হোম পলিটিক্স পর্ব-০৩

0
328

#হোম_পলিটিক্স

#পর্ব_৩

#আফসানানীতু

টেবিলে পাটিসাপটা পিঠা ভর্তি প্লেট রেখে সালেহা তার ছেলেমেয়েদের সবাইকে ডাক দেন। তারপর সবার প্লেটে হিসাব করে তিনটা করে পিঠা বাড়েন। নাফিসা ডাইনিং এ এসে পিঠা দেখে চিৎকার করে ওঠে,
– বিকালের নাস্তায় এসব পিঠা মিঠা বানাইতে তোমাকে কে শিখাইছে আম্মা?
– থাপ্পর দেবো! কারো শেখাতে হবে কেন? বিকালের নাস্তায় পিঠা খাওয়া যাবে না এটা কোথাও লেখা আছে? আম্মা আপনি বলেন তো!
সালেহা তার দল ভারী করবার জন্য শাশুড়ির সমর্থন খোঁজেন। খোদেজা বিবিও ছেলের বউকে সমর্থন জানিয়ে বলেন,
– পিঠা এমন এক জিনিস যেইটা সব সময় খাওন যায়। তাছাড়া তোর আম্মার হাতের পিঠা তো ভালো হয়। ভালো জিনিস খাইতে মন চায় না,না ?
এদিকে রুমন প্লেটে পিঠার সংখ্যা গুণে ব্যাজার মুখে বলে,
– তিনটা পিঠা কেন আম্মা?
– মানে তিনটা তোদের অবশ্যই খেতে হবে।
– এরপরে চাইলে আরো বেশি পাবো?
– ইয়া মাবুদ! তোর ওইটা পেট না চুলা,রু? তিনটা পিঠা খাবার পরে তোর পেটে আর জায়গা থাকবে? খাইতে খাইতে তো তুই নিজেই পুলি পিঠার মতন হয়ে যাইতেছিস।
রিফাত হেসে ভাইকে খোঁচা মারে, তারপর বোনকে সমর্থন করে বলে,
– তবে আম্মা, নাফুদি ঠিক বলছে। এই সময় তিনটা পিঠা খেলে রাত্রে ভাত খাব কিভাবে?
– এই পিঠা খাওয়ার পরে তোর রাতে আবার ভাতও খাইতে মন চায়!
নাফিসা নাক কুচকায়। তারপর ঘোষণা দেয়,
– যে যাই বলো আমি এখন মরে গেলেও পিঠা খাব না। আমি ডায়েটে আছি।
রিফাত নাফিসার কথা শুনে হেসে ওঠে,
– বিকালে একগাদা ফুচকা চটপটি খেয়ে সন্ধ্যা বেলা ডায়েটে যায় এমন পাবলিক এই প্রথম দেখলাম।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে নাফিসা রিফাতের মাথায় চাটি মেরে বলে,
– তুই কথা কম বলবি, যে কিনা পরীক্ষার সময় ভাইয়ের সঙ্গে রুম শেয়ার করতে পারেনা তার মতন তেলাপোকার বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ডায়েটের কি বুঝবে? তুই খাবি হাতির মতন কলা গাছ আর মুলা।
– আশ্চর্য, পরীক্ষার সময় একটু প্রাইভেসি চাওয়া যাইতে পারে না!
– প্রাইভেসি চাওয়া আর ছোট ভাই বোনের মাথার উপর থেকে ছাদ সড়ায় দেওয়া এক কথা না ভাইয়া। তুমি তো আমারে পুরা ঘরহারা করছো!
একটু আগে রিফাতের খোঁচার বদলা নেয় রুমন।
– ঘর হারা না গবেট, ওইটারে বলে গৃহহারা।
ভাই বোনদের বাক্য বিতন্ডার মাঝে সালেহা রেফারির মত বাগড়া দিয়ে বলেন,
– সারাদিন বস্তিবাড়ির মতন ঝগড়া না করলে তোদের ভালো লাগে না? রিফাত, চুপচাপ বসে নাস্তা সার তারপরে এই বক্সটা নিয়ে পাশের বাসায় যা দেখি। নাফিসা পিঠার প্লেটটা একদিকে সরিয়ে রেখে বলে,
– আমার পক্ষে এখন এইসব ফ্যাটি খাবার খাওয়া সম্ভব না। তারচেয়ে বরং ওই বক্সের ভিতরে কি আছে দেও দেখি।
– ওইটার ভেতরেও পিঠা।
নাফিসা মুখ কালো করে বলে,
– আজকে কি একশ পিস পিঠা বানাইছো, পুরা এলাকায় বিতরণ করবা বলে?
