি পেটে থাকা পেটের বাবুর জন্য ক্ষতিকর। আপা বুঝে না যেনো! এত অবুঝ হলে হবে? সেজো আপাকে ডাক দিলাম আমি। আপাও প্রতিত্তর করলো না। সামান্য নড়লো শুধু। সেজো আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে আমাদের পাশের গ্রামের। এখন একটু সতর্ক থাকতে হবে। চেহারা সুন্দর রাখতে হবে। এত দুশ্চিন্তা করলে চলবে? বিয়ের আগের গুটিকয়েক দিন আপাকে নিজের যত্ন নিতে হবে। বিয়ের দিন যেনো তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কনে লাগে।

আমার বুকে ছোট্ট একটা ভয় দানা বেঁধেছে। আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা যদি পাত্রপক্ষের কানে যায় তারা কি বিয়েটা করবে? আমি মনে মনে দুয়া করতে থাকলাম। সেজো আপার বিয়েটা যেনো ভেঙ্গে না যায়।

________

সন্ধ্যা মিলাবে মিলাবে। আমি বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম। শুকনো পুকুর। বর্ষায় জলে ভরে উঠে। বর্ষা চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে শুকিয়ে মাটি বের হয়ে যায়। পানিশূন্য পুকুর আমার ভালো লাগে না। এবারে বর্ষা আসতে এত দেরি করছে কেনো?

সময় গড়াচ্ছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক বেড়ে চলেছে। পুকুর পাড়ে বসে থাকা অবস্থায় চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। আজ অন্ধকার এত ঘন কেন? আমার মন খারাপের তীব্রতা টের পেয়েছে বুঝি?

উঠোন থেকে পুতুলের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পরলাম। পুকুর পাড় ছাড়ার আগ মুহূর্তে পুব দিকের বাড়িটিতে তাকালাম। সারা বাড়ি জুড়ে জ্বলজ্বলে সাদা আলো জ্বলছে। আমার এপাশে এত অন্ধকার। ও বাড়িতে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটি কি টের পাচ্ছে এ অন্ধকার?

সারা বাড়ি অন্ধকারে নিমজ্জিত। বিদ্যুৎ চলে গেছে দীর্ঘক্ষণ হলো! বারান্দায় বসে কাঁদছিল পুতুল। কাছে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম। আব্বা বাজার থেকে এখনো ফেরেনি। রান্নাঘরে গিয়ে বাতি খুঁজলাম। পেয়ে গেলাম দ্রুত। দেয়াশলাই ঠুকে জ্বালিয়ে দিলাম। কিন্তু শলতে নিভু নিভু হয়ে গেলো দ্রুত। এলাকায় দু-দিন বিদ্যুৎ থাকবে না। মাইক দিয়ে ঘোষণা করে গেছে গতকাল। ঘরে চার্জার লাইট নেই, কুপিতে তেল নেই! এখন উপায়?

পুতুলকে রেখে বের হলাম আমি। মোড়ের মুন্সি কাকার দোকানটার দিকে। একহাতে ছোট্ট এক প্লাস্টিকের বোতল। আরেক হাতে ময়লাযুক্ত টাকার নোট নিয়ে। হাতে বিশ টাকা! টাকাটা আব্বা দিয়েছিল মাস খানেক আগে। স্কুলে যাওয়ার সময়। খরচ করা হয়নি।

মাথায় লম্বা করে ওড়না টেনে এগিয়ে চলেছি আমি। পরিচিত কারো নজরে না পড়ি যেনো। বিশেষ করে ওই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সামনে তো আরো নয়!

‘জুঁই!’

এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটছিলাম। দ্রুত পায়ে! আচমকা এক পুরুষ অবয়ব পথ আগলে দাঁড়ালো। কণ্ঠস্বর কানে যেতে নিঃশ্বাস আটকে এলো আমার। রাফি ভাই? এড়িয়ে চলে যেতে ফের ডাক দিল,

‘জুঁই কোথায় যাস?’

এতক্ষণে গলা উপচে কান্না পেয়ে গেলো আমার। এই একটা মানুষের সামনে পড়তে চাচ্ছিলাম না। তবুও কেনো এই মানুষটার সাথে দেখা হতে হবে? সারাদিনের জমিয়ে রাখা সমস্ত অভিমান উপরওয়ালার উপর গিয়ে জমলো। আমি ব্যথা লুকিয়ে বললাম,

‘মোড়ের দোকানে রাফি ভাই।’

‘চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। এখন দোকানে কেনো যাবি?’

