হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-০৬

0
505

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
জারিফ ট্যুরের জন্য তৈরি। এখন সে প্রিয়মকে ফোন করছে। প্রিয়মের সাথে একসাথে বাস স্ট্যান্ডে যাবে। প্রিয়মকে আবার জারিফের মা দেখতেও চেয়েছেন। জারিফ কানাডা যাবার আগে প্রিয়ম জারিফদের বাড়িতে অনেক যাওয়া আসা করতো। বেস্টফ্রেন্ড কীনা। জারিফ খুব একটা কারও বাড়ি যেতো না কিন্তু নিজের বাড়িতে ফ্রেন্ডদের আনতো। বাস রাত দশটায়। এখন আটটা বাজে। প্রিয়মকে ফোন করলে প্রিয়ম বলে,

“বের হচ্ছি ওয়েট। আরে ছোটোবোন রাগ করে বসে আছে। কেনো তার ভার্সিটি বন্ধের সময় কোথাও ট্যুরে গেলাম না! এখন আবার নিয়ে যেতে বলছে। বন্ধের সময় সে অলস সময় পার করেছে যে।”

জারিফ হালকা হাসলো। তারপর বলল,
“আয় তবে। মা তোকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।”

“দশ মিনিট লাগবে অটো দিয়ে আসতে। আসতেছি।”

প্রিয়ম ওর মা-বাবা, প্রিয়া ও রাহাকে বলে বেরিয়ে পরে। প্রিয়া মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তারও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফুলিয়ে রাহার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে।

________

প্রিয়ম পনেরো মিনিটের মধ্যে জারিফদের বাড়িতে গেলো। জারিফের মা ওর সাথে কথা বলছেন। প্রিয়ম খুব সহজেই মানুষের সাথে নিজেকে খাঁপ খাইয়ে নিতে পারে। আড্ডা, সাক্ষাত শেষে জারিফ ও প্রিয়ম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। সুন্দরবন যেতে ৮-৯ ঘন্টা লাগবে। লম্বা পথের জন্য রাতের সময়টা উপভোগ্য। রাত দশটায় বাস ছাড়ে। প্রিয়মের ফোনে তখন প্রিয়ার ফোন আসে। ফোন রিসিভ করার পর অপর পাশ থেকে শুনতে পায়,

“শোন ভাইয়া, আমার জন্য সুন্দরবনের খাঁটি মধু, মুলতানি মাটি ও চন্দন আনবি। আমাকে তো নিলি না তাই এগুলো আনবি।”

“খাঁটি মধু নাহয় আনলাম। বাকিগুলো তো ঢাকাতেই পাওয়া যায়। ওগুলো ওখান থেকে কেনো আনবো?”

প্রিয়া শা*সানো স্বরে বলে,
“আনতে বলছি আনবি। এতো কথা বলিস কেন?”

প্রিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“যা আনবো। এবার ফোন রাখ।”

প্রিয়া মুখ ভে*ঙচি দিয়ে ফোন রেখে দিলো। তারপর চিল্লিয়ে মাকে বলল,

“আমিও ট্যুরে যেতে চাই চাই চাই। মানুষ ঘোরাঘুরি করবে আর ফেসবুকে ছবি আপলোড দিবে আর আমি লাস্ট কবে ট্যুরে গেছি আমার মনেই নেই।”

তারপর স্বর নিচু করে আফসোস করে বলতে থাকে,

“কতোদিনে শখ আমি সমুদ্রকন্যার কোলে সূর্যাস্ত দেখব। কক্সবাজার নিয়ে তো গেছিল তাও যখন বাবা-মাকে ছাড়া একটু দূরে যেতেই ভয় হতো। এখন কুয়াকাটা যেতে ইচ্ছে করছে আর গেলে আমি নিজের মতো ঘুরবো। ছেলেকে ঠিক বন্ধুদের সাথে একা ছেড়েছে কিন্তু আমার বেলায়, জামাই নিয়ে একা একা যাস! কী আজব! তখন জামাইয়ের হাত ধরে থাকতে হবে এটাই ভাবে। জামাই নিয়ে যে যাবো তো বিয়েটা দেও!”

