হৃদয় রেখেছি জমা পর্ব-২০+২১

0
447

#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২০

লাঞ্চ আওয়ারে নিজের রুমে বসে অগ্রীম কয়েকদিনের কাজ সেরে নিচ্ছিলো মাহমুদ। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কাজের ঝামেলায় জড়াতে মন চাইবে না। সেইজন্যই এই বুদ্ধি।
হঠাৎ দরজায় নক হলো। বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মেহরিন। মাহমুদ ফাইল থেকে চোখ না সরিয়েই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,’কাম ইন।’

নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলো মেহরিন। মাহমুদের পেছনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলো। তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের। নিমিষেই সকল ক্লান্তি অবসাদ দূর হয়ে গেলো। তথাপি ইচ্ছাকৃতভাবে দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। সকালের পর থেকে বেশ ভালো মুডেই আছে ম্যাডাম। একটু জ্বালাতন করা দরকার।

মেহরিন দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাঁর কানের কাছে দুবার ফুঁ দিলো। তথাপি কোন রিয়েকশন না পেয়ে চট করে ফাইলটা টেনে নিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

মাহমুদ যেন খুব বিরক্ত হয়েছে এমন ভাব করে বললো,’কি চাই?’

-‘আমার ছুটি লাগবে দুদিন।’

-‘ছুটি লাগবে তো আমাকে বলছো কেন? বসের কাছে যাও।’

-‘কারণ ছুটি আমরা দুজনেই নেবো।’

-‘অসম্ভব। আমি এখন কোন ছুটি নেবো না। আমার হাতে অনেক কাজ। সেগুলো শেষ করতে হবে। এমনিতেই বিয়ের চক্করে কতদিন কাজে গ্যাপ পড়বে সেটাও জানি না।’

-‘তাতে কি হয়েছে? মাত্র তো দুদিনের ব্যাপার? পরেও করে নেওয়া যাবে।’

-‘পরে করে নেওয়া যাবে, তোমার জন্য হয়তো এই কথাটা বলা খুবই সহজ। কিন্তু আমার জন্য না। আমার অন্য দুদিন মানে দুইশো দিন। কাজের পাহাড় জমে যাবে টেবিলে।’

-‘আমার জন্য সহজ মানে?’

-‘তোমার জন্য সহজ মানে তোমার দুদিন অফিসে থাকা আর না থাকার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। দুটো একই কথা। এমনিতেও খুব একটা কাজ করো না তুমি।

-‘আমি কাজ করি না?’

-‘করো? আমি তো দেখি না।’

রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো মেহরিনের। লাঞ্চের সময়টাতে মাহমুদের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাতে এসেছিলো সে। কিন্তু তার পরিবর্তে মাহমুদের এমন উস্কানিমূলক কথাবার্তা মোটেই সহ্য হলো না।
নিজের কর্তব্যে কোনদিন একফোঁটা অবহেলা করে নি সে। প্রতিটা মিশনে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে দলকে সাফল্য এনে দেওয়ার জন্য। তাঁর মত একজন ডেডিকেটেড এজেন্ট এর পক্ষে এমন কথাবার্তা সহ্য করা খুবই কষ্টসাধ্য।

-‘ইউ আর নো ওয়ান টু অ্যাসেস মাই ওয়ার্ক। এন্ড আই হ্যাভ নো অবলিগেশন টু আন্সার ইউ।’, গলা ভারী হয়ে এলো মেহরিনের। না থেমেই বললো,’আমি এনএস আইয়ের জন্য কি করেছি না করেছি সেটা এনএস আই জানে এবং আমি জানি। আর জানে আমার সহকর্মীরা। তোমাকে আমার কাজ নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।’

মাহমুদ হাতের পেপার ওয়েটটা ঘুরালো। মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি। মেহরিনের স্বভাব তাঁর অজানা নয়। একটুতেই রেগে আগুন হয়ে যায়। আগুনে আরেকটু ঘি ঢেলে দিয়ে বললো,’ঠিক বলেছো। সবাই সবটা জানে। কিন্তু তোমার বাপের ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না।’

এবারে রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো মেহরিনের। এতক্ষণ যাও শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলো কিন্তু এবার আর সেটাও পারলো না। হাতের ফাইলটা সজোরে মাহমুদের বুক বরাবর ছুঁড়ে মারলো। বিক্ষুব্ধ গলায় চিৎকার করে করলো,’কি বললে তুমি? আমার বাবার ভয়ে কেউ আমাকে কিছু বলে না? আমার নিজের কোন যোগ্যতা নেই?’

