হৃদয় রেখেছি জমা পর্ব-১৭

0
404

#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৭

পরেরদিন মাহমুদের বাসা থেকে ফেরার পর টানা তিনদিন অফিসে যায় নি মেহরিন। গতকালও শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে কামাই করেছে। সোহাগ ফোন করতেই জানালো অসুস্থ। জ্বর,মাথাব্যথা। অথচ কন্ঠ শুনে মনে হলো দিব্যি সুস্থ সে! খটকা লাগলো মাহমুদের। সোহাগকে দিয়ে আজকে আবারো ফোন করালো। কিন্তু রিসিভ করলো মেহরিন।

-‘কি বুঝলে সোহাগ?’, সোহাগ ফোন রাখতেই তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ। তাঁর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

-‘কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি গতকাল রাতেও ফোন দিয়েছিলাম,বললো ব্যস্ত। তাড়াহুড়ো করেই ফোন কেটে দিলো।’

বিচলিত চেহারা নিয়ে, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজালো মাহমুদ। গতকাল রাত থেকেই হঠাৎ করে এক অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে তাঁর। কোন কারণ ছাড়াই মনটা খচখচ করছে। কেন এমন হচ্ছে সে নিজেও জানে না। কিন্তু ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে।
সময় নষ্ট না করে টেবিলের ওপর রাখা গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পেছন থেকে সোহাগ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু জবাব দেওয়ার অবকাশ হলো না তাঁর।


তিনচারবার বেল বাজানোর পরেও ভেতর থেকে কোন সাড়া নেই। আবার বাজালো মাহমুদ। বিনা কারণেই বুক ধড়ফড় করছে তাঁর। কপালের কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে নিয়ে ফের বেল বাজালো সে। কিন্তু এবারেও কোন সাড়া পাওয়া গেলো না। অতঃপর দরজায় দাঁড়িয়ে মেহরিনের নাম্বারে ডায়াল করলো। সুইচড অফ!

টেনশনে, অস্বস্তিতে কপাল কুঁচকে গেলো মাহমুদের। অগত্যা পাশের ফ্ল্যাটে বেল বাজালো। মাঝবয়েসী এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে হাসিমুখে অভিবাদন জানালো তাঁকে। যদিও আগে কখনো মাহমুদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় নি। তথাপি মেহরিনের কলিগদের মোটামুটি সবাইকেই চেনেন ভদ্রমহিলা।

মাহমুদ সময় নষ্ট না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, মেহরিন কোথায় গেছে তিনি জানেন কিনা।

-‘আসলে আমি অনেকক্ষণ যাবত বেল বাজাচ্ছি কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছি না।’, বিনীত কন্ঠস্বর মাহমুদের।

-‘তাই নাকি?’

-‘জি।’

-‘কোথাও গেছে কিনা সেটা তো বলতে পারবো না। তবে গতকাল রাতে ওর ফ্ল্যাটে একবার গিয়েছিলাম। দেখলাম জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো অফিসের কাজে নাকি বাইরে যেতে হবে। সকালে আবার যখন আমার উনি অফিস যাচ্ছিলো তখনও দেখা হয়েছে। বাইরে থেকে দরজা লক করছিলো।’

একটু থেমে মিষ্টি করে হাসলেন ভদ্রমহিলা। তারপর খানিকটা লজ্জিত কন্ঠেই বললেন,’ঐ সময় আসলে আমার ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হয়। সকালের ঐ সময়টাতে আমার খুব তাড়া থাকে। বেশিকিছু জিজ্ঞেস করার সময় পাই নি।’

মাহমুদ মনে মনে ভদ্রমহিলার কথাগুলো আউড়ে নিলো। গতকাল রাতে মেহরিন গোছগাছ করছিলো। মানে কি? অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে? কিন্তু মিথ্যে বলে গেছে কোথায়? অফিসেও তো যায় নি!