রাহা প্রিয়ার কথা শুনে হাসতে হাসতে বিছানায় লুটোপুটি খাচ্ছে। প্রিয়া ওকে একটা ধ*মক দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

__________

সকাল ৭টার পর সুন্দরবনে পৌঁছালো। জারিফ ও প্রিয়মরা কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে। ওরা দশ জনের মতো এসেছে। ওরা এখন জামতলা সৈকতে যাবে। জামতলার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হলো আকর্ষণীয় জায়গা। টাওয়ার থেকেই বিস্তীর্ণ ছনক্ষেতে হাজার হাজার হরিণের ছোটাছুটি দেখা যায়। মাঝে মাঝে রয়েল বেঙ্গল টা*ইগারেরও দেখা পাওয়া যায়। নাস্তা শেষে জামতলা সৈকতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সবুজ বনভূমি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে বড্ড নজরকারা লাগে। মন বলে, এই বিস্তীর্ণ সবুজ অরণ্যের সমোরোহে হারিয়ে যাই। বনের ভিতর দিয়ে সরু সরু পানিপথ আছে সেখানে পর্যটক নৌকা চলাচল করে। বনের ভিতর ঢুকলে সূর্যরশ্মি খুব স্বল্প পৌঁছায় তাই প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিয়ে যেতে হয়।

জামতলা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে কচিখালী সমুদ্র সৈকত হয়ে বন বিভাগের কচিখালী স্টেশন পর্যন্ত হাঁটা পথ। পথের পাশে ঘন অরণ্যে বা*ঘ, হরিণ, শূ*কর, বি*ষধর সা*প ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায়। খুব সাবধানে যেতে হয় আর এই গা ছমছমে পরিবেশের জন্য দুঃসাহসী পর্যটকদের বিকল্প নেই। এই গাছ থেকে ওই গাছে বা*নরের ছোটাছুটি দেখে অনেক সময় পর্যটকদের ভীত করে তোলে।

প্রিয়মরা বনের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে। জারিফ বলল,

“তোরা ছবি তুলতে থাক। পরে আমি নিয়ে নিবো। আমার তো পাখির কিচিরমিচির, বা*নরদের ডাক ও বন্য প্রাণীদের ছুটে চলার শব্দে মন বারবার প্রশান্তিতে হারাতে চাইছে।”

অর্ক পিঞ্চ করে বলে,
“এট বল যে এখানে তোর বাড়ি বানিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।”

সবাই হেসে উঠল। জারিফ বলে,
“মোটেও না। এখানে থাকলে আমি তখন আর প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারাতে পারব না কারণ তখন প্রকৃতি আমার কাছে ফিকে লাগতে পারে। তাই মন ফ্রেশ করতে এসব জায়গায় ট্যুর করাটাই বেটার। এখানে যারা থাকে, তারা কী আমাদের মতো মুগ্ধতার নজরে দেখে? দেখে না। কিছু মানুষ দেখে তবে বেশিরভাগ তাদের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে এখানে আসে। তারা প্রকৃতিবিলাশ করতে খুব কম আসে। আমি মনে করি সুন্দর সবকিছুর থেকে দূরে থাকা ভালো যাতে তা চিরকাল সুন্দর থাকে।”

প্রিয়ম বলে,
“আমার বোন এলে সে সত্যি সত্যি বাড়ি বানিয়ে থাকতে চাইবে।”

রনিত জারিফের কথাগুলো একটু ভেবে বলে,
“তাহলে বিয়ের পর? তুই কি একাধিক বিয়ে করবি নাকি? কারণ তোর কাছে তো ফিকে লাগতে পারে।”