অত্যাধিক রাগে চোখে পানি চলে এলো তাঁর। এমনিতেই যথেষ্ট আত্মসম্মান বোধ। তারওপর নিজের যোগ্যতার প্রশ্নে মাহমুদ হঠাৎ ইরফান আহমেদকে টেনে আনবে ভাবতে পারে নি। মনে মনে ভীষণ ভাবে আহত হলো সে। গম্ভীর গলায় বললো,’আজকে তুমি কাজটা ঠিক করলে না মাহমুদ। বাবা তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন। তাই বলে তুমি সেই রাগ আমার ওপরে ঝাড়বে এটা আমি ভাবতে পারি নি। এরজন্য আমি তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করবো না। মনে রেখো তুমি!’

ভুল তথ্য ব্যবহার করে এয়ারলাইন্সের সহযোগীতা নেওয়ায় তিনমাসের বেতন সহ আগামী দুইমাসের সকল ছুটি ক্যান্সেল করা হয়েছে মাহমুদের। ভাইয়ের ছেলে কিংবা মেয়ের জামাই বলে কোন ছাড় দেন নি ইরফান আহমেদ। এদিকে মেহরিন ভেবেছে সেইজন্য তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করেছে মাহমুদ। কষ্টে চোখে পানি চলে এলো তাঁর।
অশ্রুভেজা চোখ নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত চেপে ধরলো মাহমুদ। মুচকি হেসে বললো,’কোথায় যাচ্ছো?’

-‘সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেবো না। ছাড়ো আমাকে।’

-‘কথায় কথায় এত রাগ দেখানোর কি আছে। আমি তো মজা করছিলাম!’

-‘ছাড়ো আমাকে। এটা কোন মজা হতে পারে না।’

-‘আচ্ছা সরি ভুল হয়ে গেছে।’

-‘ছাড়ো বলছি।’

মাহমুদ হাসলো। রেগে গেলে মেহরিন কখনো শান্তভাবে কোন কাজ করতে পারে না। বেশিরভাগ সময়ই উত্তেজিত হয়ে যায়। মেজাজ কোনমতেই কন্ট্রোলে থাকে না। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা সবসময়ই রাগের হয়।

-‘সত্যি মজা করছিলাম। তোমার সাথে ঝগড়া করতে করতে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। তাছাড়া ঝগড়া না করলে রোমান্সটাও ঠিক জমে উঠে না।’

-‘ছাড়ো আমাকে।’

-‘উঁহু!’

জোর করে তাঁকে কোলে বসিয়ে নিলো মাহমুদ। কপালের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বললো,’সরি!’

মেহরিন শান্ত হলো না। উলটো ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করে বললো,’আই ডোন্ট নিড ইউর সরি!’

-‘দ্যান, ওয়াট ডু ইউ নিড?’

-‘আই ডোন্ট নিড এনিথিং ফ্রম ইউ।’

-‘বাট আই উইল গিভ ইউ এভ্রিথিং।’

-‘সেটা তোমার ব্যাপার। ছাড়ো আমাকে।’

-‘আহারে! আমার বউটা! বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না? আচ্ছা সরি!’

মেহরিন জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,’বাবা ঠিকই বলেছে। অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত আমি মায়ের কাছেই থাকবো।’

কিসের মধ্যে কি? মেহরিন হঠাৎ ঐ বাসায় থাকার কথা বলছে কেন? নিমিষেই মুখের কালো গেলো মাহমুদের। বেশি ভাব দেখাতে গিয়ে বেচারা ফেঁসে গেছে। বিয়ের পর বউ ছাড়া থাকা? অসম্ভব!
তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো মেহরিন। রাগে নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করছে মাহমুদের। খামোখা মেহরিনের সঙ্গে ঝগড়া করেছে সে। এবার আর তাঁর কোনকথা শুনবে না ডাকুরানী।


বিকেলবেলা কাজ গুছিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো মেহরিন। তখনি মাহমুদ সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহরিন দেখেও না দেখার ভান করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু মাহমুদ পথ আগলে আগলে দাঁড়ালো। মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে বললো,’তোমার জন্য একটা চিঠি এসেছে!’

