হৃদয়েশ্বরী পর্ব-০৭

0
727

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব__০৭

ক্যালিফোর্নিয়ার চমৎকার এক রৌদ্র্যজ্বল সকাল।বহু দিনের মেঘলা আকাশের পর আজ সূর্যের দেখা মিলেছে আসমানে। ধূসর আসমান আজ হলদেটে।প্রানবন্ত, সজীব হয়ে উঠেছে গাছের পাতা গুলো। বরফের দলা রৌদ্রের তাপে গলে যাওয়া শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। এক দূরন্ত কিশোরী ক্রাচে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে এসে দাঁড়ায় বিশাল বড় জানালার কাছটায়। জানালা সম্পূর্ণ কাঁচের। বাহিরের দৃশ্য স্পষ্টত দৃশ্যমান হলো কিশোরীর চক্ষু সম্মুখে। হাসলো সে! প্রাণোচ্ছল হাসি। তার মিষ্টি মূর্হতে ব্যাঘাত ঘটাতে হাজির হয় এক তরুণী। সে দরজা সশব্দে খুলে কর্কশ কন্ঠে বলল,

‘ তূর্শী! হোয়াট আর ইউ ডুয়িং দেয়ার? ‘

ক্লারার কর্কশ কন্ঠে কেঁপে উঠে পিছনে তাকায় তূর্শী। গলা ভেদ করে ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয়ে বেড়িয়ে আসে তার জোড়াল দীর্ঘ নিঃশ্বাস। দু’দিকে মাথা এলিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। শেষে নিরাশ গলায় বলে,

‘ উফ! কাম অন ক্লারা। টক টু বাংলা। ‘

ক্লারা নিজ মুখোশ্রীতে বিরক্তি ফুটিয়ে তুললো। ঠোঁট বাঁকিয়ে অপরিপক্ক বাংলা ভাষায় বলল,

‘ আমেরিকান হয়ে কিভাবে যে তোমার বেংলাদেশের জন্য এতো ধরধ (দরদ)। আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইট! ‘

তূর্শী কাঁচের জানালা ভেদ করে বাহিরে দৃষ্টিপাত ফেলে। ক্লারাকে তার এই মূর্হতে গর্দভ মনে হচ্ছে। যদিও সে নিজ স্থান হতে সঠিক। ক্লারা কি আর জানে? তূর্শী একজন খাঁটি বাঙালি। বাহিরে দৃষ্টি স্থির করে সে বলল,

‘ কিছু বলতে চাও ক্লারা? হটাৎ এই সময় আমার রুমে কেনো?’

ক্লারার মুখোশ্রী হটাৎই ভীষণ থমথমে, গম্ভীর হয়ে উঠলো। কলমের ক্যাপ চিবুতে চিবুতে বিষয়টা বেশ তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো তূর্শী। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। নাহলে ক্লারাকে সচরাচর গম্ভীর দেখা যায় না। ক্লারা এগিয়ে আসলো। তূর্শীর পাশে বসে তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,

‘ সিক্রেট ইনফর্মার হতে যাচ্ছো তুমি মনেই হয়না। ‘

ডান চোখের ওপর থাকা কুচকুচে কালো রঙা ভ্রু’টা উঁচু করলো তূর্শী। সন্দিহান গলায় বলে উঠলো,

‘ কেনো?’

‘ বাংলাদেশের বিমানবাহিনী থেকে অফিসার আসছে তাদের লাস্ট ট্রেনিং নিতে। ওদের ওপর হামলা হতে পারে। ওপর থেকে আদেশ এসেছে আমাদের তদারকি করে দেখতে কারা ওদের ওপর হামলা করবে। ‘

‘ স্ট্রেঞ্জ! ওদের ওপর হামলা করার কি আছে? আমেরিকান হলেও কথা ছিলো বাট দে আর কামিং ফ্রম বাংলাদেশ। ‘

‘ এটাই তো মিস্ট্রি ইডিয়ট! কাজে লেগে পড়ো নিজের টিম নিয়ে। বাসায় কি তোমার? এখনি বের হচ্ছো তুমি। ‘