রাফি ভাইয়ের কণ্ঠে চাপা রাগ আর স্পষ্ট অধিকার বোধ ফুটে উঠেছে। বিস্মিত হলাম আমি। রাফি ভাই তো এত কথা বলার মানুষ না। আমাকে দেখেও সারাজীবন না দেখার ভান করে চলে গেছে। আজ আগ বাড়িয়ে এত কিছু জিজ্ঞেস করছে কেনো? আমার মন ভালো করার জন্য? উনি কি জানতে পেরেছেন আজ আমাদের ভীষন দুঃখের দিন?

‘মোড়ের দোকানে। কেরোসিন তেল আনতে যাই।’

‘মাথা খারাপ? এত রাতে তোর যেতে হবে? বাড়িতে আর কেউ নাই?’

আমি উত্তর দিলাম না। রাফি ভাই বুঝতে পারলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘তোর আব্বা কই?’

‘বাজার থেকে ফেরেনি। মাছ কিনতে গেছে।’

রাফি ভাই অস্পষ্ট সুরে কিছু বললো। আমার বোধগম্য না হলেও বুঝতে পারলাম আব্বাকে গালি দিলো হয়তো। এবারে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘বোতল দে। আমি তেল এনে দিচ্ছি। এখানে দাঁড়িয়ে থাক।’

‘আমি পারবো। আপনার কষ্ট করতে হবে না।’

‘এক থাপ্পর খাবি। বোতল দে!’

বোতল দিতে হলো না আমাকে। রাফি ভাই হাত থেকে টেনে নিল। টেনে নেওয়ার সময় হালকা যে স্পর্শ লাগলো তাতেই আমি জমে গেলাম। কোনো রকমে বললাম,

‘টাকা টা?’

রাফি ভাই পেছন ঘুরে তাকালো। দ্বিধান্বিত কয়েক মুহূর্ত অতিক্রম হলো। পরক্ষণে বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে টাকাটা নিয়ে মোড়ের দিকে হাঁটা ধরলো। আমি পাথরের মতো সেখানে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

রাফি ভাই আমার প্রথম প্রেম। আমার প্রথম অনুভূতি। আমার প্রথম আবেগ। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু এই মানুষটার বসবাস। তাকে নিয়ে আমার শ’য়ে শ’য়ে জল্পনা কল্পনা! এই মানুষটাকে ভেবে আমার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে হয়। এই মানুষটাকে বুকে নিয়ে আমি ঘুমাতে যাই। ঘুম ভাঙতে সর্বপ্রথম এই মানুষটার কথা মনে পড়ে। অথচ রাফি ভাই তার কিচ্ছু জানে না। কিচ্ছু বোঝে না। সে আমার বড়জোর তিন কি চার বছরের বড়। কলেজে পড়ে। আমি তার কলেজের উল্টো দিকের হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ি। তাকে এক পলক দেখার জন্য কতশত পাগলামি করি। দুটো কথা বলার জন্য কতশত অপেক্ষা করি! অথচ সেই মানুষটা আজ নিজে থেকে কত কথা বললো।

রাফি ভাইয়ের বাবা-মা দুজনই শিক্ষিত। বাবা বড়ো চাকুরী করে। বাড়িতে সুবিশাল বিল্ডিং। কথাবার্তা চমৎকার। পোশাক-আশাক চমৎকার। এই গ্রামের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি তারা। তার সাথে আমাদের কিচ্ছু যায় না। তবুও এই মানুষটাকে নিয়ে রোজ রাতে আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি। তাকে নিয়ে কল্পনায় আস্ত এক সংসার সাজিয়ে বসে আছি। সেই সংসার বাস্তবে রূপ দিতে নিজেকে একটু একটু করে পরিবর্তন করছি রোজ। আব্বার নিষেধাজ্ঞা না মেনে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শিখছি। আরো কত কি! আমায় তো রাফি ভাইয়ের যোগ্য হতে হবে। বুকে সাহস নিয়ে তাকে একদিন বলতে হবে, ‘আপনাকে আমি আমার দেহ-মন সঁপেছি অনেক আগে। বহুদিন অপেক্ষা করেছি। এবার আমার অপেক্ষার বাগানে খিল দিন তো।’

বাড়ি থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। আব্বার জোরালো গলা শোনা যাচ্ছে। পুতুলও বিকট সুরে কান্না করছে। আর অপেক্ষা করা যায় না। রাফি ভাই এখনো ফিরছে না কেনো? রাস্তার মোড়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে উল্টো পথে দৌঁড়ে বাড়ি আসলাম।