তাঁর হাতে সত্যিই খামে মোড়ানো একটা চিঠি।

-‘চিঠি?’, বেশ অবাক হলো মেহরিন।

আজকালকার যুগে কেউ চিঠি লেখে ? প্রমোশনের কাগজপত্র নয়তো? কিন্তু সেটা হলে তো ইরফান আহমেদ মেহরিনকে জানানোর কথা! চিঠিটা হাতে নিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে মাহমুদের দিকে চাইলো সে।

-‘লাভ লেটার! টাইপ করা।’

-‘মানে?’

-‘পড়ো। পড়লেই বুঝতে পারবে।’

ভাঁজ খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো মেহরিন।

প্রিয় এম এস,
আমি তোমার এ.পি (অজ্ঞাত প্রেমিক)।
প্রথমেই একরাশ গোলাবারুদের শুভেচ্ছা নিও। সেই সঙ্গে আমার হৃদয়ভর্তি ভালোবাসা। জানি না কবে, কখন,কীভাবে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। পড়ে আর উঠতে পারছি না। তুমি আর দিবস রজনী সব এক করে দিয়েছো। প্রিয়, তোমার মরিচ মেশানো ঠোঁটে একবার মধুভরা চুমু খেতে চাই। তোমার বন্দুকের মত চোখজোড়ায় গুলির নিশানা হতে চাই। সবশেষে তোমার ঐ ধারালো তলোয়ারের মত দেহটাকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাই…!

মেহরিন পুরোটা না পড়েই মাহমুদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’এটা নিশ্চয়ই তোমার কাজ?’

জবাবে মাহমুদ খুবই নিষ্পাপ নিরীহ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,’আমি তোমাকে চিঠি লিখতে যাবো কোন দুঃখে?’

-‘চিঠির ওপরে প্রাপকের ঠিকানায় এম এস লিখা। এম এস মানে তো মাহমুদ সিদ্দিকিও হতে পারে? তুমি আমাকে কেন দিয়েছো?’

-‘কারণ স্বভাবের যা বর্ননা দিয়েছে তাতে আমি কেন পুরো বাংলাদেশ খুঁজলেও তোমার দ্বিতীয় নমুনা পাওয়া যাবে না।’, মুখ ফস্কে কথাটা বেরোতেই সঙ্গে জিভ কাটলো মাহমুদ। মেহরিনকে আবার রাগিয়ে দিচ্ছে সে।

মেহরিন চিঠিটাকে দলামোচড়া করে বিনে ফেলে দিলো। তাঁর বুঝতে বাকি নেই চিঠিটা মাহমুদই লিখেছে। কারণ মেহরিনের সঙ্গে এমন ঠাট্টা করার সাহস মাহমুদ ছাড়া আর কারো হবে না। তা সে যতই অস্বীকার করুক না কেন।

-‘তোমার এই এ.পি মানে অজ্ঞাত প্রেমিকটা কে? মি.সাইদ?’

আবারো সাইদ? রাগে মাথায় রক্ত উঠে গেলো মেহরিনের। ত্বরিতে মাহমুদের কলার চেপে ধরে বললো,’তোমাকে আমি কতবাদ নিষেধ করেছি সাইদের নাম আমার সামনে উচ্চারণ না করতে? তবুও কেন করেছো? আর একবার ওর কথা বললে আমি তোমাকে খুন করবো।’

এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলো মাহমুদ। কালক্ষেপণ না করে সঙ্গে সঙ্গেই জড়িয়ে ধরলো মেহরিনকে। জোরপূর্বক গালে চুমু খেয়ে বললো,’তুমি বাসায় যাবে না বলেছো কেন? তাই।’
মেহরিন ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস শুরু করে দিলো।

-‘ছাড়ো আমাকে। আমি কিন্তু মেরে তোমার নাক ফাটিয়ে দেবো বলে দিলাম।’

-‘ছাড়বো না। আগে বলো আমার সঙ্গে বাসায় যাবে।’

-‘যাবো না।’

-‘না গেলে আমিও ছাড়বো না।’

-‘দরজা খোলা। কেউ এসে পড়বে।

-‘আসুক। সবাই দেখুক আর বুঝুক মাহমুদ সিদ্দিকি তাঁর বউকে কত ভালোবাসে। সারাক্ষণ বউয়ের সাথে লেগে থাকে।’

মেহরিন বিপাকে পড়ে গেলো। শক্তিতে মাহমুদের সঙ্গে পেরে ওঠা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। সাপের মতন পেঁচিয়ে ধরেছে অসভ্যটা। দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’ঠিক আছে যাবো। ছাড়ো আমাকে।’