ক্লারা লম্বা কদম ফেলে চলে যায়। তূর্শী তা দেখে বক্র চাহনি ফেললো সম্মুখে। ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয়ে আপনা-আপনি বেড়িয়ে আসলো তপ্তশ্বাস। সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ফাইলে মনোযোগ প্রদান করে তূর্শী। পায়ের জখম নিয়েও কাজ করতে বলছে। এদের মায়া – দরদ নেই নাকি? কিছু ভেবে সম্মুখে ফের অনড় দৃষ্টি ফেলে সে। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল আরশিতে আবিষ্কার করে নিজের প্রতিবিম্ব। গলার ভোকাল কর্ডে থাকা কালচে জন্ম দাগটায় আলত হাতে হাত বুলিয়ে মনোযোগী হয় নিজ কাজে।

__________________________

আর তিনদিন পরই ফাল্গুন মাস শুরু হতে যাচ্ছে। বসন্তের প্রথমাংশ কে স্বাগত জানাতে আঁটসাঁট বেঁধে নেমেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবক – যুবতীর দল। আশেপাশের বিশ্ববিদ্যালয়ও থেমে নেই। মীরার ডিপার্টমেন্টের ওপর বসন্ত উপলক্ষে আয়োজনকৃত অনুষ্ঠানের একাংশ দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে। মীরা এবং তার সহপাঠীরা ভীষণ বিরক্তি নিভৃতে পেশ করলেও বহির্ভাগে কৃত্রিম হেঁসে কাজ করছে। সিনিয়রদের দেয়া দায়িত্ব। তাদের মুখের ওপর কিছু বলল কর্কশ কন্ঠের ধমক হজম করতে হবে। সকলে কাজ ভাগ করে নেয়ার পর মীরাকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনের অংশটায় আল্পনা আকার।মীরার চারুশিল্পীর হাত ভালো তারই পরিপ্রেক্ষিতে।

শীতের প্রকোপ কমে গিয়েছে সপ্তাহখানেক পূর্বেই। মেদিনীতে এখন খা খা রোদ্দুরের রাজত্ব। সকাল হতে প্রবাহিত হওয়া মৃদু মিষ্টি অনিল এখন মীরার নিকট বড্ড বিরক্ত লাগছে। রঙমাখা হাত নিয়ে কপালের কাছে পড়া থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেয়ার তীব্র প্রয়াসে যখন সে ব্যার্থ প্রমাণিত হলো। বিতৃষ্ণায়, রাগে, ক্ষোভে, প্রচন্ড বিরক্তিতে মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বাজে কিছু অকথ্য ভাষা বেড়িয়ে এলো তার। সিনিয়রকে স্বগতোক্তি করে কড়া কিছু কথা বলে সে কাজে মনোযোগী হতেই কর্ণকুহরে লহমায় প্রবেশ করে ভারী কন্ঠ! কেও তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ চুল দিয়ে ঝাড়ু দেয়ার থেকে হাতের সাহায্যে ওড়না দিয়ে ঝাড়ু দিলে ভালো হতো না? ‘

মীরা চমকে পিছনে তাকায়। উশান সটান হয়ে দাঁড়িয়ে তার। হাত দু’টো পকেটে গুঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তার পানে তাকিয়ে আছে। হতভম্ব হয় মীরা। এই লোক এখানে? আর চুল দিয়ে ঝাড়ু? মীরা চট করে দৃষ্টি ফেলে নিজের চুলে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো তার বড়সড় হয়ে যায়। তার লম্বা চুলগুলো বাতাসে উড়ে ফ্লোরে হামাগুড়ি খাচ্ছে। ধুলোবালি লেগে বাজে অবস্থা চুলের। ফ্লোরের সব ময়লা মনেহয় একদম নিজের ভেতর টেনে নিয়েছে চুল। নিজেকে এবার শ’খানেক গালি দেয় মীরা। চুলগুলো হাত খোপা করা উচিত ছিলো। এখন কি করবে সে?হাত ভর্তি যে রঙে মাখামাখি। হাত ধুতে নিলেও তো কারো সাহায্য প্রয়োজন। তার সঙ্গী – সাথী কিয়ৎ পূর্বেই খেতে গিয়েছে।

মীরার দ্বিধায় পড়া চেহারা দেখে উশান কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। পাশে পড়ে থাকা মীরার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে কড়া গলায় বলল,