-‘আচ্ছা। ও কখন বেরিয়েছে সময় টা কি একটু মনে করে বলতে পারবেন?’

-‘ঘন্টাখানেক হবে!’

চট করে সেদিন রাতের ভিসা সংক্রান্ত মেসেজটার কথা মনে পড়ে গেলো মাহমুদের। আচমকাই পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। অশনি সংকেত বেজে উঠলো বুকের ভেতর। মেহরিন কি তবে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে? ভয়ে আতংকে আর বেশিকিছু ভাবতে পারলো না।

মেহরিনের বাসা থেকে এয়ারপোর্ট ঘন্টাখানেকের রাস্তা। তারমানে হাতে বেশি সময় নেই! দ্রুত গাড়ির কাছে এসে সোহাগের নাম্বারে ফোন করলো।সোহাগ ফোন রিসিভ করতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,’এইমুহূর্তে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করো সোহাগ। আজকে সকালে ওদের যত ফ্লাইট আছে সব একঘন্টার জন্য ডিলে করতে বলো। কুইক!’

সোহাগ তাঁর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,’কেন স্যার?’

-‘মেহরিন পালাচ্ছে!’

-‘পালাচ্ছে মানে?’

-‘তোমাকে আমি পরে সব বুঝিয়ে বলবো। আগে প্লিজ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করো।’

-‘ঠিক আছে। কিন্তু এয়ারলাইন্স থেকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে কি বলবো?’

-‘বলবে আমরা খবর পেয়েছি একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল এনএসআই এর সমস্ত ইনফরমেশন চুরি করে পালানোর চেষ্টা করছে। যেভাবেই হোক তাঁকে আটকাতে হবে। প্রয়োজনে মেহরিনের ছবি সহ ওদের কাছে পাঠিয়ে দাও।’

-‘ঠিক আছে।’

-‘আরেকটা কথা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি এবং এনা দুজনেই এয়ারপোর্টে পোঁছে যাবে। সঙ্গে আমাদের ফোর্স নিয়ে আসবে।’

-‘আচ্ছা।’

ফোন রেখে মেহরিনের বাসার সামনে থেকে সোজা এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরলো মাহমুদ। বুকের ভেতরটা অনবরত ধড়ফড় করছে তাঁর। হাতপা কাঁপছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো আর যাইহোক না কেন মেহরিন যেন এয়ারপোর্টেই থাকে!


মেহরিনের পাসপোর্ট চেক করছে অল্পবয়সী সুন্দরী এক তরুনী। পাসপোর্টের ছবি দেখেই ভ্রু কুঁচকে গেলো তাঁর। কোনরকম কথাবার্তা ছাড়াই ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো। রিসিভ হতেই মিষ্টি হেসে বললো,’উই গট হার!’

সোহাগকে নিয়ে একে একে সবগুলো ইমিগ্রেশন চেক করছিলো মাহমুদ। এরমধ্যেই সোহাগ জানালো মেহরিনকে পাওয়া গেছে। সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলো দুজনে।

মেহরিন কিছুই বুঝতে পারছে না। বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড মিলে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও কোন কথা বলছে না। অবশেষে মিনিট দুয়েক বাদে ঘর্মাক্ত, বিধ্বস্ত মাহমুদকে দেখতে পেয়ে বিষয়টা জলের মতন পরিষ্কার হয়ে তাঁর কাছে।

গায়ের ফুলহাতা শার্ট ঘামে ভিজে চুবচুবে মাহমুদের। চোখমুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। আতংকে, ভয়ে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো মেহরিনের। তাঁর চোখে চোখ পড়তেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। এতক্ষণে প্রাণ ফিরে এসেছে। চোখের কোনে জমা হলো কয়েক বিন্দু জল। কিন্তু পরোক্ষণেই আবার জ্বলে উঠলো চেহারা। এমন পাষণ্ড নারীকে এত সহজে ক্ষমা করা যাবে না। কঠিন রাগের দৃষ্টি নিয়ে সরাসরি চাইলো অপরাধিনীর দিকে।
ভয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো মেহরিন। সোহাগ তাঁর কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,’কি করতে যাচ্ছিলে তুমি? মাহমুদ ভাই কিন্তু ভয়ংকর খেপে আছেন! আজকে তোমাকে ছাড়বে না!’