-‘এইতো লক্ষ্মী মেয়ে।’, বলে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহমুদ।

তাঁর নাটক দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিলো মেহরিনের। ধমকে উঠে বললো,’আই সয়্যার! এইমুহূর্তে যদি তুমি আমাক না ছেড়েছো আগামী একমাস আমি ঐ বাসায় যাবো না। যাবো না মানে যাবোই না।’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই মাহমুদ ছেড়ে দিলো। মুচকি হেসে বললো,’দিয়েছি। এবার তুমি তোমার কথা রাখো।’
বাধ্য হয়ে মাহমুদের সঙ্গে বাসায় হতে হলো মেহরিনকে। যাওয়ার সময় মাহমুদ সারারাস্তা তাঁকে জ্বালিয়েছে।

চলবে।

#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২১

দুদিনের অনুষ্ঠান শেষে পার্মানেন্টলি মাহমুদের ফ্ল্যাটে শিফট হয়ে গেছে মেহরিন। সে চলে আসার পর লায়লা শারাফাত ইরফান আহমেদের সঙ্গেই থাকছেন। এতবছর বাদে পুরনো মান অভিমান ভুলে গিয়ে এক হয়েছেন দুজনে। মাহমুদ ভীষণ খুশি। কিন্তু মেহরিন খানিকটা একটু অসন্তুষ্ট। বাবার সঙ্গে অফিসের বাইরে তাঁর খুব একটা কথা হয় না বললেই চলে। দেখাসাক্ষাৎ তো বহু দূরের কথা।
কিন্তু বিয়ের পর সমস্যা হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হলে রোজ ঐ বাসাতেই যেতে হবে তাঁকে। রোজ, রোজ ইরফান আহমেদের সম্মুখে পড়ে নিজেকে কোনরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় না মেহরিন। চোখাচোখি হলেই ইরফান আহমেদ কেমন করে যেন চেয়ে থাকেন। তখন আর অফিসের সেই রাশভারী, গুরুগম্ভীর ইরফান আহমেদ মনেই হয় না তাঁকে। মনে হয় বহুকালের আত্মগ্লানিতে দগ্ধ, অসহায় এক পিতা নিজের কৃত অপরাধের জন্য অনুনয় করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছে।

বাবার প্রতি এখনো পুরোনো সেই ক্ষোভ রয়ে গেছে মেহরিনের। লায়লা শারাফাতের সঙ্গে করা অন্যায়ের কথা আজও ভুলতে পারে নি সে। মায়ের কষ্ট নিজের চোখে দেখেছে। তাই তো শত চেষ্টা করেও কিছুতেই ইরফান আহমেদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে নি।
ইরফান আহমেদ সেটা বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন বলেই লজ্জায়, অনুশোচনায় মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই তাঁর চোখে পানি চলে আসে। তাঁরই মেয়ে অথচ কোনদিন বাবা বলে ডাকে না। দুঃখে, কষ্টে নিজেকে শেষ করে দিতে মন চায়। কিন্তু তিনিও মেহরিনের মত। চাইলেও নিজের সবটা সবার কাছে প্রকাশ করতে পারেন না।

রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লায়লা শারাফাতের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলো মেহরিন। হঠাৎ করে নিচতলায় একটা দৃশ্য দেখে চোখ আটকে গেলো। তিনচার বছর বয়সী একটা বাচ্চা গার্ডেন এরিয়াতে বসে তাঁর বাবার সাথে দুষ্টুমি করছে। বাচ্চার বাবা ধৈর্য সহকারে ছেলের সব আবদার পূরণ করছে আর একটু পরপরই সস্নেহে ছেলের নরম তুলতুলে গালে চুমু খাচ্ছে। অপূর্ব এক দৃশ্য! নয়ন জুড়িয়ে যাওয়ার মতন। প্রশান্তিদায়ক!
দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ মাহমুদের কথা মনে পড়ে গেলো মেহরিনের। ডুঁকরে কেঁদে উঠলো বুকের ভেতরটা। সে তো চাইলেও মাহমুদকে কখনো এমন সুখ দিতে পারবে না! নিজের সমস্তটা দিয়ে হলেও না!

ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে চাচার কাছে মানুষ হয়েছে মাহমুদ। ইরফান সাহেব তাঁর কোন আবদার অপূর্ণ রাখেন নি। কিন্তু পারিবারিক স্নেহ বলতে ঐ অতোটুকুই। চাচার আদর ছাড়া অন্য কাউকে খুব একটা কাছে পায় নি। সেই মানুষটার ছোটবেলা কেটেছে বাবামায়ের আদর ছাড়া তাঁর নিজের কোন সন্তান থাকবে না ভাবতেই যন্ত্রণায় বুকটা ভারী হয়ে এলো মেহরিনের।
ফোন কেটে দুম ধরে মেঝেতে বসে পড়লো।চোখের কোনে জমা হলো বিন্দু বিন্দু নোনা জল।

মাহমুদ এসেছিলো বারান্দায় ভেজা টাওয়েল মেলে দিতে। মেহরিনকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বললো,’কি ব্যাপার? মেঝেতে বসে আছো যে?’

মেহরিন জবাব দিলো না। ফ্যালফ্যাল করে মাহমুদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তাঁর নারীসত্তা ব্যর্থ! ব্যর্থ তাঁর গোটা জীবন!
ভালো করে মাহমুদের দিকে চাইলো। সত্যিই কি এই নিয়ে কোন কষ্ট নেই মাহমুদের? কোন আফসোস নেই?

-‘কি হলো তোমার? কথা বলছো না কেন?’

মাহমুদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মেহরিন। তাঁর শূন্য কোল সারাজীবন শূন্যই থাকবে। কখনো পূর্ণ হবে না। মাতৃহৃদয় সন্তানের আকুতিতে অসহ্য বেদনায় ছটফট করে মরবে কিন্তু এই নিষ্ঠুর সত্য থেকে কখনো মুক্তি মিলবে না।
তাঁর কান্না দেখে মাহমুদ ঘাবড়ে গেলো। হাটুমুড়ে সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসে পড়লো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বারবার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে!

এবারে দুহাতে তাঁর কোমড় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো মেহরিন। অসহায় আর্তনাদ করে বললো ,’আমি কখনো মা হতে পারবো না মাহমুদ। তুমি কখনো বাবা ডাক শুনতে পারবে না। আমাদের বেবি হবে না কোনদিন।’

মেহরিনের এমন কান্না তীরের মতন বিদ্ধ করলো মাহমুদের হৃদয়টাকে। যাকে সে অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছে, বহুযত্নে বুকের ভেতর আগলে রেখেছে তাঁর এমন কান্না সত্যি বড্ড অসহায় করে দিলো মাহমুদকে। তাঁর হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো তবে সমস্ত পৃথিবীর বিনিময় হলেও মেহরিনের শূন্য কোল পূর্ণ করে দিতো সে।

-‘কান্না থামাও মেহরিন! প্লিজ!’

-‘কেন উপরওয়ালা আমাকে এতবড় শাস্তি দিলেন? আমি তাঁর কি ক্ষতি করেছি? কেন আমার সঙ্গেই এমন হলো? কেন তুমি আমাকে নিজের সঙ্গে জড়ালে!’

তাঁকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলো মাহমুদ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নেহার্দ্র কন্ঠে বললো,’এসব কথা বলো না মেহরিন। সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর কারো হাত নেই। তিনি যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।’

-‘তবে আমার সঙ্গেই কেন এমন হতে হলো? আমি তো নিজের অক্ষমতার দায় একাই বয়ে বেড়াতে চেয়েছিলাম। কেন তিনি তোমাকে আমার সঙ্গে জড়িয়ে আমার ভেতরের যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিলো?’

-‘জানো তো, উপরওয়ালা মানুষকে সুখি হওয়ার জন্য দুটো অপশন দিয়েছেন। কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হবে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আই চোজ ইউ! আমার কাছে মনে হয়েছে তোমাকে ছাড়া বাকি সবকিছু সবকিছু আমার জন্য অর্থহীন। যেকোন কিছুর বিনিময়ে হলেও তোমাকে আমার চাই। নতুবা আমি মরে যাবো। নিঃসন্দেহ আমি সৌভাগ্যবান যে তিনি আমার আকুতি শুনেছেন। এন্ড আই থিংক হি গেইভ মি দ্যা বেস্ট ওয়ান আই ডিজার্ভ। একটা কথা সব সময় মনে রেখো মেহরিন,উপরওয়ালা কখনো কারো ওপর অবিচার করেন না। আনডাউটেডলি, হি ইজ দ্যা বেস্ট অব প্ল্যানার্স!’