আব্বা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কাছে যেতে কষে এক চড় বসিয়ে দিলো। ছিটকে কিছুদূর সরে এলাম। মাথা ভনভন করছে। কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখলাম। আব্বার হঠাৎ এতো রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম না। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। অথচ তাতেই লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেলো। ব্যথা সয়ে আসতে আব্বার দিকে তাকালাম। আব্বা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। কানে কিছুই ঢুকছে না আমার। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে চোখ গেলো রাস্তার বেড়ার ওদিকে। রাফি ভাই বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখন এলেন উনি? আমি আকুল মনে বার বার বললাম,

‘চলে যান রাফি ভাই। দয়া করে এদিকে আসবেন না। আপনাকে যেনো আব্বা না দেখে। চলে যান!’

রাফি ভাই আমার মনের আকুল আবেদন শুনতে পেলো না। ঝাপসা চোখে দেখলাম সে রুদ্র মূর্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০২

আমার আকুল মনের আবেদন শুনতে পেলো না রাফি ভাই। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম রুদ্র মূর্তি নিয়ে সে এগিয়ে আসছে। আব্বার কাছে এসে থেমে গেল। বাহিরে আবছা অন্ধকার। আব্বা তাকে চিনতে পারলেন না। তিনি উচুঁ স্বরে বললেন,

‘কেডা রে?’

‘আমি রাফি। জাকির হোসেনের ছেলে।’

আমি ছোট খাটো বিস্ফোরণের অপেক্ষায় রইলাম। আব্বা কি রেগে যাবে? রাফি ভাইকে বিশ্রী কিছু বলবে? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আব্বা হেসে উঠলেন। আন্তরিকতার হাসি। রাফি ভাই কে নিয়ে হঠাৎ ভীষন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চেঁচিয়ে সেজো আপাকে ডাকতে লাগলেন।

‘এই ময়না, চেয়ার আনতো। বাবাজীকে বইতে দে।’

সেজো আপা বের হলো না। আব্বা এবার আমাকে ধমকে বলে উঠলেন,

‘হুনস না? কথা কানে যায় না! বাবাজী রে বইতে দে।’

গালে হাত রেখেই নড়লাম আমি। রুমে ঢুকে হন্যে হয়ে চেয়ার খুঁজলাম। চেয়ার নেই। ভালো চেয়ার মাত্র একটা আছে। সেটা নতুন মায়ের ঘরে। বাধ্য হয়ে পায়া ভাঙ্গা চেয়ারটা নিয়ে বের হলাম। রাফি ভাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে চেয়ার এগিয়ে দিতে ছোট্ট করে সে বললো,

‘বসবো না আমি।’

আব্বা জোর করলো বসার জন্য। তবুও সে বসলো না। তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে আমার গালের উপর ন্যস্ত হলো। আব্বা একসময় জিজ্ঞেস করলেন,

‘বাবাজী কি মনে কইরা?’

‘চাচী তেলের কথা বললো। তেল নাই নাকি। এইজন্যে মোড়ের দোকান থেকে এনে দিলাম।’

‘ও। আমারে কইবো না? আমি তো বাজারে গেছিলাম।’

‘আমি আসছি!’

কেরোসিনের বোতলটা চেয়ারের উপর রেখে রাফি ভাই ঘুরে দাঁড়ালো। আব্বা বাঁধা দিয়ে ঝটপট বললেন,

‘বাবাজী দাঁড়াও এট্টু। একখান জিনিস দেবো।’

আব্বা হেঁটে উত্তরের ঘরের দিকে গেলেন। চিন্তা হলো আমার। আব্বা কি দিবে রাফি ভাই কে! চিন্তারত অবস্থায় আচমকা মুখে আলো জ্বলে উঠলো। চোখের পাতায় পড়তে বন্ধ করে নিলাম। রাফি ভাই ফোনের লাইট দিয়ে গাল দেখল। নরম সুরে বললো,

‘ব্যথা পেয়েছিস খুব? রাতে কিছু লাগিয়ে নিস!’

রাফি ভাইয়ের বাম হাতটা গাল স্পর্শ করলো আমার। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলাম। পরক্ষণে ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলাম। রাফি ভাইয়ের ভয়ডর নেই? বাড়ি ভর্তি মানুষ! আব্বা ফিরছে। তার হাতে বক্সের মতো কিছু একটা। সেটা তিনি রাফি ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘এইডা তোমার আব্বা রে দিও।’

রাফি ভাই মাথা নেড়ে হাঁটা ধরলো। আর পেছন ফিরে তাকালো না। আমি আগের জায়গাতে জমে রইলাম। একটা মানুষ আমাকে পাথর বানিয়ে কি নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে গেলো!