‘ জলদি এখানে আয়। হাত ধুয়ে নে। ‘

মীরা আলগোছে উঠে দাঁড়ালো। কিয়ৎ পরিমাণ দূরে গিয়ে হাত দিতেই উশান পানি দেয়। হাত ধোয়া শেষে ওড়নায় হাত মুছে চুলগুলো চটজলদি হাত খোপা করে নেয় মীরা। উশান তখন মীরার মুখোশ্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত ফেলে অবলোকন করছিলো। নিভৃত তারা অশান্ত, অস্থিরতায় আনচান করছে। উটকো চিন্তা এসে মাথায় যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে বারংবার। মন ছটফট করছে সমাধান পাওয়ার আশায়। কিন্তু, কিসের কি?সবদিকেই যে শূনতা! ওড়না দিয়ে মাথা ভালোভাবে ঢেকে নিয়ে মীরা এবার মুখ খুললো। সন্দিহান গলায় বলল,

‘ আপনি আমার ভার্সিটিতে কি করছেন উশান ভাই?’

‘ হাওয়া খেতে এসেছি। এখানকার হাওয়া প্রচন্ড মিষ্টি। তাই ভাবলাম বাতাস খেয়ে যাই। ‘

মীরা হতাশ গলায় বলে উঠলো, ‘ আমার সাথে সবসময় এমনভাবে কথা বলার মানে কি উশান ভাই? সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দেয়া যায়না?’

উশান চিবিয়ে বলল, ‘ তো এমন ভিত্তিহীন প্রশ্ন করিস কেনো? এখানে এসেছি নিশ্চয়ই কোনো কাজ আছে তাই। ‘

মীরা জোড়াল শ্বাস ফেললো। কেনো যে সে এই লোকটার সাথে কথা বলতে যায়। উশানের সাথে কথা বলাই মানে মাথা নষ্ট। লম্বা কদম ফেলে মীরা সামনে এগোলো। আপাতত আল্পনার কাজ শেষ। বাড়ি ফিরতে হবে৷ উশান তার আলসেমি নিয়ে মৃদু শব্দে বসে পড়ে সেখানেই হাঁটু ভাজ করে। মীরার ওড়নার শেষ অংশ ধরে টান দেয় আলত হাতে। বাঁধা প্রদান করে মীরার চলে যাওয়া থেকে। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে পিছনে ঘুরে মীরা। চটে গিয়ে বলে,

‘ কি সমস্যা? অসভ্যদের মতো ওড়না টানাটানি করছেন কেনো?’

উশান নরম সুরে বলল, ‘ পাশে একটু বস মীরা। কথা আছে। ‘

‘ না আপনার আমার সাথে কোনো কথা নেই। থাকতে পারেনা৷ যে কাজে এসেছেন তা করুন যান।’ মীরার তেজী কন্ঠ! রাগে দাঁতে দাঁত লেগে ঘর্ষণ সৃষ্টি করছে। রোদের প্রখরতা থাকতেও কেমন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে উশানের পানে।

উশান ভড়কালো না। স্বাভাবিক, নম্র সে। ওড়না ছেড়ে দিয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

‘ তোর কি কোনো জমজ বোন ছিলো মীরা? যার ভোকাল কর্ডে কালচে ক্ষতের মতো জন্মদাগ আর চোখের পাশে তিল ছিলো? ‘

ললাটে সুক্ষ্মরেখা ফেললো মীরা। উদ্বেগ, কয়েক প্রশ্নমাখা মুখোশ্রী নিয়ে বসলো উশানের পাশে। কন্ঠ তীক্ষ্ণ করে বলে উঠলো,

‘ হটাৎ এসব জানতে চাচ্ছেন কেনো বলুন তো?মতলব কি আপনার? ‘

হাস্যজ্বল প্রকৃতির উশান আচানক গুরুগম্ভীর রূপে নিজেকে আবৃত করে নিয়ে বলল,

‘ আমার উত্তরটা আগে দে মীরা! ‘

‘ উঁহু আমার কোনো জমজ বোন নেই। আমরা এক ভাই, এক বোন। মায়ান আর আমিই শুধু। তবে,..’

উশান নড়েচড়ে বসে বলল, ‘ তবে,?’