তাঁকে ছেড়ে দিয়ে ফের দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো মেহরিন। ফের বাঁধভাঙ্গা ক্রন্দনে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। মাহমুদ সস্নেহে তাঁর মাথাটা কোলে তুলে নিলো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’বিশ্বাস করো, তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিচ্ছু বলছি না আমি। কারণ বলার মতন তেমন কিছু নেই। সত্যিটা তুমি নিজেই জানো। তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তাই প্লিজ নিজেকে দোষারোপ করা বন্ধ করো।’

অতঃপর পাঁজাকোলা করে তাঁকে তুলে নিলো মাহমুদ। ভেতরে ঢুকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,’পানি খাও।’

চোখমুছে অনেকটা স্বাভাবিক হলো মেহরিন। পানির গ্লাসটা রেখে খুবই রিলাক্সভাবে তাঁর পাশে বসলো মাহমুদ। মেহরিনের একটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,’মন খারাপ করে থেকো না প্লিজ। তুমি মন খারাপ করে থাকলে আমি শান্তি পাবো না। কি চাও বলো? বেবি? বেবি লাগবে তো তোমার? ঠিক আছে। আমি আজই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবো। স্যারোগ্যাসির মাধ্যমে যদি বেবি নেওয়া যায় তাহলে ভালো আর যদি নাও নেওয়া যায় তাহলে আমরা বেবি অ্যাডপ্ট করবো। কোন সমস্যা নেই।’

মেহরিন নতমুখে বসে রইলো। মাহমুদ দুহাতে তাঁর মুখটা তুলে ধরে বললো,’কিছু বলবে না? আর কতক্ষণ এভাবে মুখ ভার করে থাকবে?’
ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা তাঁর বুকের ওপর এলিয়ে দিলো মেহরিন। দুহাতে তাঁর গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে বললো,’আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। ইউ আর দ্যা রিজন অফ মাই লাইফ!’

মুখে হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের। মেহরিনের অগোছালো চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,’আমি জানি সেটা। তোমার চাইতে বেশি ভালো আমাকে কেউ বাসে না। বোধকরি আমি নিজেও নিজেকে ততোটা ভালোবাসি না যতটা তুমি বাসো।’

মেহরিন চুপ করে রইলো। মাহমুদ বেশকিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,’একটা অনুরোধ করবো। রাখবে?’

মুখ তুলে চাইলো মেহরিন। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’

-‘চাচ্চুর সঙ্গে সব মিটমাট করে নিলে হয় না? মানুষটা ভেতরে ভেতরে তোমার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তাছাড়া ছোটমা তো উনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ভালোও বাসেন। তাহলে তোমার উনাকে বাবা ডাকতে আপত্তি কোথায়?’

মেহরিন চুপ করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মাহমুদ ফের অনুরোধের সুরে বললো,’সন্তান না থাকার চাইতে বেশি কষ্ট হয় থেকেও না থাকার মতন হয়। সেই কষ্ট মানুষ সহ্য করতে পারে না। চাচ্চুর বয়স হয়েছে। আর কয়দিনই বা বাঁচবে। কি হয় উনাকে একটু বাবা বলে ডাকলে? নাহয় জোর করেই ডাকলে?

মেহরিনের চোখের পানি গাল গড়িয়ে মাহমুদের হাতের ওপর পড়লো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বললো,’উনি আমার মাকে কষ্ট দিয়েছেন। তাই আমি উনাকে বাবা ডাকি না। মাকে আমি খুব ভালোবাসি।’

-‘আর বাবাকে? বাবাকে একটুও ভালোবাসো না? তাঁর কিছু হলে সহ্য করতে পারবে? কষ্ট হবে না তোমার?’

মেহরিন নিরুত্তর রইলো। মানুষটা যতই অন্যায় করুক না কেন তিনি তাঁর বাবা। বাবা মাকে চাইলেও কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাদের কিছু হলে সন্তানের বুকে একটু হলেও আঘাত লাগবে।

-‘কি হলো কথা বলছো না যে? হবে না তোমার কষ্ট?’

মেহরিন চোখ মুছে মৃদু হাসলো। বললো,’কালকে আমরা বাবার সাথে দেখা করতে যাবো ঐ বাসায়। আসার সময় দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবো।’ খুশিতে ঝলমল করে উঠলো মাহমুদের চেহারা। তাঁর এতদিনের চেষ্টা সফল হতে চলেছে। মেহরিন রাজি হয়েছে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে। এবার নিশ্চয়ই আর কোন দুঃখ থাকবে না ইরফান আহমেদের! খুব খুশি হবেন তিনি।।
চলবে।