– ফাজলামো করবি না, নাফিসা! আর তুই, রিফাত!পাশের বাসায় নতুন লোক এসেছে শুনলাম, তাদের সঙ্গে এখনো আলাপ হয়নি তাই পিঠাগুলো দিয়ে আয় আর ওই বাসার আন্টিকে আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে আসবি। বলবি সময় করে যেন আমার সঙ্গে একটু কথা বলে।
– রিফাতকে যেতে হবে কেন, আমি যাই।
– তুই মেয়ে মানুষ ওই বাড়ির লোকজন কেমন না জেনে ওখানে যেতে চাস কোন বুদ্ধিতে? রিফাত যাক।
– আরে না না, তারা মানুষ ভালো। আজকে বিকালেই তো তার ছেলের বউয়ের সঙ্গে কথা হল। মেয়েটা যা সুন্দর আম্মা! না দেখলে বিশ্বাস করবা না। শুধু স্বভাবটা শাবানার মত।
– শাবানার মত মানে?
– মানে শাবানা যেমন মনের দুঃখে কোনা কাঞ্চিতে বসে বসে চোখ মুছে আর কাঁদে। অনেকটা সেই টাইপ। বিকেলে দেখলাম ছাদে বসে চুপিচুপি কাঁদছে।
সালেহা মেয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,
– তোকে কতবার বলেছি অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মজা করবি না। মেয়েরা তাদের জীবনে কত রকমের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সেটা তুই জানিস?
– ওসব আমার জানতে হবে না, ওসব তোমরা সমাজ সেবীরা জানলেই হল! আমাকে কেউ চ*ড় দিবে আর আমি তারে কিছু না বলে চিপায় গিয়ে কাঁদবো,সেই পাবলিক ভাই আমি না। দরকার হলে তারে মাটির নিচে পু*তে ফেলব!
রুমন বোনকে সমর্থন করতে চিৎকার করে বলে,
– হ্যাঁ, গুড ডিসিশন!
সালেহা আলতো করে ছোট ছেলের পিঠে চাপড় দিয়ে ধমকে বলেন,
– চুপ থাক তুই! গাধার মতো কোথায় চিৎকার দিতে হয় আর কোথায় দিতে হয় না তাও বুঝিস না! আর তুই, বাচ্চাদের সামনে এসব কি বলিস! মুখের ভাষা তো দিন দিন বস্তির মেয়েদের মত হচ্ছে। আল্লাহ জানে তোকে কে বিয়ে করবে।
খোদেজা এবার তীব্র স্বরে ছেলের বউয়ের কথার প্রতিবাদ জানায়,
– কে বিয়া করবো মানে? আমার নাতনির মতন সুন্দর মাইয়া এই এলাকায় কয়টা আছে? তারে বিয়া করার জন্য খালি বইলা দেখো লাইন লাইগা যাবে।
নাফিসা দাদীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
– তাইতো দাদী। আমারটা শুধু তুমি বুঝলা। আমি আসলে তোমার মত সুন্দর তাই এরা বুঝে না। সেজন্যই তো তোমাকে বলি দাদী, তাড়াতাড়ি আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো। অন্ততপক্ষে আমার চাহিদা কেমন এইটা তো লোকে জানুক।
– থামবি? দিন দিন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস! শিগগির পিঠা খেলে খা আর না খেলে বক্স নিয়ে যা।
সালেহা পিঠার বক্সটা ডাইনিং টেবিলে সজোরে রেখে স্বামীর জন্য প্লেটে পিঠা বেড়ে শোবার ঘরের দিকে চলে গেলেন।
***
– বৌমা, বৌমা!