ঘোর কাটলো আমার। আব্বা আবার চেঁচাচ্ছে। সেজো আপা এখনো বের হয়নি। আপার প্রচন্ড জিদ। রান্নার জন্য তখন হয়তো আপাকে ডেকেছে। আপাকে না পেয়ে আমাকে। আমি ছিলাম না বলে মারলো। এটা নতুন নয়। আব্বা আগে থেকেই আমাদের গায়ে হাত তুলে। একবার তো পুতুলকে তুলে আছাড় দিয়েছিল। ছোট্ট পুতুল! আমাদের বাবা নামক মানুষটা ভারী নিষ্ঠুর।

আব্বা আবার সেজো আপাকে ডাকছে। সেজো আপার কাজ গুছানো। চমৎকার। রান্নার হাতে যেনো জাদু আছে। আব্বা হয়তো চাচ্ছে আজ তার নতুন অতিথির জন্য আপার হাতে ঝোল করতে। কিন্তু আপা বের হলো না। তার বদলে বের হয়ে এলো বড়ো আপা। আব্বা মাছ এনেছে। মুখের টনটনে ব্যাথা নিয়ে আমি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। বড়ো আপাকে সাহায্য করতে হবে।

__________

এরপর দুদিন কেটে গেছে। বাড়ির অবস্থা ভয়াবহ। মা এখন পর্যন্ত মুখে কিছু তুলেনি। বড়ো আপা আর সেজো আপা কোনো রকমে দুটো দানা খেয়ে বেঁচে আছে। মাকে কিছুতেই খাওয়ানো যাচ্ছে না। পুতুলকেও কাছে নিচ্ছে না। মায়ের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। শরীর আরো দূর্বল হয়ে গেছে। তবুও মুখে খাবার তুলছে না।

বড়ো আপা শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে মাসখানেক হলো। বর ভালো না। সারাক্ষণ মারধর করে। ঠিকমতো খেতে দেয় না। পেটে বাচ্চা আসার পর আরো ক্ষেপেছে। সর্বদা চড়, লাথি! আপা সহ্য করতে না পেরে চলে এসেছে। আর খোঁজ নিচ্ছে না তারা। এত দুঃখ সহ্য করা যায়?
পৃথিবীর সব দুঃখ উপরওয়ালা আমাদের দিয়েছে যেনো!

বিকেলের দিকে আব্বা গোছগাছ শুরু করলো। কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার সাথে। তবুও কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম,

‘আব্বা কোথায় যাবে তুমি?’

আব্বা সদুত্তর দিলো না। নতুন মা এই দুদিন কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ থেকেছে। আব্বার ঘর থেকে বের হয়নি। খাবারও আব্বা ঘরে দিয়ে এসেছে। কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে, নতুন মা নাকি যাত্রাপালা করতো। সেখানে আব্বার সাথে পরিচয়। পরে নাকি আব্বাকে বিয়ে করে পালিয়ে এসেছে।

আব্বার বয়স বাড়েনি। দেখলে অল্প বয়সের মনে হয়। প্রথম দেখায় কেউ বিশ্বাস করবে না এত বড় বড় মেয়ে আছে। আমার নতুন মায়েরও বোধ হয় বিভ্রম হয়েছে। বুঝতে পারেনি।

সন্ধার পর পর আব্বা বের হলো। নতুন মাকে সাথে নিয়ে। একদম পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে। আব্বাকে দেখে কেন জানি আমার কষ্ট হলো। ভীষণ কষ্ট হলো। মনে হলো, আব্বাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলছি। আব্বা কি আর কোনোদিন আসবে না? নিজের অজান্তে আমার চোখের কোণ ভিজে উঠলো।

আব্বা যাওয়ার পর পরই মা রুম থেকে বের হলো। টানা ৪ দিন পর বাহির হলো মা। আব্বা যাওয়ার আগে মায়ের রুমে ঢুকেছিল। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে জানি না। কিন্তু আমি তাকিয়ে দেখলাম মা একদম স্বাভাবিক। আমার কাছে এসে লাজুক স্বরে বললেন,

‘জুঁই ভাত আছে? ভাত দে তো। খিদা পাইছে খুব।’

আমার চোখের জল গাল স্পর্শ করলো। দৌঁড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ভাত বেড়ে আনলাম। মা বারান্দায় বসে খেলো। পেটপুরে। খাওয়া শেষ করে পুতুলকে কোলে নিল। ওর সাথে দু চারটে ছেলেমানুষী কথার আদান প্রদান করলো। আমার কি যে ভালো লাগলো!