অতঃপর এয়ারপোর্ট থেকে যাবতীয় ফর্মালিটিজ সেরে মেহরিনকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো সবাই। এনা ড্রাইভ করছে। মেহরিন পেছনের সীটে সোহাগের সঙ্গে বসেছে। মাহমুদ বসেছে এনার পাশে। চারজনের একজনও কোন টু শব্দ করলো না। গাড়ি থামলো গিয়ে একেবারে কাজি অফিসের সামনে।

গাড়ি থেকে নেমে মেহরিনকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলো মাহমুদ। সোহাগ এবং এনা তাঁকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। প্রাথমিক অবস্থায় কিছুই বুঝতে পারলো না মেহরিন। চুপচাপ ওদের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই কাজি সাহেবকে দেখে অবাক হয়ে গেলো সে। গোলগোল চোখ করে সোহাগ এবং এনার দিকে চাইলো। ওরা দুজন হাসছে।

কাজি অফিসে আসার খবরটা ইরফান আহমেদকে ফোন করে জানালো মাহমুদ। খবর শুনে আধঘন্টার মাঝেই লায়লা শারাফত কে নিয়ে রওনা হলেন তিনি।


মাহমুদ ভেতরে ঢুকতেই মেহরিন দৌঁড়ে গেলো তাঁর দিকে। বিস্মিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’এসব কি হচ্ছে মাহমুদ? আমরা কাজি অফিসে কেন এসেছি? কি বলছে ওরা? কিসের বিয়ে হবে? কার বিয়ে? আমি কিন্তু কোন বিয়ে টিয়ে করবো না বলে দিলাম!’

জবাবে মাহমুদ ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো কেবল! তারপর পাশ কাটিয়ে সোহাগে পাশে চেয়ার টেনে বসলো।
ভয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলো না মেহরিন। আজকে মাহমুদকে একেবারে অন্যরকম লাগছে! বোঝাই যাচ্ছে, বাড়াবাড়ি করে বিশেষ লাভ হবে না। তাঁর কোন কথা শুনবে না মাহমুদ।
অতএব মুখ গোমড়া করে চুপচাপ এনার পাশে গিয়ে বসলো। এনা ফিসফিস করে বললো,’এমনিতেই মাহমুদ ভয়ানক রেগে আছে মেহরিন আপু। তারওপর আপনি ওকে আরো রাগিয়ে দিচ্ছেন। আমি নিশ্চিত আজকে আপনার খবর আছে।’

মেহরিন ভয়ার্ত কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,’ভয় দেখিয়ো না তো এনা। আমি কি ওকে ভয় পাই?’, চোখেমুখে কৃত্রিম বিরক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো সে।

কিন্তু এনার ধারণা মনে মনে মহাখুশি মেহরিন! মুখে না বললেও এনা জানে মাহমুদকে ঠিক কতটা ভালোবাসে সে। মাহমুদের খুশির জন্যই তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু মাহমুদের সত্যিকার খুশি যে তাঁর সঙ্গে। এইকথা বোধহয় আজকে বুঝতে পেরেছে।

বাস্তবিকই এতদিন বাদে বোধোদয় হয়েছে মেহরিনের। ভালোবাসার এমন বহিঃপ্রকাশে সত্যিই তাঁর ভেতরটা অনেকদিন বাদে প্রাণ খুলে হাসছে। মনে মনে মাহমুদকে দেখে বারবার শিহরিত হচ্ছে। বুকের ভেতর আনন্দের বাজনা বাজছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারলো না।