রুচিতা রাতের খাবার রান্না করছিল। শাশুড়ির চিৎকার শুনে তার হাত থেকে খুন্তিটা পড়ে যায়। মনে মনে প্রমাদ গুনে রুচিতা। না জানি আবার কোন ঝামেলা হলো! গতরাতে সে তার স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল বলে সারাদিন মনটা ফুরফুরে ছিল তার। এখনো রাধতে বসে গত রাতের কথাই ভাবছিল সে। অনেকদিন পর তারা দুজনে গত রাতে এভাবে চিন্তা বিহীন ভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। খেয়ে দেয়ে, ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরেছে রাত আড়াইটায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তার শাশুড়ি এ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। পুরোটা ব্যাপার অভিরূপ খুব সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করেছে।
তার শাশুড়ির গজ গজানি বারান্দা থেকে শোনা যাচ্ছে তাই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ওদিকেই পা বাড়ায় রুচিতা। তবে ওখানে পৌঁছাবার আগেই বেলের শব্দ শুনে গিয়ে দরজা খোলে। দরজার ওপাশে নাফিসাকে দেখে খুব খুশি হয় সে,
-আরে নাফিসা!
– মা আপনাদের জন্য পিঠা পাঠিয়েছে আপু।
– এসো এসো, ভেতরে এসো।
নাফিসা ঘরে পা দিয়েছে কি দেয়নি এমন সময় আনোয়ারা রীতিমতো চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসেন।
– তোমাকে কখন থেকে ডাকছি, কথা কানে যায় না তোমার? কানের মধ্যে কি তুলা দিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকেছো?
তবে লিভিং রুমে ঢুকে নাফিসাকে দেখে থমকে দাঁড়ায় আনোয়ারা। সঙ্গে সঙ্গে মুখের অভিব্যক্তি বদলে মোলায়েম স্বরে জানতে চান,
– তুমি কে?
নাফিসা চট করে এক নজরে আনোয়ারার আপাতস্তক জরিপ করে নেয়। ফিটফাট কড়া মারের আয়রন করা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা এই মহিলা নিশ্চয়ই রুচিতার শাশুড়ি হবে। কিন্তু মহিলা এমন বাজখাই গলায় চিৎকার করছে কেন কে জানে! তবে নাফিসাকে দেখে তার চেহারা বদলে যাওয়াতে বেশ মজা পায় নাফিসা। মুহূর্তে বুঝে ফেলে মহিলা সংসার নামক খেলার মাঠের বেশ পাকা খেলোয়াড়।
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমার নাম নাফিসা। আমি পাশের বাসায় থাকি। আম্মা বলল আপনারা নতুন এসেছেন তাই আপনাদের জন্য পিঠা পাঠিয়ে দিলেন।
– তাই নাকি? যাক, বোঝা গেল দেশে এখনো এই রীতি ধরে রেখেছে কিছু মানুষ। আজকাল তো কে এল কে গেল কেউ খবর রাখে না পাড়াতে।
– আমরা রাখি। আমরা বেশ পুরনো তো তাই পাড়ায় নতুন কেউ এলেই পরিচিত হতে আসি।
– আমরা তো নতুন না। এই বাড়ি আমাদের অনেক আগের, খালি এখানে থাকতাম না। তোমার আঙ্কেল সরকারি চাকরি করতো তাই চাকরির খাতিরে আমাদের ঢাকায় থাকা হয়নি।
– ও আচ্ছা! আর আপনি?
– আমি মানে?
– মানে আপনি চাকরি করতেন না?
– আরে না না! মেয়েদের আবার চাকরি বাকরি করা লাগে নাকি?
নাফিসা খুশি খুশি গলায় বলে,
– একদম ঠিক বলেছেন আন্টি। স্বামী যদি ভালো চাকরি করে আর তার যদি আঙ্কেলের মতন বাড়ি গাড়ি থাকে তাহলে বৌদের চাকরি না করাই ভালো! বাসায় বসে রান্নাবান্না করবে আর ছেলে মেয়েদের খাওয়াবে এটাই তো সবচেয়ে বড় কাজ, তাইনা আন্টি? আনোয়ারার নাফিসাকে বেশ পছন্দ হয়ে যায়। মেয়েটার বুদ্ধি আছে দেখা যায়।
– একদম ঠিক বলেছ, মা! তবে এসব আজকাল কয়জন বোঝে? এসো না, এখানে এসে বস।
শেষ কথাটা যে তিনি তার ছেলের বউকে কটাক্ষ করে বলেছেন সেটা বেশ বুঝতে পারে নাফিসা।
– আন্টি, আম্মা আপনাকে তার নাম্বারটা শেয়ার করতে বলেছে যাতে আপনি পরে সময় করে একটু ফোন দিয়ে কথা বলেন তার সাথে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ বলবো। তোমার আম্মাকেও আসতে বলবে।
– আম্মা আসলে খুব একটা সময় পায় না। আমরা তিন ভাই বোনই পড়াশোনা করছি তাই আম্মা সারাদিন ব্যস্ত থাকে।
– তবুও সময় করে আসতে বল।
– বলবো। তা আন্টি কি সন্ধ্যা বেলা কাপড় ধুচ্ছিলেন? – আরে না! কাপড় ধোবো কেন? কাপড় ধোয়া হয়নি তাই বলছিলাম। এ বাড়িতে কোন কাজই আমার তদারকি ছাড়া ঠিক মত হয় না বুঝলে? এই দেখনা ধোয়া কাপড় এটা অথচ শার্টের হাতায় আর কলারে কি পরিমান ময়লা দেখেছো?