‘ আমার খালাতো বোন। তূর্শী ! আমি আর ও হুবহু একই রকমের দেখতে ছিলাম ছোট বেলায়। ক্লাস ফাইভে ওঠার পর আমাদের চেহারায় ভিন্নতা এসেছিলো। আর আপনি যা বর্ণণা দিলেন। ওগুলো তূর্শীর মধ্যেই আছে। কাজিন হলেও প্রায় ১২ বছর বয়স অব্দি আমরা একই রকম দেখতে ছিলাম। ‘

কথা শেষে মীরা মাথা তুলে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে চমকে হোক অথবা অবাক হয়েই-বা হোক না কেনো তার ওষ্ঠাধরের মাঝে বিশাল এক ব্যাবধান সৃষ্টি হলো। উশানকে দেখে সে ঠিক এই মূর্হতে কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছে না। উশানের চাপা গায়ের রঙে মিশে আছে লালচে আভা। রক্তিমতা! মুখোশ্রীতে লালচে আভা ক্রমশ বাড়ছে বলে মনে হলো। নেত্রজোড়ার সাদা অংশটুকুও রক্তিম আকার ধারণ করেছে। উশান যে রেগে গিয়েছে তা ঢের বুঝতে পারলো মীরা। আশ্চর্যজনক লাগলো এই রেগে যাওয়াটা তার কাছে। পর্যবেক্ষণ শেষে মীরা বলে উঠলো,

‘ উশান ভাই? আর ইউ ওকে? এমন দেখাচ্ছে কেনো আপনাকে?’

উশান ধাতস্থ করে নিজেকে। আপাদমস্তক সামলে তপ্তশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

‘ নাথিং সিরিয়াস! খালাতো বোন হওয়া সত্বেও এতো মিল থাকতে পারে? ব্যাপারটা অদ্ভুত না! ‘

‘ হু! আমার কাছেও অদ্ভুত লাগতো। কিন্তু পরে যখন আলাদা দেখতে হয়ে গেলাম তখন আর অদ্ভুত লাগেনি। ‘

‘ তোর কাজিন এখন কোথায়?’

‘ জানিনা। বাবা বলতে পারবে। আম্মু মারা যাওয়ার পর বাবা আমায় আর মাহদিকে ফুপির কাছে পাঠিয়ে দেয় তখন। ফিরে আসলাম যখন কয়েক বছর পর তখন আর খালামনিকে দেখিনি। আব্বুকে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাইনি। ‘

উশান আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘ মানে যখন তোর সাত, আট বছর বয়স তখন তুই তোর ফুপির কাছে ছিলি?’

‘ হ্যা। ‘

উশান দপ করে নিজের চক্ষু জোড়া বন্ধ করে নিলো। সবকিছু এলোমেলো! সবকিছুই! কিয়ৎ বাদে মীরার নম্র কন্ঠে শুনে হটাৎই উশান প্রথম থমকালো। মীরা অতীব শান্ত থেকে বলল,

‘ আপনি আমায় পছন্দ করেন উশান ভাই? দেখুন! আমি কোনো ভিক্তিহীন কারণ ছাড়া এই প্রশ্নটা আপনাকে করিনি। সেদিন আমায় দুল কিনে দেয়া মিথ্যা বলে। চট্টগ্রাম থাকতে ফার্মেসি যাওয়ার নাম করে আমায় বাসায় পৌঁছে দেয়া। ভোরবেলা নিজের মিথ্যা কাজের অযুহাত দেখিয়ে আমায় প্রতিদিন ভার্সিটিতে পৌঁছে দেয়া। সব আমি জানি! আমাকে কি আপনার বোকা মনে হয় নাকি?মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী আমি। তার ওপর মেয়ে। মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় কতোটা তুখোড় আশাকরি বলা লাগবে না। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন উশান ভাই। কেনো করছেন এসব আমার জন্য? কারণ কি? সঠিক উত্তর দিন। ‘

চলবে,

#নোট:০১- রি-চেইক করিনি।
#নোট:০২- গল্পে একটা ভুল হয়েছে। উশান ক্যাপ্টেন না। ও জাস্ট অফিসার। এখনো পুরোপুরি নয়। ইডিট করা সম্ভব না তাই বলা। এই ত্রুটির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। সরি…🙁