জারিফ হালকা হাসলো অতঃপর বলল,
“প্রকৃতি ও লাইফ পার্টনারের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি যদি কখনও জানতেই না পারি আমি তাকে কেনো ভালোবাসি তবে সারাটাজীবন আমার কেটে যাবে সেই রহস্য উদ্ধার করতে। মানুষ বড্ড বেশি বিচিত্র। আর প্রকৃতির মধ্যে যদি আমি আমার জীবিকা খুঁজি সেটা শুধু স্বার্থই হবে। আমি জানিনা কেনো আমি সবার মতো প্রকৃতিক সৌন্দর্যময় জায়গাতে বাড়ি বানানোর ইচ্ছা মনে পোষণ করতে পারি না। আমার কাছে প্রতিটা ট্যুরের সময় একই প্রকৃতি নতুন করে অনুভব করতে ভালো লাগে। আমার মনটাও বিচিত্র!”

প্রিয়ম জানে জারিফ মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যায়। কেউ ওকে তর্ক মূলক প্রশ্ন করলে সে জবাব দিতে পারে না। এজন্য জারিফ তর্কেও যায় না খু্ব একটা। প্রিয়ম বলে,

“আরে ভাই, এখানে থাকলে বন্য প*শুর আ*ক্রমণেরও ভয় থাকবে। তাই না? সবকিছুরই ভালো ও খারাপ দিক আছে। তাছাড়া অন্যান্য টুরিস্ট স্পটেও যারা স্থায়ী বাসিন্দা তারা ঠিক জানে ওই জায়গায় থাকাটা কেমন। তাই প্রকৃতিক সৌন্দর্য খানিক সময়ের জন্য উপভোগ করে মনকে ফ্রেশ করে আবার ব্যস্ত জীবনে চলে যাওয়াই ভালো।”

জারিফ প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ওরা বিকেলের সূর্যাস্ত মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত থেকে দেখবে। মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত সুন্দরবন ও উত্তাল বঙ্গোপসাগরের এক রূপসী কন্যা। যা এখনও কিছুটা অনাবিষ্কৃত এবং অস্পর্শিত। এর কাছাকাছি কোথাও অনুমতি নিয়ে ওরা টেন্ট বানিয়ে রাতটা থাকবে তারপর সকাল হলে ঢাকা উদ্দেশ্যে রওনা করবে। জারিফের শনিবার ছুটি থাকলেও বাকিরা শনিবারের জন্য এক্সট্রা ছুটি নিয়েছে।

___________

প্রিয়ার ছুটির দিনগুলো খুব অলস যায়। সারাদিন ঘুমানো শুধু তিনবেলা খাওয়া ও নামাজের সময়গুলাতে উঠে। বিকেলে সে চা বানিয়ে ব্যালকনিতে বসেছে সাথে রাহাও আছে। ওর ব্যালকনিতে ফুলের গাছ ও বিভিন্ন রকম ক্যাকটাস গাছে ভর্তি। সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানোর কারণে শরীর ম্যাজমেজ করছে। প্রিয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আকাশপানে দৃষ্টি স্থির রেখে রাহাকে বলে,

“বুঝলি রাহা, আমি ভাবছি একবার শুধু একটা বিয়ের কথা উঠুক। আমি একবারও মানা করবো না। আমিও ট্যুরে যাবো। জামাই নিয়ে সব জায়গায় ঘুরবো। এই পড়ালেখা আমার দ্বারা হবে না।”

রাহা বিষণ্ণ মনে বলে,
“আমার কী হবে আপু? আমাকে তো প্রতিদিন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু আমি শুনেছি ডাক্তার হলে নাকি রাত-দিন কোনো শান্তি নেই।”

“আমাকেও বলছিল কিন্তু চান্স পাইনি তাই আমাকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে প্যা*রা খেতে ঢুকিয়ে দিলো। জীবনটা বেদনার!”

প্রিয়া ও রাহা দুজনেই মন খারাপ করে চা খাচ্ছে। প্রিয়ার মা হুট করে তড়িঘড়ি করে ওদের রুমে এসে যা বলল তা শুনে প্রিয়ার অক্ষিগোলক বৃহৎ আকার ধারণ করলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,