– আন্টিরা কি হাতে কাপড় ধোন?
– হ্যাঁ, কাপড় তো হাতেই ধুতে হয়।
– কি যে বলেন আন্টি! হাতে কাপড় ধুলে সেই কাপড় সব সময় ভালো মতো ধোয়া হবে না এটাই স্বাভাবিক। কাপড় ধোবেন মেশিনে, মানে ওয়াশিং মেশিনে। আমাদের বাসায় আমরা তিন ভাই বোন, আমি বড় মেয়ে তারপর আমার দুই ভাই ছোট। ওরা দুজন ভীষণ দুষ্ট! অনেক কাপড় ময়লা করে। আমার আম্মা তো সব ওয়াশিং মেশিনে পরিষ্কার করে। এই দেখেন আমার জামা কত সুন্দর পরিষ্কার! বুঝলেন আন্টি হাত দিয়ে কাপড় ধুতে গেলে কখনো ভালো হয় কখনো খারাপ, কারণ কাজ করার সময় মানুষের মন মেজাজ ওলটপালট হয়। কিন্তু মেশিনের তো মন বলে কিছুই নাই। তারা প্রোগ্রাম করা। যেভাবে দিবেন সেভাবেই হবে। তাই অলওয়েজ কাপড় ঝকঝকে পরিষ্কার হবে।

আনোয়ারা আড়চোখে তাকিয়ে দেখে রুচিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে। তিনি মনে মনে একটু বিরক্ত হন। কেননা বাড়ির সব কাপড় ধোয়ার বেশিরভাগ কাজটা তিনি রুচিতাকে দিয়েই করান। বুয়াদের দিলে ভালো করে ধোবেনা এই দোহাই দিয়ে ছেলেদের শার্ট প্যান্ট রুচিতার কাঁধে চাপিয়ে দেন। তাই নাফিসার কথায় ছেলের বউ যদি আবার মেশিন কেনার আবদার ধরে তাহলে তো মুশকিল! তিনি তাই নাফিসার ওয়াশিং মেশিনের বিজ্ঞাপন বার্তায় দাঁড়ি দিতে রুচিতাকে বলেন,
– বৌমা, এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? মেহমান এসেছে, তাকে অন্তত এক কাপ চা খাওয়াও!
– না না আন্টি আমি চা খাই না, চা খেলে গায়ের রং ময়লা হয়ে যায়।
– এইটা তুমি ঠিক বলেছ। দুধ খাবে? আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রতি সপ্তাহে দুধ পাঠায় পাঁচ লিটার করে। খুব সুন্দর দুধ! খাবে?
– আরেকদিন খাবো আন্টি। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনার সঙ্গে গল্প করার জন্য হলেও আর একদিন আসবো।
আনোয়ারার মুখ সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
– তোমার সঙ্গে কথা বলে আমারও ভালো লেগেছে খুব। তুমি বয়সে ছোট হলেও মেয়ে হিসাবে খুব বুদ্ধিমতী আর লক্ষী!
নাফিসা হেসে বিদায় নেয়।
তবে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে একা একা আনোয়ারার বক্তব্য মনে করে মুখ ভেংচায় নাফিসা,
– কাপড় ধোয়ার জন্য মেশিন দিবে না কি জন্য বুঝি না ভেবেছো? বউটাকে দিয়ে সারাদিন খাটাবার প্ল্যান, খাটাশ মহিলা! খুব তো আমাকে লক্ষী মেয়ে বললে, আর কটা দিন যাক হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবো কেমন লক্ষ্মী মেয়ে আমি।
***
ঘরে ঢুকে পিয়াকে দেখে মনটা আরো তিক্ত হয়ে ওঠে নাফিসার। এই ভর সন্ধ্যাবেলা পিয়া নিশ্চয়ই কোন নোট দেয়া নেয়ার কাজে এসেছে। ওর বান্ধবী হয়ে এমন পড়া পাগল কেমনে হয় মেয়েটা আল্লাহ জানে!