________

সেজো আপা আজ আমার পাশে শুয়েছে।মা পুতুলকে নিয়ে বড়ো আপার সাথে ঘুমিয়েছে। সমস্ত বাড়ি সুনসান। নিরব! সেজো আপা চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। আপা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না। কদিন হলো স্কুলে যাওয়া হয়নি। লোকের কথার ভয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখা হয়নি। ঘরবন্দী সময় কাটছে অনেকটা! সেজন্যে রাফি ভাইয়ের সাক্ষাৎ মেলেনি। সেই যে সেদিন রাতের অন্ধকারে দেখেছিলাম। আর চোখে পড়েনি। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম আমি। মানুষটা ঐ তো একটু দূরে রয়েছে। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে যেন! তবুও কত দূরে! একবার চোখের দেখা মেলে না।

‘জুঁই, নড়চড় করবি না। লাথি দিয়ে ফালায় দিবো কিন্তু!’

মুহূর্তে আমি স্ট্যাচুর মতো হয়ে গেলাম। আপাকে দিয়ে ভরসা নেই। সত্যি সত্যি লাথি দিতে পারে। একবার শীতের রাতে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে দুজনার। লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছিল। আপার প্রচন্ড রাগ। আপাকে দুলাভাই সামলাবে কি করে?

‘আপা! ঘুমিয়ে পড়েছ?’

ক্ষীণ গলায় ডাক দিলাম আপাকে। আপা শুনলো না। এবার হালকা করে বাহু তে ধাক্কা দিলাম। আপা বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘বল!’

‘এই বিয়েতে তোমার মত নেই?’

‘বিয়েটা হবে না রে জুঁই। তোর মনে হয় আব্বার এতবড় ঘটনার পর ওরা আমায় বাড়ির বউ করবে? করবে না। ওরা নামী-দামী পরিবার। এলাকায় নাম প্রচুর। আমদের মত এমন পরিবার থেকে মেয়ে কেন নিবে?’

আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে পাশের গ্রামে। ছেলে একটু বখাটে টাইপের। তবুও বাপের প্রচুর অর্থ। বাপ মেম্বার। সেজো আপা আগুন সুন্দরী। ছেলেটা রাস্তায় আপাকে দেখেছিল। কিছুদিন উত্যক্ত করেছে। তারপর বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। আব্বা এক কথায় রাজি হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর বিয়ে। কিন্তু কয়েক দিন হলো তারা খোঁজ নিচ্ছে না। কোনো প্রকার যোগাযোগ করছে না। আপার বিয়েটা কি ভেঙ্গে যাবে? বিয়ে ভেঙ্গে গেলে মা প্রচুর কষ্ট পাবে।

অন্ধকারে আপার দিকে তাকালাম। মুখ দেখা না গেলেও বুঝলাম আপা কাদঁছে। কেনো কাদঁছে? আপা তো এই বিয়েতে খুশি ছিল না। আব্বা এক প্রকার জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল। বিয়ে না হলেই তো ভালো। আপা তাহলে কষ্ট কেন পাচ্ছে? আপা কি কাউকে ভালোবাসে?

আচমকা প্রশ্ন টা মাথায় এলো আমার। জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেলাম। আপার মন ভালো না। অন্য সময় জিজ্ঞেস করবো। কাত ঘুরে চোখ বন্ধ করলাম আমি। বন্ধ দু চোখের পাতা পাশের বাড়ির ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেলো।

__________

জানালার বাইরে কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। আবছা ভাবে কানে আসছে। কিন্তু চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু পুরুষ কন্ঠটা চির পরিচিত মনে হচ্ছে। হঠাৎ ধপ করে চোখ খুললাম। জানালার ওপাশে রাফি ভাই। রাফি ভাই এতরাতে কার সাথে কথা বলছে? আমার বাঁ পাশের বিছানা খালি। সেজো আপা নেই। অন্ধকারে দেখলাম আপা পায়ের দিকের জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। জড়োসড়ো হয়ে। ফিসফিস করে রাফি ভাইয়ের সাথে কি যেনো বলছে! বুকের ভেতর তীব্র জ্বলুনি শুরু হলো আমার। এই অন্ধকার রাতে ভয়ংকর এক সত্য আবিষ্কার করলাম।

(চলবে)