– কিরে পিয়া, তুই এখন কি মনে করে?
কথা শেষ হওয়ার আগেই পিয়া দৌড়ে এসে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
– কি ব্যাপার, কাঁদিস কেন?
– আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে দোস্ত!
– কস কি! কি হইছে?
জবাবে পিয়া কিছু না বলে শুধু গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে। তাই দেখে নাফিসা বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
– মুখটারে মিষ্টি আলুর মতো ত্যাড়াব্যাকা করে না রেখে বলবি কি হইছে? কি সর্বনাশ হইছে বল?
– আমাকে মনে হয় ম*রতে হবে গলায় দ*ড়ি দিয়ে, এছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই আমার। দোস্ত, আমি যদি আমার বাসায় না ম*রে তোর বাসায় ম*রি তুই সঙ্গে থাকতে পারবি না? মানে,আমার একা একা ম*র*তে ভয় লাগতেছে।
নাফিসা তিক্ত কন্ঠে বলে,
– পারবো না কেন, তুই চাইলে তোর সঙ্গে ক*বরেও শুতে পারবো। বললে হাশরের দিনে তোর পাশে দাঁড়াইয়া আল্লাহরে বলবো, প্লিজ আল্লাহ ওরে মাফ কইরা দাও। ওর কোন দোষ নাই, বেচারী মনের দুঃখে গ*লায় ফাঁ*স নিছে। খুশি? এবার কান্না বন্ধ কর, তারপরে বল কি হইছে।
পিয়া বেশ কসরত করে তার উদগত অশ্রু নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর বলতে শুরু করে,
– বুঝলি, জাফরের সাথে আমার তিন বছরের রিলেশন তুই তো জানিসই। ওর সাথে আমার কত কত ছবি আছে! এখন সেই দিন শুনি ওর ফোন থেকে নাকি এই ছবি কে কেমনে জানি শেয়ার নিছে। আর সেগুলা দিয়ে এখন আমাদের ব্ল্যাকমেইল করতেছে লোকটা।
– বলিস কি! তোরে আগেই বলছিলাম, তোর ওই দাম্রা কোন কাজের না! আস্ত একটা গাধার বাচ্চা! তা মোবাইলে বিছানা টিছানার ছবি তুলিস নাই তো?
– ধুর, কি বলিস এইসব! ঐরকম কিছু আমাদের মধ্যে হয় নাই।
– তাইলে আর চিন্তা কই?
– চিন্তার বিষয় আছে! আমাদের দুজনের একসঙ্গে কাছাকাছি কত সেলফি তোলা হইছে না? তাছাড়া আমি অনেকদিন ওরে অনেক ছবি পাঠাইছি। তার মধ্যে অনেক ছবি একটু খারাপ ধরনেরও আছে।
– খারাপ বলতে? তুই কি ওরে ** ছবি পাঠাইছিস?
– ঠিক তা না, তবে অনেকটা সেইরকমই! মানে ছোট ছোট কাপড় পরেছিলাম আর কি।
নাফিসা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কতক্ষণ পিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
– তোর মাথায় যে বুদ্ধি কুনো ব্যাঙের চেয়েও কম সেটা আমার জানা ছিল। কিন্তু ওই জাফর বেটার ব্রেনের কন্ডিশনও যে একই রকম সেইটা জানা ছিল না। এইভাবে মোবাইলে কেউ এইসব ছবি নিয়ে ঘুরে?
– মোবাইলে না তো, ইমোতে শেয়ার করছিলাম।
– তুই মিচকা শয়তান জানতাম কিন্তু তোর স্বভাব যে পরবাসী বেটাদের অশিক্ষিত বউদের মতন যে ইমোতে ছবি চালাচালি করস এইটা তো জানা ছিল না! গর্ধভ কোথাকার!
পিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,
– তুই তো জানিস না,ওই লোক এখন আমাদের একলাখ টাকা দিতে বলতেছে। নইলে এই ছবিগুলা নাকি সে সবখানে শেয়ার দিয়ে দেবে। জাফর আমি দুইজনেই স্টুডেন্ট, আমরা এতগুলো টাকা কই পাব বল?
– কিডনি বেঁচে টাকা দে! এহ্, কই পাবো?
নাফিসা পিয়াকে মুখ ভেংচে বলে।
পিয়া কিছু বলে না শুধু আরো জোরে ফুঁপিয়ে ওঠে।
– হইছে হইছে, কান্দিস না। তোর কিডনি আমি এখনই নিচ্ছি না। আচ্ছা শোন, লোকটা কে সেই সম্পর্কে তোদের কোন আইডিয়া আছে?
– একদম না! সবচেয়ে বড় কথা, ওর ফোন থেকে এই ছবিগুলা কিভাবে শেয়ার নিল সেটাও জাফর বলতে পারতেছে না!
– তাইতো হবে, ফাউল পোলা একটা! তাইলে ব্যাপারটা পুলিশরে জানা।
– তোর মাথা খারাপ হইছে? আম্মা জানলে আমারে মাটির নিচে পুঁ*তে ফেলবে!
– তাইলে তো হলোই! এমনিও তো ম*রতেই চাস, কাজ আরো সহজ হয়ে যাবে।
– এদিকে জাফর কি বলছে শোন। জাফর বলতেছে, আমারে পঞ্চাশ হাজার এনে দাও আর আমি বাকীটা যোগাড় করতেছি। আমি বললাম, এত টাকা আমি কই পাবো? বলে, দরকার হইলে তোমার মার গয়না চুরি করে বেচে নিয়ে আসো।
– বেটা নিজে ভুল করছে আর তোর কাছে টাকা চায়? আর তুইও নিশ্চয়ই রাজি হয়ে গেছিস?
– কি যে বলিস! এত টাকা কোত্থেকে দেবো আমি? সেই জন্যই তো ম*রতে আসছি তোর কাছে।
– তাই তো করবি! ছবি শেয়ার করার সময় আমার কথা মনে থাকে না আর ম*রার সময় আমার বাড়িতে এসে ম*রতে মন চায়!
নাফিসা চুপ করে থেকে ভাবে কিছুক্ষণ।
– শোন পিয়া, তুই তোর ফাঁ*স নেওয়া কর্মসূচি কয়টা দিন পিছায় দে। আগে আমি ঘটনা বুঝি।
– কি বুঝবি?
– সেইটা তোরে বইলা লাভ আছে?
রীতিমত ধমকে ওঠে নাফিসা।
– আর তোর ওই গাধার বাচ্চাটার সঙ্গেও কথা বলে লাভ হবে বলে মনে হয় না। তার চেয়ে তোরা ওই লোকটাকে বল তোদের পনের দিন সময় দিতে। বল যে পনের দিন পর তোরা তাকে এক লাখ টাকা দিবি।
– কি বলিস দোস্ত! পনের দিনের মধ্যে আমরা একলাখ টাকা জোগাড় করতে পারবো?
– সেইটা আমার মাথা ব্যাথা, তোর না! তোরে যেটা বলছি তুই সেইটা কর। আর জাফর ভাইরে কালকে কলেজ ছুটির পর আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি। এখন প্যানপ্যানানি বন্ধ করে আম্মা পিঠা বানাইছে ওই পিঠা খাইয়া চুপচাপ শুয়ে ঘুমা।
পিয়া চোখ মুছে নাফিসার দেয়া পিঠা খেয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ে, তাকে দেখে মনেই হয় না যে একটু আগে এই মেয়েটাই উপায়ান্তর না দেখে ম*রতে চেয়েছিল। পিয়া সাত আট বছর ধরে নাফিসাকে চেনে। সে জানে নাফিসা যদি একবার কোন কিছুর দায়িত্ব নেয় তাহলে সেটার শেষ সে দেখেই ছাড়ে। বন্ধুর জন্য অন্তপ্রাণ নাফিসার আশ্বস্ত বাণী শুনে পিয়া নিশ্চিন্তে একটা টেডি বিয়ার জড়িয়ে ধরে রুমনের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু নাফিসার চোখে ঘুম আসে না। কেননা বন্ধুকে কথা যখন দিয়েছে তখন এর একটা সুরাহা তাকে করতেই হবে।
চলবে।